সপ্তকাণ্ড রামায়ণ
সপ্তকাণ্ড রামায়ণ হল ১৪শ শতকে মাধব কন্দলী কর্তৃক অসমীয়া ভাষায় রচিত রামায়ণ।[১] বরাহী বা কাছাড়ি রাজা মহামাণিক্যের (আনুমানিক ১৩৩০-১৩৭০) রাজসভার কবি[২] মাধব কন্দলী রাজ-অনুগ্রহে উত্তর ভারতের মধ্যে প্রথম বাল্মীকির রামায়ণ অসমীয়ায় "সপ্তকাণ্ড রামায়ণ" নামে অনুবাদ করেন।[৩] আধুনিক ভারতীয় ভাষাতে রচনা করা এই রামায়ণ শাস্ত্রীয় তামিল ভাষাতে কাম্বরের রামায়ণের পরেই অবস্থান করে। প্রাক-শংকরী যুগে রচনা করা এই গ্রন্থ লিখিত অসমীয়া ভাষার প্রথম নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম।
লেখক | মাধব কন্দলী |
---|---|
দেশ | অসম, ভারত |
ভাষা | অসমীয়া |
ধরন | কাব্য |
প্রকাশনার তারিখ | ১৪শ শতক |
পাঠ্য | সপ্তকাণ্ড রামায়ণ উইকিসংকলন |
এখানে রাম, সীতা ইত্যাদি অন্যান্য চরিত্রকে অতিমানবীয়রূপে বর্ণনা করা হয়নি। পৌরাণিক চরিত্রসমূহের অতিরঞ্জিত বর্ণনা এবং নায়কত্ব আরোপ না করা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মাধব কন্দলী নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, এই গ্রন্থ ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রচনা করা হয়নি। বাল্মীকির রামায়ণে রামকে অতিমানবরূপে দেখানো হয়নি। পরে এতে রামের অলৌকিকতা সন্নিবিষ্ট হয়েছে।
মাধব কন্দলী 'সপ্তকাণ্ড রামায়ণ পদবন্ধে নিবন্ধিলো' বলে লিখেছেন যদিও কালক্রমে রামায়ণের দুটি কাণ্ড হারিয়ে যায়। পরে নববৈষ্ণব ধর্মের মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব এবং শ্রীশ্রী মাধবদেব এই কাণ্ড দুটি সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করে মূল কাব্যর সাথে সংযোগ করেন। "গুরু-চরিতের" বিষয়ে একটি কাহিনী পাওয়া যায়। কাহিনীমতে অনন্ত কন্দলী ভক্তিরসের আধারে রামায়ণের একটি নতুন অনুবাদ করে মাধব কন্দলীর রামায়ণকে লুপ্ত করতে চেয়েছিলেন। তখন মাধব কন্দলী শঙ্করদেবকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে এর সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ জানান। তারপরে শঙ্করদেব মাধবদেবকে আদিকাণ্ড লিখতে দিয়ে নিজে উত্তরাকাণ্ড লিখে ফেলেন।[৪] মাধব কন্দলী এই কাণ্ড দুটি আগে রচনা করেছিলেন কি না তার কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৪]
সপ্তকাণ্ড রামায়ণ ইংরাজী ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
কবির পরিচয়
মাধব কন্দলী ১৪শ শতকের বরাহী রাজা মহামাণিক্যের রাজসভার একজন কবি।[২] মাধব কন্দলী উত্তর ভারতের মধ্যে প্রথম বাল্মীকির রামায়ণ অসমীয়াতে "সপ্তকাণ্ড রামায়ণ" নামে অনুবাদ করেন।[৩] মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব মাধব কন্দলীকে "অপ্রমাদী কবি" আখ্যা দিয়েছিলেন।[২]
মূল গ্রন্থ
তিনি সাতকাণ্ড রামায়ণ বরাহী রাজা মহামাণিক্যের অনুরোধে লেখেন।[৫] সেইসময়ে তাঁর রাজধানী শিবসাগরে ছিল।[৬] তিনি রামায়ণে উল্লেখ করেছেন:
কবিরাজ কন্দলী যে, আমাকেসে বলে কয়
মাধব কন্দলী আরো নাম।
সপোনে সচিতে মঞি, জ্ঞান কায় বাক্য মনে,
অহর্নিশে চিন্তো রাম রাম।
শ্লোক সংস্কৃতত আমি, গঢ়িবাক পারিচয়,
করেলোহো সর্ব্বজন বোধে।
রামায়ণ সুপবার শ্রীমহা মাণিক্য যে,
বরাহী রাজার অনুরোধে।
সাতকাণ্ড রামায়ণ, পদবন্ধে নিবন্ধিলো,
লম্ভা পরিহরি সারোদ্ধৃত।
মহা মাণিক্যর বলে, কাব্য রস কিছো দিলো,
দুগ্ধ মথনত যেন ঘৃত।
কন্দলী রামায়ণে বিভিন্ন ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। এখানে বিস্তৃত পদ বা পয়ার, ঝুমুর, দুলরি এবং ছবি ছন্দের ব্যবহার হতে দেখা যায়। তিনি বাল্মিকীর রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ না করে ভাবানুবাদ করেছিলেন। এখানে অসমীয়া চা জীবনের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। তিনি রাম, সীতা ইত্যাদি চরিত্রকে মানবীয়রূপে প্রকাশ করেছিলেন। আচরিত গুণ থাকলেও কিছু পরিস্থিতিতে মানবীয় দুর্বলতাও এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কন্দলী এখানে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, ফল-ফুল, গাছ-লতিকা, পশু-পক্ষী ইত্যাদির বর্ণনাও করেছেন।
পরবর্তী সময়
মাধব কন্দলীর প্রায় একশো বছর পরে অর্থাৎ ১৫শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে 'কৃত্তিবাসী রামায়ণ' এবং ১৬শ শতকের অষ্টম দশকে তুলসীদাসের 'রামচরিত মানস' রচিত হয়|[৩] কালক্রমে রামায়ণের দুটি কাণ্ড হারিয়ে যাওয়ার পর নববৈষ্ণব ধর্মীয় মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব এবং শ্রীশ্রী মাধবদেব এই কাণ্ড দুটি সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করে মূল কাব্যের সাথে সংযোগ করেন। শংকরদেব সপ্তকাণ্ড রামায়ণ থেকে প্রভাবিত হয়ে বলেছিলেন:
পূর্ব কবি অপ্রমাদী মাধব কন্দলী আদি
পদে বিরচিলা পদ কথা।
হাতীর দেখিয়া লাদ, শশা যেন ফারে মার্গ
মোর ভৈল তেহ্নয় অবস্থা।
পরে ১৬শ শতকে অনন্ত কন্দলী এবং কয়েকজনের পদ এখানে যোগ হয়।
পরে একটি কার্বি ভাষার রামায়ণ এই গ্রন্থের অনুকরণে রচনা করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- কান্দালি, মাধব। সপ্চকাণ্ড ৰামায়ন (অসমীয়া ভাষায়)। বনলতা।
- গোস্বামী, ইন্দিরা (১৯৯৬)। Ramayana from Ganga to Brahmaputra (ইংরেজি ভাষায়)। B.R. Pub. Corp। আইএসবিএন 81-7018-858-X।
- শর্মা, সত্যেন্দ্র নাথ (১৯৭৬), Assamese Literature [অসমীয়া সাহিত্য] (ইংরেজি ভাষায়), Wiesbaden: Harrassowitz