সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তি

একটি সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তি (ontological argument) হচ্ছে সৃৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে একরকম দার্শনিক যুক্তি যা সত্তাতত্ত্বকে ব্যবহার করে। অনেক যুক্তিই সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির শ্রেণীতে পড়ে, এবং এই যুক্তিগুলো অস্তিত্ব বা সত্তার অবস্থা নিয়েই সম্পর্কিত হয়ে থাকে। আরও বিশেষভাবে বললে, সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তিগুলো সার্বিক এর সংগঠন সম্পর্কিত কোন প্রাকসিদ্ধ তত্ত্ব নিয়ে শুরু হয়। যদি সেই সংগঠনমূলক গঠন সত্য হয়, তবে যুক্তিটি ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে।

ইতিহাস

পাশ্চাত্য খ্রিস্টীয় ধারায় আনসেল্ম অফ ক্যান্টারবেরি তার ১০৭৮ সালে রচিত গ্রন্থ প্রস্লোজিয়ন এ প্রথম সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তিটি প্রস্তাব করেন।[১] আনসেল্ম ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে -

"যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু চিন্তা করা যায় না"।

তিনি আরো বলেছিলেন,

কোনো ব্যক্তির মনে এরকম কোনো সত্তার অস্তিত্ব অবশ্যই থাকতে হবে, এমন কি এই সত্তা তাদের মনেও থাকবে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন না। যদি মনের মধ্যে সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তার অস্তিত্ব থাকে, তবে বাস্তবেও অবশ্যই এর অস্তিত্ব থাকবে। যদি এটির অস্তিত্ব কেবল মনের মধ্যেই থেকে থাকে, তবে এর থেকেও শ্রেষ্ঠতর সত্তার অস্তিত্ব থাকা সম্ভব হয়ে যায় যা মন ও বাস্তব উভয় ক্ষেত্রেই অস্তিত্ববান হয়। তাই বাস্তবে অবশ্যই সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তার অস্তিত্ব থাকবে।

সপ্তদশ শতকের ফরাসী দার্শনিক রেনে দেকার্তে একই রকম যুক্তি প্রদর্শন করেন। ডেকার্ট এই যুক্তির কয়েকটি প্রকরণ ছাপিয়েছিলেন যেগুলোর প্রত্যেকটিই এই ধারণাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় যে, একজন সর্বশ্রেষ্ঠ নিখুঁৎ সত্তার "স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট" ধারণা থেকে অবিলম্বেই ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারণাটি সামনে চলে আসে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে, গটফ্রিড লাইবনিজ "সর্বশ্রেষ্ঠ নিখুঁৎ" এর ধারণাটিকে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ডেকার্টের ধারণাটিকে বর্ধিত করেন। আরও সাম্প্রতিক সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তিটি এসেছে কার্ট গোডেলের কাছ থেকে, যিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্য একটি আকারগত যুক্তি প্রস্তাব করেন। নরমান ম্যালকম আনসেল্ম এর গ্রন্থে একটি দ্বিতীয় শক্তিশালী সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তিকে খুঁজে পাবার পর তিনি ১৯৬০ সালে সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির পুনর্জীবন দান করেন। আলভিন প্লাতিঙ্গা এই যুক্তিতিকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং এর বদলে একতি বিকল্প যুক্তি প্রস্তাব করেন যা মোডাল তর্কশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরি। অটোমেটেড থিওরেম প্রুভার এর সাহায্য নিয়েও আনসেল্ম এর যুক্তিটিকে বৈধ করবার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। ইসলামী দার্শনিক মোল্লা সদরা ও আল্লামা তাবাতাবায় এর যুক্তিগুলো সহ আরও কিছু যুক্তিকেও সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির শ্রেণীতে ফেলা হয়।

যুক্তিসমূহ

সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির প্রস্তাবের পর থেকে এরকম আগ্রহ ও আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এরকম খুব কম দার্শনিক ধারণাই আছে। পাশ্চাত্য দর্শন-জগতের প্রায় সব মহৎ চিন্তাবিদগণই এই যুক্তিকে তাদের মনোযোগ দেবার যোগ্য বলে মনে করেছেন, এবং এর সমালোচনা ও বিরোধিতার পরিমাণও নেহাত কম নয়। সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির প্রথম সমালোচক ছিলেন আনসেল্ম এর সমসাময়িক গাউনিলো অফ মারমোউশিয়ের। তিনি একটি নিখুঁৎ দ্বীপের উপমা নিয়ে এলেন। এর দ্বারা তিনি প্রস্তাব করলেন, সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির দ্বারা যেকোন কিছুর অস্তিত্বই প্রমাণ করা যায়। এটা ছিল প্রথম প্যারোডিগুলোর মধ্যে একটি, যেগুলোর প্রত্যেকটিই সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তিকে বিমূর্ত কল্পনা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে, টমাস আকুইনাস এই ধারণার ভিত্তিতে সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেন যে, মানুষের পক্ষে ঈশ্বরের প্রকৃতি জানা সম্ভব নয়। ডেভিড হিউম একটি অভিজ্ঞতাবাদী বিরোধিতা পেশ করেছিলেন। তিনি প্রমাণমূলক বিচারহীনতার সমালোচনা করেছিলেন এবং কোন কিছুর আবশ্যিকভাবে অস্তিত্ববান হবার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইমানুয়েল কান্ট সমালোচনা করে বলেন, অস্তিত্ব একটি বিধেয় - এই ভুল প্রতিজ্ঞার উপর ভিত্তি করে এই যুক্তিটি দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বলেন, কোন সত্তার অন্তঃসারে "অস্তিত্ববান হওয়া" কিছুই যোগ করেনা (নিখুঁৎ হওয়াও না), আর তাই "সর্বশ্রেষ্ঠ নিখুঁৎ" (supremely perfect) সত্তারও অস্তিত্ব থাকতে পারে না। সর্বশেষে সি. ডি. ব্রড সহ অন্যান্য দার্শনিকগণ একজন সর্বোচ্চ মহান সত্তার সঙ্গতিকে খারিজ করেছেন। তারা প্রস্তাব করেছেন, মহত্ত্বের কিছু গুণ অন্য গুণগুলোর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, কাজেই "সর্বোচ্চ মহৎ সত্তা" এর ধারণা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির সমসাময়িক সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন আলভিন প্লাতিঙ্গা, উইলিয়াম আলস্টন এবং ডেভিড বেন্টলি হার্ট।

শ্রেণিবিভাগ

সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির গতানুগতিক ধারা সংজ্ঞা প্রদান করেছিলেন ইমানুয়েল কান্ট।[২] তিনি সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তি (সত্তা বিষয়ক যুক্তি)[৩] এর সাথে মহাবিশ্বতাত্ত্বিক যুক্তি ও দেহতাত্ত্বিক যুক্তির মধ্যে পার্থক্য সূচিত করেছিলেন।[৪] কান্টীয় দর্শন অনুসারে, সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তি সেগুলোই যেগুলো প্রাকসিদ্ধ বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত।[২]

দার্শনিক গ্রাহাম অপি বলেন, এই গতানুগতিক সংজ্ঞা থেকে সরে আসার কোন "জরুরি কারণ তিনি দেখেন না"।[২] তিনিও সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে: "বিশ্লেষণীয় ছাড়া আর কিছুই না, একটি প্রাকসিদ্ধ ও অপরিহার্য প্রতিজ্ঞা" যার উপসংহার হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। যাই হোক, অপি স্বীকার করেন যে, সকল সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তিতে সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির গতানুগতিক বৈশিষ্ট্যগুলো (বিশ্লেষণযোগ্যতা, অপরিহার্যতা ও প্রাকসিদ্ধতা) পাওয়া যায় না।[৫] আর তার ২০০৭ সালের গ্রন্থ অন্টোলজিকাল আরগুমেন্টস এন্ড বিলিফ ইন গড গ্রন্থে তিনি সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির একটি অধিকতর ভাল সংজ্ঞা প্রস্তাব করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির কেবল একটিই বৈশিষ্ট্যই বিবেচিত যা হল "একে পুরোপুরি আস্তিকীয় বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিতেই পাওয়া যায়" ("entirely internal to the theistic worldview")।[২]

অপি সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তিকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। এগুলো হল সংজ্ঞাগত, ধারণাগত (বা হাইপারইন্টেনশনাল), মোডাল, মেইনঞ্জীয়, অভিজ্ঞতামূলক, মেরেওলজি সংক্রান্ত (মেরেওলজি বিভিন্ন অংশ ও অংশগুলোর সমন্বয়ে যে পূর্ণতা তৈরি হয় তা নিয়ে আলোচনা করে), উচ্চ-ক্রমীয় এবং হেগেলীয়। বিভিন্ন সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির প্রতিজ্ঞার বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে তিনি এই শ্রেণিবিভাগ করেন।[৫] তিনি বলেন, সংজ্ঞাগত যুক্তিগুলো সংজ্ঞার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়; ধারণাগত যুক্তিগুলো "কোন নির্দিষ্ট রকমের ধারণাকে গ্রহণ করে"; মোডাল যুক্তিগুলো সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে; মেইনঞ্জীয় যুক্তিগুলো "সত্তার বিভিন্ন ক্যাটাগরির মধ্যে পার্থক্য সূচিত করে", অভিজ্ঞতামূলক যুক্তিগুলো বলে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব কেবলমাত্র তাদের কাছেই আছে যারা তার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে; হেগেলীয় যুক্তিগুলো হেগেল এর দর্শন থেকে আসে।[২] পরবর্তীতে তিনি মেরেওলজি সংক্রান্ত যুক্তিগুলো নিয়ে একটি শ্রেণী তৈরি করেন যেগুলো "খণ্ড-পূর্ণতা সম্পর্কের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়"।[৬]

উইলিয়াম লেন ক্রেইগ অপির এই কাজের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, অপির কাজটি কার্যকরী শ্রেণীকরণ হিসেবে খুব অস্পষ্ট। ক্রেইগ সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, কোন যুক্তিকে সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তি তখনই বলা যায় যদি তা অপরিহার্য সত্যসমূহের দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রতিপাদিত করবার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির প্রস্তাবগুলো দাবি করে, যদি কোন ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের ধারণাটি বুঝতে পারেন, তাহলে তাকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।[৭] উইলিয়াম এল. রোয়ি সত্তাতাত্ত্বিক যুক্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, এটি কেবল প্রাকসিদ্ধ নীতিগুলোর উপর ভিত্তি করে ঈশ্বরের সংজ্ঞা ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে শুরু হয়, ও শেষ হয় ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপসংহার টানার মধ্য দিয়ে।[৮]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন