ডেভিড হেয়ার

ডেভিড হেয়ার (১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৭৭৫[১] - ১ জুন, ১৮৪২) একজন স্কটিশ ঘড়ি নির্মাতা ও ব্যবসায়ী এবং বাংলা, ভারতের এক মানবহিতৈষী ছিলেন। তিনি বর্তমান কলকাতার অনেক বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেমন, হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল। এছাড়া প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সহায়তা করেছিলেন।

ডেভিড হেয়ার
হেয়ার স্কুলে অবস্থিত ডেভিড হেয়ারের মূর্তি
জন্ম১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৭৭৫
মৃত্যু১ জুন ১৮৪২(1842-06-01) (বয়স ৬৭)
জাতীয়তাস্কটিশ
আন্দোলনমানবহিতৈষী

প্রারম্ভিক জীবন

১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন ডেভিড হেয়ার। তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন ঘড়ি নির্মাতার কাজ নিয়ে নিছকই ভাগ্যান্বেষণে।[২] যাইহোক, যখন তিনি ব্যবসায় উন্নতি করেছেন সেই সময় দেশীয় মানুষদের শোচনীয় অবস্থা দেখে তিনি মানসিকভাবে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাদের মতো নয়, যারা এদেশে এসে ভাগ্য ফিরিয়ে উন্নয়ন ও শান্তিতে জীবন যাপনের জন্যে আবার নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিল, তিনি এদেশে থেকে যেতে এবং এদেশের উন্নতিতে জীবন উৎসর্গ করবেন বলে মনস্থ করেন। যাইহোক, অন্যদের নিজের ধর্মে ধর্মান্তরিত করার মতো তিনি ধর্মযাজক ছিলেন না। তিনি নিজের মতো জীবন যাপন করতেন এবং অন্যদেরকে তাদের মতো থাকতে দিতেন, কেবল তাদের অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করতেন। তিনি স্কুল বুক সোসাইটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

কৃতিত্ব

তিনি ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তার দোকানে ঘড়ি কিনতে আসা সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গেও এব্যাপারে আলাপ করতেন। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে কলকাতায় তার সাক্ষাৎ হয়। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভার সঙ্গে তিনি যুক্ত হন এবং জনহিতকর কাজ, শিক্ষার উন্নতির জন্যে প্রচেষ্টা কর‍তে থাকেন। তার নিজের ঘড়ির ব্যবসার ক্ষতি করেও অর্থ, সময় এবং নিরলস শ্রম দান করতে থাকেন শিক্ষার উন্নতিকল্পে। 'আত্মীয় সভা'য় কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এডওয়ার্ড হাইড ইস্টকে তার এই উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য অনুরোধ করেন। এ ব্যাপারে হাইড ইস্ট ও কতিপয় ভদ্রলোকের সক্রিয় সহযোগিতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বছরই তিনি ইংরেজি এবং বাংলা পুস্তক মুদ্রণ ও প্রকাশনার জন্য ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজসেবায় সার্বক্ষণিকভাবে আত্মনিয়োগের জন্য ডেভিড হেয়ার ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তার ব্যবসার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন তার বন্ধু গ্রে সাহেব-এর ওপর। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তারা দুজন হেয়ার স্ট্রিটের একটি বাড়িতে একসঙ্গে অবস্থান করতেন। ইতোপূর্বে তিনি ব্যবসা করে কলকাতায় বিপুল পরিমাণ ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করেছিলেন। ওই সম্পত্তির কিছু অংশ তিনি হিন্দু কলেজকে দান করেন বাকিটা সংস্কৃত কলেজের নিকট নামমাত্র দামে বিক্রি করেন। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর সঙ্গে ডেভিড হেয়ারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। ইয়ং বেঙ্গলের একজন হিতৈষী হিসেবে হেয়ারের তাদের সংগঠন ‘সোসাইটি ফর দ্য প্রোমোশন অব জেনারেল নলেজ (১৮৩৮)' সংস্থার পৃষ্ঠপোষক হন। নিষ্ঠুর শ্রম আইনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। ওই আইনের আওতায় সে সময়ে ভারতীয় শ্রমিকদের দাস হিসেবে ইউরোপের উপনিবেশগুলোতে পাঠানো হোত। ঔপনিবেশিক আমলের উৎপীড়নমূলক, অমানবিক আইনের সংস্কার সাধনের জন্য তিনি জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করেন। দেশীয় সংবাদপত্রের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের জন্যও সংগ্রাম করেন। নতুন স্কুল এবং অন্যান্য জ্ঞানচর্চামূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দানের কারণে হেয়ার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কলকাতার শেরিফ পদের জন্য মনোনীত করে এবং ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মাসিক ১০০০ রুপি বেতনে উক্ত পদে নিয়োগ দিয়ে তার ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করেছিল।[২]

ডেভিড হেয়ারের সমাধি, কলেজ স্কোয়ার (অধুনা বিদ্যাসাগর উদ্যান), কলকাতা


পরবর্তী জীবন

পরবর্তী জীবনে তিনি তার ঘড়ির ব্যবসা দেখার মতো সময় দিতে পারছিলেননা এবং সেজন্যে ওটা গ্রে নামে তার এক বন্ধুর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কিছু অর্থ দিয়ে তার নিজের জন্যে একটা ছোটো বাড়ি কিনেছিলেন এবং বাকি অর্থ স্কুলের উন্নয়নের জন্যে খরচ করেছিলন। দীর্ঘ কর্মজীবনের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলন। তিনি কলেরায় আক্রান্ত হন। তার ছাত্রদের মধ্যে একজন, ডা. প্রসন্ন কুমার মিত্র তাঁকে আরোগ্য করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেও বিফল হন এবং ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন ডেভিড হেয়ারের জীবনাবসান হয়। এই মৃত্যুসংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা শহরময় বিষাদের ছায়া নেমে আসে। খ্রিস্টান মিশনারিরা যেহেতু মনে করত যে, ডেভিড হেয়ার ঈশ্বর-বিশ্বাসী নন, সেজন্যে তারা তাদের কবরস্থানে হেয়ারের মরদেহ সমাহিত করতে দেয়নি! তার দান করা জায়গা, হেয়ার স্কুল-প্রেসিডেন্সি কলেজের চত্বরেই ডেভিড হেয়ারকে সমাহিত করা হয়েছিল। হেয়ার স্কুলের উলটো দিকে বর্তমান কলেজ স্কোয়্যার (সাম্প্রতিক নাম বিদ্যাসাগর উদ্যান) সুইমিং পুলের চৌহদ্দিতে তার সমাধির ওপর এক আবক্ষ মূর্তি আছে।

শিবনাথ শাস্ত্রীর কথায়, "তার মরদেহ মিস্টার গ্রে সাহেবের বাড়ি থেকে বাইরে আনতেই কিছু গাড়িতে, অন্যেরা পায়ে হেঁটে, হাজার হাজার জনতা ওই মরদেহ অনুসরণ করেছিল। কলকাতা সেদিন যে দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিল এরকম আর কখনো হবেনা। ঠিক বো বাজার ক্রসিং থেকে মাধব দত্তের বাজার পর্যন্ত পুরো জায়গাটা জনজোয়ারে পূর্ণ হয়েছিল।"

ডেভিড হেয়ার যে রাস্তায় থাকতেন তার নাম হেয়ার স্ট্রিট; এটা বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগের (পুরোনো ডালহৌসি স্কোয়্যার) ঠিক পাশেই। জনতার অবদানে তার এক পূর্ণাবয়ব মূর্তি [ছবিতে দেখুন] তৈরি হয় এবং যেটা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল হেয়ার স্কুল চত্বরে।

মৃত্যু

অবিরাম জনহিতৈষী কার্যকলাপ ও ছাত্রদেরকে আর্থিক সহায়তা ইত্যাদির কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন হেয়ার। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন মৃত্যুমুখে পতিত হন নিঃস্বার্থ, মানবতাবাদী এই ভারতপ্রেমিক। যদিও তার অতিরিক্ত হিন্দুপ্রীতির কারণে তাঁকে 'বাইবেল বিরোধী হিন্দু' আখ্যা দেওয়া হয় ও খ্রিস্টান কবরখানায় তাঁকে স্থান দেওয়া নিয়ে তীব্র সমস্যা হয়। শেষপর্যন্ত তাঁকে কলেজ স্কোয়ারে সমাধিস্থ করা হয়। রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামতনু লাহিড়ী প্রমুখেরা তার শবানুগমন করেন।[৩]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন