দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দের প্রার্থনা

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দের প্রার্থনা হল স্বামী বিবেকানন্দের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৮৮৪ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংস নরেন্দ্রনাথ দত্তকে (স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম) দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে আর্থিক উন্নতির জন্য প্রার্থনা করতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত শুদ্ধ জ্ঞান, ভক্তি ও বৈরাগ্য প্রার্থনা করেন। গবেষকেরা এই ঘটনাটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে এটিকে বিবেকানন্দের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, বিবেকানন্দ প্রথম দিকে প্রতিমা পূজার বিরোধী হলেও, এই ঘটনার পর থেকে তিনি কালীমূর্তি পূজা মেনে নেন এবং কালীমূর্তির কাছে প্রার্থনা করেন। বি. আর. কিশোরের মতে, "এই ঘটনা নরেন্দ্রের ভক্তি ও জ্ঞানে নতুন মাত্রা যোগ করে।"

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দের প্রার্থনা
দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর (কালী) মূর্তি
তারিখ১৮৮৪
অবস্থানদক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি
অংশগ্রহণকারীরামকৃষ্ণ পরমহংস
স্বামী বিবেকানন্দ
ঘটনা (সংক্ষেপে)নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ) আর্থিক উন্নতির জন্য প্রার্থনা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত জ্ঞান, ভক্তি ও বৈরাগ্য প্রার্থনা করেন
গুরুত্বস্বামী বিবেকানন্দের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

আর্থিক সমস্যা দূর করার উদ্দেশ্যে তিন বার কালীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে গিয়ে তিন বারই নরেন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন: "মা, জ্ঞান ও ভক্তি ছাড়া আর কিছুই আমি চাই না।"

প্রেক্ষাপট

১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার এক ধনী পরিবারে নরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম হয়।[১] তার বাবা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন একজন আইনজীবী। তিনি প্রচুর আয় করলেও, আয়ের তুলনায় ব্যয় করতেন বেশি। ১৮৮৪ সালে নরেন্দ্রনাথ যখন এফ. এ. পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যু হয়।[২] বিশ্বনাথ দত্তের আকস্মিক মৃত্যুতে দত্ত পরিবার দেউলিয়া হয়ে যায়। ঋণদাতারা ঋণ শোধ করবার জন্য তাগাদা লাগাতে শুরু করে এবং আত্মীয়স্বজনেরা তাদের পৈতৃক ভিটে থেকে উৎখাত করার ভয় দেখাতে থাকেন। একদা সচ্ছল পরিবারের সন্তান নরেন্দ্রনাথ কলেজের দরিদ্রতম ছাত্রদের একজনে পরিণত হন।[৩] তিনি ছিলেন বিশ্বনাথ দত্তের বড়ো ছেলে। তাই তাকেই পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। তিনি চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরিবারের ভরনপোষণের ব্যবস্থা করতেও তিনি ব্যর্থ হন। যেসব ধনী বন্ধু ও আত্মীয়েরা সহজেই তাদের সাহায্য করতে পারতেন, তারা কেউই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন না। নরেন্দ্রনাথ জীবনে প্রথম বার চরম দুরবস্থার সম্মুখীন হলেন।[৪]

সেই দিনগুলির কথা স্মরণ করে বিবেকানন্দ লিখেছিলেন—[৫]

আমি খিদেয় মরে যাচ্ছিলাম। খালি পায়ে অফিসে অফিসে ঘুরতাম। কিন্তু কোথাও কাজ পেলাম না। আমার অভিজ্ঞতায় আমি মানুষের সহানুভূতি দেখেছিলাম। এই প্রথম জীবনের বাস্তব দিকটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল। আমি তা আবিষ্কার করলাম... দুর্বল, দরিদ্র, গৃহহারাদের জন্য সেখানে কোনো স্থানই ছিল না...

১৮৮১ সালে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯শ শতাব্দীর মরমিয়া সন্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তিনি মাঝে মাঝেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে দেখা করতে দক্ষিণেশ্বরে যেতেন। এই দুরবস্থার মধ্যে নরেন্দ্রনাথের দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত বৃদ্ধি পায়। তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপদেশে শান্তি পেতে থাকেন।[৬][৭]

রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবী কালীর পূজা করতেন। প্রথম দিকের সাক্ষাতে নরেন্দ্রনাথ কালীকে গ্রহণ করতে বা তার পূজা করতে সম্মত ছিলেন না। রামকৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "যদি আমার মা কালীকে নাই মানবি, তাহলে এখানে আসিস কেন?" নরেন্দ্রনাথ উত্তরে বলতেন, "আমি আপনাকে দেখতে আসি। আমি আসি, কারণ, আপনাকে আমি ভালবাসি।"[৮]

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে প্রার্থনা

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি, ১৮৫৫ সালে রানী রাসমণি-র প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে দেবী কালী ভবতারিণী নামে পরিচিত।
মন্দিরের প্রধান দেবী কালী। শিবের উপর দণ্ডায়মান।

একদিন নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংসকে কালীর কাছে তাদের পরিবারের প্রয়োজনে আর্থিক সুরাহার জন্য প্রার্থনা করতে বলেন। তা শুনে রামকৃষ্ণ বলেন, "আজ মঙ্গলবার। ভাল দিন। তুই নিজে মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা কর।" [৯][১০] রামকৃষ্ণ কালী সম্পর্কে নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন: "তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞান, ব্রহ্মের অখণ্ড শক্তি এবং তাঁর ইচ্ছামাত্রেই তিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সব কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তাঁর।" তখন নরেন্দ্রনাথ তার গুরুর কথায় বিশ্বাস করে আর্থিক দুরবস্থার সমাধান কল্পে কালীর কাছে প্রার্থনা করবেন বলে মনস্থির করেন।[১১]

আর্থিক দুরবস্থার সমাধান কল্পে প্রথম প্রার্থনার চেষ্টা

রামকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে, রাত্রি ৯টার সময়[১০] নরেন্দ্রনাথ মন্দিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। মন্দিরে প্রবেশ করে কালীমূর্তির দিকে তাকিয়েই তার মন ভক্তি ও প্রেমে আপ্লুত হয়ে যায়।[১১] তিনি কালীমূর্তির সামনে নতজানু অয়ে বসে পড়েন এবং "আনন্দের উচ্ছ্বাসে" কালীর নাম বারংবার উচ্চারণ করতে থাকেন। মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হয় মূর্তিটি "জীবন্ত ও চৈতন্যময়, দিব্য প্রেম ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ।" তিনি কালীর কাছে দিব্য জ্ঞান, ভক্তি ও দেবীর দিব্য দর্শন প্রার্থনা করেন এবং যে জন্য তিনি এসেছিলেন, সেই পারিবারিক আর্থিক অবস্থার উন্নতি কল্পে প্রার্থনা করতেই ভুলে যান।[৯][৯][১১]

আর্থিক দুরবস্থার সমাধান কল্পে দ্বিতীয় প্রার্থনার চেষ্টা

নরেন্দ্রনাথ যখন মন্দিরের বাইরে অপেক্ষারত রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে ফিরে আসেন, তখন রামকৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞাসা করেন, "তোর পরিবারের জন্য চাইলি?" নরেন্দ্রনাথ হতবুদ্ধি হয়ে যান। তিনি বলেন, তিনি তা চাইতে ভুলে গেছেন। সে কথা শুনে রামকৃষ্ণ দ্বিতীয়বার তাকে মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করতে বলেন।[৯]

রামকৃষ্ণের পরামর্শে নরেন্দ্রনাথ আবার মন্দিরে যান। কিন্তু আগের বারের মতোই তিনি কালীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে থাকেন-"আমাকে বৈরাগ্য ও দিব্যজ্ঞান দাও। মা, তোমার দর্শন দাও।" এবারেও তিনি আর্থিক দুরবস্থার কথা বলতে ভুলে যান।[৯] একথা শুনে রামকৃষ্ণ তাকে তিরস্কার করে বলেন, "তুই কি অন্যমনস্ক! নিজেকে সামলে নিয়ে এই সামান্য কথাগুলি বলতে পারছিস না?"[১১]

আর্থিক দুরবস্থার সমাধান কল্পে তৃতীয় প্রার্থনার চেষ্টা

নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে ফিরে আসেন। রামকৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি পারিবারিক আর্থিক দুরবস্থার সুরাহার জন্য প্রার্থনা করেছেন কিনা। কিন্তু আবারও নরেন্দ্রনাথ বলেন যে তিনি তা করতে ভুলে গেছেন। রামকৃষ্ণ তৃতীয়বার প্রার্থনার জন্য নরেন্দ্রনাথকে মন্দিরে প্রেরণ করেন।[১২]

নরেন্দ্রনাথ তৃতীয়বার কালীমন্দিরে আসেন। তিনি রামকৃষ্ণের পরামর্শ অনুযায়ী প্রার্থনা করতে গিয়ে জাগতিক বস্তুর জন্য প্রার্থনা করার জন্য লজ্জিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি প্রার্থনা না করেই রামকৃষ্ণের কাছে ফিরে আসেন। রামকৃষ্ণ তার শিষ্যের আধ্যাত্মিক চাহিদা দেখে খুশি হন। তিনি বলেন, নরেন্দ্রনাথের পরিবারের মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হবে না।[১২][১৩] নরেন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়, "আমাকে শেষ পর্যন্ত তাঁকে (কালী) মানতে হয়েছিল!" ছয় বছর কালীকে ঘৃণা করার পর সেই ছিল ঘৃণার শেষ।[১১]

এই ঘটনার পরে বিবেকানন্দ এও বলেছিলেন যে, "কালী ও মা নামে পরিচিত নারীরূপা কোনো এক মহাশক্তির অস্তিত্ব আছে, তা বিশ্বাস না করার উপায় রইল না।"[১১]

বিবেকানন্দের পরবর্তী জীবনের ভাবনা

পরবর্তী জীবনে দেবী কালীর একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হওয়া বিবেকানন্দ বলেছিলেন, কালী হলেন “ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য জননী”, যিনি “নিজের মধ্যে সৃষ্টি ও ধ্বংস, প্রেম ও ভীতি, জীবন ও মৃত্যুকে আত্মীভূত করেছেন।”[১৪]

পরবর্তীকালে বিবেকানন্দ যখন পাশ্চাত্যে বেদান্ত প্রচারে গিয়েছিলেন, তখন তিনি ভগিনী নিবেদিতাকে একটি চিঠিতে লেখেন যে, মা তাকে রক্ষা করছেন এবং হৃদয়ের সমর্থন জোগাচ্ছেন। তিনি এও বলেছিলেন যে, "কালীপূজা আমার বিশেষ ধারা" এবং তিনি এও বলেন যে তিনি কাউকে কালীপূজা করতে উপদেশ দেন না। কারণ কালীপূজা তার কাছে গোপনীয়।[১৫]

গবেষকদের মতামত

বিবেকানন্দের জীবনীকার বি. আর. কিশোরের মতে, "এই ঘটনা নরেন্দ্রনাথের ভক্তি ও জ্ঞানে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন মূর্তিপূজার বিরোধী। তিনি দিব্যজননীকে গ্রহণ করতে অসম্মত ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি মায়ের একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হলেন।"[১২] এলিজাবেথ ইউ হার্ডিং তার গ্রন্থ "কালী: দ্য ব্ল্যাক গডেস অফ দক্ষিণেশ্বর" গ্রন্থেও লিখেছেন যে এই ঘটনা নরেন্দ্রনাথের জীবনে "মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।"[১৬]

অমিয় পি. সেন লিখেছেন, এই ঘটনা নরেন্দ্রনাথের "আধ্যাত্মিক যাত্রাকে গভীরতর" করেছিল। এই ঘটনার পর তিনি দক্ষিণেশ্বরের নির্জন পঞ্চবটীতে প্রায়ই ধ্যানে বসতেন।[১৩] স্বামী নিখিলানন্দ লিখেছেন, নরেন্দ্রনাথের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। প্রথমটি একটি সুখী জাগতিক জীবনের এবং দ্বিতীয়টি আধ্যাত্মিক উন্নতি ও স্বাধীনতার। তিনি দ্বিতীয় পথটি নির্বাচন করেন।[১৭]

তথ্যসূত্র

পাদটীকা

সূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন