লোমশ ম্যামথ
লোমশ ম্যামথ (Mammuthus primigenius) ম্যামথের একটি বিলুপ্ত প্রজাতি। এই প্রজাতিটি প্লাইস্টোসিন কালে পৃথিবীতে টিকে ছিল এবং ম্যামথ প্রজাতির মধ্যে সর্বশেষ প্রজাতি এই লোমশ ম্যামথ। পূর্ব এশিয়ার ম্যামথ অঞ্চল থেকে প্রায় ৪ লক্ষ বছর আগে লোমশ ম্যামথের উত্থান ঘটে। এশীয় হাতিকে এই লোমশ ম্যামথের দূরবর্তী আত্মীয় বলা যায়। প্রাক-ঐতিহাসিক প্রাণী প্রজাতির মাঝে লোমশ ম্যামথের প্রকৃতি ও আচরণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা হয়েছে। সাইবেরিয়া ও আলাস্কায় এই ম্যামথের কঙ্কাল, দাঁত, পাকস্থলী, মল এমনকি দেহাবশেষ বরফে আচ্ছ্বাদিত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন গুহাচিত্রেও চিত্রাঙ্কিত লোমশ ম্যামথের জীবনযাত্রা নিয়ে আভাষ পাওয়া যায়। ১৭শ শতকের দিকে ইউরোপের ম্যামথের পরিচয় পাওয়ার আরো অনেক আগে থেকেই এশিয়ায় ম্যামথের অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। বিভিন্ন বিতর্ক থাকলেও ১৭৯৬ সালে জর্ক ক্যুভিয়ে হাতির বিলুপ্তপ্রাপ্ত প্রজাতি হিসেবে ম্যামথকে তালিকাভূক্ত করেন।
লোমশ ম্যামথ সময়গত পরিসীমা: মধ্য প্লাইস্টোসিন - প্রাক হলোসিন ০.০৪–০.০০০৩৭কোটি | |
---|---|
সবচেয়ে বৃহৎ ইউরোপীয় প্রাণী, একটি পুরুষ ম্যামথ। | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
মহাজগত: | সংবাহী উদ্ভিদ (ট্র্যাকিওফাইট) |
জগৎ/রাজ্য: | অ্যানিম্যালিয়া (Animalia) |
পর্ব: | কর্ডাটা |
শ্রেণি: | স্তন্যপায়ী (ম্যামেলিয়া) |
বর্গ: | Proboscidea |
পরিবার: | Elephantidae |
গণ: | †Mammuthus (ব্লুমেনবাখ, ১৭৯৯) |
প্রজাতি: | †M. primigenius |
দ্বিপদী নাম | |
†Mammuthus primigenius (ব্লুমেনবাখ, ১৭৯৯) | |
সংগ্রহকৃত ফসিল থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে মানচিত্রে প্লাইস্টোসিন যুগের শেষের দিকে M. primigenius এর বসতি। নীলা রঙের অংশ সেই সময়ে ভূ-অঞ্চল ছিল। | |
প্রতিশব্দ | |
তালিকা:
|
লোমশ ম্যামথ আকৃতিতে প্রায় আধুনিক আফ্রিকান হাতির ন্যায় ছিল। পুরুষ ম্যাম্থের কাঁধের উচ্চতা ২.৭ এবং ৩.৪ মি (৮ ফু ১০ ইঞ্চি এবং ১১ ফু ২ ইঞ্চি)এবং ওজন ৬ মেট্রিক টন পর্যন্ত হত। নারী ম্যামথের কাঁধের উচ্চতধেরপর্যন্ত হত। এরা ওজনের দিক দিয়ে ৪ মেট্রিক টন (প্রায়) হত। বাচ্চা ম্যাম্থের ওজন ৯০ কিলোগ্রাম (২০০ পা) হত। শেষ বরফ যুগের ঠান্ডা পরিবেশে লোমশ ম্যামথ সহজেই মানিয়ে নিয়েছিল। শরীরের লোমস বহির্ভাগ অনেকটা চাদরের মতো শীত থেকে এদের নিরাপত্তা দিত। শীতের আধিক্য থেকে রক্ষায় এদের ছোট কান ও লেজ বেশ কার্যকরী ছিল। অবশ্য লোমশ ম্যামথের গজদন্ত বিশাল আকৃতির ছিল। এদের গজদন্ত এক জীবনে প্রায় ছয় গুণ বড় হত। লোমশ ম্যামথের ব্যবহার আধুনিক হাতির ন্যায়ই ছিল। দাঁত ও শুড়ের ব্যবহার একই ভাবে যুদ্ধ এবং জিনিসপাতি ধ্বংসের কাজেও ব্যবহার করা হত। তৃণভোজী লোমশ ম্যামথ সম্ভবত ৬০ বছর আয়ুষ্কাল পেতো। উত্তর ইউরেশিয়া ও ঊত্তর আমেরিকার ম্যামথ অঞ্চলে লোমশ ম্যামথের বসতি বিরাজ করেছিল।
পশমী ম্যামথেরা আদিম মানুষের সময়ে সহাবস্থান করতো, যারা ম্যামথদের হাড় ও দাঁত অলঙ্কার, সরঞ্জাম হিসেবে ও বাসস্থান নির্মাণের জন্য ব্যবহার করত এবং খাদ্যের জন্য শিকার করত | ম্যামথেরা এদের মূল ভূখণ্ড থেকে প্লাইস্টোসিন যুগের শেষে অর্থাৎ ১০০০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন এবং ফলস্বরূপ বাসস্থান সংকোচন, মানুষের দ্বারা শিকার, অথবা এই দুটি কারণের সংমিশ্রণের প্রভাবে| ম্যামথেরা বিচ্ছিন্ন সংখ্যায় ৫৬০০ বছর আগে পর্যন্ত সেন্ট পল দ্বীপে এবং ৪০০০ বছর আগে পর্যন্ত ভ্রাংগেল দ্বীপে বেঁচে ছিল। এদের বিলুপ্তির পরও, মানুষ এদের দাঁত কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে যেতে থাকে, যার প্রচলন আজও অব্যাহত। এই প্রজাতিকে বিভিন্ন প্রকারে পুনঃনির্মিত করা যেতে পারে বলে প্রস্তাবিত হয়েছে, কিনতু এদের একটিও এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
শ্রেণিবিন্যাস
অধিকাংশ বিলুপ্তপ্রাপ্ত হাতির ব্যাপারে ইউরোপীয়রা মূলতঃ বাইবেল থেকেই জানতো। ঐতিহাসিক প্রাণী হিসেবে এদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই বিশালাকার দৈত্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। রোমান প্রজাতন্ত্রের সময়কালে ইউরোপে আধুনিক হাতির আবির্ভাব ঘটে ক্রয়ের মাধ্যমে। উদাহরণ হিসেবে হ্যানিবলের যুদ্ধ হাতির কথা উল্লেখ করা যায়। এই প্রজাতি উত্তরাঞ্চলে বসবাস করতো। [১] ১172৭৮ সালে ইউরোপীয় বিজ্ঞানী হানস স্লোয়েন প্রথম কোন ইউরোপীয় হিসেবে সাইবেরিয়ায় ফসিলাকারে প্রাপ্ত লোমশ ম্যামথের দাঁত ও গজদন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।স্লোয়েনই প্রথম এই দাঁত ও গজদন্ত যে হাতির তা সনাক্ত করেন। [২] স্লোয়েন বাইবেলে বিবৃত মহাপ্লাবণের দ্বারা লোমশ ম্যামথের সুমেরুতে উপস্থিতির কথা ব্যাখ্যা করেন। তিনি সাইবেরিয়ায় পূর্বে ট্রপিকাল আবহাওয়া থাকলেও মহাপ্লাবণে এই আবহাওয়া পরিবর্তিত হয় এবং লোমশ ম্যামথ মাটিচাপা পড়ে বলে উল্লেখ করেন। [৩] অন্যরা অবশ্য স্লোয়েনের মত থেকে কিছুটা ভিন্ন মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। তারা লোমশ ম্যামথ মহাপ্লাবনের পানিতে ট্রপিক অঞ্চল থেকে সুমেরু অঞ্চলে ভেসে এসেছে বলে উল্লেখ করেন। স্লোয়েনের বিজ্ঞানপত্র যুক্তরাজ্য ও সাইবেরিয়া ভ্রমণকারীদের বর্ণনা এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাড়ের ভিত্তিতে ছিল। তিনি এই হাতি তদবধি টিকে আছে কিনা এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন উত্তর দিতে পারেননি।[৪] ১৭৩৮ সালে জার্মান প্রাণিবিজ্ঞানী জোহান ফিলিপ ব্রেয়েন ম্যামথের ফসিল যে এক ধরনে হাতির সে ব্যাপারে মন্তব্য করেন। তবে তিনি মেরু অঞ্চলের প্রাণী কীভাবে সাইবেরিয়ার মতো ঠান্ডা অঞ্চলে এলো সে ব্যাপারে সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি সম্ভববত মহাপ্লাবণে এরা ভেসে এসেছে বলে উল্লেখ করেন।[৫] ১৭৯৬ সালে ফ্রান্সের দেহবিজ্ঞানী জর্জস ক্যুভিয়েঁ প্রথম লোমশ ম্যামথকে সুমেরু অঞ্চলে ভেসে আসা আধুনিক হাতি নয় বলে সনাক্ত করেন। তিনিই লোমশ হাতিকে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি হিসেবে সনাক্তকরণে সক্ষম হন। তিনি লোমশ হাতি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হাতি প্রজাতি বলে যুক্তি দেন , যা সেই সময়ে খুব একটা গ্রহণযোগ্য যুক্তি ছিল না।[৬]
বিবর্তন
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
২০০৫ সালে বিজ্ঞানীরা মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম দ্বারা লোমশ ম্যামথের সম্পূর্ণ প্রোফাইল্ল দাঁড় করান। এতে এশীয় হাতি (Elephas maximus)ও লোমশ ম্যামথের মধ্যকার বিবর্তনীয় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। .[৭] ২০১৫ সালের একটি ডিএনএ রিভিউ লোমশ ম্যামথের সাথে এখন অব্দি বেঁচে থাকা প্রাণীর মাঝে এশীয় হাতি সর্বাধিক সম্পর্কযুক্ত বলে নিশ্চিত করে। [৮] প্রায় ৬ মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকান হাতি (Loxodonta africana) এই দল থেকে আলাদা হয়ে গেছে।[৯] ঠিক এইরকম সময়েই শিম্পাঞ্জীরা বর্তমান মানুষ থেকে ভিন্ন প্রজাতিতে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। অনেক গবেষকই নিয়ান্ডারথাল জিনোমের আগে লোমশ ম্যামথের জিনোমই হবে প্রথম কোন বিলুপ্ত প্রাপ্ত প্রাণীর নিউক্লিয়ার জিনোম সিকুয়েন্স বলে ধারণা করেছিলেন। [১০] নিউক্লিয়ার জিনোম সিকুয়েন্সিং করতে একটি দল প্রায় ২০ হাজার বছর পুরনো ম্যামথের চুল এবং আরেকটি প্রায় ষাট হাজার বছর আগে মৃত ম্যামথের চুলের ফলিকল থেকে ডিএনএ এক্সট্রাক্ট করে।[১১] ২০০৮ সালে প্রাপ্ত এনালাইসিস থেকে লোমশ ম্যামথ ও আফ্রিকান হাতি প্রায় ৯৮.৫৫% থেকে ৯৯.৪০% আইডেন্টিকাল বলে তথ্য পাওয়া যায়।[১২] ২০১২ সালে ৪৩ হাজার বছর পুরনো লোমশ ম্যামথ থেকে প্রোটিন সংগ্রহ করে সনাক্ত করা সম্ভবব হয়। [১৩]