ইতিহাস (ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ)

ভারতীয় দুইটি প্রধান সংস্কৃত মহাকাব্য

ইতিহাস তৈরি হয়েছে মহাভারতরামায়ণ দিয়ে। তবে কখনো কখনো এতে পুরাণ বা এর কিছু কাহিনী অন্তর্গত বলে ধরা হয়। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেরচন্দ্রবংশীয় রাজাদের কথা লিপিবদ্ধ আছে। পুরাণে আছে হিন্দু দৃষ্টি অনুযায়ী বিশ্ব ইতিহাস; যেমন পৃথিবী সৃষ্টি, জনশ্রুতি, ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনি। রামায়ণে আছে সূর্যবংশীয় রাজা শ্রী রামচন্দ্রের কথা। ভারতীয় প্রাচীন কবিগণ তাদের কাব্য ও নাটকের গল্পগুলো এই ইতিহাস থেকে নিয়েছেন। আমাদের সময়ে প্রাপ্ত প্রাচীন পুঁথিগুলো থেকে যা পাওয়া গেছে তা সতর্কতার সাথে, ক্রমানুসারে একত্রিত করেছেন এফ.ই. পারগিটার তার প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহাসিক প্রথা বইয়ে।[১]

চিত্র- ব্যাসদেবের বর্নণা শুনে গনেশ মহাভারত লিখছেন।

ব্রাহ্মণ্য ধর্ম

সৃষ্টিতত্ত্ব ও আদিযুগের ইতিহাস

বৈদিক ধর্মানুসারে এই জগতের বিনাশ ও সৃষ্টির সাথে সাথে মানুষের জীবন চক্রাকারে আবর্তিত হয়। সময়ের ব্যাপ্তিকে চারটিভাগে ভাগ করা হয় যথা- সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগকলি যুগ। এই চার যুগ মিলে হয় এক মহাযুগ। আর একাত্তরটি মহাযুগে হয় এক মন্বন্তর। একজন মনুর জীবনকাল হল এক মন্বন্তর। অর্থাৎ এক মনুর তিরোভাব ও অপর মনুর আবির্ভাবের অন্তর্বর্তী সময়কে মন্বন্তর বলে। মনুই প্রথম ব্যক্তি, প্রথম রাজা এবং আইনপ্রণেতা। প্রত্যেক মন্বন্তরে আলাদা আলাদা ইন্দ্র, দেবদেবী ও সপ্ত-ঋষি থাকে। চৌদ্দটি মন্বন্তর নিয়ে গঠিত হয় এক কল্প। প্রতিটি কল্পের শেষে সৃষ্টির বিনাশ হওয়াকে প্রলয় বলে। প্রলয়ের পর আবার সৃষ্টির শুরু। আর এভাবে চলতে থাকে সৃষ্টি-লয়ের চক্র।

এ ধর্মের বর্ণনা অনুসারে বর্তমান কল্পের নাম বরাহ। এ কল্পের চৌদ্দটি মন্বন্তরের ছয়টি অতিবাহিত হয়েছে। রাজবংশের ইতিহাস অনুসারে বর্তমান মন্বন্তরের মনুর নাম বৈবস্বত বা সত্যব্রত। বৈবস্বত মনুর মাধ্যমেই ইতিহাস তার সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। বৈবস্বত মনুর পূর্বের মনুর নাম চাক্ষুষ মনু। চাক্ষুষ মনুর প্রপৌত্র রাজা পৃথু। রাজা পৃথু পৃথিবীর ভূভাগকে সমতল করে গ্রাম ও নগরের সৃষ্টি করেন এবং কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য ও পশুপালনের প্রচলন করেন। আট প্রজন্ম পরে এক বিশাল বন্যায় এই চক্রের শেষ হবে।

সত্য যুগ

চাক্ষুষ মন্বন্তরের শেষের দিকে এক প্রলয়ংকারী বন্যায় পৃথিবী থেকে জীবনের সকল নিশানা মুছে যায়। মৎস অবতার ধারন করে বিষ্ণু শুধুমাত্র বৈবস্বত মনুকে বাঁচিয়ে নেয়। মৎস পরবর্তী চক্রে পৃথিবীকে জনাকীর্ণ করে তোলে।[২][৩][৪] ইতিহাসের সকল রাজবংশের আগমন ঘটে বৈবস্বত মনুর পুত্র ও তার একমাত্র কন্যা ইল হতে। এই কন্যা এক যজ্ঞ থেকে জন্ম নেয় ও পরে তার স্ত্রী হয়।[৫] ইক্ষ্বাকু বৈবস্বত মনুর জ্যেষ্ঠ পুত্র যিনি কোসালা রাজ্যের অযোধ্যায় সূর্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ যে বৈবস্বত মনুর পিতা হল বিবস্বান তথা সূর্য দেবতা। ইক্ষ্বাকুর কনিষ্ঠ পুত্র নিমি একটু পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বিদেহ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মিথিলা কে বিদেহ রাজ্যের রাজধানী হিসাবে প্রথিষ্ঠা করেন নিমির পুত্র মিথি।[৬] রাজা মিথি কে জনক নামে ও ডাকা হয়, পরবর্তীতে এ নামেরই প্রচলন ঘটে।

একই সময়ে মধ্যদেশের (দোয়াব) প্রতিস্থানে উত্থান ঘটে চন্দ্র বংশের। তারা হল বৃহস্পতির স্ত্রী। তারা ও চন্দ্রের (মুন/সোম) অবৈধ প্রণয়ে জন্ম হয় বুধের। বুধ ও ইলার ঔরসজাত সন্তান পুরূরবার।[৭] পুরূরবার ও উর্বশীর প্রেম কাহিনী প্রথম বর্ণিত হয় ঋগ্বেদে।[৮] কয়েক প্রজন্ম ধরে তাদের এ প্রেম কাহিনী ভারতের পৌরাণিক কল্পকাহিনীতে আবর্তিত হয়েছে। কবি কালিদাস এ কাহিনী অবলম্বনে তার বিক্রম উর্বশী নাটক রচনা করেছেন। পুরূরবারের কনিষ্ঠ পুত্র অমাবসু কান্যকুজ্ব(বর্তমান কনৌজ) সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।[৯]

পুরূরবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র আয়ুসের পরে সাম্রাজ্যটি দুটি ভাগে ভাগ হয়। আয়ুসের বড় ছেলে নহুশ স্বর্গে ইন্দ্র হিসাবে অধিষ্ঠিত হলে সে ইন্দ্রানীর(ইন্দ্রের স্ত্রী শচী) প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পরে।[১০] তার এ লোলুপ দৃষ্টির জন্য তাকে স্বর্গ হতে বিতাড়িত করা হয়। ক্ষত্রবর্ধ আয়ুসের আরেক ছেলের নাম, তিনি কাশিতে (বারণসী) রাজ্য স্থাপন করেন। তার বংশধররা কাশ্য নামে পরিচিত।[৯]

নহুশের পুত্র ও উত্তরাধিকারী যযাতি একজন বিখ্যাত বিজেতা ছিলেন, তিনি চক্রবর্তী রাজা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তার দুই স্ত্রী, সকল অসুর-দানবদের গুরু শুক্রাচার্যের(শুক্র) কন্যা দেবযানী ও দানবরাজের কন্যা শর্মিষ্ঠা। ছিল পাঁচ পুত্র, দেবযানীর গর্ভে জন্ম হয় যদু ও তুর্বসুর ও শর্মিষ্ঠার গর্ভে জন্ম নেয় দ্রুহ্য, অণুপুরু(পোরাস) । এদের মধ্যে পুরু সর্ব কনিষ্ঠ হলেও ছিল সব থেকে কর্তব্যপরায়ণ। তাই যযাতি তাকেই প্রতিস্থানের পুরুষানুক্রমিক সার্বভৌম ক্ষমতার উত্তরাধিকারী করে যান।[১১] বড় পুত্ররা প্রতিস্থানের আশপাশের রাজ্যগুলো পেয়েছিল। যযাতির পাঁচ পুত্র থেকেই পাঁচটি রাজ বংশের সূচনা হয় যথা- যাদব, তুর্বসু, দ্রুহ্য, অনব ও পৌরব।[১২]

যদুর পরপরই যাদব সাম্রাজ্য দুভাগে ভাগ হয়ে যায় যার প্রধান অংশের নাম ক্রোষ্টি, ও অপর স্বাধীন অংশের নাম হৈহয় যার অগ্রভাগে ছিলেন সহস্রজিৎ। যদু বংশ রাজা শশবিন্দুর অধীনে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন, তিনি চক্রবর্তীও হয়েছিলেন। অযোধ্যারাজ যুবনাশ্বের পুত্র রাজা মান্ধাতা,[১৩] শশবিন্দু কন্যা বিন্দুমতিকে বিবাহ করেন ও নিজের খ্যাতি বৃদ্ধি করেন। মান্ধাতা ও তার শ্বশুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজ্য বিস্তার ঘটান ও চক্রবর্তী উপাধী ধারণ করেন।[১৪] চক্রবর্তী মান্ধাতার এক পুত্র পুরুকুতস-তিনি নদীর দেবী নর্মদাকে বিবাহ করেন। অপর এক ছেলে মুচকুন্দ, মহেশ্মতি নামে নর্মদা নদীর তীরে এক শহর গড়ে তোলেন ও সুরক্ষিত করেন।

তার অল্প পরেই দ্রুহ্যু রাজ গান্ধার উত্তর-পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হন(বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়া) ও গান্ধার রাজ্য গড়ে তোলেন। তার বংশধরগণ ভারতের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ম্লেচ্ছ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।[১৫] অণু কর্তৃক সৃষ্ট বংশ অণব, পরে উশীনর ও তিতিক্ষুর অধীনে দুভাগে ভাগ হয়। উশীনরের পুত্ররা পাঞ্জাবের পূর্ব দিকে বিভিন্ন বংশের প্রতিষ্ঠা করে যথা যোদ্ধা, অবষ্ঠী, নবরাষ্ট্র, ক্রিমিলা ও শিবি। উশিনরের পুত্র শিবি, তার নামেই তিনি শিবপুরে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীতে তার বদান্যতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তার পুত্ররা সম্পূর্ণ পাঞ্জাব দখল করে বৃষদ্রব, মদ্রক, কৈকেয় ও সৌৰীড় ইত্যাদি রাজ্য স্থাপন করে। অণু বংশের অপর অংশ পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে তিতিক্ষুর অধীনে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্মপুণ্ড্র রাজ্য স্থাপন করে। [১৫]

হৈহয় রাজা কৃতবীর্য্য, তিনি ভৃগুদের ধর্মগুরু হিসাবে পেয়েছিলেন ও তাদের উন্নয়নে অনেক সম্পদ দান করেছিলেন। এ সম্পদদানকে কৃত্যবীর্য্যের আত্মীয়স্বজন ভালোভাবে নেয় নি। ফলে তারা সে সকল সম্পদ ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করলে, ভৃগুরা প্রতিরোধ করে। তারা ভৃগুদের সাথে অন্যায় আচরণ করতে থাকে, অতিষ্ঠ হয়ে ভৃগুরা অন্য দেশে পালিয়ে যায়।[১৬] তৎকালীন কান্যকুজ্বের রাজা গধিরের পুত্র ঋষি বিশ্বামিত্র[৯][১৭] গধির কন্যা সত্যবতীর সাথে বিয়ে হয় ভৃগু ঋষি রুচিকার সাথে। সত্যবতী ও রুচিকা জমদগ্নি নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।

