জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুর
জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুর সংক্ষেপে নানুপুর মাদ্রাসা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুর ইউনিয়নে অবস্থিত একটি কওমি মাদ্রাসা। ১৯৫৭ সালে আজিজুল হকের পরামর্শে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন আমির উদ্দিন। এটি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অধিভুক্ত। ১৯৭৬ সালে মাদ্রাসার প্রথম শায়খুল হাদিস হিসেবে মাসউদুল হকের মাধ্যমে এই মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস চালু হয়। বর্তমান মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস কুতুব উদ্দিন নানুপুরী। মাদ্রাসার তৃতীয় পরিচালক জমির উদ্দিন নানুপুরীর সময়ে মাদ্রাসার অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। বর্তমানে মাদ্রাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন সালাহ উদ্দিন নানুপুরী। ২০১৯ সালে প্রথম কওমি মাদ্রাসা হিসেবে এটি অনলাইন ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে। এই মাদ্রাসায় প্রতি বছর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইতিকাফের আসর বসে। শিক্ষা-কার্যক্রমের বাইরে মাদ্রাসাটি সমাজসেবা ও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এজন্য পরিচালিত সংস্থার মধ্যে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ অন্যতম।
![]() | |
আরবি: الجامعة الاسلامية العبيديه نانوفور | |
অন্যান্য নাম | নানুপুর মাদ্রাসা |
---|---|
প্রাক্তন নাম | ওবাইদিয়া হাফিজুল উলুম |
ধরন | কওমি মাদ্রাসা |
স্থাপিত | ১৯৫৭ |
প্রতিষ্ঠাতা | আমির উদ্দিন |
মূল প্রতিষ্ঠান | দারুল উলুম দেওবন্দ |
অধিভুক্তি | বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ |
ধর্মীয় অধিভুক্তি | ইসলাম |
বাজেট | ১০ কোটি |
মহাপরিচালক | সালাহ উদ্দিন নানুপুরী |
শায়খুল হাদিস | কুতুব উদ্দীন নানুপুরী |
শিক্ষায়তনিক ব্যক্তিবর্গ | ১৫৫ |
শিক্ষার্থী | ৮০০০ |
অবস্থান | ২২°৩৭′৩৩″ উত্তর ৯১°৫০′৩১″ পূর্ব / ২২.৬২৫৯৪০৯° উত্তর ৯১.৮৪১৯৭৪২° পূর্ব |
শিক্ষাঙ্গন | পল্লী অঞ্চল |
ওয়েবসাইট | jionanupur |
![]() | |
![]() |
ইতিহাস
প্রেক্ষাপট
ইসলামি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ওবাইদুল হক তার নিজ গ্রাম নানুপুরের কালু মুন্সিরহাটে মাদ্রাসায়ে হেমায়াতুল ইসলাম নামে একটি কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।[১] এই মাদ্রাসায় পর্যায়ক্রমে কওমি মাদ্রাসার জামাতে চাহারুম পর্যন্ত চালু হয়। এরপরে ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ, দারুল উলুম হাটহাজারী অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে গমন করতেন। তবে ওবাইদুল হকের মৃত্যুর পর মাদ্রাসার কার্যক্রমে ক্রমান্বয়ে ভাটা চলে আসে এবং এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। এই মাদ্রাসার অন্যতম ছাত্র ছিলেন আমির উদ্দিন, যিনি এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা সমাপ্ত করে দারুল উলুম দেওবন্দে চলে যান।[১]
প্রতিষ্ঠা
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/4/41/Jamia_Islamia_Obaidia_Nanupur_02.jpg/220px-Jamia_Islamia_Obaidia_Nanupur_02.jpg)
আমির উদ্দিন দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ালেখা সমাপ্ত করে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় তার শিক্ষক হুসাইন আহমদ মাদানি তাকে নিজ এলাকায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন।[২] দেশে ফিরে তিনি তার পূর্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হেমায়াতুল ইসলাম মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন, যেখানে তিনি সাত বছর পড়ালেখা করেছেন।[৩] পরবর্তীতে এই মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বাবুনগর মাদ্রাসায় যোগদান করেন এবং নানুপুরে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে বাবুনগর মাদ্রাসা থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি তার বন্ধু মাহমুদ অলীর পরামর্শে একটি নতুন মাদ্রাসায় প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন।[৪] প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি নানুপুর বাজারের উত্তর পার্শ্ববর্তী মসজিদে মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয় নি। পরবর্তীতে তিনি পটিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আজিজুল হকের সাথে পরামর্শ করেন। আজিজুল হক তাকে নানুপুরের স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুর রহমানের ইবাদতখানায় মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে তিনি ১৩৭৭ হিজরির ২৯ শাওয়াল মোতাবেক ১৯৫৭ সাল থেকে এই ইবাদতখানায় পড়াশোনা শুরু করেন।[৪] তার সাথে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন মাহমুদ অলী ও ভুজপুরের কারী হামেদ। ধীরে ধীরে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তিনি সেখানে একটি বাঁশের ঘর নির্মাণ করেন এবং আবু সুফিয়ানকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। পর পর দুইবার বাঁশের ঘরটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তৃতীয়বার ১৯৬০ সালের ৫ ডিসেম্বর অগ্নিকাণ্ডে মাদ্রাসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্থানীয়দের পরামর্শে সেখানে মাটির ঘর নির্মাণ করা হয়।[৫] তিনি তার শিক্ষক ওবাইদুল হকের নামানুসারে এই মাদ্রাসার নাম রাখেন 'ওবাইদিয়া হাফিজুল উলুম'।[১]
ক্রমবিকাশ
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/5/54/Jamia_Islamia_Obaidia_Nanupur_05.jpg/220px-Jamia_Islamia_Obaidia_Nanupur_05.jpg)
আমির উদ্দিন ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত মাদ্রাসাটি পরিচালনা করেন। তার আমলে মাদ্রাসা মক্তব থেকে হিফজ পর্যায়ক্রমে জামাতে শশুমে উন্নীত হয়। তখন ছাত্রসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০ এবং শিক্ষক ৫/৬ জন।[৫] ১৯৬০ সালে তিনি হজ্জে গমন করেন। হজ্জে গমনের পূর্বে তিনি আজিজুল হকের সাথে পরামর্শ করে সুলতান আহমদ নানুপুরীকে মাদ্রাসার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান।[৫] তার নিয়োগের পর হাজী আব্দুস সালামের অর্থায়নে ইটের দেয়াল ও একটি বড় পুকুর খনন করে তার সংলগ্ন পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়।[৬] ১৯৬৫ সালে তিনি জমির উদ্দিন নানুপুরীকে মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।[৭] ১৯৭৬ সালে এখানে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস চালু হয় আর প্রথম শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব পান মাসউদুল হক।[৮] ১৯৮৫ সালে সুলতান আহমদ নানুপুরী জমির উদ্দিন নানুপুরীকে মাদ্রাসার পরিচালক মনোনীত করেন।[১] তার সময়ে মাদ্রাসার ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে এবং এটি অন্যতম ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।[৯] তার আমলে মধ্যখানে মাঠসহ চতুর্দিকে মাদ্রাসা ভবন, তিনতলা বিশিষ্ট মসজিদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অতিথিশালা, চর্তুদিকে পাকা ঘাট বিশিষ্ট পুকুর ও বাবুর্চিখানা নির্মিত হয়।[১] ২০১১ সালে জমির উদ্দিন নানুপুরীর মৃত্যুর পর মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান সালাহ উদ্দিন নানুপুরী।[১০] ২০১৫ সালে এই মাদ্রাসায় উচ্চতর তাফসির বিভাগের সূচনা হয়।[১১] শেখ আহমদের পর ২০১৮ সালে কুতুব উদ্দিন নানুপুরীকে মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস মনোনীত করা হয়।[১২] ২০১৯ সালে প্রথম কওমি মাদ্রাসা হিসেবে এটি অনলাইন ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে।[১৩] ২০২৪ সালে মাদ্রাসার নিজস্ব অর্থায়নে নানুপুর ইউনিয়নে চালু হয় ওবাইদিয়া এলপিজি ফিলিং স্টেশন।
ব্যবস্থাপনা
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/4/42/Jamia_Islamia_Obaidia_Nanupur_11.jpg/220px-Jamia_Islamia_Obaidia_Nanupur_11.jpg)
এই প্রতিষ্ঠানে কওমি মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তর থেকে দাওরায়ে হাদিস (স্নাতকোত্তর) এবং তার পরবর্তী উচ্চতর তাফসির বিভাগ, উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ, উচ্চতর ইসলামি আইন বিভাগ, উচ্চতর তাজবিদ ও কেরাত বিভাগ, উচ্চতর আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, উচ্চতর দাওয়া বিভাগ, উচ্চতর বাংলা/ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ রয়েছে।[১] এছাড়াও কম্পিউটার কোর্স, হস্তলিপি, দরজীগিরি ও বই পুস্তক বাইন্ডিংসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। বিশেষ বিভাগ হিসেবে আছে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ইসলামি কিন্ডার গার্ডেন, কুরআন মুখস্থকারীদের জন্য তাহফীযুল কুরআন বিভাগ এবং স্কুল কলেজের ছাত্রদের আলেম হওয়ার কোর্স হিসেবে সর্টকোর্স বিভাগ। ছাত্রদের বিনা বেতনে শিক্ষাদান ও বাসস্থানের ব্যবস্থাসহ যাবতীয় পাঠ্য পুস্তক ফ্রি প্রদান করা হয়। বর্তমানে মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৮০০০ এবং শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৫৫ জন।[১] মাদ্রাসার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার 'সুলতানিয়া পাঠাগার' সকলের জন্য উন্মুক্ত। এর পক্ষ থেকে প্রতি মাসে শিক্ষা সেমিনার আয়োজিত হয়। এছাড়াও আরবি ভাষা ও বক্তৃতাচর্চা বিভাগ প্রতি মাসে একটি সেমিনার এবং কাব্যরচনা বিভাগ প্রতিবছর ৪/৫ টি কাব্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে। নূরানী মুয়াল্লিম প্রশিক্ষণ বিভাগ কর্তৃক প্রতি বছর ২১ দিন ব্যাপী ফ্রী মুয়াল্লিম তথা শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন জেলাতেও এই বিভাগের কার্যক্রম বিস্তৃত।[১৪] প্রতি বছর ২ সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে এই মাদ্রাসায় ইতিকাফের আসর বসে, যা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইতিকাফের আসর হিসেবে বিবেচিত।[১৫] এই ধারাবাহিকতা আরম্ভ হয় ১৯৬৯ থেকে, তখন সুলতান আহমদ নানুপুরী সর্বপ্রথম ১৮ জন নিয়ে এই আসর শুরু করেন।[৬]
পরিচালিত সংস্থা
আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/8/80/Al_Manahil_food_distribution_28_October_2020.jpg/220px-Al_Manahil_food_distribution_28_October_2020.jpg)
১৯৯৮ সালে জমির উদ্দিন নানুপুরী দাতব্য সংস্থা হিসেবে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি নলকূপ স্থাপন, মসজিদ, মাদ্রাসা-মক্তব, অজুখানা প্রতিষ্ঠা, দুর্যোগকালে ত্রাণ বিতরণ এবং রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে সেবা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা সহ নানারকম কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।[১৬]
জমীরিয়া দাওয়াত সেন্টার বাংলাদেশ
ইসলামের দাওয়াত প্রদানের লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশব্যাপী এই সংগঠনের কার্যক্রম বিস্তৃত। প্রতি বৃহস্পতিবার মাদ্রাসার মসজিদে সংগঠনটির সাপ্তাহিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিভিন্ন সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।[১৪]
জমীরিয়া তা'লিম ও তাযকিয়া পরিষদ
ইসলামের মৌলিক জ্ঞান প্রসারের লক্ষ্যে ২০১০ সালে জমির উদ্দিন নানুপুরী এই শিক্ষাবোর্ডটি গঠন করেন। এর অধীনে প্রায় ৮০০ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটিতে সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৬ জন।[১৪]
প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান
সোলতানিয়া একাডেমী
শহরাঞ্চলে ইসলামি শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে জমির উদ্দিন নানুপুরী চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদে ২৪ কাটা জায়গার উপর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিকভাবে তিনতলা বিশিষ্ট ভবনে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কিন্ডার গার্ডেন ও হিফজ বিভাগ নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে একটি দশতলা বিশিষ্ট নির্মাণাধীন ভবনে একাডেমীকে একটি পূর্ণাঙ্গ বহুমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রতি মাসের প্রথম শনিবার এতে ইসলাহি মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।[১৪]