কালো সেপ্টেম্বর (জর্ডানের গৃহযুদ্ধ)

১৯৭০-১৯৭১ সালের জর্ডানি গৃহযুদ্ধ

কালো সেপ্টেম্বর বলতে ১৯৭০ সালের ১৬ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাত এর নেতৃত্বাধীন মুনাজ্জামাত আল-তাহরির আল-ফিলিস্তিনিয়া (ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা) এবং জর্ডানের সম্রাট হুসাইন বিন তালাল এর নেতৃত্বাধীন জর্ডান সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধকে বোঝানো হয়। যদিও কিছু এলাকায় যুদ্ধ ১৯৭১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

সৌদি প্রভাবশালী নেতার সাথে জামাল আবদেল নাসের

এই গৃহযুদ্ধ জর্দান আল-হাশিম রাজবংশ দ্বারা পরিচালিত হবে নাকি মুনাজ্জামাত আল-তাহরির আল-ফিলিস্তিনিয়া দ্বারা পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করে। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ফিলিস্তিনি নাগরিক ছিলেন। যুদ্ধশেষে জর্ডানে মুনাজ্জামাত আল-তাহরির আল-ফিলিস্তিনিয়া এর নেতৃত্ব শেষ হয় এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে লেবাননে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

পটভূমি

জর্দানে ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের আধিক্য

১৯৪৭ এর শেষের দিকে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাগ পরিকল্পনা একই সাথে একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা করে,ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট এর অবসান ঘটায় এবং ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণায় ভূমিকা রাখে। তীব্র জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রভাবে চলমান গৃহযুদ্ধটি ধীরে ধীরে ইসরায়েল এবং আরব রাজ্যগুলোর যুদ্ধে পরিণত হয়।ইরাকের সৈন্য বাহিনী সহ মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়ার সৈন্য বাহিনী প্রথমে তৎকালীন মেন্ডেটরি প্যালেস্টাইন এ আক্রমণ চালায়। তারা আরব সাগর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং সাথে সাথে ইসরায়েলি বাহিনী এবং কিছু ইহুদি বসতির উপর হামলা চালায়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৪৯ এর যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান হয়।যুদ্ধের ফলস্বরুপ মেন্ডেটরি প্যালেস্টাইন এর বাকি অংশ মিশর এবং তৎকালীন ট্রান্সজর্ডান আমিরাত এর অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৯ সালে ট্রান্সজর্ডান নিজের নাম পরিবর্তন করে জর্ডানে পরিণত হয়; ১৯৫০ এ জর্দান নদীপশ্চিম তীর এর অন্তর্ভুক্ত হয় এবং জর্ডানিয় সরকারে ফিলিস্তীনি প্রতিনিধিত্বের সূচনা করে। ১৯৪৮ এর সেপ্টেম্বরে মিশরের অধীন গাজা ভূখণ্ড এ একটি সর্ব ফিলিস্তিনি সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হয়, যেটি আংশিকভাবে আরব লীগ দ্বারা স্বীকৃত ছিল(ট্রান্সজর্ডান বাদে) , কিন্তু এর ক্ষমতা ছিল সীমিত এবং ১৯৫২ সালে একে বৈধভাবে মিশরের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা হয়।১৯৫৯ সালে জামাল আবদেল নাসের একে কার্যকর ভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। জর্ডান এবং পশ্চিম তীরের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জর্ডান নাগরিক ছিল। ফিলিস্তিনিদের জর্ডান পার্লামেন্টে প্রায় অর্ধেক এবং বেশ কিছুসংখ্যক সরকারি পদ দেয়া হয়। Moshe Shemesh দাবি করেন যে এটি জর্ডানের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠে। পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনি সমস্যাসমূহের সমাধানের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠে। সম্রাট হুসাইন এর মতে ফিলিস্তিনি সমস্যাগুলো জর্ডানের জন্য ছিল "জীবন- মৃত্যু" সমস্যার সমতুল্য। সম্রাট হুসাইনের ভয় ছিল পশ্চিম তীর স্বাধীন হলে তার স্বায়ত্বশাসন হুমকির মধ্যে পড়বে। অনেক আরব দেশই তখন ফিলিস্তিনি সঙ্ঘাত গুলোর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিল। বিশেষ করে মিশরের রাষ্ট্রপতি জামাল আবদেল নাসের রাজনৈতিক সমর্থন ও প্রকাশ করেন। ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক সংগঠন ফাতাহ ১৯৬৫ সালে জানুয়ারিতে ইসরাইলে পরিকল্পিত হামলা শুরু করে। তাছাড়া ফিলিস্তিনি ফিদায়ীন(Palestinian fedayeen) নামক একটি গেরিলা বাহিনী বারবার ইসরায়েলী সীমান্তে আক্রমণ চালাতে থাকে।এই আক্রমণের পাল্টা জবাবও আসতে থাকে। জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের শান্তি এবং নিরাপত্তা বিষয়ক দীর্ঘমেয়াদি গোপন সম্পর্ক ছিল। কিন্তু জর্ডান সরকারের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে সম্রাট হুসেনের আক্রমণ বন্ধ করার বেশির ভাগ আদেশ ই অমান্য করা হত।

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল জর্ডানের সাথে ৬ দিন যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম তীর দখল করে ।

কারামেহ'র যুদ্ধঃ

১৯৬৮ সালের ২১ মার্চ ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী জর্ডানে প্রবেশ করে। মুনাজ্জামাত আল-তাহরির আল-ফিলিস্তিনিয়া(পি এল ও) এর প্রায় ২০০ সদস্য নিহত হয় এবং ১৫০ জন আটক হয়। ৪০ জন জর্ডান সৈন্যেরও মৃত্যু ঘটে। এসময় প্রায় ২৮-৩৩ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয় এবং ৬৯-১৬১ জন আহত হয়। এই যুদ্ধ পি এল ও এর জর্ডান নদী তীরবর্তী ঘাটিগুলোর দুর্বলতা ফুটিয়ে তোলে। এজন্য পি এল ও তাদের ঘাটিগুলো পর্বতাঞ্চল এর দিকে সরিয়ে নেয়। এরপর ইসরায়েলিরা সাধারণ জর্ডান নাগরিক সমাজে আশ্রয় নেয়া ফিলিস্তিনি সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে।যা ধীরে ধীরে গেরিলা ও জর্ডানের নাগরিকদের মাঝে সঙ্ঘাত বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

সাত দফা চুক্তিঃ

ফিলিস্তিনি ছিটমহল ও শরণার্থী শিবিরগুলোয় জর্ডান পুলিশ ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল। পি এল ও যোদ্ধারা প্রকাশ্যে বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করত এবং কর উত্তোলনের চেষ্টা করত। ১৯৬৮ এর আলোচনার সময় সম্রাট হুসেইন ফিলিস্তিনি সংগঠন গুলোর সাথে সাত দফা চুক্তিতে পৌঁছান :

  1. সংগঠনের সদস্যরা শহরের বাহিরে সশস্ত্র এবং উর্দি পরিহিত অবস্থায় চলাফেরা করতে পারবে না।
  2. সংগঠনের সদস্যরা সাধারণ নাগরিকদের গাড়ির গতি রোধ এবং তল্লাশি চালাতে পারবে না।
  3. সংগঠনের সদস্যরা চাকরিতে নিয়োগের জন্য জর্ডান সেনাবাহিনীর সাথে প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারবে না।
  4. সংগঠনের সদস্যদের সর্বদা জর্ডানিয় পরিচয়পত্র সাথে বহন করতে হবে।
  5. সংগঠনের সদস্যদের যানবাহনে জর্ডানের লাইসেন্স থাকতে হবে।
  6. সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত যেকোন অপরাধ্মূলক কাজ জর্ডান কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিরীক্ষিত হবে।
  7. ফিলিস্তিনি সংগঠন এবং সরকারের মধ্যবর্তী যেকোন বিতর্ক সম্রাট হুসেন এবং পি এল ও এর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমিটির মাধ্যমে সমাধান করা হবে।

কিন্তু পিএলও এই সাত দফা চুক্তি মেনে চলল না। বরং ধীরে ধীরে এই অঞ্চল জর্ডানে একটি স্বাধীন অঙ্গরাজ্য হবার পথে এগিয়ে যেতে থাকে। ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের গ্রুপে কোন নিয়ম শৃঙ্খলা ছিল না এবং এই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোন কেন্দ্রীয় অবকাঠামো ছিল না।অনেক সংগঠনই ছিল নতুন এবং কারামেহ'র যুদ্ধের পর নতুন নতুন সংগঠনের সৃষ্টি হয়।যা একটি অবিশ্বাস পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। নতুন নতুন তৈরি হওয়া সংগঠন গুলো নিজেদের দিকে কর্মীদের আকৃষ্ট করারা জন্য মৌলবাদের দিক থেকে একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। পি এল এফ পি( Popular Front for the Liberation of Palestine) এবং ডি এফ এল পি(Democratic Front for the Liberation of Palestine) এর কিছু বামপন্থী ফিলিস্তিনি আন্দোলন প্রকাশ্যে জর্ডানের গণতন্ত্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করে এবং এর অবসানের দাবি জানায়। একই সাথে তারা বিভিন্ন উদ্দেশ্য প্রণোদিত ধর্মবিরোধী কাজের মাধ্যমে রক্ষণশীল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে থাকে। অন্য কথায় বলা যায়, দুর্বল সরকার ব্যাবস্থাপনার পরিপ্রেক্ষিতে ফিদায়ীন একটি অপরাধ্মূলক সংগঠনে পরিণত হয়ে পড়ছিল। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ জর্ডানিয় সমস্যায় না জড়ানোর অঙ্গিকার ব্যক্ত করে। তবে দলের অনেক সদস্যই তা মেনে নেয়নি।এর মধ্যে সরকার ফাতাহ'র মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দ্ল সৃষ্টির চেষ্টা চালালে ফাতাহ সরাসরি জর্ডান সরকারের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হবার হুমকি দেয়। অনেক ফিলিস্তিনি যোদ্ধার মনে ফিদায়ীনের অভ্যন্তরেই অনেক জর্ডানি এবং বিভিন্ন গোপন সংস্থার গুপ্তচর লুকিয়ে ছিল। যাদের কাজই ছিল রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনমন ঘটানো।

১৯৬৮ এর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে ১৯৬৯ এর শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি বাহিনী এবং জর্ডান নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে কমপক্ষে ৫০০ সংঘর্ষ হয়।এ সময় সাধারণ নাগরিকদের অপহরণের মত ঘটনাও ঘটতে থাকে। জর্ডান রাজ-আদালতের প্রধান বিচারপতি জায়িদ আল রিফাই এক বার্তায় উল্লেখ করেন যে,"ফিদায়ীনরা এক সৈন্যকে হত্যা করে তার শিরশ্ছেদ করে এবং তার মাথা দিয়ে তার বাসস্থানের সামনে ফুটবল খেলে"।

জর্ডান কর্তৃপক্ষ এবং নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে পিএলও ইসরায়েলের উপর জর্ডান সীমান্ত দিয়ে হামলা চালাতে থাকে।ইসরায়েলও ধীরে ধীরে প্রতিআক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে থাকে।ধীরে ধীরে বড় মাত্রার যুদ্ধের সম্ভাবনা বড় হতে থাকে।

দশ দফা অধ্যাদেশঃ

১৯৭০ সালে সম্রাট হুসেইন মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসেরের এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এর সাথে আলোচনার জন্য বিদেশ সফর করেন। তিনি ফিরে আসার পর পরই একটি দশ দফা অধ্যাদেশ জারি করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি আম্মান এর রাস্তায় জর্ডান নিরাপত্তা বাহিনী এবং ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোর মধ্যে দাঙ্গা বেধে যায়। এতে প্রায় ৩০০ লোক নিহত হয়।এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে সম্রাট হুসেইন ঘোষণা দেন, "আমরা সবাই ফিদায়ীন"। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকেও বরখাস্ত করেন তিনি।

সশস্ত্র ফিলিস্তিনিরা জর্ডানের শহরগুলোয় ভিসা নিয়ন্ত্রণ, যাতায়াতের বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু করে, যা জর্ডান নাগরিক সমাজ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যকার উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মাঝে জর্ডানে বিভিন্ন সংঘর্ষে প্রায় এক হাজার লোক নিহত হয়।

জুলাই মাসে মিশর এবং জর্ডান যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা প্রস্তাবিত "রজারস নীতি" গ্রহণ করে।যাতে মিশর ও ইসরায়েলের এই শক্তিক্ষয়ের যুদ্ধের বিরতির আহবান জানানো হয়। এ নীতিতে ইসরায়েলকে ১৯৬৭ সালে দখল করা অঞ্চল ছেড়ে দিতে আহবান জানানো হয়। "জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা সভার প্রস্তাব ২৪২" মতে পশ্চিম তীরকে সম্রাট হুসেইন এর শাসন ব্যাবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা মৌলবাদী সংগঠনগুলোর কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। পিএলও, পি এল এফ পি, ডি এল এফ পি এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা জানায় এবং এ প্রস্তাবে একমত পোষণ করার জন্য নাসের এর কঠোর সমালোচনা করে। অনেকেই মনে করেন যে নাসেরের সাথে পি এল ও এর সম্পর্কে ফাটল ধরানোর একটা কৌশল ছিল এই নীতি। এ নীতি বাস্তবায়িত হয় নি।

নাসেরের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সুযোগে সম্রাট হুসেন পিএলও এর বিরুদ্ধে সামরিক উদ্যোগের প্রস্তুতি শুরু করেন। এদিকে মৌলবাদী সংগঠনগুলোও হুসেনের পশ্চিমা-শাসন ব্যবস্থা ধ্বংস করার সঙ্কল্প গ্রহণ করে।

কালো সেপ্টেম্বর ১৯৭০

বিমান ছিনতাই

১৯৭০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর সম্রাটকে হত্যার বেশ কয়েকটি ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। ৭ সেপ্টেম্বর ডসনের মাঠের ছিনতাই এর সময় পি এল এফ পি তিনটি বিমান ছিনতাই করে। যার মধ্যে ছিল জর্ডানের আজরাকে অবতরণ করা সুইস এয়ারলাইন এবং ট্রান্স-ওয়ার্ল্ড এয়ারলাইন্স এর দুটি বিমান । আরেকটি ছিল কায়রোগামী প্যান আমেরিকান বিমানসংস্থার একটি বিমান যা জারকাতে ছিনতাই হয়। ৯ সেপ্টেম্বর বাহরাইন থেকে উড্ডয়ন করা তৎকালীন ব্রিটিশ বিমানসংস্থার একটি বিমান জারকাতে ছিনতাই হয়।পি এফ এল পি ঘোষণা দেয়, "ফিলিস্তিনি সমস্যাগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য" এই ছিনতাই গুলো করা হয়। জিম্মিদের সরিয়ে নিয়ে বিমানগুলোকে তারা টেলিভিশন ক্যামেরার উপস্থিতিতে নাটকীয়ভাবে পোড়ায়।এরপর সরাসরি সম্রাটের বিরোধীতা করে বিদ্রোহীরা ইরবিদ কে বিমুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষিত করে।

জর্ডান সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ

সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ সম্রাট হুসেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্তা হাবিস আল মাজালি কে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন এবং সামরিক শাসন ঘোষণা করেন। আক্রমণের পরিকল্পনায় জর্ডানে পাকিস্তানি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রধান মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরের দিন , জর্ডানের ৬০ নম্বর ব্রিগেডের ট্যাংক আম্মানে অবস্থিত ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোর সদর দপ্তরে হামলা চালায়। এর পাশাপাশি সৈন্যবাহিনী ইরবিদ,সল্ট,সুইলেহ,বা'কা, ওয়েহদাত এবং জারকাতে আক্রমণ চালায়। তবে জর্ডান সৈন্যবাহিনী শুধুমাত্র ফিলিস্তিনীদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল না। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইরাকি সৈন্যবাহিনীর "৩য় সশস্ত্র বিভাগ" জর্ডানে রয়ে যায়। ইরাকি সরকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি যতই সহানূভুতিশীল হচ্ছিল, এই যুদ্ধে ইরাকের হস্তক্ষেপের ধারণা ততই জমাট বাঁধতে থাকে। এজন্য জর্ডানি ৩য় সশস্ত্র বাহিনীর ৯৯তম ব্রিগেড কে শুধুমাত্র ইরাকি বাহিনীর উপর নজর রাখার জন্য নিয়োজিত করা হয়। তাছাড়া , উত্তর জর্ডানে অবস্থিত ৪০ তম সশস্ত্র বাহিনী, ২য় পদাতিক বাহিনী এবং অন্যান্য সাহায্যকারী সংস্থাগুলো সিরিয়ার আক্রমণের ভয়ে পি এল ও র বিরুদ্ধে তাদের পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করতে পারছিল না। শেষমেশ পি এল ও র প্রতি সহানুভূতিশীল আরব নেতাদের চাপে জর্ডানের এই প্রথম আক্রমণের সাফল্য সামান্যতেই সীমাবদ্ধ থাকে। এতদসত্ত্বেও, ২৭ সেপ্টেম্বর মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসেরের শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরের আগেই জর্ডান সৈন্যবাহিনী মূল শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নেয়।

নভেম্বরের শেষদিকে জর্ডানিরা পুনরায় একত্রিত হয় এবং এবার তারা পি এল ও কে উৎপাটিত করতে সম্পূর্ণরুপে প্রস্তত ছিল। সম্রাট হুসেন এবার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিদ-বিন-সাকেরের হাতে যুদ্ধের নেতৃত্ব অর্পণ করেন।

তার অধীনে জর্ডানবাহিনী একটি নিয়মতান্ত্রিক এবং সতর্ক সমরাভিযান পরিচালনা করে। প্রথমে তারা পি এল ও এর অধীনে থাকা প্রধান শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। এরপর পিএলও কে তারা আজিওন এবং জারাশের পর্বত অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। অবশেষে সৈন্যবাহিনী পিএলও কে ঐ অঞ্চলের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। প্রচন্ড সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে পিএলও এর মূলোৎপাটিত হয়।

আরাফাত পরবর্তীতে দাবি করেন যে জর্ডান বাহিনী প্রায় ১০০০০-২৫০০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল। যদিও বিভিন্ন রক্ষণশীল সূত্রের মতে সংখ্যাটি ১০০০-২০০০ এর মধ্যে ছিল।

ডেভিড রাব নামের একজন জিম্মি ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের প্রাথমিক সামরিক আক্রমণের বর্ণনা দেন এভাবেঃ

"যেহেতু আশরাফিয়া জর্ডান বাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, আমাদের অঞ্চলে প্রচুর গোলাবর্ষণ হচ্ছিল ।বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং আমাদের কাছে খুব সামান্য খাবার ও পানি ছিল। শুক্রবার বিকালে আমরা রাস্তায় ট্যাঙ্কের ধাতব ঝনঝন শব্দ শুনতে পাই। আমরা সবাই দ্রুত একটি রুমে আশ্রয় নিই। গেরিলারা ঐ রুমের দরজাগুলো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল যাতে ভবনটিকে পরিত্যাক্ত বলে মনে হয়। হঠাৎ করে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়ে গেল।"

সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী শহরের সঙ্কীর্ণ রাস্তাগুলোয় অতটা কার্যকরভাবে কাজ করতে না পারায় জর্ডান বাহিনী ঘরে ঘরে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের খোঁজে তল্লাশি চালাতে থাকে এবং ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সাথে কয়েক সপ্তাহের প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

কালো সেপ্টেম্বরের বিদ্রোহের সময় আম্মান সবচেয়ে তীব্র যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে। সিরিয়ার ট্যাঙ্ক ইয়ারামী নদী দিয়ে উত্তর জর্ডানে প্রবেশ করে এবং আম্মান ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন শহরে গোলাবর্ষণ শুরু করে। পিএলও র ছোড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এক সপ্তাহ ধরে আম্মানকে প্রকম্পিত করে। জর্ডান পদাতিক বাহিনী ফিলিস্তিনি ফিদায়ীন বাহিনীকে কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আম্মান থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়।

সিরিয়ার হস্তক্ষেপের চেষ্টাঃ

এই গোলযোগময় পরিস্থিতিতে ১৮ সেপ্টেম্বর সিরিয়া ফিলিস্তিনি গেরিলাদের পক্ষে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল-আসাদ তার জীবনীলেখক প্যাট্রিক সীলকে বলেন যে সিরিয়ার এই হস্তক্ষেপ শুধুই ফিলিস্তিনিদের গণহত্য্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য পরিকল্পিত হয়েছিল। সিরিয়ার সরকার একটি পূর্ণ ব্রিগেডের সমতুল্য সশস্ত্র বাহিনী পাঠিয়েছিল এ যুদ্ধে এবং এই বাহিনীর কিছু অংশ সরাসরি সৈন্যবাহিনী থেকে এসেছিল। বাকি অংশ ছিল ৫ম পদাতিক বিভাগ এবং কমান্ডো। তারা দামেস্কে অবস্থিত ফিলিস্তিনি মুক্তি বাহিনীর সিরিয়া শাখার অধীনে ছিল।

আসাদের নির্দেশে সিরিয়ার বিমান বাহিনী এ যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। এর পেছনে অনেকেই সিরিয়ায় বাথ পার্টির অভ্যন্তরে দলীয় কলহ এবং ইসরায়েলের সামরিক হস্তক্ষেপের হূমকির ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন। জোয়েল এল মিগডাল দ্বিমত পোষণ করেন বলেন ,ইসরায়েল হুমকিগুলো কিসিঞ্জার ও নিক্সন এর যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে দিয়েছিল।

ফিলিস্তিনি শরণার্থী সমস্যা এবং সিরিয়ান আক্রমণ সামলাতে ব্যস্ত সম্রাট হুসেইন এবার যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যকে জর্ডানে হস্তক্ষেপের অনুরোধ করেন।এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সিরিয়াতে আক্রমণ চালাতেও অনুরোধ করেন। টিমোথি নাফথালির ভাষ্যমতে "সিরিয়া জর্ডান আক্রমণ করে এবং জর্ডান সম্রাট এই সামরিক বিশৃঙ্খল অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে যেকোন উপায়ে তাদের সাহায্যের আহবান জানান।"

একটি টেলিগ্রাম নির্দেশ করে যে হুসেইন নিজেই একজন আমেরিকান কর্মকর্তাকে ভোর ৩ টা সময় সাহায্যের জন্য ফোনে বার্তালাপ করেন। এ দলিলের মতে :

".................. সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখন্ডতা এবং জর্ডানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে আমি অতিসত্বর ভূমি এবং আকাশে প্রায়োগিক হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাচ্ছি। অতিসত্বর আক্রমণকারী বাহিনীর উপর বিমান হামলা চালানো এবং আকাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এখন আবশ্যকীয়।"

২১ সেপ্টেম্বর সিরিয়ান ৫ম বিভাগ জর্ডানি ৪০তম ব্রিগেডকে ভেদ করে ঢুকে পড়ে এবং তাদের আর-রাম্থা পর্যন্ত পিছাতে বাধ্য করে। ২২ সেপ্টেম্বর, জর্ডান রাজকীয় বিমান বাহিনী সিরিয়ান বাহিনীর উপর হামলা শুরু করে। ক্রমাগত আক্রমণ সিরিয়ান বাহিনীকে ক্রমেই দুর্বল করে দেয় এবং ২২ সেপ্টেম্বরের শেষ বিকালে ৫ম পদাতিক বিভাগ পিছু হটতে শুরু করে।

কারণ যাই হোক না কেন, সিরিয়ানদের আকস্মিক এই পিছু হটা ফিলিস্তিনিদের আশায় জোরে আঘাত হানে। জর্ডান সামরিক বাহিনী আম্মানে তাদের প্রধান দপ্তর গুড়িয়ে দেয় এবং অন্য রাজ্য থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেয়। ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়। কায়রোতে আরব দেশগুলোর সম্মেলনে হুসেইন এবং আরাফাত যোগ দেন, যেখানে আরাফাত কূটনৈতিক জয়লাভ করেন। ২৭ সেপ্টেম্বর, হুসেইন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এ চুক্তিতে জর্ডানে ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বৈধ ঘোষণা করা হয়।উভয় পক্ষকে এক্ষেত্রে সমান ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা জর্ডানের জন্য ছিল অবমাননাকর।

বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সম্পৃক্ততাঃ

যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নঃ

"ইউনাইটেড স্টেটস নেভি" এর ষষ্ঠ নৌবহর জর্ডানের নিকট উপকূলে অবস্থান করছিল। সেপ্টেম্বরের শুরুতে , নিক্সন একটি অতিরিক্ত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দল পাঠান এবং "ইউএস গুয়াম" নামক আরেকটি জাহাজ ষষ্ঠ বাহিনীর সাথে পাঠান।দুটি রাজকীয় নৌবহর মাল্টার অদূরে এসে পৌঁছায়। ১৯-২০ সেপ্টেম্বরের দিকে, আমেরিকার নৌবাহিনী পূর্ব-ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলে শক্তিশালী বাহিনী জড়ো করে। এর উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলে আমেরিকান স্বার্থ রক্ষা করা এবং প্রায় ৫০ জন জার্মান, ব্রিটিশ ও আমেরিকার নাগরিক আটকের জবাব দেয়া।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মতে এ মিশনের উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়া , জর্ডান ও লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণের সমর্থনে জর্ডান তীরবর্তী পশ্চিম উপত্যকা দখল করা। এই অঞ্চলে সোভিয়েতদের স্বার্থ রক্ষার্থে সিরিয়াকে সাহায্য করতে সোভিয়েত নৌবাহিনীর ভূমধ্যসাগরীয় উপদলকে প্রায় ২০ টি স্থল যুদ্ধযান ও ৬ টি ডুবোজাহাজ দ্বারা সমৃদ্ধ করা হয়। সিরিয়ার সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে সোভিয়েত সৈন্যদের আমেরিকান সৈন্যের জবাব দিতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয় এবং সিরিয়ার সীমান্ত ইসরায়েলের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে নির্দেশ দেয়।

১৯-২০ সেপ্টেম্বর । মোকাবেলার ব্যস্ততম সময়। আমেরিকার জাহাজ হাইফার বহিস্থ পোতাশ্রয়ে প্রবেশ করে এবং আমেরিকান নৌবাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়।

যদিও টারটাসএ সোভিয়েত সৈন্যরা যাবার পর আমেরিকানরা পিছু হটে। ৮২ তম বিমানবাহিনীর দলকে ১৫ সেপ্টেম্বর সতর্ক করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর তাদের সি-১৪১এস এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের আম্মান এয়ারপোর্টে নামার কথা ছিল এবং পরবর্তী দলগুলোর তাদের অনুসরণ করার কথা ছিল। কিন্তু সি-১৪১ অবতরণের কয়েক মিনিট পরই এ মিশন বাতিল করা হয় এবং সবাই ব্র্যাগ এর দুর্গে ফেরত আসে।

সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসজুড়ে আমেরিকান সৈন্যবাহিনী তৎপর ছিল। ২৩-২৪ সেপ্টেম্বর এর দিকে যখন সিরিয়ার বাহিনীর জর্ডান অভিযান নিস্ফল হল তখন উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমে আসে।

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