কারখানা

শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণের সুবিধাবিশিষ্ট স্থান
(ফ্যাক্টরি থেকে পুনর্নির্দেশিত)

কারখানা বা শিল্প-কারখানা হচ্ছে সাধারণত ভবন ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি শিল্পোৎপাদন স্থল। আরো সাধারণভাবে বলতে এটি হল কয়েকটি ভবনের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্থাপনা, যেখানে শ্রমিকরা বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদন অথবা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য যন্ত্রসমূহ পরিচালনা করেন।

জার্মানির মোটরযান নির্মাতা ফোকসভাগেন কোম্পানির শিল্পকারখানা, ভোলফসবের্গ, জার্মানি

শিল্প বিপ্লবের সময় যন্ত্রপাতি ও মেশিনারি উদ্ভাবনের সাথে সাথে বিভিন্ন কারখানা গড়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে কুটির শিল্প বা কর্মশালার থেকে অধিক মূলধন ও জায়গার প্রয়োজন হতো। প্রথম দিকের কারখানাগুলিতে অল্প সংখ্যক যন্ত্রপাতি থাকত। যেমন এক বা দুইটি সুতা কাটার চরকা এবং এক ডজনের চেয়েও কম শ্রমিকযুক্ত কারখানাকে "সুখ্যাত কারখানা" বলা হয়েছে। [১]

অধিকাংশ আধুনিক কারখানায় বড় গুদাম বা গুদাম-এর মতো বিস্তৃত জায়গার সুবিধা রয়েছে যাতে পণ্যের বিভিন্ন অংশ সংযোজনের জন্য ব্যবহৃত ভারী যন্ত্রপাতি রাখা হয়। বড় কারখানাগুলো একাধিক পরিবহন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত থাকে। যেমন- রেলপথ, মহাসড়ক এবং জলপথে মালামাল বোঝাই এবং খালাসসের ব্যবস্থা থাকে।

কারখানায় পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে উৎপাদিত দ্রব্য এবং ধারাবাহিকভাবে উৎপাদিত দ্রব্য । যেমন - রাসায়নিক পদার্থ, মণ্ড ও কাগজ, পেট্রোলিয়াম উভয়ই তৈরি করতে পারে। রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলিকে প্রায়শই ইংরেজিতে প্ল্যান্ট (Plant) বলা হয় এবং তাদের অধিকাংশ সরঞ্জাম - টাঙ্কি, চাপীয় প্রকোষ্ঠ, রাসায়নিক চুল্লী, নিষ্কাশনযন্ত্র (পাম্প) এবং নলব্যবস্থা (পাইপিং) ইত্যাদি বাইরে রাখতে দেখা যায় এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পরিচালিত হতে পারে । তেল পরিশোধনাগারের অধিকাংশ সরঞ্জাম উন্মুক্ত স্থানে থাকে।

বিচ্ছিন্ন পণ্যসমূহ চূড়ান্ত ভোগ্যপণ্য সামগ্রী, অথবা পণ্যের অংশ এবং উপাংশ হতে পারে, যা থেকে চূড়ান্ত ভোগ্যপণ্য তৈরি হতে পারে। কারখানাগুলিতে বাইরে থেকে কাঁচামাল সরবরাহ করা যেতে পারে অথবা তারা নিজেরাই কাঁচা মাল তৈরি করতে পারে। ক্রমাগত উৎপাদন শিল্পে কাঁচামালের প্রবাহকে চূড়ান্ত পণ্যে রূপান্তরিত করতে সাধারণত তাপ বা বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করা হয়।

"কল" (ইংরেজি মিল) শব্দটি মূলত ব্যবহৃত হয় শস্য পিষ্টকরণ ও চূর্ণকরণ যন্ত্রের ক্ষেত্রে। উনবিংশ শতাব্দীতে সাধারণত প্রাকৃতিক সম্পদ। যেমন- জলীয় বা বায়বীয় শক্তিকে বাষ্পীয় শক্তিতে পরিণত করে এ ধরনের যন্ত্র চালানো হত। যেহেতু, সুতা কর্তন ও বয়ন, লৌহ ঘূর্ণন, এবং কাগজ উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলি মূলত জলের দ্বারা পরিচালিত হত, তাই ইংরেজিতে স্টিল মিল, পেপার মিল শব্দগুলি এখনও ব্যবহৃত হয়।

নিরাপত্তা ম্যাচ উৎপাদন জন্য জিলিনা (স্লোভাকিয়া) তে পুনর্নির্মিত ঐতিহাসিক কারখানা। মূলত 1915 সালেউইটেনবার্গ এন্ড সন্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্মিত ।

ইতিহাস

ভেনিসীয় অস্ত্রগারের প্রবেশদ্বার। ১৭৩২ সালে কানালেত্তোর আঁকা চিত্র ।
লায়েম রেগিস জলচালিত কলের অভ্যন্তর, যুক্তরাজ্য (১৪ শতক)।

মাক্স ভেবার প্রাচীনকালের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীকে অনিশ্চিত হিসেবে বিবেচনা করতেন, কারণ সে সময়কার উৎপাদন পদ্ধতি এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, শিল্পের আধুনিক বা এমনকি প্রাক-আধুনিক বিকাশের তুলনায় কিছুই ছিল না। প্রাচীনকালে, উৎপাদন ব্যবস্থা গৃহস্থালির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যা বসবাসের স্থান এবং উৎপাদনকে অভিন্ন রাখার উদ্যোগ হওয়ায় শিল্পের মত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল। এগুলো "অধীনস্থ বিপণি শিল্প" হিসাবে পরিচিত ছিল। বিশেষত মিশরীয় ফারাওয়ের শাসনে, ক্রীতদাস নিয়োগ এবং আধুনিক শ্রম বিভাগের ন্যায় দাস শ্রেণীর মধ্যে দক্ষতার কোন পার্থক্য করা হত না। [২][৩][৪]

ডেমোথেনেস এবং হেরোডোটাসের অনুবাদ অনুসারে, নোক্রাতিস সমগ্র প্রাচীন মিশরের একমাত্র কারখানা ছিল। [৫][৬][৭] হপকিন্স (১৯৮৩) এর একটি সূত্রমতে, প্রাচীনকালের সবচেয়ে বড় উৎপাদন কারখানা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর এথেন্সে যাতে ১২০ জন ক্রীতদাস কর্মরত ছিল। [৮] ১৩ই অক্টোবর, ২০১১ তারিখের নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে:

"In African Cave, Signs of an Ancient Paint Factory" (আফ্রিকান গুহায়, প্রাচীন রঙের কারখানার নিদর্শন) – জন নোবেল উইলফোর্ড

... দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত একটি গুহা ব্লোম্বস গুহায় ১০০,০০০ বছর আগের বিভিন্ন সরঞ্জাম এবং উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছিল, যার সাথে প্রাক-আধুনিক মানুষেরা গৈরিক মাটি-ভিত্তিক রং মিশ্রিত করেছিল। [৯]

যদিও ক্যামব্রিজ অনলাইন অভিধান অনুসারে কারখানার সংজ্ঞা হল:

একটি ভবন বা স্থাপনার সমষ্টি যেখানে কলকব্জার সাহায্যে প্রচুর পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করা হয়। [১০]

অন্যত্র বলা হয়েছে যে:

... যন্ত্রের সদ্ব্যবহারের পূর্বশর্ত হল সামাজিক সহযোগিতা এবং শ্রমের বিভাজন

— ফন মাইসেস [১১]

একটি সূত্রমতে, মনুষ্যসৃষ্ট প্রথম মেশিন হল প্রাণী ধরার কাজে ব্যবহৃত ফাঁদ। এক্ষেত্রে, মেশিনের সাথে সংশ্লিষ্ট বৈশিষ্ট্য গুলি হল, এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা খুব সামান্য মনুষ্যশক্তি দ্বারা পরিচালিত একটি যান্ত্রিক কৌশল, যা কোন কাজ একইভাবে বারবার করতে সক্ষম। [১২] খ্রিষ্টপূর্ব ৩,০০০ সালে চাকা উদ্ভাবন করা হয় আর স্পোকঅলা চাকা তৈরি হয় খ্রিষ্টপূর্ব ২,০০০ সনে। প্রায় ১,২০০-১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লৌহ যুগ শুরু হয়। [১৩][১৪] অন্যান্য সূত্রে মেশিনারি বা কলকব্জাকে উৎপাদনের একটি উপায় হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। [১৫]

প্রত্নতত্ত্ব হতে, ৫,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীনতম শহর টেল ব্রাক (ঊর et al. ২০০৬) এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। সম্প্রদায়ের বৃহৎ আকার এবং জনসংখ্যা থেকে এর চাহিদা এবং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের ধারণা পাওয়া যায়। অতএব, এখানে শিল্প পর্যায়ের কারখানার অস্তিত্বের অপরিহার্যতা সহজেই অনুমেয়। [১৬][১৭][১৮]

৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে ফার্সি সাম্রাজ্যে প্রথম জল কল তৈরি হয়। [১৯] চতুর্থ শতকের সময়, দিন প্রতি ২৮ টন শস্য চূর্ণ করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জল-কল স্থাপন করা হয়েছিল। [২০] যা রোমান সাম্রাজ্যের ৮০,০০০ ব্যক্তির চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। [২১][২২][২৩]

অষ্টম শতাব্দী থেকে ইসলামিক জগতে সর্বপ্রথম প্রকৃত কারখানা স্থাপন শুরু হয়। মধ্যযুগীয় ইসলামী শহরগুলিতে বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে, যেমন বাগদাদের জনসংখ্যা ছিল ১.৫ মিলিয়ন। এই বিপুল বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার ভরণপোষণের জন্যে বৃহৎ মাপের এবং উচ্চ উৎপাদনক্ষম কারখানা স্থাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, দশম শতাব্দীতে মিশরের বিলবে শহরের একটি শস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায়, প্রতিদিন আনুমানিক ৩০০ টন শস্য এবং আটা উৎপাদন হত।[২০] সে সময় জল কল ও বায়ু কল উভয়ই ইসলামী বিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত। [২৪]

ভেনিস আর্সেনাল প্রথম দিকের আধুনিক কারখানার একটি উদাহরণ। এটি শিল্প বিপ্লবের কয়েকশত বছর আগে, ১১০৪ সালে ভেনিস প্রজাতন্ত্রের ভেনিসে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি নির্মিত যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে অ্যাসেম্বলী লাইনে জাহাজ গণউৎপাদন করত। ভেনিস আর্সেনাল দৃশ্যত প্রতিদিন একটির মত জাহাজ তৈরি করত এবং সর্বোচ্চ অবস্থায় তারা ১৬,০০০ জন কর্মী নিযোগ করেছিল।[২৫]

শিল্প বিপ্লব

ক্রোমফোর্ড মিল বর্তমান অবস্থায়

প্রথমদিকের কারখানাগুলোর মধ্যে একটি হল ১৭১২ সালে ডার্বিতে চালু হওয়া জন লোম্বের পানি চালিত রেশম মিল (ডার্বি সিল্ক মিল)। ১৭৪৬ সাল নাগাদ ব্রিস্টলের কাছে ওয়ার্মলিতে একটি সমন্বিত পিতল কারখানা ছিল। এই কারখানায় একদিক দিয়ে কাঁচামাল প্রবেশ করানো হত, এরপর তা গলানোর পর প্যান, পিন, তার এবং অন্যান্য পণ্য তৈরি করা হত। সেখানে শ্রমিকদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা চালু করা হয়। স্টাফোর্ডশায়ারের জোসিয়াহ ওয়েজউড এবং সোহো কারখানার ম্যাথিউ বোল্টন ছিলেন তখনকার বিশিষ্ট শিল্পপতিদের মধ্যে অন্যতম, যারা সে সময় কারখানা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছিলেন।

যান্ত্রিক তুলো কাটার চরকা উদ্ভাবনের কিছুদিন পরেই কারখানা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

রিচার্ড আর্করাইট আধুনিক কারখানার মূল প্রতিরূপ উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেয়া হয়। ১৭৬৯ সালে পানি ফ্রেম পেটেন্ট করার পর তিনি ডার্বিশায়ার, ইংল্যান্ডে ক্রোমফোর্ড মিল প্রতিষ্ঠা করেন, যার ফলে অভিবাসী শ্রমিকদের স্থানসংকুলানের জন্য ক্রোমফোর্ড গ্রাম ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। এই কারখানা ব্যবস্থাটি ছিল জনবল সংগঠিত করার একটি নতুন পন্থা, যা বৃহৎ আকারের মেশিনারি পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল। এখানে কাজের সময়সূচী ছিল কৃষকদের অনুরূপ, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, সপ্তাহে ছয় দিন। সামগ্রিকভাবে, এই ব্যবস্থার ফলে দক্ষ এবং অদক্ষ কর্মীরা প্রতিস্থাপনযোগ্য হয়ে ওঠে। আর্করাইটের কারখানা ছিল বিশ্বের প্রথম সফল তুলো কাটার কারখানা; যা দ্ব্যর্থহীনভাবে শিল্পের ভবিষ্যৎ অবস্থাকে প্রতিফলিত করেছিল এবং এটিকে ব্যাপকভাবে অনুকরণ করা হয়েছিল।

১৭৭০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে যন্ত্রচালিত কারখানাগুলোর কারণে প্রথাগত কারিগরি কারখানাগুলো উচ্ছেদ হয়ে যায়, কারণ ছোট কারিগরি দোকানগুলির তুলনায় বড় আকারের কারখানাগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত ও রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা পাওয়া যেত। [২৬] প্রথমদিকে কারখানা ব্যবস্থা স্থাপন করা কারখানাগুলো তুলো এবং উল বয়ন শিল্পে উন্নতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ের কারখানাগুলিতে যান্ত্রিক জুতা তৈরি, মেশিনারি উৎপাদন সহ যান্ত্রিক সরঞ্জামাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। রেলপথ শিল্পে সরবরাহকারী কারখানাগুলির মধ্যে রোলিং মিল, ঢালাইয়ের কারখানা এবং লোকোমোটিভ সংক্রান্ত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কৃষি-সরঞ্জামের কারখানাগুলি ইস্পাতের ঢালাই করা লাঙল এবং ফসল কাটার যন্ত্র তৈরি করত। ১৮৮০ এর দশকে ব্যাপকভাবে বাইসাইকেল উৎপাদন শুরু হয়।

ন্যাশমিথ, গাস্কেল এন্ড কোম্পানি (ব্রিজওয়াটার ফাউন্ড্রি) ১৮৩৬ সালে যাত্রা শুরু করে। এটি প্রথম দিকের কারখানাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল যারা ভারী জিনিস বহন করার জন্য ভবনের মধ্যে ক্রেন এবং রেল ট্র্যাকের মতো আধুনিক ব্যবস্থা স্থাপন করে। [২৭]

১৯০০ সালের দিকে এসি মোটর উদ্ভাবনের পরে কারখানাগুলিতে বড় পর্যায়ে বৈদ্যুতীকরণ শুরু হয়। বৈদ্যুতিক ফ্রিকোয়েন্সি এবং পোলের উপর নির্ভর করে এসি মোটর ধ্রুবগতিতে চলতে পারত।[২৮] প্রথমদিকে লাইন শ্যাফটের সাথে বড় বড় মোটর যুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু যখন ছোট ক্ষমতাসম্পন্ন মোটর বাজারে চলে আসে তখন, কারখানাগুলো ইউনিট ড্রাইভ স্থাপন করে। লাইন শ্যাফট অপসারণ করার ফলে কারখানাগুলো জায়াগার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয় এবং কারখানার লেআউট আরো কার্যকরী হয়ে ওঠে। বৈদ্যুতীকরণের ফলে রিলে লজিক ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমিক স্বয়ংক্রিয়করণের প্রচলন শুরু হয়।

অ্যাসেম্বলী বা সন্নিবেশন সারি

কারখানা স্বয়ংক্রিয়করণের উদাহরণস্বরূপ জার্মানির একটি বেকারিতে রুটি এবং টোস্টের মত খাদ্য পণ্য প্যালেটাইজ করতে শিল্প রোবটের ব্যবহার

বিংশ শতকের প্রথম দিকে গণউৎপাদনের ধারণা উদ্ভাবনের সাথে হেনরি ফোর্ড কারখানার ধারনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। এক্ষেত্রে, সুদক্ষ শ্রমিকরা একটি চলমান র‍্যাম্পের ধারে কাজের ধারা অনুসারে পাশাপাশি অবস্থান নিতেন এবং পণ্য (যেমন, ফোর্ডের ক্ষেত্রে গাড়ি) তৈরি ও সন্নিবেশনের কাজ করতেন। এই ধারনাটির বাস্তবায়নের ফলে নাটকীয়ভাবে প্রায় সমস্ত পণ্যের জন্য উৎপাদন খরচ কমে আসে এবং ভোগবাদী যুগের সূচনা হয়। [২৯]

বিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে শিল্পোন্নত দেশগুলি পরবর্তী-প্রজন্মের কারখানার প্রবর্তন করে যাতে দুটি উন্নত বৈশিষ্ট্য সংবলিত ছিল:

  1. আমেরিকান গণিতবিদ উইলিয়াম এডওয়ার্ডস ডেমিং কর্তৃক প্রবর্তিত মান নিয়ন্ত্রণের জন্য উন্নত পরিসংখ্যান সংক্রান্ত পদ্ধতির অনুসরণ (যিনি তার নিজ দেশে প্রাথমিকভাবে উপেক্ষিত হয়েছিলেন, কিন্তু জাপান তাকে স্বাগত জানায়)। সঠিক মান নিয়ন্ত্রণের ফলে জাপানী শিল্প কারখানাগুলো, পণ্যের গুণমান ও দামের ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থান লাভ করেছে।
  2. ১৯৭০ এর দশকের শেষ দিকে, কারখানার কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে শিল্প রোবট এর ব্যবহার চালু হয়। ২৪ ঘণ্টা ধরেই এসব কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত রোবট ঢালাইএর যন্ত্র এবং গ্রিপার দ্বারা সহজে, দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে গাড়ীর দরজা সংযুক্ত করা যেত। এর ফলে খরচ কমে আসত এবং দ্রুত কাজ করা যেত।

ভবিষ্যতের কারখানার সম্পর্কে কিছু ধারণা [৩০] হিসাবে র‍্যাপিড প্রোটোটাইপিং, ন্যানো প্রযুক্তি, অরবিটাল জিরো-গ্র্যাভিটি প্রভৃতির উল্লেখ করা যায় [৩১]

ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখযোগ্য কারখানা

হাইল্যান্ড পার্ক ফোর্ড প্ল্যান্ট, 1922
  • ভেনেশিয়ান আর্সেনাল
  • ক্রমফোর্ড মিল
  • লোম্ব'স মিল
  • সোহো কারখানা
  • পোর্টসমাউথ ব্লক মিলস্
  • স্ল্যাটার মিল
  • লোয়েল মিলস্
  • স্প্রিংফিল্ড অস্ত্রাগার
  • হারপার্স ফেরি অস্ত্রাগার
  • নাসমিথ, গ্যাস্কেল এন্ড কোম্পানি, ব্রিজওয়াটার ফাউন্ড্রি নামেও পরিচিত
  • বল্ডউইন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস
  • হাইল্যান্ড পার্ক ফোর্ড প্ল্যান্ট
  • ফোর্ড রিভার রুজ কমপ্লেক্স
  • হথ্রোন ওয়ার্কস

কারখানার অবস্থান নির্বাচন

১৯৪০ সালের একজন কারখানা কর্মী, ফোর্ট ওয়ার্থ, টেক্সাস যুক্তরাষ্ট্র

গনপরিবহনের প্রচলনের আগে কারখানায় অধিক শ্রমিকের চাহিদার মেটানোর জন্য সেগুলো হয় শহুরে এলাকায় গড়ে উঠত নয়ত নিজেদের আশেপাশে নগর তৈরি করত। এর ফলে শিল্প এলাকায় বস্তি গড়ে ওঠে আর কারখানাগুলির মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আরও উন্নতি করতে থাকে। কারণ একটি কারখানার উতপাদিত পণ্য বা বর্জ্য পদার্থ কাছাকাছি অন্যান্য কারখানার কাঁচামাল হয়ে ওঠে। কারখানার প্রসারের সাথে সাথে সাশ্রয়ী শক্তির উৎস, কাঁচামাল এবং/অথবা বাজারের আশেপাশে খালরেলপথ জড়ো হতে থাকে। এমনকি, বোর্নভিলের মত গ্রামীণ কারখানা অঞ্চলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার জন্য নিজস্ব আবাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।[৩২]

ব্রিটেনে কারখানা আইনের কয়েকটি ধারার বিধি প্রবর্তনের ফলে কারখানা-ভিত্তিক সমাজের উপর শিল্পায়নের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের কিছু বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। ট্রাম, মোটরগাড়ি এবং নগর পরিকল্পনার উন্নয়ন শিল্প শহরতলি এবং আবাসিক অঞ্চলের আলাদা এবং স্বতন্ত্র বিকাশ ত্বরান্বিত হয়, যার মধ্যে শ্রমিকরা যাতায়াত শুরু করে।

শিল্প বিপ্লবের যুগে কারখানাগুলো প্রভাবশালী থাকলেও, সেবাদানকারী সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের আধিপত্য কমে আসে। [যাচাই প্রয়োজন] সাধারণ শ্রমিকরা কেন্দ্রীয় শহুরে অফিস টাওয়ার বা মফস্বলের স্থাপনা প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর ফলে গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বহু স্থানীয় কারখানা "রাস্ট বেল্ট" এ পরিত্যাক্ত হয়েছিল।

ঐতিহ্যবাহী কারখানাগুলোর উপর পরবর্তী আঘাত আসে বিশ্বায়ন থেকে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের উৎপাদন কারখানাগুলো (অথবা অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট) উন্নয়নশীল দেশেসমূহের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা শিল্পায়িত রাজ্যের সীমানায় অবস্থিত শুল্ক-মুক্ত কারখানাগুলোর প্রতি মনোযোগ দিচ্ছিল। ভবিষ্যতে আউটসোর্সিং এবং পরিবর্তনযোগ্য অবস্থানের সুবিধার কারণে কম শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনাও প্রতীয়মান হচ্ছে। [যাচাই প্রয়োজন]

কারখানা পরিচালনা

কারখানার প্রক্রিয়াগুলি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে বেশিরভাগ ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব বিকশিত হয়।[যাচাই প্রয়োজন] অদক্ষ, অর্ধ-দক্ষ, দক্ষ শ্রমিক, তাদের সুপারভাইজার এবং পরিচালকদের অনুক্রমের ধারণা এখনও প্রচলিত। যদিও, উৎপাদন ব্যবস্থার আরো সমসাময়িক পদ্ধতির একটি উদাহরণ হচ্ছে আর্থ-কারিগরি ব্যবস্থা (Socio-Technical Systems, STS)।

ছায়া কারখানা

ছায়া কারখানা বলতে যুদ্ধের সময় শত্রু কর্তৃক বোমাহামলা এড়াতে এবং একই সাথে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির দ্বৈত উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মিত উৎপাদন স্থলকে বোঝানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেনে অনেকগুলো ছায়া কারখানা নির্মাণ করেছিল।

ব্রিটিশ ছায়া কারখানা

সাউন্ডাম্পটন -এর ওলস্টন- এ অবস্থিত সুপারমারিন স্পিটফায়ার উৎপাদনের মূলঘাঁটি শত্রুদের আক্রমণের একটি শীর্ষ লক্ষ্য ছিল এবং একইসাথে লুফটওয়াফ বোমারুদের পরিসরের মধ্যে ছিল। প্রকৃতপক্ষেই, ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৪০ সালে এই কারখানাটি শত্রুদের বোমা হামলার কবলে পড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সুপারমারিন তার আগেই কাসল ব্রোমভিচ এ একটি প্লান্ট প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকারের চাপে তারা স্পিটফায়ার উৎপাদনকে দেশজুড়ে আরও অনেক স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। [৩৩]

স্পিটফায়ারের সাথে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ রোলস-রয়স মার্লিন ইঞ্জিনের উৎপাদনও যুক্ত ছিল। ডার্বিতে রোলস-রয়স এর প্রধান বিমান ইঞ্জিন তৈরির কারখানা ছিল। এর বাড়তি উৎপাদন চাহিদা ক্রু ও গ্লাসগোতে নতুন কারখানা তৈরি করে এবং ট্র্যাফোর্ড পার্ক, ম্যানচেস্টারে ফোর্ডের একটি বিশেষায়িত কারখানা ব্যবহার করে পূরণ করা হত। [৩৪]

গ্যালারি

আরও দেখুন

  • ব্রিটিশ ছায়া কারখানা
  • কোম্পানি শহর
  • কারখানা কৃষি
  • কারখানা ব্যবস্থা
  • শিল্প রোবট
  • শিল্প রেলওয়ে
  • শিল্প বিপ্লব
  • উৎপাদন বিষয়ের তালিকা
  • লকআউট (শিল্প)
  • শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন
  • কারখানা নকশা প্রণয়ন
  • সফটওয়্যার কারখানা

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

আরও পড়ুন

  • Christian, Gallope, D (1987) "Are the classical management functions useful in describing managerial processes?" Academy of Management Review. v 12 n 1, pp. 38–51
  • Peterson, T (2004) "Ongoing legacy of R.L. Katz: an updated typology of management skills", Management Decision. v 42 n10, pp. 1297–1308
  • Mintzberg, H (1975) "The manager's job: Folklore and fact", Harvard Business Review, v 53 n 4, July – August, pp. 49–61
  • Hales, C (1999) "Why do managers do what they do? Reconciling evidence and theory in accounts of managerial processes", British Journal of Management, v 10 n4, pp. 335–50
  • Mintzberg, H (1994) "Rounding out the Managers job", Sloan Management Review, v 36 n 1 pp. 11–26.
  • Rodrigues, C (2001) "Fayol's 14 principles then and now: A plan for managing today's organizations effectively", Management Decision, v 39 n10, pp. 880–89
  • Twomey, D. F. (2006) "Designed emergence as a path to enterprise", Emergence, Complexity & Organization, Vol. 8 Issue 3, pp. 12–23
  • McDonald, G (2000) Business ethics: practical proposals for organisations Journal of Business Ethics. v 25(2) pp. 169–85

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন