প্রাচীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা

(Ancient Olympic Games থেকে পুনর্নির্দেশিত)

জিউসের সম্মানার্থে প্রাচীন গ্রীসের বিভিন্ন নগর-রাজ্যের অংশগ্রহণে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা (প্রাচীন গ্রিকτὰ Ὀλύμπιαta Olympia; আধুনিক গ্রিক : Ὀλυμπιακοὶ Ἀγῶνες (Katharevousa), Ολυμπιακοί Αγώνες (Dimotiki) i– Olympiakoi Agones) অনুষ্ঠিত হত। এতে মূলত বিভিন্ন দৌড়বাজীর প্রতিযোগিতা হত। অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্ভব সম্পর্কে নানা জনশ্রুতি এবং কিংবদন্তি আছে, তবে ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে মনে করা হয় ৭৭৬খৃঃপূঃ-তে গ্রীসের অলিম্পিয়ায় এই খেলার সূচনা হয়। এরপর এই খেলা প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হত। এই সময়কালকে অলিম্পিয়াডও বলা হয়। প্রায় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলার পর ৩৯৪খৃঃ ষষ্ঠ রোমান সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে খৃষ্টীয় মতবাদ প্রবর্তন করতে চেয়ে এই খেলা বন্ধ করে দেন। মানব সভ্যতার উষালগ্নের প্রাচীন গ্রিস বিভক্ত ছিল অনেক গুলো স্বাধীন নগররাস্ট্রে। উল্লেখযোগ্য নগর রাস্ট্র গুলো ছিল স্পার্টা, এথেন্স, ডেলফি,করিন্থ, থিবিস, আরগোস প্রভৃতি। সে সময়ে নগর রাস্ট্রগুলো একে অপরের সাথে প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকত। অলিম্পিক চলাকালীন অলিম্পিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হত যাতে প্রতিযোগিরা নির্ভয়ে স্ব-স্ব দেশ থেকে এসে অলিম্পিকে অংশ নিতে পারে। বিজয়ীর মাথায় পরিয়ে দেওয়া হত লরেল পাতার মুকুট। ক্রমে অলিম্পিক নগর-রাজ্যগুলির পরস্পরের উপরে ক্ষমতা জাহির করার রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে। একদিকে যেমন খেলা চলাকালীন রাজনীতিকরা রাজনৈতিক মৈত্রীর কথা ঘোষণা করতেন, তেমনি, যুদ্ধকালে পুরোহিতেরা ঈশ্বরের কাছে জয়কামনায় বলি চড়াতেন। এই খেলার মাধ্যমে গ্রিক সংস্কৃতিও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপক প্রসার পায়। অলিম্পিক শুধু মাত্র ক্রীড়ার উৎসব ছিল না, এখানে একাধারে ধর্মীয় ও শিল্পকলার উৎসবও হত। ৪৩৫ খৃস্টপূর্বাব্দে অলিম্পিয়ায় নির্মিত হয় সিংহাসনে বসা হাতির দাঁত এবং সোনার তৈরী দেবরাজ জিউসের মুর্তি, যা ছিল প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য্যের অন্যতম। আজ আর সে মূর্তি নেই। হবু পৃষ্ঠপোষকদের আশায় ভাস্কর ও কবিরা এখানে সম্মিলিত হয়ে নিজ নিজ কলার প্রদর্শনী করতেন।

অলিম্পিয়ার প্যালিয়েস্ত্রা, কুস্তিগির ও অন্যান্য খেলোয়াড়দের অনুশীলনের জন্য নির্দিষ্ট স্থান।

প্রাচীন অলিম্পিক আজকের অলিম্পিকের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। অনেক কম বিভাগ ছিল, এবং শুধুমাত্র স্বাধীন, গ্রিকভাষী পুরুষই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত; যদিও বিলিস্টিচ নামের এক মহিলার নাম বিজয়ী হিসাবে পাওয়া যায়। ঐ তিন শর্তপূরণ হলে যে কোনো দেশের প্রতিযোগী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অংশ নিতে পারত। এই খেলা আজকের মত এক এক বছর এক এক স্থানে না হয়ে প্রতি চার বছর অন্তর অলিম্পিয়াতেই অনুষ্ঠিত হত।[১] তবে একটা ব্যাপারে প্রাচীন ও আধুনিক অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে মিল আছে - বিজয়ী প্রতিযোগিরা আজও সমধিক সম্মানিত, প্রসংশিত ও সম্বর্ধিত। তাদের কীর্তি ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও নথিবদ্ধ হয় যাতে আগামী প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হতে পারে।

হোমার

প্রাচীন অলিম্পিকের সমসাময়িক ছিলেন অন্ধকবি হোমারইলিয়াডওডিসিতে তার অলিম্পিক সম্পর্কিত বর্ণনাই পাশ্চাত্য সাহিত্যে প্রথম ও সর্বোত্তম।[২] হোমারের সাহিত্যেই আমরা প্রথম এই খেলার প্রকৃত মর্মোদ্ধার করতে পারি, বুঝতে পারি একজন খেলোয়াড়ের সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাপিয়ে সেরা হবার বাসনা এবং সেই চেষ্টার আনন্দ। হোমার সমর্থন করতেন খেলার বিষয়ে প্রাচীন গ্রিক মূল্যবোধ ও অভিজাত সৌজন্যবোধ। হোমারের কাছে খেলা নিছক কোনো খেলা ছিলনা। খেলার প্রতিযোগিতা ছিল শৌর্য্যের পরিচয় দেবার মাধ্যম, আর প্রতিযোগিতার শেষে জয়লাভ ও পুরস্কার বিতরণ হল প্রতিযোগী ও আয়োজকের শৌর্য্যের দ্যোতক।

হোমারের মহাকাব্যের নায়কদের মধ্যেও দেখা যায় যে তারা সর্বদা যে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিতে ব্যগ্র।

হোমারের মহাকাব্যে অন্ত্যেষ্টি ক্রীড়াই (একজন নায়কের মৃত্যুর পর, তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে অন্ত্যেষ্টি ক্রীড়ার আয়োজন করা হত) মূলতঃ আছে। যেমন, ইলিয়াডের ২৩শ অধ্যায়ে অ্যাকিলিস প্যাট্রোক্লাসর স্মৃতিতে অন্ত্যেষ্টি ক্রীড়ার আয়োজন করেছিল।[২] অন্ত্যেষ্টি ক্রীড়াই হোক বা সামাজিক ক্রীড়া, আমন্ত্রিত হলে এটা ধরে নেওয়া হত যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণ করতেই হবে। তবে কখনো কখনো নায়কেরা প্রতিযোগিতার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতেন বা এড়িয়ে যেতেন। আর দর্শকাসন গ্রহণ করতেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করা, বা আমন্ত্রণ সত্ত্বেও নিজের শৌর্য্য প্রদর্শণ না করা খুবই অস্বাভাবিক ছিল, এমনকি কখনো কখনো একে স্বেচ্ছায় নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেবার সমতুল্য মনে করা হত। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলে তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।[৩] অ্যাকিলিসের পুরস্কারগুলি প্রধানত ছিল যুদ্ধ পরবর্তী লুঠের মাল, যেমন কোনো বিজিত শত্রুর বর্ম।[৪] প্রাচীন উপহার প্রদান প্রথা অনুসারেই হোমার খেলাধূলার পুরস্কারের ঘোষণা বা বিতরণের বর্ণনা করেছেন। মৃত ব্যক্তির কোনো সম্পত্তি, নতুন সম্পর্কের সূচনা বা কোনো সম্পর্কের নবীকরণ পুরস্কার হিসাবে গণ্য হত।

উৎপত্তি

শিল্পীর চোখে প্রাচীন অলিম্পিয়া

গ্রিক পুরাণে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার গুরুত্ব অপরিসীম।[৫] প্রাচীন অলিম্পিকের সৃষ্টি সম্পর্কে মনে করা হয় কোনো দৈব সংযোগ আছে, এ বিষয়ে অনেক উপকথা প্রচলিত। তবে সঠিক কোনো উৎস জানা যায় না।[৬] এই সকল উপকথা থেকে অলিম্পিকের প্রথার সঠিক উৎস না পাওয়া গেলেও, একটা কালক্রমের চেহারা পাওয়া যায় যার থেকে অলিম্পিকের গল্পটা বোঝা যায়।[৭] গ্রিক ঐতিহাসিক পসানিয়াসের লেখায় এই সংক্রান্ত প্রাচীনতম উপকথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই কাহিনী অনুসারে, ডাক্টাইল হেরাক্লিস (জিউসের পুত্রের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না) তার দুই ভায়ের সাথে অলিম্পিয়ায় এক দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি বিজয়ীকে লরেল পাতার মুকুট পরান, যার থেকে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের পুরস্কার হিসাবে লরেল পাতার মুকুটের প্রথার প্রচলন হয়।[৮][৯] এছাড়া অন্যান্য অলিম্পিয়ান দেবমণ্ডলীও (কারণ এই দেবতারা অলিম্পিয়া পর্বতে স্থায়ীভাবে বাস করতেন), কুস্তি, লাফানো, দৌড়ানো ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন।[১০] পিন্ডার বর্ণনায় আর একটি উপকথা পাওয়া যায় যেটি পূর্বোক্ত উপকথার পরবর্তী সময়কালের।তার মতে অলিম্পিয়ার উৎসবের সূচনা হয় অলিম্পিয়ার রাজা ও পেলোপোনেসাসের স্বনামধন্য বীর পেলোপ্স এবং জিউসের পুত্র হেরাক্লিস বা হারকিউলিসের মাধ্যমে। কাহিনী অনুসারে, ১২টি শ্রম সফলভাবে শেষ করার পর হেরাক্লিস তার পিতার সম্মানার্থে এক দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। পেলোপ্স, পসেইডনের সাহায্যে চালাকি করে, স্থানীয় এক রাজাকে রথের দৌড়ে পরাস্ত করেন এবং জয়ের পুরস্কার হিসাবে রাজকন্যা হিপ্পোডামিয়াকে দাবী করে বসেন।[১১] সর্বশেষ যে উপকথাটি পাওয়া যায় সেটিও পসানিয়াস বর্ণিত ও ঐতিহাসিকদের মতে এটির সময়কাল ৭৭৬ খৃঃ পূঃ।[১২] অজ্ঞাতকারণবশতঃ প্রায় হাজার বছর অলিম্পিক বন্ধ থাকার পর স্পার্টার লাইকার্গুস, এলিসের ইফিটোস, এবং পিসার ক্লিওস্থেনিস ডেল্ফির ওরাকলের আদেশে এই খেলার পুনরুজ্জীবন ঘটান। কারণ ডেল্ফির ওরাকলের মতে মানুষ ঈশ্বর বিমুখ হয়ে পড়েছে, ফলে মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছে ও অনবরত যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই রয়েছে। অলিম্পিক নতুন করে শুরু করলে মহামারী শেষ হবে, শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং মানুষ আবার সাধারণ প্রথাগত জীবনধারায় ফিরে যাবে।[১৩] এই সব উপকথা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, গ্রিক জনগণের কাছে অলিম্পিক তাদের ধর্মে গভীরভাবে প্রোথিত, এবং প্রাচীন অলিম্পিকের পুনরুজ্জীবনের মূল কারণ হল দেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আনা ও চিরাচরিত গ্রিক জীবনধারা ফিরে পাওয়া।[১৪] তবে এই কাহিনীগুলি যেহেতু পসানিয়াসের মত ঐতিহাসিকেরা বর্ণনায় পাওয়া যায়, যিনি মার্কাস অরেলিয়াসের সময়কালে (১৬০ খৃঃ) বর্তমান ছিলেন; তাই মনে করা হয় এগুলি যতটা না ঘটনা তার থেকে বেশি রটনা।[১৫]

ইতিহাস

প্রাচীন গ্রীসের দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রথার অন্যতম হল অলিম্পিক, আর অন্যটি হল আরও প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব এলুসিনিয়ান রহস্য।[১৬]

এলিস ও পিসা শহরের (উভয়েই পেলোপোনেসোস উপদ্বীপের এলিসের অন্তর্গত) কাছে অলিম্পিয়াতে গ্রিক দেবদেবীদের সম্মুখে এই খেলার সূত্রপাত। প্রথম প্রতিযোগিতাটি ছিল কম বয়সী মহিলাদের মধ্যে এক বার্ষিক দৌড় প্রতিযোগিতা, যেখানে বিজয়িনী, দেবী হেরার[১৭] পূজারিনী হত। দ্বিতীয় প্রতিযোগিতাটি হত, হেরার মন্দিরে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পূজারিনীর সঙ্গী নির্বাচনের জন্য।[১৮]

অলিম্পিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম নথিবদ্ধ মহিলাদের প্রতিযোগিতা হেরিয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রথম শুরু হয় অন্ততঃ খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে। শুরুতে এই প্রতিযোগিতা, পুরুষদের ক্ষেত্রেও, শুধুমাত্র দৌড় প্রতিযোগিতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৭৫ খৃঃ সময়কালে পসানিয়াসের গ্রীসের বর্ণনা ও অন্যান্য লেখা থেকে জানা যায় হিপ্পোডামিয়া তার পেলোপ্সের সাথে বিবাহের খুশিতে ষোলোজন মহিলার একটি দল গঠন করেন হেরিয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রশাসনিক কাজের জন্য। আবার এলিস ও পিসার দ্বন্দ্বের উপরে যে সব লেখা পাওয়া যায় তার থেকে জানা যায় ষোলোজন মহিলা আসলে এলিস ও পিসার শান্তিরক্ষক, এবং তাদের এই রাজনৈতিক দক্ষতার জন্য তাদের হেরিয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রশাসনের কাজে নিযুক্ত করা হয়। ধ্রুপদী গ্রিক পুরাণ মতে হেরার সঙ্গী হিসাবে জিউস সেই সময়ের সকল প্যান্থিয়ন দেব-দেবীর পিতা ছিলেন। অলিম্পিয়ায় জিউসের উপাসনাস্থলে একটি ১৩ মিটার (৪৩ ফু) উঁচু হাতির দাঁত ও সোনার তৈরি জিউসের মুর্তি ছিল, যেটি ফিডিয়াস ৪৪৫খৃঃ পূঃ তৈরী করেন। এই মূর্তি প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম। খৃঃ পূঃ পঞ্চম ও চতুর্থ শতাব্দীর অলিম্পিক শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।

মনে করা হয়, খৃঃ পূঃ চতুর্থ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ইফোরাস বর্ষগণনার একক হিসাবে অলিম্পিয়াডের প্রথম ব্যবহার করেন। অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হত, ফলে পরবর্তিকালে অলিম্পিয়াড ও অলিম্পিক সমার্থক হয়ে পড়ে। অলিম্পিয়াড বলতে পরপর দুটি অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যবর্তী সময়কালকে বোঝায়। আগে, প্রতিটি গ্রিক নগররাষ্ট্রের নিজস্ব দিন গণনার পদ্ধতি ছিল যা স্থানীয় ভাবে ব্যবহৃত হত। ফলে তারিখ নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তির সৃষ্টি হত। যেমন, ডিওডোরাসের লেখায় পাওয়া যায় ১১৩তম অলিম্পিয়াডের তৃতীয় বর্ষে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, এটি নিশ্চয় ৩১৬ খৃষ্টপূর্বাব্দের গ্রহণ। আর তা যদি হয়, তাহলে প্রথম অলিম্পিয়াডের প্রথম বর্ষের সময়কাল হচ্ছে, ৭৬৫খৃঃ পূঃ গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি।[১৯] তাসত্ত্বেও, অলিম্পিকের শুরুর সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে।[২০]

অলিম্পিয়ার স্টেডিয়ামের উত্তর পার্শ্বে বিচারকদের জন্য সংরক্ষিত এক্সেড্রা

পরবর্তীকালের গ্রিক পর্যটক পসানিয়াস ১৭৫খৃঃ লেখেন সে যুগে স্ট্যাডিয়ন ছিল একমাত্র প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রতিযোগিরা হারকিউলিসের পায়ের সমান দুরত্ব বা ১৯০ মিটার (৬২০ ফু), দুরত্বের কিছু বেশি দৌড়াত। স্টেডিয়াম কথাটি এই প্রতিযোগিতা থেকে উদ্ভূত।

ক্রীড়াক্ষেত্রে নগ্নতার গ্রিক প্রথার প্রচলন করে স্পার্টা অথবা মেগারিয়ান ওর্সিপ্পাস ৭২০ খৃঃ পূঃ নাগাদ, এবং এটি দ্রুত অলিম্পিকেও প্রচলিত হয়।

অলিম্পিয়ার উপাসনাস্থলের দখল নিয়ে গোষ্ঠিদ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। কারণ ঐ স্থানের অধিকার মানে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উপর নিয়ন্ত্রণ ও সেই সঙ্গে সম্মান ও রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেত। পরবর্তীকালে পসানিয়াসের লেখায় পাওয়া যায় ৬৬৮ খৃঃ পূঃ সালে আর্গোসের ফিডনকে পিসা অলিম্পিয়ার উপাসনাস্থল এলিসের কাছ থেকে দখল করার জন্য নিযুক্ত করে। তিনি সফল হন ও সে বছরের অলিম্পিক নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু, পরের বছরই এলিস অলিম্পিয়া পুনরুদ্ধার করে।

অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, চারটি প্যানহেলেনিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অন্যতম, যে গুলি দুই থেকে চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হত। এগুলির সময় এমনভাবে ফেলা হত যাতে প্রতি বছর অন্ততঃ একটা খেলা থাকে। তবে পাইথিয়ান, নিমিয়ান ও ইস্থমিয়ান ক্রীড়া প্রতিযোগিতার থেকে অলিম্পিক ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বিখ্যাত।

অবশেষে, শুধুমাত্র খৃষ্টধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে প্রতিপন্ন করার জন্য, হয় ৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম থিওডোসিয়াস নতুবা ৪৩৫খ্রিষ্টাব্দে তার নাতি দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেন।[২১] অলিম্পিয়ার ক্রীড়াভূমি এরপরও বহুকাল পড়ে থাকার পর ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভুমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়।

সংস্কৃতি

ডিস্কোবোলাস - একটি খৃঃ পূঃ পঞ্চম শতাব্দীর মূর্তির প্রতিরূপ। এখানে একজন প্রাচীন ডিসকাস থ্রোয়ারকে দেখা যাচ্ছে।

প্রাচীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা যতটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল ততটাই ধর্মীয় উৎসবও ছিল। গ্রিক দেবতা জিউসের সম্মানার্থে এই প্রটিযোগিতার আয়োজন করা হত, এবং খেলার মাঝে একদিন জিউসের কাছে ১০০টি ষাঁড়ের বলি দেওয়া হত।[১] সময়ের সাথে সাথে অলিম্পিয়া গ্রিক প্যান্থিয়নের প্রধান, জিউসের মুখ্য উপাসনাস্থল হয়ে ওঠে। গ্রিক স্থপতি লিবন পাহাড়ের উপরে একটি মন্দির গড়ে তোলেন। এই মন্দির গ্রিসের সর্ববৃহৎ ডোরিক মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম।[১] ভাস্কর ফিডিয়াস সোনা ও হাতির দাঁত দিয়ে জিউসের একটি ৪২ ফুট (১৩ মি) উঁচু মূর্তি বানান। মূর্তিটি মন্দিরের ভিতরে সিংহাসনে বসানো ছিল। এই মূর্তি প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য্যের অন্যতম।[১] ঐতিহাসিক স্ট্রাবো বলেছেন,

"... উৎসবে জনসমাগম ও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলা অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য ... মন্দিরের গরিমা বজায় ছিল... অলিম্পিকে পুরস্কার হিসাবে পাতার মুকুট দেওয়া হলেও তা পবিত্র মানা হত। গ্রীসের সকল প্রান্তের থেকে আসা অর্ঘ্যে মন্দিরটি অলঙ্কৃত ছিল।"[১]

শৈল্পিক অভিব্যক্তি ছিল অলিম্পিকের অবিচ্ছেদ্দ অংশ। ভাস্কর, কবি এবং অন্যান্য শিল্পীরা অলিম্পিকে এসে নিজেদের শিল্পকলার প্রদর্শন করতেন। এই সব ভাস্করদের সৃষ্ট কাজের মধ্যে মাইরনের ডিস্কোবোলাস বা ডিসকাস থ্রোয়ার।এই সব ভাস্কর্য্যের লক্ষ্যনীয় ব্যাপার ছিল, মানব শরীরের স্বাভাবিক সঞ্চালন ও শরীরে পেশির গঠন। অলিম্পিক বিজয়ীদের প্রশস্তিগাথা লেখার জন্য কবিদের সাহায্য নেওয়া হত। "এপিনিসিয়ান" নামে পরিচিত এই কবিতাগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্মের মুখে মুখে ফিরে, অন্য যে কোনো সম্মানের থেকে অনেক বেশি কালোত্তীর্ণ হয়েছিল।[১] আধুনিক অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পিয়ের দ্য কুবেরত্যাঁ প্রাচীন অলিম্পিকের সর্বতোভাবে হুবহু অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি ভেবেছিলেন খেলাধূলার প্রতিযোগিতা ছাড়াও প্রাচীন অলিম্পিকের মত শৈল্পিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করবেন।[২২] ১৮৯৬ সালে আথেন্সে আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম অধিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে তার স্বপ্ন সফল হয়।[২৩]

রাজনীতি

প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম অগ্রণী নগররাষ্ট্র আথেন্সের পার্থেনন

খৃঃ পূঃ ৮ম শতাব্দীর প্রাচীন গ্রীসে নগর-রাষ্ট্রগুলির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল।[২৪] ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল থেকে এই নগররাষ্ট্রগুলির উদ্ভব হলেও, ধীরে ধীরে এদের নিজস্ব রাজনৈতিক সত্ত্বার বিকাশ হয়।[২৫] এই নগররাষ্ট্রগুলির ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। তবে সংঘাত সত্ত্বেও, নিজেদের স্বার্থেই নগররাষ্ট্রগুলি পরস্পরের সাথে বাণিজ্য, সামরিক সমঝোতা ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান করত।[২৬] নগররাষ্ট্রগুলি একদিকে যেমন সামরিক ও রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য প্রতিবেশীদের উপর নির্ভরশীল ছিল, অন্যদিকে তেমন বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রসদের তাগিদে সেই প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধেই অস্ত্রধারণ করতে দ্বিধা করত না।[২৭] এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সূচনা। নগররাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিরা অলিম্পিকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত।[২৮]

অলিম্পিকের প্রথম ২০০ বছরে শুধুমাত্র স্থানীয় পরিমন্ডলে ধর্মীয় গুরুত্ব ছিল। এসময় অলিম্পিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চল ছাড়া গ্রীসের অন্য জায়গা থেকে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ ছিল না। বিজয়ীদের তালিকায় পেলোপোনেসিয়ান প্রতিযোগীদের রমরমা থেকেই এটা বোঝা যায়।[২৯] খৃঃ পূঃ ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিক উপনিবেশের প্রসার অনেক সফল অলিম্পিক প্রতিযোগির যোগান দেয়। যেমন, পসেনিয়াসের লেখায় পাওয়া যায়, খৃঃ পূঃ ৬৩০ সালে থেরার ঔপনিবেশিকরা স্পার্টার সাহায্যে সিরিনের পত্তন করেন। তিন বারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন চিওনিসকে ঋণ হিসাবে প্রদান স্পার্টার প্রধান সাহায্য ছিল। একজন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের উপস্থিতি একদিকে যেমন উপনিবেশগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে, তেমনি অলিম্পিয়ার নিকটবর্তী নগররাষ্ট্রগুলির সাথে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। এভাবে অলিম্পিয়ার প্রাধান্য বজায় রেখে হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি ও অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রসার হয়।[৩০]

পেলোপোনেসিয়ান যুদ্ধের সময় অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এক গভীর সংকটে পড়ে। এই যুদ্ধ মূলত অ্যাথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে হলেও, বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রায় সব গ্রিক নগররাষ্ট্রই কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে পড়ে।[৩১] এই সময়ের অলিম্পিক মূলতঃ বিভিন্ন রাজনৈতিক সমঝোতা ঘোষণা ও যুদ্ধ জয়ের কামনায় ঈশ্বরের কাছে বলি দেবার জায়গা হয়ে ওঠে।[১][৩২]

অলিম্পিক চলাকালীন ইকেচেইরিয়া বা যুদ্ধবিরতি পালন করা হত। স্পন্ডোফোরোই নামে পরিচিত তিনজন রানার এলিস থেকে সকল অংশগ্রহণকারী শহরগুলিতে গিয়ে গিয়ে এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করত।[৩৩] এই সন্ধির সময় অলিম্পিয়ায় সৈন্যবাহিনীর প্রবেশ নিষেধ ছিল, যুদ্ধ স্থগিত হয়ে যেত এমনকি আইনি লড়াই ও মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ ছিল। এই যুদ্ধবিরতির মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে প্রতিযোগী ও দর্শক নিরাপদভাবে খেলার যায়গায় ভ্রমণ করতে পারে, তাই সবাই মোটামুটিভাবে এটা মেনে চলত।[৩৩] থুকিডিডাসের লেখায় একটা ঘটনার কথা পাওয়া যায় যেখানে স্পার্টাবাসীদের অলিম্পিকে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হয়ে যায় ও ইকেচেইরিয়ার সময় লেপ্রিয়াম শহর আক্রমণকারীদের ২০০০মিনা জরিমানা করা হয়। তবে স্পার্টা এই জরিমানার বিরোধিতা করে বলে যে সেই সময় লেপ্রিয়াম আক্রমণ হয় তখনো যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়নি।[৩২][৩৪]

জানিসের ভিত্তিপ্রস্তর - প্রতারক প্রতিযোগীদের জরিমানার অর্থে তৈরী

যদিও সকল নগররাষ্ট্রগুলি যুদ্ধবিরতি পালন করত, এর অন্যথা হলে রাজনৈতিক ভাবে কোনো রকম বিধিনিষেধ ছিল না। অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে প্রাচীন গ্রীসের, তথা তর্কসাপেক্ষে প্রাচীন বিশ্বের, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।[৩৫] প্রভাব এতটাই বেড়ে যায় যে নগররাষ্ট্রগুলি একে নিজেদের প্রচারের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে চূড়ান্ত রাজনৈতিক অশান্তি ও বিতর্ক শুরু হয়। গ্রিক ঐতিহাসিক পসেনিয়াসের লেখায় সোতাদেস নামক এক প্রতিযোগির ঘটনায় এই পরিস্থিতির একটা উদাহরণ পাওয়া যায়,

"নবনবতিতম ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দুরপাল্লার দৌড়ে সোতাদেস বিজয়ী হন ও ঘোষণা করেন তিনি ক্রীটবাসী। প্রকৃতপক্ষে তিনি ক্রীট দ্বীপেরই অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু পরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতাই তিনি, ইফিসিয়ানদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে, নিজেকে ইফিসিয়ান বলে দাবী করেন। এর ফলে তিনি ক্রীট থেকে নির্বাসিত হন।"[১]

খেলার বিভাগসমূহ

একদল দৌড়বীর হপলিটোড্রোমোসে দৌড়াচ্ছেন।

একমাত্র গ্রিক ভাষী মুক্ত পুরুষেরাই (ক্রীতদাস নন এমন) প্রাচীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করতে পারতেন। বিভিন্ন গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলি অংশগ্রহণ করত বলে, কিছুটা হলেও এই অংশগ্রহণকে আন্তর্জাতিক বলা চলে। এছাড়া, অংশগ্রহণকারীরা গ্রিক উপনিবেশ থেকেও আসত, ফলত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিকতা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, এমনকি কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত ব্যপ্ত ছিল।

মূল খেলায় অংশগ্রহণের জন্য প্রতিযোগীদের যোগ্যতা অর্জন করতে হত, যাতে তাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়। সম্ভবতঃ শুধুমাত্র যুবাবয়সী প্রতিযোগীদেরই অংশগ্রহণে অনুমতি দেওয়া হত। গ্রিক লেখক প্লুটার্কের লেখা থেকেও পাওয়া যায়, যে একজন প্রতিযোগীকে বয়স বেশি মনে হওয়ায় প্রাথমিক ভাবে অংশগ্রহণে নিষেধ করা হয়। পরে স্পার্টার রাজার কাছে ঐ প্রতিযোগির যৌবনের সপক্ষে তার প্রেমিকা সাক্ষ্য দিলে, রাজার অনুমতিতে ঐ ব্যক্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে সমর্থ হয়। অংশগ্রহণের আগে সকল প্রতিযোগীকে জিউসের মূর্তির সামনে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করতে হত যে তারা দশ মাস যাবৎ অনুশীলন করেছে।

প্রথমে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা মাত্র একদিনের হলেও অচিরেই বেড়ে পাঁচদিনের প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। শুরুতে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা একটি মাত্র প্রতিযোগিতা ছিল: স্ট্যাডিয়ন (বা "স্ট্যাড") দৌড়, এটি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের দৌড় প্রায় ১৮০ এবং ২৪০ মিটার (৫৯০ এবং ৭৯০ ফু), যা একটি স্টেডিয়ামের দৈর্ঘ্যের সমান। তবে এই দৌড়ের সঠিক দূরত্ব আজও অনিশ্চিত, কারণ প্রত্নস্থলগুলিতে পাওয়া ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ও সমকালীন লেখায় পরস্পর বিরোধী হিসাব পাওয়া যায়। দৌড়বীরদের দৌড়ানোর সময় পাঁচটি খুঁটি পেরোতে হত: শুরুতে ও শেষে একটি করে এবং মাঝে আরও তিনটি।

অলিম্পিয়ার পাথরের দৌড় শুরুর যায়গার একটি অংশ; এখানে দুই পা রাখার জন্য খাঁজ কাটা রয়েছে।

৭২৪ খৃষ্ট পূর্বাব্দে ১৪শ অলিম্পিকের সময় ডায়াউলোস, বা দ্বি-স্ট্যাড দৌড়ের প্রচলন হয়। এটি আসলে স্টেডিয়ামের দ্বিগুণ দূরত্ব বা একপাকের সমান - প্রায় ৪০০ মিটার (১,৩০০ ফু), তবে গবেষকেরা এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন যে, প্রতিটি দৌড়বীরের পাক খেয়ে ফিরে আসার জন্য নিজস্ব খুঁটি ছিল; নাকি সকল দৌড়বীর একই খুঁটি থেকে পাক খেয়ে শুরুর স্থানে ফিরে আসত।

খৃঃ পূঃ ৭২০ অব্দে ডোলিকোস নামে তৃতীয় একটি দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করা হয়। যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাতে এই দৌড়ের দৈর্ঘ্য নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে, সম্ভবতঃ এই রেস প্রায় ১৮-২৪ পাকের হত, মানে, প্রায় তিন মাইল (৫ কিমি)। এটি অনেকটা আজকের ম্যারাথনের অনুরূপ - দৌড় শুরু ও শেষ স্টেডিয়ামে হলেও মাঝের পথটি আঁকা বাঁকা ভাবে পুরো অলিম্পিয়া জুড়েই ছিল। এই পথের ধার দিয়ে অলিম্পিয়ার বিভিন্ন যে সব মন্দির ও মূর্তি পড়ত, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নাইকির মূর্তি ও জিউসের মন্দির।

সর্বশেষ যে দৌড় প্রতিযোগিতাটি অলিম্পিকের নির্ঘন্টে যুক্ত হয়, তার নাম ছিল হপলিটোড্রোমোস, বা হপলাইট দৌড়। খৃঃ পূঃ ৫২০ সালে অলিম্পিকে এটির প্রচলন হয়। প্রথাগতভাবে এটি অলিম্পিকের শেষ দৌড় প্রতিযোগিতা হত। প্রতিযোগিরা পূর্ণ বা আংশিক বর্ম পরে, ঢাল হাতে, শিরস্ত্রাণ বা হাঁটুর নিজে বর্ম পরে, হয় একপাক নয়ত দুই পাক ডায়াউলোস (প্রায় ৪০০ বা ৮০০ গজ) দৌড়াত।[৩৬][৩৭] এই প্রতিযোগিতায় বর্মের ওজনই প্রায় ৫০ থেকে ৬০ পা (২৭ কেজি) হওয়ার দরুন, হপলিটোড্রোমোস আসলে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় গতি ও মনের জোরের পরীক্ষা হয়ে উঠেছিল। বর্মের ওজনের জন্য, প্রায়শঃই প্রতিযোগীদের হাত থেকে ঢাল পড়ে যেত বা কোনো পড়ে যাওয়া প্রতিযোগির গায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত। একটি পাত্রের গায়ে অঙ্কিত এই প্রতিযোগিতার চিত্রে দেখা যায়, কিছু প্রতিযোগী পড়ে থাকা ঢালের উপর দিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছে। এ কারণেই সম্ভবতঃ এই প্রতিযোগিতার পথটি মাটির তৈরী হত যার উপরে বালি ছড়িয়ে দেওয়া হত।

পরবর্তীকালে আরও বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সংযোজন হয়: মুষ্টিযুদ্ধ (পিগমি/পিগম্যাচিয়া), কুস্তি (পেল), এবং প্যাংক্রাশন।আধুনিক মিশ্র মার্শাল আর্টের পূর্বসূরী এই প্যাংক্রাশন কারণ এতে "সেযুগের" মুষ্টিযুদ্ধ ও কুস্তির মিশেল থাকত। যদিও মুষ্টিযুদ্ধ কথাটা এই জাতীয় খেলার একটি অতি সরলীকৃত শব্দ। এর বিভিন্ন ধারাগুলির মধ্যে থাই মুষ্টিযুদ্ধ, চীনা মুষ্টিযুদ্ধ, ফরাসি মুষ্টিযুদ্ধ, বর্মী মুষ্টিযুদ্ধ উল্ল্যেখযোগ্য। অন্যদিকে পুরাতত্ত্ব আমাদের দেখিয়েছে যে প্রাচীন গ্রেকো-রোমান কুস্তি বা পেল-এর আজকের যে কোনো ধরনের কুস্তি, এমনকি আধুনিক গ্রেকো-রোমান কুস্তির সাথে কোনো মিলই নেই।[৩৮] অন্যান্য খেলাগুলির মধ্যে রথচালনা, এবং আরও অনেক দৌড়ের প্রতিযোগিতা (ডায়াউলোস, হিপ্পিওস, ডোলিকোস, এবং হপলিটোড্রোমোস), এমনকি পেন্টাথলনও ছিল, যার মধ্যে কুস্তি, স্ট্যাডিয়ন, লং জাম্প, জ্যাভেলিন থ্রো, এবং ডিসকাস থ্রো। তবে শেষের তিনটি খেলার আলাদা কোনো প্রতিযোগিতা হত না।

সময়ের সাথে সাথে মুষ্টিযুদ্ধ ক্রমশঃ পাশবিক হয়ে পড়েছিল। প্রথমদিকে, নরম চামড়ার দস্তানা ব্যবহার হত, কিন্তু পরে, আরও শক্ত চামড়া দস্তানা ব্যবহার শুরু হয়; এমনকি কখনো কখনো বিভিন্ন ধাতু ভরে দস্তানা গুলি আরও ভারী করে তোলা হত।[৩৯] এক একটি লড়াইয়ে কোনো বিরতি থাকত না এমনকি প্রতিপক্ষ পড়ে গেলেও তাকে না মারার কোনো নিয়ম ছিল না। একটি লড়াই ততক্ষণ পর্যন্ত চলত যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন প্রতিযোগী আত্মসমর্পণ করছে বা মারা যাচ্ছে। তবে প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলাটা কখনোই ভালো চোখে দেখা হত না, বরং কোনো মুষ্টিযোদ্ধা লড়াইয়ে মারা গেলে তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হত।

খৃঃপূঃ ৪৮৪ বা ৪৮০ সালে, রেজিয়ামের অত্যাচারী শাসক অ্যানাক্সিলাস খচ্চরচালিত বিগা প্রতিযোগিতাটিতে বিজয়ী হন। এই টেট্রাদ্রাখ্ম বা চতুষ্কোণ মুদ্রাটি সেই ঘটনাটিকে স্মরনীয় করে রাখতে তৈরী করা হয়।[৪০]

রথ চালনার প্রতিযোগিতায়, চালকের বদলে রথের মালিক ও তার দলকেই প্রতিযোগী মনে করা হত। ফলে একজন মালিক একাধিক শীর্ষস্থান অধিকার করতে পারত। নতুন নতুন প্রতিযোগিতার সংযোজনে অলিম্পিক একদিনের অনুষ্ঠান থেকে বেড়ে পাঁচদিনের উৎসবে পরিণত হয়। তার মধ্যে তিন দিন বরাদ্দ ছিল প্রতিযোগিতার জন্য ও বাকি দুদিন ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য। শেষদিন, সকল প্রতিযোগির জন্য মহাভোজের আয়োজন করা হত। আর সেই ভোজে অলিম্পিকের প্রথমদিনে জিউসের কাছে বলি প্রদত্ত ১০০ মোষের মাংস খাওয়া হত।

অলিম্পিকের কোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ীকে জলপাই শাখা পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হত এবং এটি সারা গ্রীসে, বিশেষ করে বিজয়ীর নিজের শহরে, অসীম শ্রদ্ধার সাথে গৃহীত হত। নিজের শহরে একজন অলিম্পিক বিজয়ী প্রায়শঃই প্রচুর আর্থিক পুরস্কারও পেত (অ্যাথেন্সে দেওয়া হত ৫০০ দ্রাখমা, সে যুগের হিসাবে অনেকটাই) এছাড়া অন্যান্য পুরস্কারও দেওয়া হত; যেমন ক্রোটনের মিলোকে জলপাই তেলে পূর্ণ বড় বড় ঘড়া দেওয়া হয়েছিল। অলিম্পিক বিজয়ীদের মূর্তি তৈরী করা হত,[৪১] এবং কবিরা অর্থের বিনিময়ে বিজয়ীদের উদ্দেশ্যে স্তব গান গাইত।

প্রাচীন অলিম্পিকের অংশগ্রহণ করার অধিকার মূলতঃ ছেলেদের থাকলেও অশ্বচালনা প্রতিযোগিতায় মেয়েরা অংশ নিতে পারত। খৃঃ পূঃ ৩৯৬ ও পরে আবার খৃঃ পূঃ ৩৯২ সালে স্পার্টান রাজকুমারী সিনিস্কার ঘোড়াগুলি চার-চারটে ঘোড়দৌড়ে বিজয়ী হয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় কুমারী মহিলাদের (বাগদত্তা বা বিবাহিতা নয় এমন) অলিম্পিকের দর্শকাসনে বসার অনুমতি ছিল। আর অনুমতি ছিল, জিউসের মন্দিরে তৈলপ্রদীপ প্রজ্বলনকারী পূজারিণীদের।

নেবার প্রথার কারণ শুধুমাত্র ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়া জন্য নয়; বরং এই প্রতিযোগিতা কিছুটা হলেও মানব শরীরের অতুলনীয় ক্ষমতার উৎসব বলেও - অলিম্পিকে প্রতিযোগিরা নগ্ন হয়ে প্রতিযোগিতায় নামার প্রথা ছিল। সাবানের পরিবর্ত হিসাবে জলপাই তেল কাপড়কাচা, স্নান বা অন্যান্য পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত যেমন হত, তেমনি রূপচর্চার কাজেও ব্যবহৃত। জলপাই তেল প্রতিযোগীদের ত্বক মসৃণ আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করত।

বিখ্যাত প্রতিযোগী

প্রাচীন অলিম্পিক বিজয়ীদের তালিকা - ৭৫তম থেকে ৭৮তম ও ৮১তম থেকে ৮৩তম অলিম্পিয়াড (৪৮০-৪৬৮ খৃঃপূঃ, ৪৫৬-৪৪৮খৃঃপূঃ)।
  • স্পার্টা থেকে
    • স্পার্টার সিনিস্কা (দৌড়: স্ট্যাডিয়ন, ডায়াউলোস, লং ও ট্রিপল জাম্প) (অলিম্পিক বিজয়ীর তালিকায় স্থান পাওয়া প্রথম মহিলা)
  • রোডস থেকে:
    • রোডসের ডায়াগোরাস (মুষ্টিযুদ্ধ ৭৯তম অলিম্পিয়াড, ৪৬৪খৃঃ পূঃ) এবং তার সুযোগ্য পুত্রদ্বয় আকুসিলাওস ও ড্যামাগেতোস (মুষ্টিযুদ্ধ ও প্যাঙ্ক্রাশন)
    • রোডসের লিওনিডাস (দৌড়: স্ট্যাডিয়ন, ডায়াউলোস এবং হপলিটোড্রোমোস)
  • ক্রোটন থেকে:
    • ক্রোটনের অ্যাস্টিলোস (দৌড়: স্ট্যাডিয়ন, ডায়াউলোস এবং হপলিটোড্রোমোস)
    • ক্রোটনের মাইলো (কুস্তি)
    • ক্রোটনের স্ট্যানলিওবোস (স্ট্যাডিয়ন)
    • ক্রোটনের টিমাসিথিওস (কুস্তি)
  • অন্যান্য শহর থেকে:
    • এলিসের কোরোইবোস (স্ট্যাডিয়ন, প্রথম অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন)
    • মেগারার ওর্সিপ্পাস (দৌড়: ডায়াউলোস)
    • থাসোসের থেজিনিস (প্যাঙ্ক্রাশন)
  • গ্রিক নন এমন প্রতিযোগী:
    • টাইবেরিয়াস (চারঘোড়ার রথের চালক)[৪২]
    • নিরো (দশ ঘোড়ার রথের চালক)
    • ভারাস্টাডেস, আর্মেনিয়ার যুবরাজ - এখনো পর্যন্ত জানা সর্বশেষ প্রাচীন অলিম্পিক বিজয়ী (মুষ্টিযুদ্ধ) - ৪র্থ শতাব্দীতে অনুষ্ঠিত ২৯১তম অলিম্পিক[৪৩]

অন্যান্য স্থানে অনুরূপ উৎসব

অলিম্পিয়ায় অনুষ্ঠিত "অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা" নামক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের খ্যাতির কারণে একই নামের আরও অনেক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সেই যুগের পুরো গ্রিক দুনিয়াতেই স্থানে স্থানে শুরু হয়ে যায়। এদের মধ্যে কয়েকটির কথা শুধুমাত্র কিছু শিলালিপি ও মুদ্রা থেকে জানা যায়; অন্যদিকে অ্যান্টিওকের অলিম্পিক কিন্তু বেশ খ্যাতি অর্জন করে। একটা সময় এত বেশি "অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা" চালু হয়ে যায় যে আসল অলিম্পিককেই কোনো কোনো শিলালিপিতে "পিসার অলিম্পিক" বলে সম্বোধন করা হয়।[৪৪]

আরও দেখুন

  • পিন্ডার
  • হেরেয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতা
  • অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা
  • ইস্থমিয়ান ক্রীড়া প্রতিযোগিতা
  • অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উৎসব
  • অলিম্পিয়ার প্রত্নতাত্তিক জাদুঘর

টিকা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

টেমপ্লেট:অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন