পেয়ালবর

তামিল বৈষ্ণব সাধক ও কবি

পে আলবর (এছাড়াও পেয়ালবর', পিয়ালবর, পে আজবর, বা পে আজওয়ার নামে পরিচিত) দক্ষিণ ভারত-এর বারোজন অলবর-এর অন্তর্ভুক্ত একজন বৈষ্ণব সাধক।আলবরদের রচিত শ্লোকগুলি নালায়রা দিব্য প্রবন্ধম শিরোনামে সংকলিত হয়েছে যেখানে ১০৮টি মন্দিরকে দিব্য দেশম নামে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। তিনজন প্রধান আলবর-এর তালিকায় পে আলবরকে তৃতীয় আলবর হিসাবে বিবেচনা করা হয়, অন্য দুজন হলেন পোইগায় আলবর এবং ভূতথ আলবর। ইহাদেরকে সম্মিলিতভাবে মুতালামালবরগাল বলা হয় যারা জন্মগতভাবে দৈবশক্তির অধিকারী বলে পরিচিত। পে আলবর শতাধিক শ্লোক রচনা করেছেন যা মুনরাম তিরুবন্ততি শিরোনামে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর রচনাটি অন্ততি শৈলীতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যেখানে শেষ শব্দটি পরের শ্লোকের শুরুতে যুক্ত হয়েছে।

পে আলবর
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম৪২০৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ (ইতিহাস অনুযায়ী )[১][২]
মাইলাপুর
ধর্মহিন্দুধর্ম
দর্শনবৈষ্ণব ভক্তি
ধর্মীয় জীবন
সাহিত্যকর্মমুনরাম তিরুবন্ততি
সম্মানঅলবর সাধু, বিষ্ণুর নন্দক তলোয়ারের অবতার

হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে পে আলবরকে মাইলপুর আদি কেশব পেরুমাল মন্দিরের পুকুরে পদ্ম ফুলের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল।[৩] মন্দিরটি অরুন্ডেল স্ট্রিট, মাইলপুর, চেন্নাই-এ অবস্থিত। তামিল ভাষায়, পে বলতে এমন একজনকে বোঝায় উপযুক্ত অধিকারী। যেহেতু পে আলবর হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতি উন্মত্তভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাই তিনি এই নামটি প্রাপ্ত হয়েছেন।

কিংবদন্তি অনুসারে, তিনজন আলবর একবার থিরুকোভিলুর-এ বৃষ্টির সময় একটি ছোট অন্ধকার ঘরে অবস্থান করেছিলেন। হঠাৎ তারা তাদের মধ্যে চতুর্থ ব্যক্তিকে অনুভব করেন। তারা জানতে পেরেছিলেন, ইনি দেবতা বিষ্ণু এবং পোইগাই আলবর একদৃষ্টিতে তাঁর মুখ দেখতে চেয়েছিলেন, তবে কেবল বিদ্যুতের ন্যায় জ্বলন্ত আলো দেখতে সক্ষম হন। আলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার লক্ষ্যে, পোইগাই অবিলম্বে শতাধিক গান রচনা করেছিলেন। পে আলবর এবং ভুথাথ আলবর উভয়ই বিষ্ণুকে নিবেদর করে একশটি গান রচনা করতে থাকেন।এই প্রাচীনতম সাধুদের কাজ বৈষ্ণবধর্মের দার্শনিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক ধারণাগুলিতে অবদান রেখেছিল। তিনজন শৈব নায়নার এর সাথে, তাদের রচনাগুলি দক্ষিণ ভারতীয় অঞ্চলের শাসক পল্লব রাজাদের প্রভাবিত করেছিল, যার ফলে ধর্মীয় ভূখণ্ড বৌদ্ধ এবং জৈনধর্ম থেকে দুটি সম্প্রদায়ে বিভাগ করা হয়। উপরন্তু, হিন্দুধর্ম-এর দুটি সম্প্রদায় এই অঞ্চলে আলাদা হয়ে বসবাস করতে শুরু করে।

অলবর

"অলবর" শব্দের অর্থ "যিনি ঈশ্বরের অগণিত গুণসমুদ্রের গভীরে অবগাহন করেন"। অলবরদের বিষ্ণুর দ্বাদশ উচ্চকোটির ভক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা ৫ম থেকে ৮ম শতাব্দীতে বৈষ্ণবধর্মকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন। অলবর সাধুদের তামিল ভাষায় রচিত প্রেম ও ভক্তিগীতিগুলি নালায়ীরা দিব্য প্রবন্ধম নামে সংকলিত হয়েছে। এখানে ৪০০০টি শ্লোক রয়েছে। এতে ১০৮টি দিব্য দেশম্ তথা বিষ্ণু মন্দিরকে তাদের রচিত গানের মাধ্যমে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। [৪][৫] অলবরগণ ছিলেন বিভিন্ন বর্ণের অন্তর্গত। ঐতিহ্য অনুসারে, পোইগাই, ভুথ,পেয়ালবর, ভক্তিসার ছিলেন ঋষিপুত্র, তোণ্ডারাড়ি, মথুরকবি, বিষ্ণুচিত্তঅন্ডাল ব্রাহ্মণ বর্ণভুক্ত ছিলেন, কুলশেখর ক্ষত্রিয় বর্ণের, নম্মালবর কৃষক পরিবার, তিরুপ্পানার পানার সম্প্রদায় এবং তিরুমঙ্গায়ালবর কল্বর সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।গরুড়বাহন পণ্ডিতের (খ্রিস্টাব্দ ১১ শতক) 'দিব্য সুরি চরিত', পিনবরাগিয়া পেরুমল জিয়ার 'গুরুপরম্পরাপ্রবরম্', কোবিল কান্দাদাই আপ্পনের 'পেরিয়া তিরু মুদি আদাইভু', পিল্লাইয়ের 'যতীন্দ্র প্রণব প্রবরম্', লোকম জিয়া'র 'দিব্য প্রবন্ধম-এর ভাষ্য', 'গুরু পরম্পরা(গুরুগণের ক্রমাণুক্রমিক ধারা)' গ্রন্থ, মন্দিরের সংস্কৃতি এবং শিলালিপিতে আলবরদের কর্মের বিশদ বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। এই গ্রন্থগুলি অনুসারে, অলবরগণ বিষ্ণুর পার্ষদ ও অস্ত্রের অবতার বলে পরিগণিত পোইগাই অলবরকে পাঞ্চজন্য শঙ্খ, কৌমুদকীর অবতাররূপে পে-অলবর, ভুতথকে নন্দক তলোয়ার ,ভক্তিসারকে সুদর্শন চক্র, নম্মালবরকে বিষ্বকসেন, মধুরকবিকে বৈনতেয় গরুড়, পেরিয়ালবরকে বৈকুন্ঠবাসী গরুড়, অণ্ডালকে ভূদেবী, বনমালার (বিষ্ণুর গলমাল্য) অবতার তোণ্ডারাড়িপ্পোড়ি, শ্রীবৎসের অবতার তিরুপ্পানালবর এবং তিরুমঙ্গাই আলবারকে শাঙ্গর্ধনুর (রামের ধনুক) অবতার হিসেবে দেখা হয়। প্রবন্ধম-এর গীতিগুলি দক্ষিণ ভারতের সমস্ত বিষ্ণু মন্দিরে প্রতিদিন এবং বিবিধ উৎসবে নিয়মিত গাওয়া হয়।[৫][৬] মনবলা মামুনিগল-এর ঐতিহাসিক বিবরণ অনুসারে, প্রথম তিনজন আল্বর অর্থাৎ পোইগাই, ভুতথ এবং পে দ্বাপরের (খ্রিস্টপূর্ব ৪২০০ সালের আগে) অন্তর্গত। ইতিহাস এবং ঐতিহাসিকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এই ত্রয়ী দ্বাদশ আলবরদের মধ্যে প্রাচীন। [৪][৫][৭][৮][৯]

তিনজন শৈব নায়নমারদের সাথে তারা দক্ষিণ ভারতীয় রাজাদের প্রভাবিত করেছিলেন। তারা একটি ভক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন, এর ফলে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ, জৈন ধর্ম এবং হিন্দু ধর্ম এই দুটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভূগোল পরিবর্তিত হয়। আলবরগণের ভাগবত ধর্মের প্রচারে ভারতের দুটি মহাকাব্য যথা রামায়ণ এবং মহাভারত এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়।[১০] আলবরগণ সমগ্র অঞ্চলে "বৈষ্ণববাদ" ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন।[১১] কতিপয় আলবর এর চরিত ধর্মতাত্ত্বিক নাথমুনি {(৮২৪-৯২৪ খ্রিস্টাব্দ) দশম শতকের একজন বৈষ্ণব} দ্বারা সংকলিত হয়েছিল।তিনি আলবরদের রচনাগুলোকে "তামিল বেদ" বলে আখ্যায়িত করেছেন। [১২][১৩]

জীবনের প্রথমার্ধ

তামিল ভাষায়, পে বলতে এমন একজনকে বোঝায় যিনি আবিষ্ট এবং যেহেতু আলবর দেবতা বিষ্ণুর প্রতি উন্মত্তভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাই তিনি এই নামটি পেয়েছেন। [১৪] হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে, পে আলবরকে চেন্নাইয়ের একটি শহরতলির আদিকেশভ পেরুমাল মন্দির, মাইলাপুর (ঐতিহাসিকভাবে মানিকাইবরম নামে পরিচিত) পুকুরে কমল ফুলে পাওয়া গিয়েছিল। তাকে মহাদহভায়া এবং মায়লাপুরাদপধীও বলা হয়। [১৫]

রচনা

হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে, বিষ্ণু থিরুক্কোইলুরে মুতালাম আলভারের (প্রথম তিনটি আলবর ) নিকট আবির্ভূত হন। দিনের বেলা ছিল, কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেল এবং প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। ভ্রমণকারী পোইগাই একটি ছোট আস্তানা খুঁজে পেয়েছিল যেখানে একজন ব্যক্তির শুয়ে থাকার জায়গা রয়েছে । বুদথ সেখানে আশ্রয়ের জায়গা খুঁজতে এসে পৌঁছয় এবং পোয়গাই তার সাথে বসে যান । এদিকে পে আলবরও একই জায়গায় এসেছিলেন। তিনজনই জায়গার অভাবে দাঁড়াতে পছন্দ করেছিলেন । অন্ধকার ঘন হয়ে আসে এবং ছোট ঘরের ভিতরে তারা একে অপরকে দেখতে পায় না । এদিকে তারা অনুভব করেছিল যে চতুর্থ ব্যক্তিও তাদের মধ্যে জোর করে তার পথ তৈরি করেছে । তিন আলভবর বিদ্যুতের আলো থেকে বুঝতে পেরেছিল যে চতুর্থজনের একটি আকর্ষণীয় মুখ রয়েছে যা মহিমান্বিত এবং ঐশ্বরিক । এই তিনজন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে যে , তাদের মধ্যে বিষ্ণু গাদাগাদি করছেন।  [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]পোইগাই ক্রমাগত বিষ্ণুর মুখ দেখতে চেয়েছিলেন কিন্তু কেবল বিদ্যুতের আলো দেখতে পান। ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য তিনি তৎক্ষণাৎ একশো গান রচনা করেন যাতে পৃথিবী একটি মহাসাগরের মতো ঘি দিয়ে ভরা একটি বড় পাত্র হয়ে ওঠে যেখানে সূর্য জ্বলন্ত প্রতীপ হতে পারে।[১৬][১৩][৮]

তামিল লিপি
திருக்கண்டேன் பொன் மேனி கண்டேன் திகழும்
அருக்கனணி நிறமும் கண்டேன் - செருக்கிளரும்
பொன்னாழி கண்டேன் புரி சங்கம் கைக்கண்டேன்
என்னாழி வண்ணன் பால் இன்று

ভূতথ আলবর তাঁর প্রতি প্রবল ভালবাসার মাধ্যমে ক্রমাগত প্রদীপ জ্বালানোর কল্পনা করে ১০০ গান গেয়েছিলেন । পে আলবর আরও ১০০টি গান গেয়েছেন যেখানে তিনি ঐশ্বরিক মুখের মোহনীয় আকর্ষণ এবং চক্র ও শঙ্খ এবং তাঁর ঐশ্বরিক সঙ্গী দেবী লক্ষ্মীর সাথে সজ্জিত নারায়ণের বর্ণনা দিয়েছেন। [১৪][৮]

পে আলবর মুনরাম তিরুবন্ততি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ একশটি শ্লোক রচনা করেছেন। [১৮] পে আলবরের রচনাটি অন্তাতি শৈলীতে সৃষ্টি করা হয়েছিল । অন্ধা শব্দের অর্থ শেষ এবংআদি শব্দের অর্থ শুরু। অন্ততি শৈলীতে পরবর্তী শ্লোকের প্রারম্ভিক শব্দ হিসাবে প্রতিটি শ্লোকের শেষ শব্দ বা অক্ষর রয়েছে এবং শততম শ্লোকের শেষ বাক্যটি প্রথম শ্লোকের শুরুতে পরিণত হয় যা শতশ্লোককে প্রকৃত শ্লোকের মালা করে তোলে। প্রাচীনতম সাধুদের রচনাগুলি বৈষ্ণবধর্মের দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ধারণাগুলিতে অবদান রেখেছিল। [১৪] এই ত্রয়ীদের শ্লোকে নারায়ণ (বিষ্ণুর অপর নাম) কথা বলা হয়েছে এবং তাঁরা প্রায়শই বিষ্ণুর অবতার ত্রিবিক্রম ও কৃষ্ণের কথা উল্লেখ করেছেন। [১৯][২০]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন