ঈশ্বর
একেশ্বরবাদী চিন্তাধারায়, ঈশ্বরকে সর্বোচ্চ সত্তা, স্রষ্টা ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের প্রধান উপাস্য হিসাবে কল্পনা করা।[১] ঈশ্বর সাধারণত সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বত্র বিরাজমান ও সার্বজনীন হিসাবে ধারণা হয় সেইসাথে তিনি অনন্ত এবং প্রয়োজনীয় অস্তিত্ব থাকেন। ঈশ্বরকে প্রায়শই উৎকর্ষ বা অব্যবস্থা ধারণার সাথে সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিরাকার বলে ধরে নেওয়া হয়।[২][৩]
ঈশ্বর কথার আক্ষরিক অর্থ আরাধ্য, ভগবান, স্রষ্ঠা, প্রভু, স্বামী বা প্রধান আশ্রয়।[৪] বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বরের সংজ্ঞা বিভিন্ন। আব্রাহামিয় ধর্ম (ইহুদি, খ্রীষ্টান, ইসলাম, জেহোবাস ,উইটনেস ইত্যাদি), অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, বহুশ্বরবাদী ইত্যাদিদের মতে ঈশ্বর হলো জাগতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে অবস্থানকারী কোনো অস্তিত্ব । অনেকের মতে, এই মহাবিশ্বের জীব ও জড় সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক আছে বলে মনে করা হয় । এ অস্তিত্বে বিশ্বাসীগণ ঈশ্বরের উপাসনা করে, তাদেরকে আস্তিক বলা হয়। আর অনেকে এ ধারণাকে অস্বীকার করে, এদেরকে বলা হয় নাস্তিক। অনেকে ঈশ্বর আছে কি নেই তা সম্বন্ধে নিশ্চিত নয় (যেমন বৌদ্ধদের কিছু সম্প্রদায়)। এদের সংশয়বাদী বলে।
আস্তিক সমাজে , ঈশ্বরের ধারণা ধর্ম , ভাষা ও সংস্কৃতিভেদে নানারূপী। ভাষাভেদে একে ইংরেজি ভাষায় গড, এবং বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় ঈশ্বর ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়।
সর্বেশ্বরবাদ ও একেশ্বরবাদ হলো ঈশ্বরবাদের প্রধান দুটি শাখা । সর্বেশ্বরবাদে ক্ষমতার তারতম্য অনুযায়ী একাধিক ঈশ্বর বা অনেক সময় ঐশ্বরিক সমাজে বিশ্বাস করা হয় এবং প্রতিমা প্রতিকৃতি আকারে পরোক্ষভাবে এর উপাসনা করা হয় (যেমন প্রাচীন রোমান, গ্রীক, মিশরের ঈশ্বরসমৃহ) । উল্লেখ্য সনাতন ধর্মের (হিন্দুদের) ক্ষেত্রে প্রতীমার মধ্যে এক কিন্তু নাম রূপ ভেদে ভিন্ন রূপে আপতিত ঈশ্বরকে আহ্বান করে পূজা করা হয়। আর শুধুমাত্র একজন সার্বভৌম ঈশ্বরের ধারণাকে বলা হয় একেশ্বরবাদ ।
বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বর
ইহুদী ধর্ম
খ্রিস্টান ধর্মে ঈশ্বরের নাম ইহুদি ধর্মের অনুরূপ। তারা ঈশ্বরকে ইয়াহওয়েহ/যিহোবা, এলোহিম বা আদোনাই নামে ডাকে। যারা এলোহিম নামে ঈশ্বরকে ডাকে তাদের এলোহীয়, যারা ইয়াহওয়েহ নামে ডাকে তাদের ইয়াহওয়েহীয় বলে ডাকা হয়। তবে, তারা খ্রিষ্টধর্মের মত ঈশ্বরের ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী নয়। হিব্রু ভাষায় ঈশ্বরের নাম যিহোবা বা এলোহিম হলেও আরবী ভাষী ইহুদিরা ঈশ্বরকে "আল্লাহ" নামে সম্বোধন করে থাকে। ইসলামের বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ ও সীরাত থেকে যার সত্যতা পাওয়া যায়। আরবী ভাষার বাইবেলে ঈশ্বরের সমার্থক হিসেবে কেবলমাত্র আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তবে সেটি সর্বনাম হিসেবে।
সনাতন ধর্ম
হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের ধারণা মূলত নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহ্য অথবা দর্শনের ভিত্তিতে তৈরি নয়। চিণ্ময়বাদ, অদ্বৈতবাদ,[৫] সর্বেশ্বরময়বাদ, অদ্বৈতবাদ, আস্তিক্যবাদ – সকল প্রকার বিশ্বাসের সমাহার দেখা যায় হিন্দুধর্মে।
