বত্রিশ সিংহাসন
বত্রিশ সিংহাসন বা সিংহাসন বত্তিসি ভারতীয় লোককাহিনীর একটি সংগ্রহ। বত্রিশ সিংহাসন শিরোনামের আক্ষরিক অর্থ হল "সিংহাসনের বত্রিশটি গল্প"। গল্পে ১১শ শতকের রাজা ভোজ কিংবদন্তি প্রাচীন রাজা বিক্রমাদিত্যের সিংহাসন আবিষ্কার করেন। সিংহাসনে ৩২টি পুতুল রয়েছে, যারা আসলে অপ্সরা। তারা কোন এক অভিশাপের কারণে পাথরে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি অপ্সরা ভোজকে বিক্রমাদিত্যের জীবন এবং দুঃসাহসিক কার্য সম্পর্কে একটি করে গল্প বলে যাতে বোঝানো যায় যে ভোজ বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনের যোগ্য নন।
মূল শিরোনাম | সিংহাসন দ্বাত্রিংশিকা |
---|---|
দেশ | ভারত |
ভাষা | সংস্কৃত |
ধরন | কিংবদন্তি |
সংস্কৃতে লেখা মূল সংগ্রহটি সিংহাসন দ্বাত্রিংশিকা নামে পরিচিত ছিল। 'বত্রিশ সিংহাসন' কাহিনিমালার অন্যান্য নাম দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা ("বত্রিশটি পুতুলের গল্প"), বিক্রমাদিত্য সিংহাসন দ্বাত্রিংশিকা ("বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনের বত্রিশ গল্প"), এবং বিক্রম চরিত (" বিক্রমের দুঃসাহসিক কার্য বা ক্রিয়াকলাপ")। [১] আধুনিক আঞ্চলিক ভাষায়, সংগ্রহটি সিংহাসন বত্তিসি নামে পরিচিত; শিরোনামের অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে সিনহাসন বট্টিসি এবং সিমহাসন বত্তিসি ।
পটভূমি
একবার রাজা ভোজ তার রাজকীয় বাহিনী নিয়ে একজন ব্রাহ্মণের একটি মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ব্রাহ্মণ একটি উঁচু ঢিবির উপর থেকে তার পুরো ক্ষেত্রটি দেখে রাজাকে তার ক্ষেতের তাজা ফসলের স্বাদ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ব্রাহ্মণের মাঠে রাজার আগমনের পর, তিনি পাখিদের তাড়াতে তার আসন ছেড়ে দেন। এর পরে তিনি কৃপণভাবে তার মাঠে রাজার প্রবেশের বিরোধিতা করেন এবং তার বিরুদ্ধে গুরুতর অনুপ্রবেশ এবং নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন যার ফলে রাজা অবিলম্বে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। পাখিদের তাড়িয়ে দেওয়ার পর, ব্রাহ্মণ ঢিবির উপর বসতে পুনরায় ফিরে আসে। তারপরে ব্রাহ্মণ আবার রাজা ভোজকে মাঠে ফিরে এসে ফসলের স্বাদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। পুনরায় একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি হয়, এবং ভোজ উৎসাহী হয়ে চিন্তা করেন যে ঢিবি ও সমতলে থাকাকালীন ব্রাহ্মণের আচরণ কীভাবে পরিবর্তিত হয়।
তিনি অবগত হলেন যে শুধুমাত্র ঢিবির উপর পা রাখার মাধ্যমে, কারো হৃদয়ে সমস্ত মহৎ বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পায় এবং ভালবাসা, ন্যায় গুণে পূর্ণ হয়। এরপর ভোজের সৈন্যরা ঢিবি খনন করতে শুরু করল এবং একটি সিংহাসন খুঁজে পায়। সিংহাসনটি প্রাচীন সম্রাট বিক্রমাদিত্যের হিসাবে চিহ্নিত করা হয় যিনি তার ন্যায়পরায়ণতার জন্য সুপরিচিত এবং সম্মানিত ছিলেন। ভোজের উপদেষ্টারা তাকে বলে যে তিনি সিংহাসনে বসলে তিনিও সেরা বিচার করতে সক্ষম হবেন।
সিংহাসনটি ৩২টি অপ্সরার পুতুল দ্বারা সজ্জিত ছিল। ভোজ যেই মূহুর্তে সিংহাসনে বসতে যাবেন, তখন পুতুলগুলির মধ্যে একটি জাগ্রত হয় এবং হেসে রাজাকে বলে যে কেবল সিংহাসনে বসে থাকলে তিনি মহান বিচারক হতে পারবেন না: কারণ তার অন্যান্য গুণাবলীর অভাব রয়েছে। অপ্সরা তাকে সৎ গুণের সাথে সম্পর্কিত বিক্রমাদিত্যের একটি গল্প বলে যা একজন ভাল বিচারকের অবশ্যই থাকতে হবে। গল্প কথনের শেষে অপ্সরা উড়ে চলে যায়। একই ভাবে একের পর এক অপ্সরারা বিক্রমাদিত্যের গুণ সম্পর্কিত একটি গল্প বলে অন্তর্হিত হয়। ভোজ বুঝতে পারেন যে তার এমন গুণাবলী নেই যা তাকে সিংহাসনে বসার যোগ্য করে তুলতে পারে। বিক্রমাদিত্যের এই গুণগুলির মধ্যে কয়েকটি হল নিঃস্বার্থতা, সম্পূর্ণ সততা, পক্ষপাতিত্বের অভাব এবং ন্যায়বিচার প্রদানের জন্য সত্যিকারের তাগিদ।
লেখকত্ব এবং সময়কাল
'বত্রিশ সিংহাসন' গ্রন্থের প্রকৃত লেখক এবং সময়কাল অজানা। যেহেতু গল্পে ভোজের (মৃত্যু ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখ রয়েছে, তাই এটি অবশ্যই একাদশ শতকের মধ্যে বা তার পরে রচিত হয়েছে। [২]
সংস্কৃত সংস্করণ সিংহাসন-দ্বাত্রিংসিকার পাঁচটি প্রাথমিক সংশোধিত গ্রন্থ ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর। [৩]
সুজন রাই রচিত খুলসাত-উত-তাওয়ারীখ (১৬৯৫ খ্রি.) দাবি করেন যে রচনাটি ভোজের মন্ত্রী পণ্ডিত ব্রজ রচনা করেছিলেন। [৪]
অনুবাদ
আবদুল কাদির বাদাউনি মুঘল সম্রাট আকবরের জন্য গল্পগুলি ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন যার নাম - খিরাদ আফজা ("জ্ঞান-বর্ধক বই")। অনুবাদটি ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয়েছিল। [৫] [৬] অন্যান্য ফার্সি অনুবাদের মধ্যে রয়েছে গুল আফশান [৪] এবং সেঙ্গুয়েহাসেন বত্তিসি । [৩]
লাল্লু লাল এবং কাজিম আলী জবান এটি হিন্দিতে অনুবাদ করেন। [৭] ১৮১৪-১৫ সালে, উইলিয়াম কেরি পঞ্চতন্ত্র এবং হিতোপদেশ সহ সিংহাসন বত্তিসি শিরোনামে মারাঠি অনুবাদ প্রকাশ করেন। [৮] ১৭শ শতাব্দীর কবি শমল ভট্ট এই গল্পগুলিকে আখ্যানমূলক কবিতায় রূপান্তরিত করেছিলেন।
ফ্র্যাঙ্কলিন এডগারটন এর চারটি জনপ্রিয় সংস্করণে এটিকে "দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ বিক্রম " হিসাবে অনুবাদ করেছেন। 'সিংহাসন বত্তিসি' কখনও কখনও বৈতাল পচিসি সহ প্রকাশিত হয়।
কোরাভি গোপারাজু এটি তেলেগু ভাষায় ১৫শ শতাব্দীতে সিংহাসন দ্বাত্রিংসিকা নামে অনুবাদ করেন। অনুবাদটি অন্ধ্র সাহিত্য পরিষদ, কাকিনানা দ্বারা ১৯৩৬ সালে বেম্পরালা সূর্যনারায়ণ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। [৯] পরবর্তীকালে অন্ধ্রপ্রদেশ সাহিত্য আকাদেমি, হায়দ্রাবাদ ১৯৮২ সালে এক খণ্ডে প্রকাশ করে। সম্পাদক গাদিয়ারাম রামকৃষ্ণ শর্মা এতে একটি বিস্তারিত মুখবন্ধ লিখেছেন। [১০]
টেলিভিশন অভিযোজন
১৯৮৫ সালে দূরদর্শনে সিংহাসন বত্তিসির একটি টেলিভিশন অভিযোজন প্রচারিত হয়েছিল। ২০১৪ সালে, আরেকটি অভিযোজন সনি পাল- এ প্রচারিত হয়েছিল। [১১] ভারতীয় অ্যানিমেটেড টেলিভিশন সিরিজ, সিংহাসন বত্তিসি, শেঠিয়া অডিও এবং ভিডিও দ্বারা নির্মিত, যা পোগোতে ২০১১-১২ থেকে প্রচারিত হয়েছিল। [১২]
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
- Vikram & Vetaal - containing the Singhasan Battisi and the Baital Pachisi (Annotated)
- All the 32 Stories of Singhasan Battisi, along with illustrations