হিন্দু পুরাণ
হিন্দু পুরাণ হল হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত অজস্র ঐতিহ্যবাহী কথামালার একটি বৃহৎ রূপ, যা প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য (যেমন রামায়ণ ও মহাভারতের ন্যায়, প্রবিত্র গ্ৰন্থ অষ্টাদশ পুরাণ ও বেদ), প্রাচীন তামিল সাহিত্য (যেমন সংগম সাহিত্য ও পেরীয় পেরুনম্), ভাগবত পুরাণের (যাকে পঞ্চম বেদ আখ্যায় ভূষিত করা হয়) ন্যায় অন্যান্য হিন্দু রচনা এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সাহিত্যে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়াও এই হিন্দু পুরাণ ভারত ও নেপালের সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ। সুসংবদ্ধ এই কাহিনিগুলো এক সুবিশাল ঐতিহ্যের বাহক ও রক্ষক, যা বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন উপায়ে, বিভিন্ন মানুষ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বারা বিভিন্ন অঞ্চলে বিকাশপ্রাপ্ত হয়। এটি যে কেবল হিন্দু সাহিত্য ও ঘটনাবলির দ্বারা প্রভাবিত তা নয়, বরং এই কাহিনিগুলো বিশদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাজ-সংসারের নানা চিত্রকে প্রতীকী মাধ্যমে গভীর ও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।[১]
পুরাণ অর্থ পুরাতন বা প্রাচীন। পুরাণের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাচীনকালের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধার্মিক ও প্রাকৃতিক অবস্থা বর্ণনা করে মানুষের মন যেন ধর্মের পথে আকৃষ্ট হতে পারে তার জন্য গল্পের ছলে ধর্ম উপদেশ দেওয়া।
উৎস
বেদ
ধ্রুপদী হিন্দুধর্ম থেকে উদ্ভূত পৌরাণিক কাহিনির মূল হল ভারতের প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা ও তার সময়কাল। বেদ, বিশেষত ঋগ্বেদের অজস্র স্তোত্রে পরোক্ষ ভাবে নানা বিচিত্র কাহিনির উল্লিখিত হয়েছে।
বৈদিক চরিত্র, দর্শন এবং কাহিনিগুলো যে পৌরাণিক কথামালার সৃষ্টি করেছে, তা হিন্দু রীতিনীতি ও বিশ্বাসের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে রচিত ছান্দগ্যো উপনিষদে (৭।১।২) পুরাণের একটি প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ পুরাণকে "পঞ্চম বেদ" নামে অভিহিত করে,[২] (ইতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদম্)। এতে প্রাচীন যুগে পুরাণের ধর্মীয় গুরুত্বের কথা জানা যায়। সম্ভবত সেই যুগে পুরাণ মৌখিকভাবে প্রচারিত হত। অথর্ববেদেও (১১।৭।১৪) এই শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়।[৩][৪]
ইতিহাস ও পুরাণ
পরবর্তী বৈদিক যুগে সভ্যতার নানা উপাদানই সংস্কৃত মহাকাব্যগুলোতে সংরক্ষিত করা হয়েছে। স্বাভাবিক কথামালাগুলোর পাশাপাশি একাধিক খণ্ডে বিভক্ত মহাকাব্যগুলোও ভারতীয় সমাজ, সভ্যতা, দর্শন, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা ইত্যাদি সম্বন্ধীয় নানা তথ্যের ধারক হয়ে রয়েছে। রামায়ণ ও মহাভারত – এই দুটি হিন্দু মহাকাব্যই যথাক্রমে ভগবান্ বিষ্ণুর দুই অবতার – রাম ও কৃষ্ণের কাহিনি পরিবেশন করে। এই দুটি গ্রন্থই ‘ইতিহাস’ নামে পরিচিত। রামায়ণ ও মহাভারত উভয়কেই ধর্মের পথপ্রদর্শক এবং দর্শনতত্ত্ব ও নীতিকথার আধার হিসেবে গণ্য করা হয়। এই গ্রন্থ দুটি একাধিক অধ্যায়ে (কাণ্ড ও পর্ব) বিভক্ত এবং এতে অসংখ্য নীতিমূলক সংক্ষিপ্ত কাহিনি সংকলিত হয়েছে, যেখানে চরিত্রগুলো কাহিনির অন্তে হিন্দু নীতি ও আচরণবিধির সঠিক শিক্ষালাভ করে। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হল মহাভারতের ভগবদ্গীতা, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখা মহারথি অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক প্রাক্কালে ধর্মাচরণ ও জীবনকর্তব্যের বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এই গ্রন্থটি হিন্দু দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে ও হিন্দুধর্মের প্রধান উপদেশমূলক গ্রন্থ হিসেবে খ্যাত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহাভারত হল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কাব্যগ্রন্থ, এতে প্রায় এক লক্ষ শ্লোক রয়েছে।
মহাকাব্যগুলোর প্রতিটিই ভিন্ন যুগে বা সময়কালে বর্ণিত। মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ, যা রামের (ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার) জীবন ও সময়কাল বর্ণনা করে, তা ত্রেতা যুগে সংঘটিত হয়। মহাভারত বর্ণনা করে পাণ্ডব ও কৃষ্ণের (বিষ্ণুর অষ্টম অবতার) সময়কাল, এটি ঘটিত হয় দ্বাপর যুগে। সর্বসাকুল্যে যুগ রয়েছে ৪টি। সত্য বা কৃত যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং কলি যুগ। অবতার-এর ধারণাটি পৌরাণিক যুগে উঠে এসেছিল, যা মহাকাব্যদ্বয়ের সাথে সরাসরি সম্বন্ধযুক্ত, তবুও অবতার প্রাক্-পৌরাণিক যুগের বলে বর্ণিত হয়েছে।
পুরাণের কাহিনিগুলো অনেক প্রাচীন এবং মূলত মহাকাব্যগুলোতে অনুপস্থিত (অথবা কদাচিৎ উপস্থিত)। এতে রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির কাহিনি, বিভিন্ন দেবদেবীর জীবন ও কীর্তিকলাপ, নায়ক-নায়িকা এবং পৌরাণিক জীবের (অসুর, দানব, দৈত্য, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, অপ্সরা, কিন্নর, কিংপুরুষ ইত্যাদি) কাহিনি। প্রাচীন রাজা, ভগবানের অবতার, পবিত্র তীর্থ ও নদীসমূহের সাথে সম্পর্কিত নানা ঐতিহ্যও এতে রয়েছে। ভাগবত পুরাণ হল সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় পুরাণ, ভগবান বিষ্ণু ও তাঁর মর্ত্যে অবতার গ্রহণের গল্প রয়েছে এই পুরাণে।
পুরাণে বংশবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ রাখার উপরেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বায়ু পুরাণ অনুসারে: "পুরাকালে ল দেবতা, ঋষি, গৌরবশালী রাজন্যবর্গের বংশবৃত্তান্ত ও মহামানবদের কিংবদন্তি লিপিবদ্ধ রাখার দায়িত্ব সূতের উপর অর্পিত হয়।"[৫] পৌরাণিক বংশবৃত্তান্ত অনুযায়ী মনু বৈবস্বত ভারত যুদ্ধের ৯৫ প্রজন্ম পূর্বে জীবিত ছিলেন।[৬]
পারগিটার (১৯২২) বলেছেন, "মূল পুরাণগুলো" ("original Purana") সম্ভবত বেদের সর্বশেষ লিখিত রূপের সমসাময়িক।[৩] এবং পারগিটার (১৯৭৯) মনে করেন,[৭][৮] বায়ু পুরাণে যে যুগগুলো ৪৮০০, ৩৬০০, ২৪০০ ও ১২০০ বছরে বিভক্ত হয়েছে তার মধ্যে পৌরাণিক কৃত যুগ " সমাপ্তি রাম জমদগ্ন্যের দ্বারা হৈহয়দের ধ্বংসপ্রাপ্তিতে; ত্রেতা যুগের সূত্রপাত রাজা সগরের সময়কালে এবং সমাপ্তি রাম দাশরথি কর্তৃক রাক্ষস ধ্বংসে; দ্বাপর যুগের সূত্রপাত অযোধ্যা-প্রত্যাবর্তনে এবং সমাপ্তি ভারতযুদ্ধে।"[৯]
আরিয়ান রচিত ইন্ডিকায়, মেগাস্থিনিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে ভারতীয়রা শিব (ডায়োনিসাস) থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (সান্ড্রাকোটাস) পর্যন্ত "ছয় হাজার তেতাল্লিশ বছরে একশো তিপান্ন জন রাজা" গণনা করে।[১০] খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে রচিত বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৪।৬) গুরু-পরম্পরায় ৫৭টি যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ গুরু-পরম্পরা তারও ১৪০০ বছর আগে থেকে প্রচলিত ছিল। যদিও এই তালিকার যথার্থতা নিয়ে মতদ্বৈধ রয়েছে।[১১] কহ্লন রচিত রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে বর্ণিত রাজাবলিতে খ্রিস্টপূর্ব ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজাদের তালিকা পাওয়া যায়।[১২]
পুরাণ গ্রন্থসমুচ্চয় এমন এক জটিল উপাদান-সংগ্রহ যাতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী সম্প্রদায়ের উদ্ভবতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে।[১৩] তাই গেভিন ফ্লাড ঐতিহাসিকভাবে লিখিত পুরাণের উদ্ভবের সঙ্গে গুপ্তযুগে নির্দিষ্ট দেবতাকেন্দ্রিক ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভবের ঘটনাকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত মনে করেছেন:
যদিও এই গ্রন্থগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এদের একটিতে অপরটির উপাদান প্রায়শই গৃহীত হয়েছে, তবুও বলতে হয়, প্রতিটি গ্রন্থেই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে জগতকে দেখা হয়েছে। এগুলোকে প্রচলিত উপকথার এলোপাথাড়ি সংকলন মনে করা উচিত নয়। এগুলো সুসংকলিত, বিষয়গতভাবে সুসংবদ্ধ, বিশ্বচেতনার অভিপ্রকাশ এবং ধর্মীয় তত্ত্বকথা। ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নির্দিষ্ট দর্শনকে তুলে ধরার জন্য এগুলো সংকলন করেছিলেন; কেবল কেউ বিষ্ণু, কেউ শিব, কেউ বা দেবী বা অন্য কোনো দেবতার উপর আলোকপাত করেন।
স্থানীয় ভাষার অনুবাদে পুরাণগুলো সহজলভ্য। কথক নামে পরিচিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে কথকতার মাধ্যমে ভক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণের কাহিনিগুলো জনসমাজে প্রচার করে সাধারণ্যে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেন।
পুরাণের লক্ষণ
মৎস্য, বরাহ পুরাণ অনুসারে,[১৪] পুরাণের মূল বিষয় পাঁচটি: সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত। এগুলো পঞ্চলক্ষণ নামে পরিচিত। কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে পঞ্চলক্ষণ নামে পরিচিত এই বিশেষ লক্ষণগুলো অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও দৃষ্ট হয়।[১৫] কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবত অনুসারে পুরাণের মূল বিষয় দশটি। যথা:-
- সর্গ – ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকাহিনি।
- বিসর্গ বা প্রতিসর্গ – চরাচরের সৃষ্টিকাহিনি বর্ণনা।
- বৃত্তি – মানুষের জীবনোপায়ের বিধি নির্দিষ্ট হওয়া।
- রক্ষা – দৈত্যদের উপদ্রপ হতে রক্ষার জন্য নারায়ণের অবতার রূপে গ্রহণ করা।
- বংশ – দেবতা ও ঋষিদের বংশবৃত্তান্ত বর্ণনা।
- অন্তর বা মন্বন্তর – মানবজাতির সৃষ্টি ও প্রথম সৃষ্ট মানবজাতির কাহিনি।
- বংশানুচরিত – রাজবংশের ইতিহাস বর্ণনা।
- সংস্থা – প্রলয় বর্ণনা।
- হেতু – বিশ্বে জীবের বন্ধন হওয়ার কারণ বর্ণনা।
- অপাশ্রয় – ব্রহ্মের সাথে জীবের সম্পর্ক বর্ণনা।
সর্গ – ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকাহীনি
ঋগ্বেদে বিশ্বজগত সৃষ্টি সম্পর্কে বহু তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত অনুযায়ী, সৃষ্টির প্রকাশ হয়েছিল হিরণ্যগর্ভ নামক এক মহাজাগতিক অণ্ড তথা ডিম থেকে।[১৬] এ সূক্তে বর্ণনা করা হয়েছে, পুরুষের বিরাট নামক বিশ্বরূপ হল সৃষ্টির উৎস। বিরাটের মধ্যে সর্বব্যাপী জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে এবং বিরাট থেকে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। শেষের দিকের শ্লোকগুলোতে বলা হয়েছে, পুরুষ নিজেকে আহুতি দিয়ে পক্ষী, বন্য ও গবাদি পশু, তিন বেদ, মন্ত্রের ছন্দ সৃষ্টি করেন। তার মুখ, বাহু, জঙ্ঘা ও পা থেকে চার বর্ণের জন্ম হয়। পুরুষের মন থেকে চন্দ্র ও চোখ থেকে সূর্যের জন্ম হয়।[১৭] তার মুখ ও নিঃশ্বাস থেকে ইন্দ্র ও অগ্নির জন্ম হয়। তার নাভি থেকে আকাশ, মাথা থেকে স্বর্গ, পা থেকে পৃথিবী ও কান থেকে অন্তরীক্ষের জন্ম হয়।[১৮] এই সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষ, জাগতিক ও মহাজাগতিক সকল সত্ত্বার মধ্যে একত্ব স্থাপিত হয়। কারণ, সবই সেই একক সত্ত্বা পুরুষের অংশসম্ভূত।[১৯] পুরুষসূক্তে আরো বলা হয়েছে, পুরুষের কৃত যজ্ঞের মাধ্যমে এবং যজ্ঞ থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই আদি যজ্ঞ থেকেই যাবতীয় সৃষ্টি রূপ ধারণ করেছে। সপ্তদশ শ্লোকে বলা হয়েছে যে, এই আদি যজ্ঞ থেকেই যজ্ঞের ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। শেষ শ্লোকগুলোতে সকল সৃষ্টির আদিশক্তি রূপে যজ্ঞের গৌরব ঘোষিত হয়েছে।[২০] নাসদীয় সূক্তও বিশ্বতত্ত্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির ধারণার সঙ্গে জড়িত।[২১] বিশ্বসৃষ্টির বিষয়ে সূক্তটি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দার্শনিক মহলে প্রসিদ্ধ।[২২] ঋগ্বেদেের নাসদীয় সূক্তে সৃষ্টিতত্ত্ব সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[২৩][২৪][২৫][২৬] বিভিন্ন পুরাণেও বিশ্বজগত ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনার পাশাপাশি অসংখ্য মহাবিশ্বের ধারণা উল্লেখ করা হয়েছে।[২৭][২৮][২৯][৩০][৩১][৩২][৩৩][৩৪] এছাড়াও শতপথ ব্রাহ্মণে, মনুসংহিতায়, ঐতয়ের উপনিষদে, সাংখ্য-দর্শনেও বিশ্বজগত ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে।[৩৫][৩৬][৩৭][৩৮][৩৯]
প্রতিসর্গ – পরবর্তীকালের (মুখ্যত প্রলয় পরবর্তী) সৃষ্টিকাহিনি
হিন্দুধর্মে চোদ্দটি লোক বা জগতের কথা বলা হয়েছে – ৭টি ঊর্ধ্বলোক এবং ৭টি নিম্নলোক (পৃথিবী রয়েছে ঊর্ধ্বলোকগুলোর সবচেয়ে নিচে)। ঊর্ধ্বলোকগুলো হল – ভূ (ভূমি), ভূবঃ (বায়ু), স্ব (স্বর্গ), মহঃ, জন, তপ ও সত্য। সত্যলোকে ব্রহ্মার বাস, মহঃ লোকে ঋষিগণের বাস এবং স্বর্গে বাস দেবতাদের। নিম্নলোকগুলো হল – অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল ও পাতাল[৪০]।
প্রতিটি লোকই হল (পৃথিবী বাদে) মৃত্যুর পর আত্মার অস্থায়ী বাসস্থান। পৃথিবীতে জীবের মৃত্যুর পর ধর্মরাজ যম জীবের সমস্ত পাপ-পুণ্যের বিচার করে তাকে ঊর্ধ্ব কিংবা নিম্নলোকে পাঠান। ধর্মের কিছু শাখায় বলা আছে, পাপ ও পুণ্য পরস্পরকে প্রশমিত করতে পারে, তাই পরবর্তী জন্ম স্বর্গ বা পাতালে হতেই পারে। আবার কোথাও বলা হয়েছে, পাপ ও পুণ্য একে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে না। এই ক্ষেত্রে আত্মা উপযুক্ত লোকটিতে জন্ম নেয়। তারপর ওই লোকে আত্মার জীবনকাল শেষ হলে তা পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে (পৃথিবীর কোনো এক জীব রূপে জন্ম নেয়)। বলা হয়, একমাত্র পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই আত্মার মোক্ষলাভ বা পরমধামে যাত্রা হতে পারে, যে স্থান জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত, যেখানে রয়েছে স্বর্গীয় পরমানন্দ।[৪১][৪২]
মন্বন্তর – মানবজাতির সৃষ্টি ও প্রথম সৃষ্ট মানবজাতির কাহিনি
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, মহাজগৎ অনন্তকাল ধরে সময়চক্রে গতিশীল। এই চক্রের প্রারম্ভিক বিভাগটি হল কল্প বা "ব্রহ্মার এক দিন", যা ৪৩২ কোটি বছরের সমান। ব্রহ্মার এক রাতের পরিসরও একই। এমন ৩৬০ ব্রাহ্ম দিন-রাত বা অহোরাত্র মিলে তৈরী হয় এক ব্রাহ্ম বৎসর যার পরিমাণ ৩,১১০,৪০ কোটি মানব বছর বা সৌর বছর, যেখানে ব্রহ্মার জীবনকাল ১০০ ব্রাহ্ম-বৎসর, একে এক পরযুগ বলা হয়।[৪৩] অর্থাৎ সর্ববৃহৎ সময়চক্রটি ৩১,১০৪,০০০ কোটি মানব বছর বা সৌর বছরের সমান। এই সময়কাল অতিবাহিত হলে গোটা ব্রহ্মাণ্ড পরমাত্মা বা পরমব্রহ্মে বিলীন হয়, যতক্ষণ না নতুন সৃষ্টির উদ্ভব ঘটে। প্রতি ব্রাহ্ম দিনে ব্রহ্মা মহাজগৎ সৃষ্টি করেন এবং ব্রাহ্ম রাত্রে এটিকে ধ্বংস করেন। প্রতি ব্রাহ্ম রাতে নিদ্রিত ব্রহ্মার শরীরে সমাহিত হয় ব্রহ্মাণ্ড। প্রতিটি কল্প ১৪ উপকল্প বা মন্বন্তর (মনু+অন্তর) এবং এক সত্য যুগ পরিমাণ সময়ে বিভক্ত, যার প্রতিটির পরিসর ৩০,৮৪,৪৮,০০০ বছর। দুটি মন্বন্তরের মাঝে এক বিরাট শূন্যস্থান থাকে। এই সময় বিশ্বে পুনর্জন্ম হয় এবং এক নতুন মনুর উদ্ভব হয়, যিনি মনুষ্যজাতির জনক ও রক্ষক। বর্তমানে আমরা এই কল্পের সপ্তম মন্বন্তরে রয়েছি, বর্তমান মনুর নাম বৈবস্বত মনু। প্রত্যেকটি মন্বন্তর আবার ৭১ মহাযুগ বা চতুর্যুগ এবং এক সত্য যুগ সমন্বিত। ১০০০ মহাযুগে এক কল্প। প্রতিটি মহাযুগ ৪ যুগ নিয়ে গঠিত–সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। এদের সময়কাল যথাক্রমে ৪৮০০, ৩৬০০, ২৪০০ ও ১২০০ দৈব বৎসর।[৪৪][৪৫][৪৬][৪৭][৪৮][৪৯][৫০][৫১][৫২][৫৩][৫৪]
বংশ – দেবতা ও ঋষিদের বংশবৃত্তান্ত
- ক্লে সংস্কৃত গ্রন্থাগারটি ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ জুলাই ২০১৯ তারিখে মহাভারত এবং রামায়ণ সহ শাস্ত্রীয় ভারতীয় সাহিত্য প্রকাশ করে, যার মুখোমুখি পৃষ্ঠা পাঠ্য এবং অনুবাদ রয়েছে।এছাড়াও অনুসন্ধানযোগ্য কর্পাস এবং ডাউনলোডযোগ্য উপকরণ সরবরাহ করে।
- সংস্কৃত নথি সংগ্রহ : উপনিষদ, স্টোত্রাস ইত্যাদির আইটিএক্স বিন্যাসে নথি
শিব
শিব হলেন হিন্দু দের প্রধান দেবতা যিনি পরমাত্মা রূপেও প্রকাশক। পশুপাত, শৈব সিদ্ধান্ত এবং অন্যান্য গ্রন্থানুযায়ী, শিব ব্রহ্মের সমান। শিব নির্গুণ এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মূলধারার বাইরের উপাসকদের আরাধ্য। শিব তন্ত্র সাধনা সৃষ্টি করেন।
দেবী
দেবী হলেন দেবতারও আরাধ্য ঈশ্বরের রূপ যা স্ত্রীরুপে কল্পিত। নির্গুণ ব্রহ্মের চালিকা শক্তি ক দেবীরুপে ভাবা হয়। বস্তুত ব্রহ্ম ও শক্তি এক ও অভেদ।
অন্যান্য দেবদেবী
হিন্দু ধর্মে বিষ্ণু, শিব ও দুর্গা ছাড়াও অন্যান্য অনেক দেবতাও পূজিত হন। বলা হয়, হিন্দু ধর্মে তেত্রিশ রকমের দেবতা রয়েছেন। ব্রহ্মার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় পরবর্তী বৈদিক যুগের আরণ্যক ও উপনিষদে। বেদে তিনিই ছিলেন প্রজাপতি, পরে তাকেই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মায় রূপান্তরিত করা হয়। তাঁর সমস্ত সৃষ্টিই বারংবার পুনরাবৃত্ত হয় বলে বিশ্বাস। ব্রহ্মাণ্ডের চিরন্তন সত্তার মূল আধার হলেন বিষ্ণু, শিব অথবা শক্তি, কিন্তু ব্রহ্মা তার স্রষ্টা মাত্র (অথবা পুনঃস্রষ্টা)।
ঋগ্বেদের ৩৩ জন দেবতার নামোল্লেখ রয়েছে, যাঁদেরকে ‘ত্রিদশ’ (তেত্রিশ) বলা হয়। তাঁরা হলেন দ্বাদশ (১২) আদিত্য, অষ্ট (৮) বসু, একাদশ (১১) রুদ্র এবং অশ্বিনীদ্বয় (২)। দেবতাদের রাজা ‘ইন্দ্র’-কে শক্র বলা হয়, তিনি এই ৩৩ দেবতার সর্বপ্রথম জন। তাঁর পরেই রয়েছেন অগ্নি। এই দুই দেবভ্রাতার জোড়কে সাধারণত ইন্দ্র-অগ্নি, মিত্র-বরুণ ও সোম-রুদ্র বলা হয়।
নির্দিষ্ট দেবতারা কিছু বিশেষ চরিত্র ও চিহ্ন ধারণ করেন, যেমন – ইন্দ্র (দেবতাদের রাজা, যাঁর রাজধানী অমরাবতী, তাঁর হাতে থাকে বজ্র এবং তিনি বৃষ্টির দেবতা), বরুণ[৫৫] (জলের দেবতা), যম (মৃত্যুর দেবতা), কুবের (ঐশ্বর্য, অলংকার ও সম্পদের দেবতা বা রক্ষক), অগ্নি (আগুনের দেবতা), সূর্য (সূর্যের দেবতা), বায়ু (বাতাসের দেবতা) এবং চন্দ্র বা সোম (চাঁদের দেবতা)। ইন্দ্র, যম, বরুণ ও কুবেরকে ‘দিক্পাল’ বা লোকপাল বলা হয়, এরা চতুর্দিকের অধিপতি। শিব ও পার্বতীর দুই পুত্র – গণেশ ও কার্তিক। কার্তিক যুদ্ধের দেবতা তথা দেব-সেনাপতি এবং গণেশ সিদ্ধির দেবতা, যিনি সকল বিঘ্ন-বাধা নষ্ট করেন। মদন হলেন প্রেমের দেবতা, এঁকে শিব ভস্ম করেন এবং পুনর্জন্ম দেন।
দেবীদের মধ্যে, বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী, সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী। ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী হলেন বিদ্যা, কলা ও সংগীতের দেবী।
জীবজন্তু
এসব দেবদেবী ছাড়াও হিন্দু ধর্মে অসংখ্য অলৌকিক জীবজন্তুর কথা বলা হয়েছে, যারা পৃথিবীতেই বাস করে। ‘নাগ’-রা হল অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক সাপ, যারা প্রচুর ধনসম্পদের রক্ষক হিসেবে পাতালের ভোগবতী নগরে বাস করে। ‘যক্ষ’-রা হল এক ধরনের বামন আকৃতির জীব, যারা গ্রামের মানুষের পুজো পায় (কুবের একজন যক্ষ)। ‘গন্ধর্ব’ হল ইন্দ্রের সমস্ত সুদৃশ পুরুষ দাস এবং স্বর্গের গায়ক ও বাদক। এদের সহযোগীরা হল ‘কিন্নর’, এরা অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক ঘোড়া (গ্রিক পুরাণের ‘সেন্টর’দের সাথে মিল রয়েছে)। গন্ধর্বদের স্ত্রী সহকারীরা হল গান্ধর্বী। ‘অপ্সরা’ সমুদ্র মন্থন থেকে জাত। তারা চিরযৌবনা ও চিরকুমারী।। তারা অপরূপ সুন্দরী, লাস্যময়ী ও স্বাধীন, প্রধানত এরা ঘর তপস্যারত ঋষিদের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও ‘বিদ্যাধর’ নামে কিছু জীবের কথা রয়েছে, যারা স্বর্গের উড়ন্ত জাদুকর, এরা হিমালয় ও বিন্ধ্যের রহস্যময় নগরে বাস করে।
বৈদিক স্তোত্রের স্রষ্টা ও প্রাচীন কালের মহান প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা হলেন ঋষি। এই দলের প্রধানের হলেন ‘সপ্তর্ষি’ বা সাতজন ঋষি, যাঁরা সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাতটি তারা দ্বারা চিহ্নিত। এঁদের নাম – মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বশিষ্ঠ। অন্যান্য ঋষিরা হলেন ‘কশ্যপ’ ও ‘দক্ষ’, যাঁরা দেবতা ও মানুষের মিলনে জাত, ‘নারদ’, যিনি বীণার আবিষ্কর্তা এবং অন্যতম বৈষ্ণব (বিষ্ণুর ভক্ত), ‘বৃহস্পতি’ ও ‘শুক্র’, যাঁরা যথাক্রমে দেবতা আর অসুরদের গুরু, ‘অগস্ত্য’, যিনি দক্ষিণ ভারতে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রচার করেন। ‘পিতৃ’-রা হলেন পিতা বা পূর্বপুরুষের আত্মা, মৃত ব্যক্তিদের তর্পণের সাথে এরাই জড়িত।
অসুরেরা হল দুর্বৃত্ত বা অশুভ শক্তির অধিকারী জীব, যারা সর্বদাই ক্ষমতার লোভে দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করতে চায়, এরা কোনো কোনো সময় আলোড়ন তৈরী করলেও কক্ষনো জয়ী হয় না (অসুর কথার অর্থ ‘দেবতা নয় যে’)। অসুরদের মধ্যে রয়েছে কশ্যপ ঋষির স্ত্রী দিতির পুত্রগণ ‘দৈত্য’ আর দনুর পুত্রগণ ‘দানব’। অসুরদের নানা গোষ্ঠীও রয়েছে, যেমন – কালকেয় ও নিবাতকবচ। এদের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন – বৃত্র, হিরণ্যকশিপু, বলি ইত্যাদি। এই অসুরেরা বেশিরভাগই বিষ্ণু অথবা ইন্দ্রের হাতে নিহত হয়। ‘রাক্ষস’রা হল পুলস্ত্যের পুত্র, এদের প্রধান নায়ক হল রাবণ, যাকে বিষ্ণুর অবতার রাম বধ করেন। এছাড়াও আরও কিছু জীব রয়েছে, যেমন ‘পিশাচ’, যারা বিধ্বংসী যুদ্ধক্ষেত্রে ও শ্মশানে হানা দেয়। ‘ভূত’ ও ‘প্রেত’ হল নগ্ন অতৃপ্ত আত্মা, যাদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর পর আত্মার শান্তি বা শ্রাদ্ধ হয়নি।
যুদ্ধ
দেবাসুর সংগ্রাম
ত্রিভুবনের অধিকার নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে বারোটি বিধ্বংসী যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যথা – বরাহ, নৃসিংহ, তারকবধ, অন্ধকবধ, ত্রিপুর, সমুদ্র মন্থন, বামন, ধ্বজাপাত, আদিবক, কোলাহল, বৃত্রসংহার ও হলাহল। প্রথম যুদ্ধে বরাহ কারণ-সমুদ্রে হিরণ্যাক্ষকে বধ করে তার পাপ নিবারণ করেন। দ্বিতীয় যুদ্ধে নৃসিংহ হিরণ্যকশিপু নামে দৈত্যকে বধ করেন। তৃতীয় যুদ্ধে কার্তিক বজ্রাঙ্গের পুত্র তারকাসুরকে বধ করেন। হিরণ্যাক্ষের পালিত পুত্র অন্ধককে চতুর্থ যুদ্ধে হত্যা করেন বিষ্ণু। পঞ্চম যুদ্ধে তারকাসুরের তিন পুত্রকে দেবতারা হারাতে ব্যর্থ হলে শিব তাদের হত্যা করেন। সমুদ্র মন্থনে ইন্দ্র মহাবলিকে পরাস্ত করেন। বামন অবতারে বিষ্ণু ত্রিভুবনকে অধিকারে নিয়ে মহাবলিকে পাতালে বন্দি করেন। অষ্টম যুদ্ধে ইন্দ্র নিজে বিপ্রচিত্ত ও মায়ার দ্বারা অদৃশ্য তার অনুগামীদের বধ করেন। নবম যুদ্ধে ইক্ষ্বাকুর প্রপৌত্র কাকুষ্ঠের সহায়তায় ইন্দ্র আদিবককে বোধ করেন। কোলাহল যুদ্ধে শুক্রাচার্যের দুই অসুরপুত্রকে বোধ করেন শিব। একাদশ যুদ্ধে বিষ্ণুর মন্ত্রণায় ইন্দ্র দানবরাজ বৃত্রকে হত্যা করেন। দ্বাদশ যুদ্ধে অসুরদের হারাতে ইন্দ্রকে সাহায্য করেন নহুষের ভাই রাজি।
অস্ত্রশস্ত্র
হিন্দু পুরাণে তথা প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে কিছু অতিপ্রাকৃত অস্ত্রশস্ত্রের কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর এক-একটা এক বিশেষ দেবতা (যেমন ইন্দ্রের বজ্র) অথবা বিশেষ নায়কেরা ব্যবহার করতেন। এই অস্ত্রগুলো মানুষের ব্যবহৃত সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র থেকে (তরোয়াল, গদা, ঢাল, তির, ধনুক, ছুরি, বর্শা ইত্যাদি) থেকে অনেকটাই আলাদা। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানুষ কিংবা রাক্ষসেরা তাদের তপস্যাফল হিসেবে দেবতা নয়তো ঋষিদের কাছ থেকে দিব্যাস্ত্রগুলো উপহার পেয়েছে।
হিন্দুধর্মে দেবতাদের অনেক ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়, যেমন – আগ্নেয়াস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, গরুড়াস্ত্র, কৌমদকী, নারায়ণাস্ত্র, পশুপতাস্ত্র, শিবধনু, সুদর্শন চক্র, ত্রিশূল, বৈষ্ণবাস্ত্র, বরুণাস্ত্র ও বায়বাস্ত্র।
যদিও এদের কিছু অস্ত্রকে বর্ণনা অনুযায়ী সাধারণ অস্ত্রের সাথে তুলনা করা যায়, (যেমন – শিবধনু হল একটি ধনুক, সুদর্শন চক্র হল একটি চাকতি আর ত্রিশূল হল বর্শাজাতীয় কিছু), আবার কিছু অস্ত্র আছে, যা সম্পূর্ণ অলৌকিক ও দিব্য – ব্রহ্মাস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র। (সংস্কৃতে ‘অস্ত্র’ বলতে সেসব হাতিয়ারকে বোঝানো হয়, যা শত্রুর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু ‘শস্ত্র’জাতীয় হাতিয়ারগুলো ছোঁড়া হয় না।) আরও কিছু অস্ত্রের কথা আছে, যেগুলোকে ব্যবহার করতে বিরাট জ্ঞানের দরকার হয়, লক্ষণীয়, এই দিব্যাস্ত্র-গুলোকে শিল্পকলা, সাহিত্য এমনকি চলচ্চিত্রেও ধনুকে জুড়ে দেওয়ার দৈব তির হিসেবে দেখানো হয়।
কিছু অস্ত্রের নাম এদের ক্রিয়াপদ্ধতির সাথে জড়িত, অথবা নামটি প্রকৃতির কোনো শক্তির সাথে সম্পর্কিত। মহাভারতে আছে, যখন নাগাস্ত্র (নাগ মানে সাপ) ছোঁড়া হয়েছিল, তখন আকাশ থেকে অসংখ্য সাপ নেমে এসে শত্রুকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। একইভাবে আগ্নেয়াস্ত্র শত্রুকে আগুনে পুড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়, আবার বরুণাস্ত্র কাজে লাগে আগুন নেভাতে আর বন্যা আনতে। ব্রহ্মাস্ত্রের মতো কিছু অস্ত্র বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তুকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া যায়।
অস্ত্র বাদে সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত, এমন কিছু পৌরাণিক জিনিস হল – ঢাল, কবচ, কুণ্ডল, মুকুট ইত্যাদি।
বংশানুচরিতম্ – রাজবংশের ইতিহাস
ইক্ষ্বাকু বংশ
বৈবস্বত মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকুর বংশকে ইক্ষাকু'র নামে ইক্ষ্বাকু বংশ বলা হয়। বৈবস্বাত মনুর পিতা বিবস্বান সূর্যের নামে একে সূর্যবংশ-ও বলা হয়। ব্রহ্মার পুত্র মরীচি। মরীচি-র পুত্র কশ্যপ। কশ্যপের পুত্র বিবস্বান সূর্য, বিবস্বানের পুত্র শ্রাদ্ধদেব বৈবস্বাত মনু। বৈবস্বাত সপ্তম মনু। এই মন্বন্তরে সাতজন সপ্তর্ষি। যথাঃ- অত্রি, বশিষ্ঠ, কশ্যপ, গৌতম, ভরদ্বাজ, বিশ্বমিত্র ও জমদগ্নি। বৈবস্বত মনু সুদীর্ঘকাল পুত্রহীন ছিলেন।অবশেষে অপত্যলাভের জন্য যুগল দেবতা মিত্র-বরুণের উদ্দেশ্যে বিশাল যজ্ঞ করেন,এই যজ্ঞের পুরোহিত ছিলেন মহর্ষি বশিষ্ঠ।অতঃপর ভগবান শ্রীহরির আশির্বাদে এবং অবশ্যই যজ্ঞের ফলে বৈবস্বাত মনুর দশজন বিখ্যাত পুত্রের জন্ম হয়।তার মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন ইক্ষ্বাকু। বৈবস্বত মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু্ই সর্বপ্রথম অযোধ্যায় রাজধানী স্থাপন করেন। রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে ইক্ষ্বাকুকে সম্পূর্ণ পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি বলা হয়েছে।
মহাপ্লাবন
শতপথ ব্রাহ্মণের মতো কিছু হিন্দু গ্রন্থে ‘মহাপ্লাবন’-এর কথা বলা আছে।[৫৬] অন্যান্য অনেক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বর্ণিত মহাপ্লাবনের সাথে হিন্দু মহাপ্লাবনের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ভগবান বিষ্ণু একটি মাছের রূপ (মৎস্য অবতার) ধারণ করে মনুকে আসন্ন বিধ্বংসী মহাপ্লাবনের কথা জানান এবং তাকে রক্ষা করেন। এই ভাবে তিনি ধার্মিক মনু এবং সমস্ত পশুপাখি-গাছপালাকে বাঁচিয়ে পাপপূর্ণ পৃথিবীকে ভয়ানক বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে বিনষ্ট করেন ও নতুন যুগের সূচনা করেন।[৫৭] এই মহাপ্লাবনের পরই ‘মনুস্মৃতি’ লেখা হয় বলে বিশ্বাস।
ভারতবর্ষ
দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র ভরত প্রথমবার সারা বিশ্ব জয় করেন এবং তাঁর নাম অনুসারে ঐক্যবদ্ধ বিজিত ভূমির নাম রাখা হয় ‘ভারতবর্ষ’। তাঁর বংশের নাম হয় চন্দ্রবংশ। এই বংশেই মহাভারতের পাণ্ডব ও কৌরবরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
সংস্থা – প্রলয় বর্ণনা
প্রতিটি কল্পের শেষে ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসকে প্রলয় বলা হয়। কল্পান্তের প্রলয়কে নৈমিত্তিক বলে। প্রলয় জীবজগতের ধ্বংসসাধন হয়, কিন্তু ব্রহ্মাণ্ড গঠনকারী পদার্থের নাশ হয় না। অন্য প্রকার প্রলয় ঘটে ব্রহ্মার জীবনান্তে, যা প্রাকৃতিক নামে পরিচিত। তৃতীয়টি অত্যন্তিক, যা চরম নাশ এবং ভবিষ্যৎ থেকে মোক্ষ দেয়।
পুরাণসমূহের শ্রেণিবিভাগ
পুরাণসমূহ প্রধানত দুইভাগে ভাগ হয়েছে - মহাপুরাণ ও উপপুরাণ। পুরাণ মতে, ব্যাসদেব দশহাজার শ্লোকযুক্ত পুরাণের রচনা করেন। কিন্তু দেখা যায় অষ্টাদশ মহাপুরাণে চারলক্ষ আটশ শ্লোক নির্ণয় করা হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যাটি নির্ণয় করা দুরূহ।
মহাপুরাণ
পুরাণ নামাঙ্কিত সাহিত্যধারায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মহাপুরাণ (সংস্কৃত: महापूराण, Mahāpurāṇas)। পুরাণ অনুযায়ী মহাপুরাণের সংখ্যা আঠারো এবং এগুলো ছয়টি করে পুরাণযুক্ত তিনটি পৃথক শ্রেণিতে বিন্যস্ত। ত্রিমূর্তির বিচারে নিম্নলিখিত তিন শ্রেণিতে পুরাণগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। আবার পদ্ম পুরাণ[৫৮] অনুসারে সত্ত্বগুণ, রজোগুণ ও তমোগুণ – এই ত্রিগুণের আলোকে পুরাণ তিনপ্রকার হয়ে থাকে। যদিও অষ্টাদশ পুরাণ ও শ্রেণিবিভাগ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
বৈষ্ণব পুরাণ | ব্রাহ্ম পুরাণ | শৈব পুরাণ |
---|---|---|
সাত্ত্বিক | রাজসিক | তামসিক |
|
|
|
উপপুরাণ
উপপুরাণ অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অথবা আনুষঙ্গিক ধর্মগ্রন্থ। কোনো কোনো মতে উপপুরাণ আঠারোটি। কিন্তু মহাপুরাণের সংখ্যার মতোই এই সংখ্যা নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। কয়েকটি উপপুরাণ সমালোচনার সহিত সম্পাদিত হয়েছে।
উপপুরাণের তালিকা:
গণেশ ও মুদগল পুরাণ গণেশের মহিমাবাচক।[৬১][৬২] দেবীভাগবত পুরাণ দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য কীর্তন করে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যম্ অংশের সঙ্গে এই পুরাণটিও শক্তি উপাসকদের মূল ধর্মগ্রন্থ বলে বিবেচিত হয়।[৬৩]
ভারতীয় উপমহাদেশে এইরূপ অনেক উপপুরাণের সন্ধান পাওয়া যায়।[৬৪] তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বঙ্গদেশ ও অসমে প্রচলিত সর্পদেবী মনসার মহিমাজ্ঞাপক পদ্মপুরাণ।
পৌরাণিক থিম এবং প্রকার
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- Dowson, John (১৮৮৮)। A Classical Dictionary of Hindu Mythology and Religion, Geography, History, and Literature। Trubner & Co., London।
- Buitenen, J. A. B. van; Dimmitt, Cornelia (১৯৭৮)। Classical Hindu mythology: a reader in the Sanskrit Puranas। Philadelphia: Temple University Press। আইএসবিএন 0-87722-122-7।
- Campbell, Joseph (২০০৩)। Myths of light: Eastern Metaphors of the Eternal। Novato, California: New World Library। আইএসবিএন 1-57731-403-4।
- Dallapiccola, Anna L. (২০০২)। Dictionary of Hindu Lore and Legend। আইএসবিএন 0-500-51088-1।
- Pattanaik, Devdutt (2003). Indian mythology: tales, symbols, and rituals from the heart of the Subcontinent. Inner Traditions/Bear & Company. আইএসবিএন ০-৮৯২৮১-৮৭০-০.
- Walker, Benjamin (১৯৬৮)। Hindu World: An Encyclopedic Survey of Hinduism। London: Allen & Unwin।
- Wilkins, W.J. (১৮৮২)। Hindu mythology, Vedic and Purānic। Thacker, Spink & co.।
- Williams, George (২০০৩)। Handbook of Hindu mythology। ABC-Clio Inc। আইএসবিএন 1-57607-106-5।
- Macdonell, Arthur Anthony (১৯৯৫)। Vedic mythology। Delhi: Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 81-208-1113-5।
বহিঃসংযোগ
- ওয়েব্যাক মেশিনে [https://web.archive.org/web/20190707040843/http://www.claysanskritlibrary.org/ আর্কাইভকৃত ৭ জুলাই ২০১৯ তারিখে Clay Sanskrit Library] publishes classical Indian literature, including the Mahabharata and Ramayana, with facing-page text and translation. Also offers searchable corpus and downloadable materials.
- Sanskrit Documents Collection: Documents in ITX format of Upanishads, Stotras etc.