তাণ্ডব
সরঞ্জাম
সাধারণ
মুদ্রণ/রপ্তানি
অন্যান্য প্রকল্পে
তাণ্ডব (আরো একটা বানান হল তাণ্ডবম্) অথবা তাণ্ডব নাট্য হল একটা পরিচিত স্বর্গীয় নাচ যা হিন্দু দেবতারা প্রদর্শন করতেন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী দেবতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাণ্ডবের প্রদর্শন করতেন। ভাগবত পুরাণে কালীয় নাগের মাথায় কৃষ্ণের তাণ্ডব নাচের কথা বলা হয়েছে।[১] পুরাণে বর্ণিত একটি ঘটনায় শিবপত্নি সতী যখন রাজা দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানের অগ্নি কুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন, তখন শিব তাঁর শোক এবং ক্রোধে ধ্বংসাত্মক রুদ্র তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন। শিবের পুত্র গণেশকে মন্দির ভাস্কর্যে অষ্টভুজ তাণ্ডব নৃত্য মূর্তি (আট হাতওয়ালা তাণ্ডব নৃত্যরত গণেশের মূর্তি) হিসেবে দেখানো হয়েছে। [১]
জৈন ঐতিহ্য অনুযায়ী বলা হয় যে, ইন্দ্র ঋষভের (জৈন তীর্থঙ্কর) জন্মের সময় তাঁর সম্মানে তাণ্ডব নৃত্য প্রদর্শন করেছিলেন। [১]
তাণ্ডব হল ভারতের এক পবিত্র নৃত্য-নাট্য প্রদর্শন, যাতে বলিষ্ঠ, প্রাণবন্ত অঙ্গ সঞ্চালন আছে। আনন্দে প্রদর্শন করা নৃত্য হচ্ছে আনন্দ তাণ্ডব। রৌদ্র বা রুদ্র তাণ্ডব হল ধ্বংসাত্মক ভাবের প্রদর্শন। হিন্দু গ্রন্থাদিতে যে ধরনের তাণ্ডবের উল্লেখ আছে সেগুলো হল: আনন্দ তাণ্ডব, ত্রিপুরা তাণ্ডব, সান্ধ্য তাণ্ডব, সমাহার তাণ্ডব, কালী (কালিকা) তাণ্ডব, উমা তাণ্ডব, শিব তাণ্ডব, কৃষ্ণ তাণ্ডব এবং গৌরী তাণ্ডব।[১]
ভাগবত পুরাণ বলছে, কালীয় নামক এক নাগকে দমন করে কৃষ্ণ তার ফণার ওপর নেচেছিলেন এবং অশুদ্ধ যমুনা নদীকে শুদ্ধ করেছিলেন। এই পর্বটা ব্রজের মানুষদের আতঙ্ক দূর করে বিষাক্ত নাগ কালীয়কে দমন করার বর্ণনা দেয়; এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণ তাণ্ডব বা কৃষ্ণের তাণ্ডব নৃত্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। [২]
লেখিকা অঙ্গনা ঝাবেরি রাসলীলা কৃষ্ণ তাণ্ডবের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন যে, এটা খুব দ্রুততা এবং আনন্দপূর্ণ নাচের অঙ্গ সঞ্চালন। এতে সংশ্লিষ্ট আছে ছোটো ছোটো দ্রুত অঙ্গ সঞ্চালন, হালকা ঘুরন্ত লাফ, দ্রুত পদসঞ্চালন, চঞ্চলগতিতে দ্রুত ঘূর্ণন এবং কিছু শারীরিক কসরত। কিন্তু এই নাচে সর্বোপরি মাধুর্য এবং মার্জিত রূপে মানানসই কৃষ্ণের রোমান্টিক ও যৌবনোদ্দীপ্ত চরিত্র ফুটে উঠেছে।[৩]
ষোড়শ শতকের পূর্ব পর্যন্তও 'নাচের দেবতা' হিসেবে কৃষ্ণের উপাসনা প্রচলিত ছিল। লেখক এবং অধ্যাপক ক্যালেব সাইমন্স তাঁর ডিভোশনাল সভারেন্টি: কিনসিপ অ্যান্ড রিলিজিয়ন ইন ইন্ডিয়া বইতে বলেছেন যে, রাজা চিক্কা দেবরাজা (মহীশূর রাজ্যের চতুর্দশ মহারাজা) নিজের রাজ্যাভিষেককে স্মরণীয় করার জন্যে 'দেবরাজা (সঙ্গে) নৃত্যরত কৃষ্ণের প্রতিকৃতি' (তাণ্ডব কৃষ্ণমূর্তি দেবরাজা) নামে এক ধারাবাহিক স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন।[৪]
লেখক সহদেব কুমার তাঁর আ থাউস্যান্ড পেটাল্ড লোটাস: জৈন টেম্পল অব রাজস্থান: আর্কিটেকচার অ্যান্ড আইকনোগ্রাফি বইতে বলেছেন যে, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের আগে, চোল রাজত্বের সময়ে, নটরাজা নাচ এবং কালিয়া নাগের একশো ফণার ওপরে কৃষ্ণ তাণ্ডব নাচ শিল্পীদের সমাদৃত বিষয় ছিল। [৫]
বিদুষী লাবণ্য ভেমসানি বলেছেন, "ভরতনাট্যম এবং কুচিপুড়ি তাণ্ডব নামে একটা নৃত্যশৈলীর উন্নয়ন ঘটায়, প্রাণবন্ত পদসঞ্চালনের সঙ্গে প্রধানত জোরালো নাচ হিসেবে প্রচলিত হয় যেটা একসময় শিশু কৃষ্ণ বৃন্দাবনে কালিন্দী হ্রদে কালীয় নাগকে দমন করে এই নাচ প্রদর্শন করেছিলেন।"[৬]
কৃষ্ণ নৃত্যের (নাচ) অনেকগুলো রচনা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। পুরন্দর দাস 'নৃত্য কৃষ্ণ'কে 'তাণ্ডব কৃষ্ণ' হিসেবে নামকরণ করেছেন। পুরন্দর দাস তাঁর একটা রচনায় বলেছেন, 'তাণ্ডব কৃষ্ণনা ভজিসি' ('তাণ্ডব কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা')। এই সূত্র ধরে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, 'তাণ্ডব' হল কৃষ্ণ এবং অন্যান্যদের চর্চিত একটা নৃত্য (নাচ)।[৭]
শৈববাদ মতে শিবের তাণ্ডবকে সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় চক্রের উৎস হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। যখন রুদ্র তাণ্ডব তাঁর হিংস্র রূপ চিত্রিত করে, প্রথমটা সৃষ্টি এবং পরবর্তীটা বিশ্বের ধ্বংস, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত দেখায়, তখন আনন্দ তাণ্ডব তাঁকে আনন্দপূর্ণ দেখায়। শিব সিদ্ধান্ত ঐতিহ্য অনুযায়ী, নটরাজরূপী শিবকে (আক্ষরিক অর্থে 'নৃত্যের রাজা' [৮]) নৃত্যের সর্বোচ্চ দেবতা বলে মান্য করা হয়।[৯] তাণ্ডবম্ নামটা এসেছে শিবের অনুচর তাণ্ডু (তণ্ডু) থেকে, যিনি শিবের তাণ্ডব নাচের বিন্যাস অনুযায়ী অঙ্গহার ও করণ গুলোর[১০] আঙ্গিকে ভরতকে (নাট্যশাস্ত্র রচয়িতা) নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিছু পণ্ডিতের ভাবনা ছিল যে, তাণ্ডু নিজে গোড়ায় নাটকীয় শিল্প রচনার লেখক অবশ্যই ছিলেন, যেগুলো নাট্যশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১১] প্রকৃতপক্ষে, শিব ঐতিহ্যের মুদ্রাসমূহ এবং আচার-অনুষ্ঠান থেকেই সম্ভবত উচ্চাঙ্গের নৃত্য, নাট্য ও সংগীত এসেছে।
ভরত রচিত নাট্যশাস্ত্রে তাণ্ডব লক্ষণম[১২] নামে চতুর্থ অধ্যায়ে ৩২টা অঙ্গহার এবং ১০৮টা কারণের বর্ণনা দেওয়া আছে। কারণ হল পায়ের সঙ্গে যুগ্ম হাতের ভঙ্গী এবং নাচের একটা অঙ্গবিন্যাস। অঙ্গহার হচ্ছে সাত অথবা ততোধিক কারণের সমাহার।[১৩]
শিবের উপাসনায় কতগুলো বিভিন্ন নাচ আছে তা আমি বলতে পারিনা। এই সমস্ত নাচের পিছনে কমবেশি এক এবং অদ্বিতীয় মূল ধারণা ছিল নিঃসন্দেহে আদিম ছন্দোবদ্ধ শক্তির অভিব্যক্তি। শিবের নাচের উৎস হিসেবে যেটা ছিল, এটা কালক্রমে দেবতার কার্যকরতার পরিষ্কার চিত্র হয়েছিল, যা নিয়ে যেকোনো শিল্প অথবা ধর্ম অহংকার করতে পারে।" - আনন্দ কুমারস্বামী[১৪]
শিবের তাণ্ডব নাচের প্রত্যুত্তরে তাঁর সহধর্মিনী পার্বতী যে নাচ প্রদর্শন করেন তাকে লাস্য বলা হয়, যে নাচের অঙ্গসঞ্চালনগুলো নম্র, মাধুর্যপূর্ণ এবং অনেক সময় কামদ। কিছু পণ্ডিতের মতে লাস্য হল তাণ্ডবের নারীত্বপূর্ণ রূপ। লাস্য দুরকমের, জারিতা লাস্য এবং যৌবক লাস্য।
শিব তাণ্ডব স্তোত্রম্ হল একটা স্তোত্র (হিন্দু স্তব) যেটা শিবের শক্তি ও সৌন্দর্য বর্ণনা করে।
কত্থক নাচে কৃষ্ণ তাণ্ডব, শিব তাণ্ডব এবং রাবণ তাণ্ডব, এই তিন প্রকারভেদ আছে, তবে কখনো কখনো কালিকা তাণ্ডব নামে চতুর্থ ধরনও ব্যবহার করা হয়।[১৫][১৬] মণিপুরি নৃত্য 'তাণ্ডব' (সাধারণত শিব, শক্তি অথবা কৃষ্ণকে যোদ্ধা-ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখিয়ে জোরালো বিষয় ভাব রাখা হয়) অথবা লাস্য (রাধা ও কৃষ্ণের সূক্ষ্ম[১৭] প্রেম উপাখ্যানকে সাধারণত ভাবার্থ করা