শাক্তধর্ম

হিন্দুধর্মের দেবী-কেন্দ্রিক সম্প্রদায়
(শাক্ত থেকে পুনর্নির্দেশিত)

শাক্তধর্ম বা শাক্ত (সংস্কৃত: शाक्तं) হলো হিন্দুধর্মের একটি শাখা। শাক্তধর্মে দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী হলেন পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর। হিন্দুধর্মের প্রধান চারটি শাখার অন্যতম শাক্তধর্ম। অন্য তিনটি শাখা হল বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্মস্মার্তধর্ম

শাক্তধর্ম হিন্দুধর্মের একটি দেবীকেন্দ্রিক ঐতিহ্য।[১][২] ত্রাণকর্তা বৈষ্ণবী, বরাহী, ইন্দ্রাণীচামুণ্ডার মূর্তি

শাক্তধর্মমতে, দেবী হলেন পরব্রহ্ম। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। অন্য সকল দেব ও দেবী তার রূপভেদমাত্র। দর্শন ও ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে শাক্তধর্মের সঙ্গে শৈবধর্মের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। যদিও শাক্তরা কেবলমাত্র ব্রহ্মের শক্তিস্বরূপিণী নারীমূর্তিরই পূজা করে থাকেন। এই ধর্মে ব্রহ্মের পুরুষ রূপটি হল শিব। তবে তার স্থান শক্তির পরে এবং তার পূজা সাধারণত সহায়ক অনুষ্ঠান রূপে পালিত হয়ে থাকে।[৩]

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ভারতে শক্তিপূজা প্রচলিত। ১৬০০ বছরেরও আগে ভারতের প্যালিওলিথিক জনবসতিতে প্রথম দেবীপূজার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে সিন্ধু সভ্যতার যুগে এই সংস্কৃতি আরও উন্নত রূপে দেখা দেয়। বৈদিক যুগে শক্তিবাদ পূর্বমর্যাদা হারালেও পুনরায় ধ্রুপদী সংস্কৃত যুগে তার পুনরুজ্জীবন ও বিস্তার ঘটে। তাই মনে করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই "হিন্দু ঐতিহ্যের ইতিহাস নারী পুনর্জাগরণের ইতিহাস রূপে লক্ষিত হয়"।[৪] বৈদিক যুগেও শক্তিপূজা প্রচলিত ছিল । ঋকবেদের দেবীসূক্ত এবং রাত্রিসুক্ত থেকে প্রমাণিত হয় এটি। ঋকবেদে বিশ্বদুর্গা,সিন্ধু দুর্গা, অগ্নি দুর্গা এবং অন্যান্য দেবীর উল্লেখ আছে। সংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রে "ভদ্রকালী" নামটি আছে।

শাক্তধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংস্কৃত সাহিত্যহিন্দু দর্শনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল শক্তিবাদ তথা তন্ত্র সাধনা। এমনকি আজও জনপ্রিয় হিন্দুধর্মের উপর এই মতবাদের প্রভাব অপরিসীম। ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার বাইরেও বহু অঞ্চলে তান্ত্রিক ও অতান্ত্রিক পদ্ধতি সহ একাধিক পন্থায় শাক্ত ধর্মানুশীলন চলে। যদিও এই ধর্মের বৃহত্তম ও সর্বাধিক প্রচলিত উপসম্প্রদায় হল দক্ষিণ ভারতের শ্রীকুল (ত্রিপুরসুন্দরী বা শ্রী আরাধক সম্প্রদায়) এবং উত্তরপূর্ব ভারতের, বিশেষত বঙ্গদেশের কালীকুল । হিন্দু তন্ত্রের মত বৌদ্ধতন্ত্রেও অসংখ্য গ্রন্থ আছে । মূল কল্পতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র নামক দুইখানি প্রাচীনতম বৌদ্ধতন্ত্র যথাক্রমে প্রথম ও তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত হয়। চীনদেশীয় ত্রিপিটক এ চীনা ও তিব্বতীয় ভাষায় অনূদিত কয়েকটি গ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । জাপানে এক বৌদ্ধ দেবী পূজিতা হন তার নাম সপ্তকোটি বুদ্ধমাতৃকা "কোটিশ্রী। বৌদ্ধ ধর্মের মারিচি দেবীও দশভূজা। তিব্বতি লামাগণ মারিচি দেবীকে উষাদেবীরূপে আবাহন করেন । বৌদ্ধ শাস্ত্র মহাবস্তু তে আছে বুদ্ধদেব যখন মায়ের সাথে কপিলাবস্তু তে আসেন তখন শাক্যবংশের শাক্য বর্ধন মন্দিরে অভয়াদেবীর পূজা করেন। চীনের ক্যান্টন শহরে অবস্থিত বৌদ্ধমন্দিরে একটি শতভুজা দেবী মূর্তি আছে [৩]

জৈন ধর্মেও শক্তি বাদের প্রকাশ রয়েছে। রাজপুতানার আবু পাহাড়ে যে বিখ্যাত শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত সুবৃহৎ জৈন মন্দির রয়েছে, তার শীর্ষে ষোলটি জৈন দেবদেবীর বিগ্রহ রয়েছে । কাথিয়াবাড়েৱ গিরনার পর্বতে পাষাণ নির্মিত সরস্বতী মূর্তি পাওয়া গেছে। "রত্ন সাগর" নামক জৈন ধর্মগ্রন্থে সরস্বতী দেবীকে "বিশ্বরূপিনী" বলা হয়েছে ।

সামগ্রিক ধারণা

শক্তি ও শিব


শাক্ত বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবীই সর্বোচ্চ ও পরম দৈবসত্ত্বা। তিনিই সমগ্র সৃষ্টির উৎস ও স্বরূপ এবং সর্বজীবের শক্তি ও চালিকা। মনে করা হয়, “বিশ্বের ধর্মীয় ইতিহাসের কোথাও আমরা এই প্রকার সম্পূর্ণ নারীতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখি না।”[৫]

শাক্ত মতবাদ দৈব নারীসত্ত্বায় কেন্দ্রীভূত হলেও তা পুরুষ বা জড় দৈবসত্ত্বাকে অস্বীকার করে না। যদিও মনে করা হয় যে এই উভয় প্রকার দৈবসত্ত্বায় শক্তির উপস্থিতি বিনা নিষ্ক্রিয়। আদি শংকর তার প্রসিদ্ধ শাক্ত স্তোত্র সৌন্দর্যলহরী-র প্রথম পংক্তিতে বলেছেন, “শক্তির সহিত মিলিত হইলে শিব সৃষ্টিক্ষম হন; না হইলে তাঁহার আলোড়ন তুলিবার ক্ষমতা পর্যন্ত নাই।” [৬] এই হল শাক্তধর্মের মূলতত্ত্ব।[৭] আপাতদৃষ্টিতে প্রাণহীন শিবের দেহের উপর দণ্ডায়মান দেবী কালীর বহুপরিচিত মূর্তিটি এই তত্ত্বেরই মূর্তরূপ।[৮]

অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে শিবশক্তি। (এলিফান্টা গুহা, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী, মুম্বাই, ভারত)

সাধারণভাবে, শক্তিকেই মহাবিশ্ব মনে করা হয়। তিনি বলশালিতা ও কর্মক্ষমতার মূর্ত প্রতীক। তিনি পার্থিব জগতের অস্তিত্ব ও সকল ক্রিয়ার পশ্চাতে বিদ্যমান কারণস্বরূপা ঐশীশক্তি। শিব তার সহকারী পুরুষ সত্ত্বা; তিনি সমগ্র সত্ত্বার দিব্যক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। "শিব বিনা শক্তি অথবা শক্তি বিনা শিবের কোনো অস্তিত্ব নাই। তাঁরা উভয়ে [...] এক।” [৯]

ঐতিহাসিক ভি. আর. রামচন্দ্র দীক্ষিতরের মতে,[১০] “শাক্তধর্ম হল জীবনবাদী (dynamic) হিন্দুধর্ম। শাক্তধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত রয়েছে চৈতন্যরূপে শক্তির স্বীকৃতি ও শক্তি ও ব্রহ্মের সত্ত্বাপরিচিতি (identity) মধ্যে। সংক্ষেপে বললে, ব্রহ্ম হল জড়রূপী শক্তি ও শক্তি হল জীবনরূপী ব্রহ্ম।” (এখানে ব্রহ্ম অর্থে শিব) [১১] ধর্মীয় শিল্পকলায় অর্ধশক্তি-অর্ধশিব দেবতা অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে এই বিশ্বজীবনতত্ত্ব জোরালোভাবে মূর্ত হয়েছে। ভাগবত পুরাণের প্রসিদ্ধ টীকাকাৱগনেৱ মতে অগ্নির দাহিকা শক্তিৱ মতো ব্রহ্মের স্বাভাবিক শক্তি রয়েছে। বিষ্ণুপুরাণে আছে, ব্রহ্মার প্রধান শক্তি ব্রহ্মা-বিষ্ণু- শিব ।মার্কন্ডেয় পুরাণের মত অনেক পুরাণে দেবীমাহাত্ম্য শীর্ষক অধ্যায় আছে। দেবীভাগবতেএবং বামন পুরাণের 18 ও 19 নম্বর অধ্যায়ে দেবীমাহাত্ম্য রয়েছে। দেবগনের দেহজাত পুঞ্জিভূত শক্তি থেকে দেবী কাত্যায়নীর আবির্ভাব মার্কন্ডেয় পুরাণের মত বামন পুরাণে(18, 19 অধ্যায়ে) এবং দেবীভাগবতে(5/8)বিবৃত। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডে আছে মহাশক্তিমুলা প্রকৃতি থেকে বিশ্ব উৎপন্ন এবং তিনি বিশ্বপ্রপঞ্চেৱ সাৱভুতা সত্তা । দেবী ভাগবত এর মতে সর্বভূতে শক্তি আত্মারূপে বিদ্যমান এবং প্রাণী শক্তিহীন হলে নিষ্ক্রিয় হয়। উক্ত পুরাণ অনুসারে পরমপুরুষ দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগ সচ্চিদানন্দ এবং দ্বিতীয় ভাগ পরাশক্তি ।কিন্তু দুই ভাগ মূলত অভিন্ন। [১২]

শাক্তধর্ম মনে করে, শিব সহ কার্যত সৃষ্টির দৃশ্য ও অদৃশ্য “সবেরই” উৎস, সার ও সত্ত্বা হলেন দেবী। প্রধান শাক্ত ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণ-এ দেবী ঘোষণা করেছেন:

"আমিই প্রত্যক্ষ দৈবসত্ত্বা, অপ্রত্যক্ষ দৈবসত্ত্বা, এবং তুরীয় দৈবসত্ত্বা। আমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব; আবার আমিই সরস্বতী, লক্ষ্মীপার্বতী। আমি সূর্য, আমি নক্ষত্ররাজি, আবার আমিই চন্দ্র। আমিই সকল পশু ও পাখি। আবার আমি জাতিহীন, এমনকি তস্করও। আমি ভয়াল কর্মকারী হীন ব্যক্তি; আবার আমিই মহৎ কার্যকারী মহামানব। আমি নারী, আমি পুরুষ, আমিই জড়।"[১৩]

ধর্মবিশারদ সি. ম্যাককেঞ্জি ব্রাউন শাক্তধর্মের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, "স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, দুই লিঙ্গের মধ্যে নারীসত্ত্বাই মহাবিশ্বের প্রধান শক্তিস্বরূপা। যদিও সত্যকারের পরম সত্ত্বাকে পেতে দুই লিঙ্গকেই পরম সত্ত্বার সঙ্গে যোগ করতে হবে। পুরুষ ও নারী দৈবসত্ত্বার দুই রূপ। তুরীয় সত্য তাঁদের নিয়েই তাঁদের বাইরে প্রসারিত হয়েছে। এইভাবেই চৈতন্যরূপা দেবী লিঙ্গকে অতিক্রম করেন। কিন্তু তাঁর এই অতিক্রমকরণ তাঁর সর্বেশ্বরবাদী সত্ত্বার বাইরে ঘটে না।"[১৪]

ব্রাউন আরও লিখেছেন, "বাস্তবিক, তুরীয় ও সর্বেশ্বরবাদী সত্ত্বার এই স্বীকৃতি দিব্য জননী [ও তাঁর] সর্বোচ্চ বিজয়ের সারবত্তা। এমন নয় যে তিনি শেষাবধি পুরুষ দেবতাদের তুলনায় অনন্তভাবে শ্রেষ্ঠতর। যদিও শাক্তধর্ম মতে তিনি তা-ই। কিন্তু তিনি প্রকৃতি রূপে তাঁর নারীসত্ত্বাকে অতিক্রম করেন, তাকে অস্বীকার না করেই।[১৫] শাস্ত্রমতে এক অদ্বিতীয় নিরতিশয় চৈতন্যস্বরূপ ব্রম্ভ অনাদিসিদ্ধ মায়ার আবরণে ধর্ম ও ধর্মী রূপে প্রতিভাসিত হন । নানা উপনিষদে ব্রহ্মের ঈক্ষণ বহুভাবে বর্ণিত । এই ঈক্ষনই ব্রহ্মের নিত্য -জ্ঞান- ইচ্ছা -ক্রিয়া। একে স্যার জন উডৱফ "creative imagination" বলেছেন। শাক্ত সিদ্ধান্তের সারতত্ত্ব এই যে মহাশক্তি ব্রম্ভধর্মরুপা। ধর্মজগতকাৱন ব্রহ্ম থেকে একই বলে চিদৱূপিনী, সদৱূপিনী ও আনন্দময়ী এবং এই জগত ব্রহ্মশক্তি পরিনাম।

শাক্তধর্ম ও তন্ত্র

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন