ক্রিপস অভিযান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের প্রচেষ্টার জন্য পূর্ণ ভারতীয় সহযোগিতা এবং সমর্থন নিশ্চিত করার জন্

ক্রিপস অভিযান হল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের পূর্ণ সহযোগিতা এবং সমর্থন আদায় করার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার বর্ষীয়ান সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এর নেতৃত্ব দেন। ক্রিপস বামপন্থী লেবার দলের সদস্য ছিল যেই দলটি ঐতিহ্যগতভাবেই ভারতীয় স্বায়ত্তশাসনের পক্ষপাতী ছিল। তা সত্ত্বেও ক্রিপস উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধকালীন কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেন। চার্চিল দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় স্বাধীনতাবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিলেন।

ক্রিপসকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়ের প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম লীগের সাথে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্রই নতুন নির্বাচন এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দেন। এর পরিবর্তে তিনি ভারতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশের আহবান জানান। ক্রিপস ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে এই প্রস্তাবগুলোর খসড়া প্রস্তুত এবং প্রকাশ করেন। বড় দুই দলই ক্রিপসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি চার্চিলও এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কোনোরূপ মধ্যস্থতায় পৌঁছানোও সম্ভব হয়নি। যার দরুন অভিযানটি ব্যর্থ হয়। কংগ্রেস পরবর্তীতে ভারত ছাড় আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের যুদ্ধ প্রচেষ্টার সর্বাত্মক বিরোধিতা করে। পরিণামে ব্রিটিশ সরকার সম্পূর্ণ কংগ্রেস নেতৃত্বকে যুদ্ধকালে কারান্তরীণ করে রাখে। জিন্নাহ এবং মুসলিমরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ফেডারেশন থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ পেয়ে ব্রিটিশদের যুদ্ধপ্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানান এবং ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশদের কাছে তাঁদের কদর বেড়ে যায়।[১]

স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস

পটভূমি

গোলটেবিল বৈঠক,সাইমন কমিশন এবং ভারত শাসন আইন-১৯১৯ এর আলোকে ভারত শাসন আইন-১৯৩৫ প্রণীত হয়। এর প্রতিপাদ্য ছিল একটি সর্বভারতীয় ফেডারেশন গঠন, যার ফলে ভারতীয়রা রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিকতর ক্ষমতা লাভ করবে। কিন্তু স্বাধীন রাজাদের কর্তৃত্বাধীন অধিরাজ্য এবং কংগ্রেসের পারস্পরিক মতানৈক্য, এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পারস্পরিক মতানৈক্যের ফলে এর বাস্তবায়নের গতি মন্থর হয়ে পড়ে। আইনের প্রাদেশিক অংশটুকুই শুধু বাস্তবায়িত হয়েছিল।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্য জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের সাথে কোন ধরনের পরামর্শ ছাড়াই ভারতকে যুদ্ধরত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। লিনথিনগোর এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় স্বায়ত্তশাসনের অগ্রগতি বাস্তবায়নে একটি বিরাট বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়। কংগ্রেস এতে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয় এবং দলে অতিদ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তীব্র হয়ে উঠে। নানারকম দাবিদাওয়ার পরিবর্তে মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভাসহ অনেক আঞ্চলিক দলই ব্রিটিশদের প্রতি সমর্থন জানায়। কংগ্রেসবিরোধিতায় সৃষ্ট অচলাবস্থায় কংগ্রেস-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাদেশিক সরকারগুলো একের পর এক পদত্যাগ করে, যা গণবিদ্রোহ এবং বিশৃঙ্খলা উসকে দেয়।

জাপানিজ সাম্রাজ্য ডাচ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট খুব দ্রুত পাল্টে যায়। ১৯৪২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের পতন এবং রেঙ্গুন যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর আত্মসমর্পণের ফলে ব্রিটিশদের প্রতি আস্থা অনেকাংশেই হ্রাস পায়। ভারত দখলের হুমকি অনেকটাই বাস্তব হয়ে উঠে। জাপানিদের সঙ্গে কংগ্রেসের অনেক সদস্যের আঁতাতও শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কংগ্রেসের সাথে আপোসের বিষয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। লেবার পার্টি এবং কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যপন্থী সদস্যরা ভারতকে অধিক স্বায়ত্তশাসন দিতে চাইলেও চার্চিল এর বিরোধিতা করেন। চার্চিল মনে করতেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অশ্বেতাঙ্গ প্রজারা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভের যোগ্যতা রাখে না। চার্চিলের এহেন মানসিকতা তাঁকে খোদ কনজারভেটিভ পার্টিতেই বিচ্ছিন্ন অবস্থানে নিয়ে যায়। তবে ভারতসচিব লিও অ্যামেরি চার্চিলকে সমর্থন করেন।

পুরো ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্র অধিক গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করে। বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চিয়াং কাই শেকের নেতৃত্বাধীন চীনা সরকার অংশগ্রহণ করে। চীনা সরকারকে সাহায্য প্রদানে একটি গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক হিসেবে ভারতের প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উপলব্ধি করে। মায়ানমার সীমান্তে সুরক্ষিত উপায়ে পণ্য পরিবহনেও ভারতীয় সেনাদের প্রয়োজন অনুভূত হয়। তবে ভারতীয় জনগণ এবং কংগ্রেসের সমর্থন ব্যতীত এ লক্ষ্যগুলোর পূরণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারে উপনিবেশবাদের অবসান হওয়া প্রয়োজন ছিল।[২]

সমর্থন ও বিরোধিতার প্রশ্নে বিতর্ক

`কংগ্রেস

ব্রিটিশকে সমর্থন করা এবং বিরোধিতা করার প্রশ্নে কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করলেও চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর ন্যায় নেতৃবৃন্দ তাদের সাথে মৈত্রী স্থাপনের আহবান জানান। তাঁরা মনে করেন, ব্রিটিশদের সহযোগিতা প্রদান করলে তাঁরা স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হবেন। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশদের সমর্থনদানে অস্বীকৃতি জানান। তবে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল,মৌলানা আজাদ,জওহরলাল নেহরু প্রমুখ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে সবুজসংকেত পেয়ে রাজাগোপালাচারী ক্রিপসের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

মুসলিম লীগ

জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। পাকিস্তানের পরিবর্তে অখণ্ড ভারত সৃষ্টির প্রস্তাব তাঁকে ক্ষুব্ধ করে। এপ্রিলে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি ক্রিপস অভিযানের সমালোচনা করেন।আলোচনার শেষ ধাপে মুসলিম লীগকে অন্তর্ভুক্ত না করায় জিন্নাহ উষ্মা প্রকাশ করেন। [৩]

ভারতে ক্রিপস

ক্রিপস এবং গান্ধী

ভারতে পৌঁছে ক্রিপস আলোচনার চেষ্টা করলেও পারস্পরিক আস্থাহীনতার কারণে সেই আলোচনা ক্রমেই ব্যর্থ হতে থাকে। ক্রিপস নেহরুর বন্ধু ছিলেন এবং সে আলোকেই তিনি সমঝোতার চেষ্টা চালান। চার্চিল এবং লিও অ্যামেরি কী মাত্রায় আপোস করার জন্য ক্রিপসকে অনুমতি দেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। ভারতের প্রতিরক্ষাবাহিনী ব্রিটিশদের জন্য সংরক্ষিত রেখে অপরাপর বিষয়ে ভারতকে "পূর্ণ ডোমিনিয়ন"রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দেবার ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। এছাড়াও তিনি লর্ড লিনথিনগোকে পদচ্যুত করারও আশ্বাস দেন। তবে এ সকল আলোচনাই তিনি একান্তে রাজনীতিকদের সাথে সম্পন্ন করেন। জনসমক্ষে ভাইসরয়ের নির্বাহী কাউন্সিলে ভারতীয় সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো সুদৃঢ় প্রস্তাব তিনি উত্থাপন করতে পারেননি।

কংগ্রেসের সাথে ব্রিটিশ সরকারের সম্পর্কের ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। মহাত্মা গান্ধী মন্তব্য করেন, "ক্রিপস মিশন একটি দেউলিয়া ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ চেক।"

ব্যর্থতার কারণ

নিম্নোক্ত কারণে ক্রিপস মিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় :

১.গান্ধীর বিরোধিতার ফলে কংগ্রেস কর্তৃক ক্রিপসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা।

২.ক্রিপস কর্তৃক সংশোধিত প্রস্তাবে স্বাধীনতা বিষয়েকোনোকিছু উল্লেখ না করা।

৩.পর্দার অন্তরালে ভারতসচিব এবং ভাইসরয় লিনথিনগোর এ অভিযানের উদ্দেশ্য সফল হতে বাধাদান।[৪]

সুদূরপ্রসারী প্রভাব

বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে এ অভিযানের সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনুভূত হয়। চার্চিল বলেন, "ক্রিপস অভিযানে প্রস্তাবিত স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। " কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী নির্বাচনে ক্লিমেন্ট অ্যাটলির লেবার পার্টি বিজয়ী হলে স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়। ১৯৪৫-১৯৪৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে কংগ্রেসও রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে প্রত্যাবর্তন করে। ১৯৪৭ সালে এরই ধারায় ভারত ও পাকিস্তান নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।[৫]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকাজী নজরুল ইসলামবাংলাদেশ ডাক বিভাগশেখ মুজিবুর রহমানএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশছয় দফা আন্দোলনক্লিওপেট্রাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়ামুহাম্মাদব্লু হোয়েল (খেলা)বাংলা ভাষাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাভারতভূমি পরিমাপবাংলা ভাষা আন্দোলনমহাত্মা গান্ধীমিয়া খলিফামৌলিক পদার্থের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলপহেলা বৈশাখপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামাইকেল মধুসূদন দত্তসুনীল ছেত্রীবাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তালিকাবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহআসসালামু আলাইকুমপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশেখ হাসিনাবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীজয়নুল আবেদিন