সনাতন ধর্ম অনুযায়ী জীব-আত্মা শাশ্বত।[৬] অদ্বৈত বেদান্তের ন্যায় অদ্বৈতবাদী বা সর্বেশ্বরময়বাদী দর্শন অনুসারে, জীবনের উদ্দেশ্য হল আত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতা বা একাত্মতা অনুভব করা।[৭]আত্মা সর্বশেষে পরমাত্মা বা ব্রহ্মে বিলীন হয়। এই কারণেই এই দর্শন অদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত।[৮] উপনিষদে বলা হয়েছে, মানুষের পরমসত্ত্বা আত্মাকে যিনি ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন রূপে অনুভব করতে সক্ষম হন, তিনিই মোক্ষ বা মহামুক্তি লাভ করেন।[৬][৯] পরমসত্ত্বা রূপে ঈশ্বর সনাতন ধর্মে ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান বা পরমেশ্বর নামে আখ্যাত।[৮] অবশ্য ঈশ্বর শব্দের একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। মীমাংসাবাদীরা ঈশ্বরে অবিশ্বাস করেন; অপরদিকে সাংখ্যবাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। আবার অদ্বৈতবাদীরা আত্মা ও ব্রহ্মকে অভিন্ন মনে করেন।[৮]
জৈন ধর্ম
বর্তমানে যে ধর্ম গুলো বিদ্যমান আছে সেগুলো একেশ্বরবাদ, বহুশ্বরবাদ আর অনাশ্বরবাদ।যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী তাঁদের মতে ঈশ্বর মানে হলো- জেনেরেটর, অপারেটর & ডিস্ট্রাক্টর (মানে কেউ একজন আপনাকে তার প্রয়োজনে তৈরি করলেন, পরিচালনা করলেন এবং প্রয়োজন শেষে ধ্বংস করে দিলেন)। তাঁদের মতে ঈশ্বর মানে হলো একটা বিংস বা পার্সন। তাঁদের কথায় প্রশ্ন আসতে পারে যদি ওনি একজন হন তার স্বরূপ কি হতে পারে? ওনারা উত্তর দিবেন ওনি তাহার মত, ওনার কোনো শরিক নাই, ওনার কোনো তুলনা নাই। আবারো প্রশ্ন আসতে পারে ওনি যে একজন আপনি বা আপনারা বুঝলেন বা জানলেন কীভাবে? এটা একটা ধারণা মাত্র আর ধারণা দিয়ে কখনো ধর্ম হয়না।এবার বহুশ্বরবাদ/সনাতনী মতবাদে ফেরা যাক- সনাতনী মতে ওদের ঈশ্বর ব্রহ্মা। ওনি খুব আলৌকিক শক্তির অধিকারি ওনি যখন যা চান তাই করতে পারেন। আবার সনাতনী বেদ শাস্ত্রমতানুসারে ওনি মুক্ত পুরুষ নন। এখন আবারো প্রশ্ন আসতে পারে যেখানে ঈশ্বর নিজেই মুক্ত নন সেখানে তিনি আমাদের কীভাবে রক্ষা করবেন? কীভাবে? কেন? কিজন্য? পৃথিবীতে আসছেন সেটা জানা যেমন জরুরী তার চেয়ে আরও অধিক জরুরী এই দুঃখময় জগতসংসার থেকে মুক্ত হবেন কি করে?
বৌদ্ধ ধর্ম
ঈশ্বর নেই এই হৃদয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে বৌদ্ধধর্ম। সেটা বড় কথা নয়। থাকলে কতটুকু উপকারে আসতো আর্থমানবে?ফেরা যাক বৌদ্ধধর্মের ঈশ্বরে, বৌদ্ধ ত্রিপিটকের ব্রাহ্মাজাল সুত্র পাট করলে জানতে পারবেন এই বিশ্বব্রাহ্মাণ্ড পরিচালিত হয় পাঁচটা ইউনিভার্সাল রোলসের উপর ভিত্তি করে যার দ্বারা এই বিশ্বব্রাহ্মাণ্ড পরিচালিত হয়। যাকে বলে ইউনিভার্সালত্রুথ।আসুন এবার জানা যাক সেই পাঁচটা ইউনিভার্সাল রোলস কি? যার দ্বারা জগতের সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে?১ঃ চিত্ত নিয়ম।২ঃ রীত নিয়ম৩ঃ বীর্য নিয়ম।৪ঃ ধর্ম নিয়ম।৫ঃকর্ম নিয়ম।এগুলোই বৌদ্ধধর্মের ঈশ্বর। এই পাঁচটি ইউনিভার্সাল রোলস চক্রাকার নিয়মে চলে।অনেক বৌদ্ধ'রা বলে থাকনে সব কর্মফল আসলে ইহা ভুল বাকি চারটা নিয়ম বা রোলস বাদ দিয়ে কর্মফল একা কিছুই করতে পারেনা।তার মানে আমরা কি জানলাম ঈশ্বর নিরাকার, অপার সমুদ্র, তিনি তার মতন। তার কোনো রুপ আর লিঙ্গ নাই।ঈশ্বর= 0x0=0তাই সরাসরি বৌদ্ধধর্ম ঈশ্বর অস্বীকার করে।যদি আপনি ঈশ্বরের অবিশ্বাস নাস্তিক আসে বলে মনে করে থাকেন তাহলে জেনে রাখুন বৌদ্ধমতবাদে ঈশ্বর এক কাল্পনিক চরিত্র বা অন্ধবিশ্বাস।বৌদ্ধধর্মে নাস্তিক কাকে বলে জানেন?ত্রিপিটকে বলছেঃ অন্ধবিশ্বাসীগণ নাস্তিক তারা পচাগন্ধ ন্যায়। মাংসভোজী গন নহে।
খ্রিস্ট ধর্ম
খ্রিস্টান ধর্মে ঈশ্বরের নাম ইহুদি ধর্মের অনুরূপ। তারা ঈশ্বরকে ইয়াহওয়েহ (Yahweh)/যিহোবা (Jehovah), এলোহিম (Elohim) বা আদোনাই (Adonai) নামে ডাকে। যারা এলোহিম নামে ঈশ্বরকে ডাকে তাদের এলোহীয় (Elohim), যারা ইয়াহওয়েহ নামে ডাকে তাদের ইয়াহওয়েহীয় (Yahwist) বলে ডাকা হয়। তবে, তারা ইহুদিদের মত গোঁড়া একেশ্বরবাদী নয়, তারা ঈশ্বরের তিনটি সত্বায় বিশ্বাস করে, যাকে ত্রিত্ববাদ (Trinity) বলা হয়। এ মতবাদ অনুসারে, পিতা যিহোবা, পুত্র যীশু খ্রিষ্ট এবং পবিত্র আত্মা এই তিন সত্বা মিলেই ঈশ্বরের সত্বা গঠিত। যীশু খ্রিস্টকে ঈশ্বরের পুত্র বলা হলেও তাকে ঈশ্বরের মর্যাদা দেওয়া হয়। যীশুকে রিডিমার, ইমানুয়েল ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। আর পবিত্র আত্মাকে ডাকা হয় দেবদূত গাব্রিয়েল নামে।
ইসলাম ধর্ম
আল্লাহ্ (আরবি: الله) একটি আরবি শব্দ, ইসলাম ধর্মানুযায়ী যা দ্বারা বিশ্বজগতের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক ও উপাস্যের নাম বোঝায়।
"আল্লাহ" শব্দটি প্রধানত মুসলমানরাই ব্যবহার করে থাকেন। "আল্লাহ্" নামটি ইসলাম ধর্মে বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তার সাধারণভাবে বহুল-ব্যবহৃত নাম। এটি ছাড়াও কিছু মুসলিম তাকে আরো কিছু নামে সম্বোধন করে থাকে যেমন ‘খোদা’, ‘মাবুদ’, ‘প্রভূ’। তবে খোদা নামটি উৎপত্তিগতভাবে পারস্যের জরাথুস্ট্র ধর্মের ঈশ্বরকে ডাকতে ব্যবহৃত হয়।
তবে আরব খ্রিস্টানরাও প্রাচীনকাল থেকে "আল্লাহ" শব্দটি ব্যবহার করে আসছেন। বাহাই, মাল্টাবাসী, মিজরাহী ইহুদি এবং শিখ সম্প্রদায়ও "আল্লাহ" শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।
মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহর ৯৯টি নাম উল্লেখ আছে। আরও ১৮টি নামের উল্লেখ রয়েছে হাদীসগ্রন্থগুলোতে। নামগুলোর কয়েকটির অর্থ হল: একমাত্র উপাস্য, একক স্রষ্টা, রিজিকদাতা, অধিক ক্ষমাকারী, অতিদয়ালু, বিচারদিনের মালিক, রাজাধিরাজ, সর্বজ্ঞ, চিরঞ্জীব, প্রার্থনা শ্রবণকারী, অমুখাপেক্ষী প্রভৃতি।
আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে,
"বলুন, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ্ হচ্ছেন অমূক্ষাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। এবং তার সমতুল্য কেউই নেই।"[কুরআন ১১২:১–৪]
কুরআনে আরও বলা হয়েছে,
"আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না, নিদ্রাও নয়। আকাশসমূহে যা রয়েছে ও পৃৃথিবীতে যা রয়েছে সবই তার। কে আছে এমন, যে তার অনুমতি ব্যতীত তার কাছে সুপারিশ করবে? তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে তা তিনি জানেন। আর যা তিনি ইচ্ছে করেন তা ছাড়া তার জ্ঞানের কোনো কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারে না। তার আসন আকাশসমূহ ও পৃৃথিবীকে পরিব্যাপ্ত করে আছে; আর এ দুটোর রক্ষণাবেক্ষণ তার জন্য বোঝা হয় না। আর তিনি সুউচ্চ, সুমহান।"[কুরআন ২:২৫৫]
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহর কোনো গুণাবলীই সৃষ্টজীবের মত নয়। সৃষ্টজীব যেভাবে শোনে, আল্লাহ সেভাবে শোনেন না। সৃষ্টজীব যেভাবে দেখে, আল্লাহ সেভাবে দেখেন না। আল্লাহর গুণাবলীর ধরন মানুষের অজানা। কুরআনে বলা হয়েছে,
"...কোনো কিছুই তার সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।"[কুরআন ৪২:১১]