চৌর্যোন্মাদ
চৌর্যোন্মাদ বা ক্লেপটোম্যানিয়া [১] বলতে কোন বস্তু চুরি করার আকাঙ্ক্ষাকে দমন না করতে পারাকে বোঝায়। চৌর্যোন্মাদভোগী ব্যক্তি মূলতঃ ব্যক্তিগত বা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রচেষ্টায় চুরি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম এব্যাপারে উল্লেখ করে একে একধরনের মানসিক সমস্যা তালিকা ভুক্তি করা হয়। [২][৩][তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
চৌর্যোন্মাদ | |
---|---|
প্রতিশব্দ | ক্লেপটোম্যানিয়া[১] |
![]() | |
চৌর্যোন্মাদের ফলাফল নিজের অনেক জুতা থাকা সত্ত্বেও সে জুতা চুরি করছে | |
বিশেষত্ব | মনোরোগ বিজ্ঞান |
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
চৌর্যোন্মাদ শব্দের ইংরেজি শব্দ ক্লেপটোম্যানিয়া গ্রিক ভাষার κλέπτω (ক্লেপটো) এবং μανία (ম্যানিয়া) শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ যথাক্রমে "চুরি করা" ও " পাগলের মতো তীব্র আকাঙ্ক্ষা" থেকে এসেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় "চুরির প্রতি বাধ্যবাধকতা"।[৪]
লক্ষণ
চৌর্যোন্মাদের উল্লেখযোগ্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত চিন্তাভাবনা মাথায় আসা। চুরি করা থেকে বিরত থাকার মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অক্ষমতা প্রকাশ এবং চুরি করার মাধ্যমে মানসিক চাপ থেকে উত্তরণ পাওয়া। এই লক্ষণগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ক্লেপটোম্যানিয়াকে অবসেসিভ কম্পালসিভ ধরনের ডিজঅর্ডার বলে আখ্যায়িত করা যায়।[৫][৬]
সাধারণ চুরি এবং ক্লেপটোম্যানিয়ার মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান। সাধারণ চুরি (পরিকল্পিত কিংবা তাৎক্ষণিক সংঘটিত অপরাধ) করার পেছনে চুরি করা বস্তুর প্রয়োজনীয়তা এবং অর্থনৈতিক মূল্য গুরূত্বপূর্ণ। কিন্তু, ক্লেপটোম্যানিয়ার কারণে চুরি করার ক্ষেত্রে চুরির একমাত্র কারণ ব্যক্তির চুরি করার আকাঙ্ক্ষা দমনে ব্যর্থতা। এক্ষেত্রে বস্তুর প্রয়োজনীয়তা কিংবা অর্থনৈতিক মূল্যের ভূমিকা গুরুত্ব বহন করে না।[৭]
কারণ
মনঃসমীক্ষণ পর্যবেক্ষণ নমুনা
বহু মনঃসমীক্ষার তাত্ত্বিক ক্লেপ্টোম্যানিয়া একজন ব্যক্তির কোন সত্যিকারে অথবা কাল্পনিক ক্ষতির প্রতীকি ক্ষতিপূরণ হিসেবে বস্তু দখলের প্রবণতা বলে ব্যাখ্যা করেন। তাদের মতে, এই আচরণ চুরি করা বস্তুর প্রতীকি ভাবার্থের মাঝেই নিহিত।[৮] চালক তত্ত্ব বা ড্রাইভ থিওরি এই চুরি করা প্রবণতাকে প্রতিরক্ষামূলক আচরণবলে প্রস্তাব করেছে।এই তত্ত্ব মতে, চুরির মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ কিংবা অনুভূতি প্রকাশ থেকে বিরত রাখে। অন্যদের মতে ক্লেপটোম্যানিয়াক ব্যক্তি চুরি করা বস্তু কিংবা চুরি করে যে অনুভূতি পাওয়া যায়,সেটার জন্যই চুরি করে থাকে।
চেতনা- আচরণগত নমুনা
চেতনা -আচরণগত নমুনা ক্লেপটোম্যানিয়ার কারণ ও বিস্তার ব্যাখায় পূর্বে উল্লেখিত মনঃসমীক্ষণ নমুনাকে সরিয়ে দিচ্ছে।চেতনা - আচরণগতচর্চাবিদরা এই ডিজঅর্ডারকে অপারেন্ট কন্ডিশনিং(শাস্তির মাধ্যমে আচরণ পরিবর্তনের শিক্ষা), আচরণগত শৃংখল (বারবার হাত ধোয়া, প্রতিদিন দাঁত মাজা ইত্যাদি শৃংখলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার আচরণ গড়ে তোলা), বিকৃত বোধশক্তি এবং দূর্বল মানিয়ে চলার প্রবণতাকে দায়ী করেছেন।[৯][১০] চেতনা -আচরণগত নমুনা অনুসারে, ব্যক্তি চুরি করার পর তার আচরণ ধনাত্মকভাবে পুনর্বহাল হয়। যেহেতু ব্যক্তি চুরি করার দরুন কোন ধরনের ঋণাত্মক অনুভূতি বা ফলাফল (শাস্তি) অনুভব করে না। ফলে ব্যক্তি একই কাজ আরো করতে অনুপ্রাণিত হয়। আর বারবার একই আচরণ দ্বারা ধাবিত হওয়ার ফলে এক পর্যায়ে ব্যক্তির এইসকল চৌর্যকর্ম শক্তভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে শক্তিশালী আচরণগত শৃংখল হয়ে পরে। উদাহরণস্বরূপ ২০০২ সালে কো'ন এন্টোনুচিঅ তাদের একজন রোগীর বক্তব্য বর্ণনা করেছেন। এই ক্লেপটোম্যানিয়াক ব্যক্তি অন্যদের তুলনায় নিজেকে চতুর ভাবতেন। তিনি যাদের কাছ থেকে চুরি করতেন মনে করতেন তাদের এটা প্রাপ্য। এধরনের চিন্তাভাবনা এতটআই শক্তিশালী ছিলো যে তিনি চুরি করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। এমনকি চুরি করার পেছনে এক ধরনের গর্বো কাজ করতো। উদাহরণস্ব্রূপ, এক বড় কোম্পানি থেকে চুরির সময় কোন গরিব ব্যক্তির কথা চিন্তা করে চৌর্য্যকর্মকে মহান রূপ দেয়া এবং কোম্পানির প্রতি এক ধরনের শাস্তি বলে বিবেচনা করা। অবশ্য এভাবে যেতে থাকলে এক পর্যায়ে ব্যক্তি মানসিক চাপ থেকে নিষ্কৃতি পেতেও চুরি শুরু করে।[১১]
জীববৈজ্ঞানিক নমুনা
জীববৈজ্ঞানিক নমুনায় চৌর্যোন্মাদের মূল প্রধানত কিছু নির্দিষ্ট সেরোটোনিন ইনহিবিটর (SSRIs), ভাবের স্থিরতা এবং অপিওয়েড রিসেপ্টরের প্রতিদ্বন্দী।
কিছু গবেষণায় ক্লেপটোম্যানিয়াক ব্যক্তির মাঝে আফিম আসক্তির মতো এক ধরনে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় যা শুধুমাত্র চৌর্য্যকর্মের মাধ্যমেই নিবারণ হয়। এতদ্বারা দূর্বল সেরোটোনিন , ডোপামিন নিঃসরণ এবং/অথবা মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক অপিওয়েড ক্লেপটোম্যানিয়াকের জন্য দায়ী করা যায়। যা এই আচরণকে ইমপালসিভ কন্ট্রোল ডিজঅর্ডারের তালিকায় যুক্ত করে।
অন্য একটি ব্যাখায় ক্লেপটোম্যানিয়াকে স্বচিকিৎসার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চুরির মাধ্যমে ব্যক্তির প্রাকৃতিক অপিওয়েড নিঃসরণ উত্তেজিত হয়। এই "অপিওয়েড নিঃসরণ রোগীর দুঃখ, দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। ফলে চুরিরা মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের মানসিক প্রশান্তি আনে।":৩৫৪