সূর্য বংশের ধারাবাহিকতায় গধি ও কৃতবীর্য্যের সমসাময়িক ছিলেন ত্যূর্য অরুণ। তিনি অযোধ্যার শাসক ছিলেন। ত্যূর্য অরুণ তার গুরু বশিষ্ঠের পরামর্শে নিজের সন্তান, সত্যব্রত কে বনবাস দেন। সত্যব্রতের অপর নাম ত্রিশঙ্কু। ত্যূর্য অরুনের মৃত্যুর পর ত্রিশঙ্কু সশরীরে স্বর্গারোহণের জন্য যজ্ঞের আয়জন করেন। ঋষি বশিষ্ঠ সে যজ্ঞে পৌরহিত্য করতে অস্বীকার করেন।[১৮] প্রত্যাখ্যাত হয়ে ত্রিশঙ্কু গুরুপুত্রদের শরণাপন্ন হন। পিতার কাছে থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আবার তার সন্তানদের কাছে আসায় তারা কুপিত হয়ে ত্রিশঙ্কুকে অভিশাপ দেন। এর অব্যবহিত পরে কান্যকুজ্বের রাজা বিশ্বামিত্র ঋষি বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনী (আরেক নাম শবলা - একটি দুগ্ধবতী গাভী) কে অধিকার করার চেষ্টা করেন। এতে বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের মাঝে প্রচণ্ড এক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বিশ্বামিত্রের পরাজয় ঘটে। এতে তিনি ক্ষত্রিয় শক্তি থেকে ব্রহ্মশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারেন। তাই নিজে ব্রহ্মঋষি হওয়ার জন্য তার সিংহাসন ত্যাগ করে তপস্যা করতে থাকে।[১৯] এ সময় বিশ্বামিত্রের সাথে ত্রিশঙ্কুর মিত্রতা হয়। বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুর স্বশরীরে স্বর্গারোহণ যজ্ঞ করতে রাজি হন।[২০]

এভাবে বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের মাঝে শত্রুতা চলতে থাকে। এমনকি ত্রিশঙ্কুর পুত্র হরিশচন্দ্রের রাজত্ব কালেও তা বিদ্যমান ছিল। হরিশচন্দ্রের এক ছেলে, নাম রোহিত। হরিশচন্দ্র রোহিতকে বরুণের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। বলি উৎসর্গে দেরি হচ্ছিল কেননা রাজা হরিশচন্দ্র শোথ রোগে (যে রোগে জলীয় পদার্থ জমে শরীরের কোনো অংশ ফুলে ওঠে) ভুগছিলেন। বশিষ্ঠের পরামর্শে রোহিত আজিগর্তের পুত্র শুনঃশেফকে ক্রয় করে নেয়। যাতে নিজের জায়গায় শুনঃশেফকে বলি দেওয়া যায়। উল্লেখ্য যে শুনঃশেফ ছিলেন বিশ্বামিত্রের বোনের নাতি। শুনঃশেফকে বিশ্বামিত্র বরুণমন্ত্র শিখিয়ে দেন। তাই বলির পূর্বে শুনঃশেফ যখন মন্ত্র উচ্চারণ করে তখন বরুণের আবির্ভাব ঘটে, তিনি শুনঃশেফের প্রতি খুশি হয়ে তাকে মুক্ত ঘোষণা করেন ও রাজা হরিশচন্দ্রের রোগ মুক্তি ঘটান। বিশ্বামিত্র তখন শুনঃশেফকে নিজের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন ও নতুন নাম দেন দেবরথ।[২১][২২] কিন্তু এতে বিশ্বামিত্রের কিছু ছেলে বিদ্রোহ করে, বিশ্বামিত্র ও রাগান্বিত হয়ে তাদেরকে সমাজচ্যুত হওয়ার অভিশাপ দেন। তারাই ছিল বিভিন্ন দস্যু বংশ যেমন অন্ধ্র, মুতিব, পুলিন্দ ইত্যাদি বংশের পূর্বপুরুষ।[২৩][২৪] তৎপর বিশ্বামিত্র ব্রহ্মঋষির মর্যাদা প্রাপ্ত হন।[২৫]

অপর দিকে হৈহয় বংশের রাজা অর্জুন কৃতবীর্য্য তার পিতা কৃতবীর্য্যের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন একজন পরাক্রমশালী রাজা। জমদগ্নির সাথে তিনি দীর্ঘ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরেন। ইক্ষ্বাকু বংশের এক ক্ষুদ্র রাজার কন্যা রেণুকা। জমদগ্নি ও রেণুকার ঔরসে জন্ম নেন বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম। পরশুরাম অর্জুন কৃতবীর্য্যকে হত্যা করলে প্রতিশোধ হিসাবে কৃতবীর্য্যের সন্তান জমদগ্নিকে হত্যা করেন। পরশুরাম এর সমুচিত জবাব দিতে ক্ষত্রিয় বংশের বিনাশ সাধনে দৃঢ় সংকল্প হন। পাঁচজন ব্যতীত তিনি সকল ক্ষত্রিয়কে হত্যা করেন।[২৬]

এই পাঁচজন পাঁচটি জাতির সৃষ্টি করেন যথা — তলজংঘা, বিতিহোত্র, অবন্তি, তুডিকের, ও যত। এরা সম্মিলিত ভাবে অযোধ্যা আক্রমণ করে ও বাহু রাজাকে রাজ্যচ্যুত করে।[২৭] তারা কাশিরাজ দিবদাস কে পরাজিত করে রাজ্যচ্যুত করে। দিবদাসের পুত্র প্রতর্দন, বিতিহোত্রদের পরাজিত করে রাজ্য উদ্ধার করেন।[২৮] ক্ষণকাল পরে বাহু সাগর নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সাগর তাদের সকল শত্রুকে পরাজিত করে সম্পূর্ণ রাজ্য উদ্ধার করেন ও চিরজীবনের জন্য হৈহয় বংশকে ধ্বংস করেন।[২৭]

সাগরের পুত্রদের সংখ্যা ষাট হাজার। এক সময় সাগর রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন । দেবরাজ ইন্দ্র সাগর রাজের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া চুরি করে পাতালে কপিল মুনির আশ্রমে বেধে রেখে আসেন। সাগর রাজার ষাট হাজার পুত্র ঘোড়া খুঁজতে গিয়ে সেটিকে কপিল মুনির আশ্রমে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পান ।সাগর রাজার ছেলেরা কলিপ ঋষিকে ভুল বুঝে এই কাজের জন্য অপমান করলে, ঋষি তাদের শাপ দিয়ে ভস্মে পরিণত করেন। অতঃপর সাগর তার নাতি অংশুমানকে অযোধ্যার উত্তরাধিকারী করে যান।[২৯] সাগরের শাসনের অবসানের সাথে সাথে সত্য যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ত্রেতা যুগ

অংশুমানের পৌত্র, রাজা সাগরের প্রপৌত্র — ভগীরথ, গঙ্গা নদীকে মর্ত্যে এনেছিলেন যাতে তার পূর্বপুরুষ গণ তথা সাগরের পুত্রদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় ও তারা স্বর্গে যেতে পারে।[৩০] পরবর্তী খ্যাতিমান রাজা ছিলেন ঋতুপর্ণ, তিনি নিষদ রাজ নলের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে তার খ্যাতি আরও বৃদ্ধি করেছিলেন। বিদর্ভের যাদব রাজ ভীমের কন্যা দময়ন্তির সাথে নলের বিবাহ হয়। দময়ন্তি ও নলের বিবাহের মজার কাহিনী তৎপরবর্তীতে দ্যূত ক্রীড়ায় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে যান। পাণ্ডবরা যখন কাম্যক বনে ছিলেন তখন মহর্ষি বৃহদশ্ব যুধিষ্ঠিরকে নল-দময়ন্তীর এই উপাখ্যান বলেছিলেন।[৩১]

ভগীরথের পাশাপাশি সময়ে দুষ্মন্ত পৌরব বংশের পুনরুত্থান ঘটান। দুষ্মন্ত বিশ্বামিত্রের কন্যা শকুন্তলা কে বিয়ে করেন। দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা ভরত নামের এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।[৩২] ভরত চক্রবর্তী উপাধী ধারণ করেন ও তার নামেই বংশের নামকরন করেন। তার উত্তর পুরুষদের মধ্যে হস্তী হলেন পঞ্চম। তিনি উচ্চ দোয়াবে রাজধানী স্থানান্তর করে তার নামানুসারে হস্তীনাপুর রাখেন। কয়েক পুরুষ পরে ভরত বংশীয়রাই বিখ্যাত ভ্রাতৃহত্যার যুদ্ধ - কুরুক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। যেখানে কৌরব, পাণ্ডব ও ভরতবংশের মধ্যে যুদ্ধ হয়।[৩৩]

হস্তীর অব্যবহিত পরেই ভরত বংশ চারটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কৌরব ও পাঞ্চাল দুটি উল্লেখযোগ্য় বংশ। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে যে পাঞ্চাল নরেশ দিবদাস, দস্যু সম্বরের ৯৯ টি দুর্গ ধ্বংস করেন।[৩৪] গৌতম মুণির স্ত্রী অহল্যা তার বোন। ইন্দ্র অহল্যাকে প্ররোচিত করেন ও নিজ কাম বাসনা চরিতার্থ করেন। এতে গৌতম ক্ষিপ্ত হয়ে অহল্যা কে শাপ দিয়ে পাথরে পরিণত করে বনে ফেলে যান।[৩৫]

সুর্য বংশের আরেকবার উত্থান ঘটে রঘু, অজো ও দশরথের মত প্রজাবৎসল নৃপতিদের সময়ে।[৩৬] বাল্মীকির রামায়ণে দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম ও তার স্ত্রী সীতার কাহিনী বর্ণীত হয়েছে। রামের সৎমাতা কৈকেয়ির ষড়যন্ত্রের কারণে রাম, সীতা ও অনুজ লক্ষ্মণের বনবাস হয়। বনের মধ্যে সীতাকে রাক্ষস রাজ রাবণ হরণ করেন, লঙ্কায় নিজের প্রাসাদে বন্দী করে রাখেন। রামচন্দ্র বনের বানর ও ভল্লুকদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করে লঙ্কা অবরোধ করেন। লঙ্কার যুদ্ধে রাবণ রামের কাছে পরাজিত হলে রাম তাকে হত্যা করেন। সীতাকে উদ্ধার করে তিনি অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

শ্রী রাম চন্দ্রের তিরভাবের সাথে সাথে ত্রেতা যুগের অবসান হয় ও দ্বাপর যুগের শুরু হয়। রাম চন্দ্রের পর সূর্য বংশের স্থায়ী পতন ঘটে।

দ্বাপর যুগ

ভিমের রাজত্বের পর যদু বংশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সতবতের দুই পুত্র অন্ধক ও বৃষ্ণি নিজ নিজ নামে রাজ্য পরিচালনা করেন। কংসের পিতা উগ্রসেন ছিলেন অন্ধক বংশীয়। অপরদিকে কৃষ্ণের পিতা বাসুদেব ছিলেন বৃষ্ণি বংশীয়।

পাঞ্চাল ভরত বংশীয় রাজা শ্রঞ্জয় এ সময় খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। তার পুত্র চ্যবন ও পিজবন ছিলেন বীর যোদ্ধা। পিজবনের পুত্র সুদাস। তিনিও কিছু রাজ্য জয় করে সুদাস বংশের পত্তন করেন। কুরু, যাদব, শিবি, দ্রুহ্য, মৎস্য তুর্বসু ও অন্যান্যরা মিলে এক ফেডারেল রাজ্য স্থাপন করে। কেননা সুদা রাজ তাদের সবাইকে পরুশ্নি নদীর তীরে এক বিশাল যুদ্ধে পরাজিত করে। এ যুদ্ধকে বলা হয় দশ রাজার যুদ্ধ[৩৭] ঋগ্বেদের অনেকগুলো শ্লোকে এ বংশের ৫-৬ পুরুষ পর্যন্ত রাজাদের ও তাদের সমসাময়িক কবিদের সম্পর্কে বলা আছে।[৩৮]

হস্তীর পুত্র অজমীঢ় কুরু/কৌরব বংশ অব্যহত রাখেন। পাঞ্চালরা এ বংশের সংবরণ রাজাকে সিন্ধু নদের তীরে এক যুদ্ধে পরাজিত করে তাকে বনবাসে পাঠান। পারগিটার এই পাঞ্চাল নরেশকে সুদাস বংশীয় বলে উল্লীখ করেন, কিন্তু তার সাথে এ বংশের কি সম্পর্ক বা তার বংশ পরিচয়ের কোন উল্লেখ করেননি। পরে সংবরণ পাঞ্চালদের কাছ থেকে তার রাজ্য উদ্ধার করেন। ও সূর্য কন্যা তপতীকে বিয়ে করেন।[৩৯] নাট্যকার কুলশেখর(খ্রিঃ ৯০০) এ কাহিনীকে তার তপতি-সংবরণ নাটকে অমর করে রেখেছেন। তপতী ও সংবরণের পুত্র কুরু। কুরুর বংশধরগণ কৌরব নামে পরিচিত। তারপর কুরুর দ্বিতীয় পুত্র জহ্নু ক্ষমতায় বসেন।

কুরু বংশীয় বসু, যদু বংশের চেদী রাজ্য জয় করে সেখানে শাসন করতে থাকেন। তার জ্যেষ্ঠপুত্র বৃহদ্রথ মগধের রাজগিরিতে রাজধানী স্থাপন করেন। বৃহদ্রথের পুত্র জরাসন্ধ তার ক্ষমতা উত্তরে মথুরা ও দক্ষিণে বিদর্ভ পর্যন্ত বিস্তার করতে সক্ষম হন। উল্লেখ যে মথুরার অন্ধক রাজ কংশ তার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। কংস ছিল অত্যাচারী শাসক। সে তার পিতা উগ্রসেন কে বন্দী করে ক্ষমতা দখল করে। কংসের ভাগ্নে শ্রী কৃষ্ণ। তিনি কংসকে বধ করে উগ্রসেনকে মুক্ত করে হৃত সিংহাসন ফিরিয়ে দেন। এতে জরাসন্ধ ক্ষিপ্ত হয়ে মথুরা আক্রমণ করেন। কৃষ্ণ তখন অন্ধক ও বৃষ্ণিদের সাথে পশ্চিম দিকে সৌরাষ্ট্রের দ্বারকায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। এর পর কৃষ্ণ বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিনীকে হরণ করতে গিয়ে রুক্মিনীর ভ্রাতাকে পরাজিত করেন ও রুক্মিনীকে বিয়ে করেন।[৪০] পরবর্তী জীবনে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের মিত্রে পরিণত হন। (নিচে দেখুন।)

পরবর্তী বিখ্যাত কৌরব রাজা হলেন প্রতীপ। তার পুত্র শান্তনু । প্রতীপের জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবপি, সিংহাসনে বসলে বারো বছর রাজ্যে কোন বৃষ্টিপাত হয় না। এতে দেবপি তার অনুজ শান্তনুকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে প্রধান ধর্ম গুরুর ভূমিকা পালন করে যজ্ঞ করতে থাকেন। ফলে অচিরেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়।[৪১]

ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু ছিলেন শান্তুনুর পৌত্র । ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠ হলেও অন্ধ হওয়ার কারণে রাজ্য শাসনের অযোগ্য হন। ফলে পাণ্ডু সিংহাসনে বসেন। ধৃতরাষ্ট্রের অনেক পুত্র সন্তান ছিল, জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন। অপরদিকে পাণ্ডুর ছিল পাঁচ পুত্র যথা- যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুলসহদেব। ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু জ্যেষ্ঠ তাই তার পুত্ররা কৌরব বংশের ধরা হয়। আর পাণ্ডুর পুত্রদের পাণ্ডব বলা হয়। কুরু সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী কে, এ প্রশ্নে দুই পরিবারের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়। শান্তিপূর্ণ কোন সমাধান না হওয়ায় এ দুই পরিবার এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বলা হয় যে ভারতের সকল ক্ষত্রিয় রাজারা কোন না কোন এক পক্ষের হয়ে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আঠারো দিন ব্যাপী এ যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাণ্ডবরা অনেক চাপের মধ্যে থাকলেও শ্রী কৃষ্ণের চালাকিতে তারা জয়ী হয়। মহাভারতে-এ যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা আছে।

উত্তরকালে যাদবরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, কৃষ্ণ ও নিজেকে ধ্যানে মগ্ন রাখেন। দৈবক্রমে এক শিকারির বাণ এসে কৃষ্ণকে বিদ্ধ করে ও তিনি মারা যান।[৪২] পাণ্ডবরা কৃষ্ণের পৌত্রকে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্যভার দেন। শীঘ্রই পাণ্ডবরা ও অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিতকে হস্তীনাপুরের উত্তরাধিকারী করে নিজেরা বানপ্রস্থে গমন করেন। শ্রী কৃষ্ণের মৃত্যুর সাথে সাথে দ্বাপর যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে।

কলি যুগ

পরীক্ষিত মৃগয়ায় ঋষি শমীককে অপমান করেন। এতে ঋষি শমিকের পুত্র শৃঙ্গী, পরীক্ষিত কে তক্ষকের দংশনে মৃত্যুর অভিশাপ দেন। অভিশাপের সপ্তম দিনে পরীক্ষিতকে তক্ষক দংশন করে। তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি কেননা তক্ষকের বিষহরি মন্ত্র তেমন কেউ জানত না।[৪৩] কেবল জানত কশ্যপ। আর কশ্যপ ও তাদের আয়ত্তের বাইরে ছিল। পরীক্ষিতের পুত্র জনমজেয় তখন খুব ছোট ছিলেন। বড় হয়ে মন্ত্রীদের কাছে যখন তার পিতার মৃত্যুর বিবরণ শুনলেন, তখন তিনি সকল সর্পকে হত্যা করার জন্য সর্পসত্র যজ্ঞ করার প্রতিজ্ঞা করলেন। সর্পসত্র যজ্ঞ শুরু হলে সকল সর্প যজ্ঞের অগ্নিতে ভস্মীভূত হতে লাগল।[৪৪] তখন নাগরাজ বাসুকি তার ভগিনী মনসা ও মনসার স্বামী জরৎকারুর সাহায্য চাইলেন। জরৎকারুর নির্দেশে তার পুত্র মহাত্মা আস্তীক[৪৫](যে তার মায়ের দিক থেকে ছিল অর্ধ সর্প) জনমেজয়ের কাছে গিয়ে তার প্রীতি উৎপাদন করে সর্পসত্র যজ্ঞ বন্ধ করান।[৪৬] সর্প যজ্ঞ চলার সময় জনমেজয়ে বৈসাম্পায়ন কাছ থেকে মহাভারতের কাহিনী শোনেন। বৈশম্পায়ন ছিলে ব্যাসদেবের শিষ্য।[৪৭]

পরীক্ষিতের ষষ্ঠ বংশধর নিচাক্ষু হস্তীনাপুরের রাজধানীকে ব্যস্ত নগরের কৌসম্বি তে স্থানান্তর করেন। পূর্বে এ নগরীটি গঙ্গা নদীর এক বন্যায় ধ্বংস হয়েছিল।[৪৮] উদ্যয়ন পর্যন্ত এ বংশের অনেকে শাসন করেন। উদ্যয়ন ছিলেন বৎসের রাজা, যিনি বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন। অবন্তির যুবরাজ বাসবদত্ত পরে এ সাম্রাজ্য জয় করে নেন। বাসবদত্তের এ বিজয় আখ্যান বর্ণনা করেন গুনধ্য। পরে ভাষা ও শুদ্রক যথাক্রমে স্বপ্নবাসবদত্তবিনাশবাসবদত্ত নাটকে বর্ণনা করেন।

মগধে বৃহদ্রথ ও জরাসন্ধের বংশধরেরা শাসন করতে থাকেন। পরে শিশুনাগ সাম্রাজ্যের কাছে তারা ও পরাজিত হয়। শিশু নাগ সাম্রাজ্যের বিখ্যাত রাজাদের মধ্যে আছেন- বিম্বিসারঅজাতশত্রুমহাপদ্ম নন্দ শিশুনাগ সাম্রাজ্যের সর্বশেষ রাজাকে পরাজিত করেন। তিনি সকল ক্ষত্রিয় বংশকেই তথা ইক্ষ্বাকু, পাঞ্চাল, কাশি, হৈহয়, বিতিহোত্র, কলিঙ্গ, অসংকা, কুরু, মৈথিলী, সুরসেনা সহ সবাই কে উৎখাত করে কেন্দ্রীয় ভারতকে হস্তগত করেন। পুরাণে তাই তাকে সকল ক্ষত্রিয় সংহার কারকসমগ্র পৃথিবী তাঁর একক শসনাধীন থাকায় সার্বভৌম শাসক হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।[৪৯]

মহাভারত অনুসারে কল্কি অবতারের আগমনে কলি যুগের সমাপ্তি ঘটবে ও আবার সত্য যুগ আরম্ভ হবে।[৫০]

উপসংহার

যশ-খ্যাতির ক্ষণস্থায়ীত্ব বিবেচনা করে কবিগণ, রাজা ও ঋষিদের এই সুবিস্তৃত ইতিহাস কে কটাক্ষ করে সমাপ্ত করতে চেয়েছে:[৫১]

জৈন ঐতিহ্য

জৈনদের নিজস্ব ধর্মীয় ইতিহাস আছে, এ ধর্মের ২৪ জন তীর্থঙ্কর সময়ে সময়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে তাদের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে তাদের কর্তব্য কর্ম করা শিখিয়েছেন। রাম, জৈনরা যাঁকে পদ্ম হিসাবে চেনে তিনি পৃথিবীতে একজন স্বর্গীয় বীর হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ ধর্মে আছেন নয়জন বাসুদেব ও নয়জন বলদেব/বলরাম, এঁনারাও এক একজন বীর, প্রত্যেক বাসুদেব-বলদেবের প্রতিপক্ষ হিসাবে মোট নয়জন প্রতিবাসুদেব আছেন। মহাভারতের কৃষ্ণ ও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জৈনধর্মের বাসুদেব ও বলদেব। প্রতিবাসুদেব হিসাবে অন্যানদের সাথে আছেন রাবণজরাসন্ধভরতসাগর সহ আছেন ১২ জন বিশ্বাধিপতি চক্রবর্তী সম্রাট । ২৪ জন তীর্থঙ্কর, ৯ জন বাসুদেব, ৯ জন বলরাম, ৯ জন প্রতি বাসুদেব ও ১২ জন চক্রবর্তী সম্রাট কে একত্রে ৬৩ শাল্কো পুরুষ (গ্রেট মেন) বলা হয় । ব্রহ্মদেব/ব্রহ্মদত্তকে যেমন বৌদ্ধ ধর্মে পাওয়া যায়, জৈনধর্মে তার উপস্থিতি আছে। প্রাচীন ধর্মীয় উৎসগুলোতে ব্রাহ্মণদের থেকে জৈনদেরও আংশিক স্বতন্ত্রতা আছে বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা তাদের উপকথা বা কিংবদন্তীগুলো অপরাপর ধর্মের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বিধিবদ্ধ ও সুবিন্যাস্ত।

তেষট্টি জন শাল্কো পুরুষ

তীর্থঙ্করচক্রবর্তীবলদেব/বাসুদেব/প্রতিবাসুদেব
ঋষভনাথ(আদিনাথ)
অজিতনাথ
সম্ভবনাথ
অভিনন্দননাথ
সুমতিনাথ
পদ্মপ্রভ
সুপার্শ্বনাথ
চন্দ্রপ্রভ
পুষ্পদন্ত
শীতলনাথবিজয়/ত্রিপ্রস্থ/অশ্বগ্রীবা
শ্রেয়াংশনাথঅচলা/দ্বিপ্রস্থ/তারকা
বসুপূজ্যধর্ম/স্বয়ম্ভু/মধু
বিমলনাথশুপ্রভ/পুরুষোত্তম/মধুসূদন
অনন্তনাথ
ধর্মনাথ
মাঘবানসুদর্শন/পুরুষাসিম/মধুকৃদা
সনতকুমার
শান্তিনাথশান্তিনাথ
কুন্ঠুনাথকুন্ঠুনাথ
অরনাথঅরনাথ
নন্দীসেন/পুন্দারিকা/নিসুম্বা
শুভম
নন্দী মিত্র/দত্ত/বালি
মাল্লীনাথ
রাম (পদ্ম)/লক্ষ্মণ/রাবণ
মুনিসুব্রতপদ্ম
নমিনাথহরিসেন
জয়সেন
নেমিনাথবলরাম/কৃষ্ণ/জরাসন্ধ
ব্রহ্মদত্ত
পার্শ্বনাথ
মহাবীর

বৌদ্ধ ঐতিহ্য

বৌদ্ধদেরও স্বতন্ত ধর্মীয় ইতিহাস আছে। এ ধর্মমতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চক্রের শুরুর দিকে মানবজাতি অবস্তুগত এক জগতে বাস করত, সেখানে তাদের খাদ্য-বস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না, প্রয়োজন ছিল না কোন ব্যক্তিগত সম্পদের। সেখানে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা এমনকি কোন আইনগত বিধিনিষেধ ও ছিল না। বিশ্ববহ্মণ্ড যখন ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে মানুষ তখন নিজেকে ক্ষিতিতে(পৃথিবীতে) আবদ্ধ করে ফেলে, ফলে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যেহেতু মানুষ তার আদি গৌরব হারিয়েফেলে তাই সমাজে উদ্ভব হয় বর্ণপ্রথার। ফলে মানুষ উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের পার্থক্য করে, নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সমঝতা করে। এ সমঝতার ভিত্তিতেই মানুষ ব্যক্তিগত সম্পদ, পরিবার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ধারণা লাভ করে। পারস্পারিক স্বার্থ সংঘাতে সমাজে শুরু হয় চৌর্যবৃত্তি, খুন, রাহাজানি ও ব্যভিচার। তাই মানুষ একত্রে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা নিজেদের মধ্য থেকে একজন কে বেছে নেবে যিনি শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন। বিনিময়ে তাকে উৎপাদিত ফসল ও গবাদিপশু থেকে কিয়দংশ দেওয়া হবে। এভাবে প্রথমে যাকে বেছে নেওয়া হয় তাকে বলা হয় মহাসামন্ত (উৎকৃষ্ট বাছাই)। তাকে রাজা অভিধা দেওয়া হয় কেননা তিনি প্রজাদের শান্তিবিধান করেন।[৫২] এভাবে নির্বাচিত ষোড়শ মহাসামন্ত ও প্রথম চক্রবর্তী মহারাজা মান্ধাতা। মান্ধাতার পূর্বপুরুষদের মধ্যে আছেন, শুদ্রসেন, সাগর, ভরত, রাম দশরথী। তবে উল্লেখ্য যে শেষোক্ত তিনজনকে ব্রাহ্মণ ও জৈন ধর্মে ও পাওয়া যায়।

এই ধারাবাহিকতার একজন রাজা- কর্ণিকা, তার দুই পুত্র গৌতম ও ভরদ্বাজ। রাজা কর্ণিকার মৃত্যুর পর ভরদ্বাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিছুদিন পর বিনা কারণেই তিনি মারা যান। অপরদিকে গৌতমের জমাটবাঁধা রক্ত ও বীর্যের দ্বারা গঠিত ডিম্বে সুর্যের তাপে দুই পুত্রের জন্ম হয়। তাদের একজন বিখ্যাত ইক্ষভাকু(পালি ভাষায়- অক্কাকা) যিনি ভরদ্বাজের স্থলাভিষিক্ত হন ও সুর্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।[৫৩]

ইক্ষভাকুর চার পুত্র ও চার কন্যা কে তাদের সৎ মাতার ষড়যন্ত্রের কারণে হিমালয়ের পাদদেশের পাহারে বনবাস দেওয়া হয়। সেখানে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নিজেদের মধ্যে এ বিবাহের কারণ তাদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা। পরবর্তীতে তারা সেখানে কপিলাবস্তু ও কলি নামে দুটি নগরের পত্তন করেন। তাদের বংশধরগণই ইতিহাসে শাক্য বংশ নামে পরিচিত।[৫৪] বিশ্বন্তর, ইক্ষভাকু তথা অক্কাকার কাছাকাছি সময়ের একজন যুবরাজ ছিলেন। পরবর্তীতে এ বংশেই জন্ম গ্রহণ করেন গৌতম বুদ্ধ

প্রকৃত ইতিহাস হিসাবে ইতিহাসের গুরুত্ব

ঐতিহাসিক ও বিভিন্ন কালানুক্রমিক প্রকৃত ঘটনার পরিবর্তে, ঘটনাগুলোকে শুধু তাদের স্থানান্তরে গমন ও বসতি স্থাপন হিসাবে নিয়ে যদি পৌরাণিক বংশবৃতান্ত বুঝতে চেষ্টা করি তাতে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদির(যেমন পেইন্টেড গ্রে ওয়্যার, অথবা চলকোলিথিক ব্লাক এন্ড রেড ওয়্যার) সাথে উল্লেখযোগ্য বংশগুলোর অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়। যা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন ইতিহাসবেত্তা রমিলা থাপর । তিনি চেষ্টা করেছেন, বিশেষ বিশেষ বংশগুলো যেমন পুরু ও যদু বংশের ঘটনাগুলোকে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্তরের সাথে মিলিয়ে নিতে। পারগিটারের মত তিনিও পুরু বংশকে তিনটি স্বতন্ত্র অংশে ভাগ করেছেন। অকার কালারড পয়েট্রি এর সাথে প্রথম অংশে মনু ও ভরতকে সংযুক্ত করেছেন। একটু বিরতি দিয়ে পেইন্টেড গ্রে ওয়্যার এর সাথে দ্বিতীয় অংশে ভরতের পালিত পুত্রের সাথে কুরুর সংযোগ ঘটিয়েছেন। তৃতীয় অংশ কুরু থেকে শুরু হয়ে মহাভারতের যুদ্ধের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটান। যাদবরা ব্লাক এন্ড রেড সংস্কৃতির, পুরাণ অনুসারে তাদের বিভিন্ন অংশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গমন তাদের ভৌগোলিক বিস্তৃতির প্রমাণ মেলে। যাহোক অধিক সতর্কতার সাথে ( কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতির সাথে যদু ও পুরু বংশের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা--- তাদের মাঝে সম্পর্কের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তা নিশ্চিত করে বলার মত যথেষ্ট নয়। ফলে তা অনুমান নির্ভরই থেকে যায়।) ধর্মীয় ঘটনাক্রম বনাম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অন্তর্দ্বন্দ্ব বিবেচনা করে ও ইন্দো-আর্য ভাষাভাষীদের কথা মাথায় রেখে ভরত পর্যন্ত প্রথম অংশকে ইন্দো-আর্য পূর্ব বংশ বলে ধরা হয় । পরে যা আর্য ভাষাভাষীদের মাঝে মিশে যায়।[৫৫]

ভারতীয় ধ্রুপদী কাব্যে প্রভাব

ভারতীয় ধ্রুপদী কাব্য সাহিত্য যেমন মহাকাব্য[৫৬][৫৭] (অলংকার সমৃদ্ধ), নাটক[৫৮] ইত্যাদির মূলবিষয় বস্তু হিসাবে ধর্মীয় ইতিহাসকে মাপকাঠি হিসাবে প্রাথমিক ভাবে নির্ধারন করেছে। সে অনুসারে ভাল ভাল মহাকব্য যেমন- কালিদাসের রঘুবংশ, কুমার দাসের জানকি হরণ, ভাট্টির রাবণবধ বা ভাট্টিকাব্য ইত্যাদির কাহিনি রামায়ণ থেকে নেওয়া হয়েছে। এবং ভারবের কীর্তার্জুন, মাঘের শিশুপালবধ ও শ্রীহর্ষের নৈষাদ্ধচরিত ইত্যাদি মহাভারত-এর কাহিনি অবলম্বনে রচিত।

আরও দেখুন

আরও পড়ুন

তথ্যসূত্র

মূল উৎস( সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত এবং তামিল)

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন