স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা ও দর্শন

বানী

স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা ও দর্শন ভারতের ধর্ম, শিক্ষা, চরিত্র গঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিবেকানন্দ ছিলেন একজন ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসী। তিনি পাশ্চাত্যে বেদান্ত দর্শন প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ভারতেও ধর্মসংস্কারে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, "যদি ভারতকে জানতে চাও, তবে বিবেকানন্দকে জানো। তাঁর মধ্যে যা কিছু আছে সবই ইতিবাচক; নেতিবাচক কিছুই নেই।"[১] বিবেকানন্দ অনুভব করেছিলেন, দেশের ভবিষ্যৎ জনগণের উপর নির্ভর করে। তাই তিনি মানুষের উপর বেসহী জোর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "আমার উদ্দেশ্য হল মানুষের চরিত্র গঠন"। এইভাবেই তিনি নিজের শিক্ষা বর্ণনা করেন।[২] বিবেকানন্দ তার আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, "(তাঁর উদ্দেশ্য) মানবজাতিকে তার অন্তর্নিহিত দেবত্ব শিক্ষা দেওয়া এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তা শেখানো।"[৩]

শিক্ষা

শিক্ষার সারমর্ম

স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন, শিক্ষা পরিপূর্ণতার এক প্রকাশ। তা মানুষের মধ্যেই থাকে।[৩] তিনি মনে করতেন, সমসাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা যে মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে না, বা মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে না, তা খুব বেদনার বিষয়। বিবেকানন্দ শিক্ষাকে তথ্যের সমষ্টি মনে করতেন না। তার কাছে শিক্ষা ছিল আরও বেশি কিছু। তিনি শিক্ষাকে মানুষ তৈরি করার, জীবন দানের ও চরিত্র গঠনের মাধ্যম মনে করতেন। তিনি শিক্ষাকে মহান চিন্তার সমষ্টি মনে করতেন।[২]

ইতিবাচক শিক্ষা

স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে শুধু ইতিবাচক শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, নেতিবাচক চিন্তাগুলি মানুষকে দুর্বল করে দেয়। তিনি বলেছিলেন, যদি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সবসময় দোষারোপ না করে উৎসাহিত করা হয়, তবে তারা এক সময় উন্নতি করবেই।[৬]
নিউ ইয়র্কে বিবেকানন্দ দেখেছিলেন, আইরিশ উপনিবেশ-স্থাপকরা খুবই খারাপ অবস্থায় খুব সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে ভয়ে ভয়ে সেখানে এসেছিল, কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তাদের পোষাকপরিচ্ছদ আচারব্যাবহার সব পালটে যায়। তখন তাদের মধ্যে সেই ভয়ভীতির ভাব সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়েছিল। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিবেকানন্দ দেখেন যে, যদি বেদান্তের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে বলতে হবে সেই আইরিশেরা স্বজাতীয়দের দেয়ারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং সবাই তাকে বলছিল, "প্যাট, তোমার কোনো আশা নেই, তুমি ক্রীতদাস হয়ে জন্মেছো এবং তাই থাকবে।" এই কারণে তার মনে হীনম্মন্যতা এসেছিল। কিন্তু আমেরিকায় আসার পর থেকে সবাই তাকে বলতে শুরু করল, "প্যাট, তুমিও মানুষ আমাদের মতো। মানুষই সব করে। তোমার আমার মতো মানুষেরাই করে। তাই সাহসী হও!" সেই জন্যই সে মাথা তুলে আত্মমর্যাদায় ভর করে চলছে।[৭] তাই বিবেকানন্দ বলেছেন, ম্যাকোলে শিক্ষাব্যবস্থা ও ভারতীয় বর্নব্যবস্থা ছেলেমেয়েদের নেতিবাচক শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা থেকে তারা আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদার শিক্ষা পায় না। বিবেকানন্দের মতে, একমাত্র ইতিবাচক শিক্ষাই তাদের দেওয়া উচিত।

ধর্ম

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বেদান্ত দর্শনের অনুগামী। তিনি বলেছেন, ধর্ম শুধুমাত্র বক্তৃতা বা দর্শনতত্ত্বে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ধর্মকে আত্ম-উপলব্ধি বলেছেন। তার ভাষায়, "এটি হওয়া বা হতে থাকা। তবে শোনা বা জানা নয়। ...প্রত্যেকের অন্তরে যে দেবত্ব (ঐশ্বরীয় সত্ত্বা) আছে, তার পূর্ন বিকশিত রূপই ধর্ম।"[৩]তার মতে সব পূজা যদি পবিত্র হয় ও অপরের হিতের জন্য করা হয়, তবে তার সমষ্টিকেই ধর্ম বলা চলে।[৮] বিবেকানন্দ বলেছেন, ধর্ম হল মানুষকে পশু থেকে মানুষে এবং তারপর মানুষ থেকে দেবতায় রূপান্তরিত করা।[৯] He firmly said, despondency can not be religion.[১০] বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংসের থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব শিখেছিলেন, "জীবই শিব"। তাই তিনি "শিবজ্ঞানে জীবসেবা"র উপর বেশি গুরুত্ব দেন। বিবেকানন্দ বলেছেন, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর থাকেন। তাই মানুষের সেবা করাই ঈশ্বরের সেবা।[১১]

ধর্মসমন্বয়

স্বামী বিবেকানন্দের মতে, জগতের সবচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য হল একটি ধর্মের মানুষের অপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার অভাব। ১৮৯৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বধর্ম মহাসভায় দেওয়া ভাষণে তিনি একটি ব্যাঙের গল্প বলেন। ব্যাঙটি কুয়োর মধ্যে থাকত এবং ভাবত সেই কুয়োর চেয়ে বড়ো জগতে আর কিছু নেই। গল্পের শেষে বিবেকানন্দ বলেন-

বিবেকানন্দ বলেছেন, আমাদের শুধু সহিষ্ণুই হতে হবে না, বরং অন্য মতকেও গ্রহণ করতে হবে। কারণ সব ধর্মের সার কথাটিই হল সত্য।[১৩]

ভারত

স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে যদি কোনো দেশকে পুণ্যভূমি বলতে হয়, যদি কোনো দেশে মানবিকতা, পবিত্রতা, শান্তি সর্বোচ্চ স্থান নেয় এবং সর্বোপরি কোনো দেশ যদি আধ্যাত্মিক ধারণায় পূর্ণ থাকে, তবে সেই দেশটি হল ভারত[১৪] তার মতে, ভারতীয়রা প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও অর্থকেই জীবনের লক্ষ্য মনে করে না।[১৫]

জাতীয় সংহতি

বিবেকানন্দের মতে, ইচ্ছা ও তার সংহতিই হল শক্তি। তিনি বলেন, ইংরেজরা ভারতীয়দের থেকে সংখ্যায় অনেক কম হয়েও ভারত শাসন করছে। এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ইংরেজদের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তিকেই এর কারণ বলেছেন। তাই বিবেকানন্দ বলেছেন, ভারতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে হলে, সংগঠন, শক্তিসঞ্চয় ও ইচ্ছাশক্তির সমন্বয়ের উপর জোর দিতে হবে।[১৬]

মানব মন

স্বামী বিবেকানন্দ মানুষের মনকে একটি সর্বদা অশান্ত ও নিজের প্রকৃতির বশে চঞ্চল বানরের সঙ্গে তুলনা করেছেন।[১৭] তিনি দেখেছিলেন, মানুষের মন সাধারণত বাইরের দিকে বেরোতে চায়। আর তার জন্য সে ইন্দ্রিয়গুলিকে অবলম্বন করে।[১৮] তাই তিনি আত্মসংযমের উপর জোর দিয়েছিলেন।[১৯] কারণ তিনি বলেছেন, সংযত মনের চেয়ে শক্তিশালী আর কিছুই হয় না। আর যতই মনকে সংযত করা হয়, তার শক্তি তত বাড়ে।[২০] তাই তিনি এমন কিছু করতে বারণ করেছেন, যা মনকে অশান্ত করে বা মনের অসুবিধা সৃষ্টি করে।

নারীত্ব প্রসঙ্গে

স্বামী বিবেকানন্দ লিঙ্গ বৈষম্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছেন। তার মতে আত্মায় লিঙ্গ বা বর্ণভেদ করা অশাস্ত্রীয়। এমনকি যোগ্যতার নিরিখ বিচার করাও অন্যায়। তাই তিনি পুরুষ-নারী চিন্তা না করে মানুষ চিন্তা করতে বলেছেন।[২১]স্বামী বিবেকানন্দের মতে, জাতির উন্নতির মাপকাঠিই হল সেই জাতিতে নারীর মর্যাদার স্থান।[২১] আর তাই ভারতে নারীর অবস্থা ভাল না হলে ভারতের অতীত মর্যাদা ও গৌরব উদ্ধার করা সম্ভব নয় বলেই তিনি মত প্রকাশ করেছেন।[২২] বিবেকানন্দ পুরুষ ও নারীকে পাখির দুই ডানার সঙ্গে তুলনা করেছেন। পাখি যেমন এক ডানায় ভর করে উড়তে পারে না, তেমনি নারী জাতির অবস্থা উন্নত না হলে জগতের উন্নতি সম্ভব নয় বলেই তিনি মত প্রকাশ করেছেন।

নারী জাতি খেলনা নয়

স্বামী বিবেকানন্দ লক্ষ্য করেছিলেন সব জায়গাতেই নারী জাতিকে খেলনা মনে করা হয়। আধুনিক যুগে আমেরিকার মতো দেশে নারীর স্বাধীনতা আছে। তবুও বিবেকানন্দ সেখানে দেখেছিলেন, পুরুষ জাতি মেয়েদের সৌন্দর্যের নিরিখে তাদের বিচার করে। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, এটা অনৈতিক। আর নারী জাতিরও এটা মেনে নেওয়া উচিত না। বিবেকানন্দের মতে, এতে মানবতার মহান দিকটি নষ্ট হয়ে যায়।[২৩]

ভারতীয় নারী

বিবেকানন্দের মতে, ভারতে নারী জাতির আদর্শ হল মাতৃত্ব। অসামান্য, নিঃস্বার্থ, সর্বংসহা, ক্ষমাশীলা মায়ের আদর্শটিকে বিবেকানন্দ উচ্চ স্থান দিয়েছেন।[২৪] ভারতীয় জাতির যে দুটি অভ্যাসকে তিনি সবচেয়ে অকল্যাণকর বলে চিহ্নিত করেন, সেদুটি হল নারী জাতির অবমাননা ও জাতিভেদ প্রথা।[২৫]

ভারতীয় নারীর আদর্শ সীতা

বিবেকানন্দ সীতাকে ভারতের প্রতীক। তার মতে, অতীতের বিশ্বসাহিত্যে বা ভবিষ্যতের বিশ্বসাহিত্যেও সীতার মতো চরিত্র সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। কারণ, সীতা অনন্য এক চরিত্র। তার মতে, রাম চরিত্রটির অনেক তুলনা থাকতে পারে। কিন্তু সীতা চরিত্রের কোনো তুলনা নেই।[২৬][২৭] তিনি লিখেছেন:

সীতা কখনও প্রত্যাঘাত করেননি। তাই তাকেই বিবেকানন্দ যথার্থ ভারতীয় বলেছেন।[২৯]

চরিত্র গঠন

প্রতিটি মানুষ ও প্রতিটি জাতির উন্নতির জন্য যে আবশ্যিক প্রয়োজনের কথা বিবেকানন্দ বলেছেন, তা হল:[৩০]

  • ভালর শক্তিতে দৃঢ় বিশ্বাস।
  • ঈর্ষা ও সন্দেহের অবসান।
  • যারা ভাল হতে বা ভাল করতে চেষ্টা করছে, তাদের সাহায্য করা।

বিবেকানন্দ ঈর্ষা ও অহংকার বাদ দিয়ে একত্রে সবাইকে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পবিত্রতা, ধৈর্য ও মানসিক দৃঢ়তা সব বাধা দূর করে দেয়। তাই তিনি সাহসের সঙ্গে কাজ করতে বলেছেন। যে কাজ ধৈর্যের সঙ্গে সঠিক ভাবে করা হয়, বিবেকানন্দের মতে, সেই কাজই সফল হয়।

আত্মবিশ্বাস

বিবেকানন্দের মতে, মহত্বের গোপন রহস্যটি হল – আত্মবিশ্বাসই ঈশ্বরবিশ্বাস। বিবেকানন্দ বলেছেন, বিশ্বের ইতিহাস হল কয়েকটি আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন মানুষের ইতিহাস। নিজের উপর বিশ্বাস থাকলেই অন্তরের দেবত্ব জাগরিত হয়। তাই তিনি বলেছেন, তেত্রিশ কোটি হিন্দু দেবদেবী ও বিদেশি দেবদেবীতে বিশ্বাস থাকলেও, কারো যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে সে মুক্তি পাবে না।[৩১]

পাদটীকা

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন