কৌণ্ডিন্য

কৌণ্ডিন্য (সংস্কৃত: कौण्डिन्य; পালি: कोन्दन्न) বা অজ্ঞাত কৌণ্ডিন্য (সংস্কৃত: अज्ञात कौण्डिन्य; পালি: अन्न कोन्दन्न) (জীবনকাল- আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী) বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে প্রথম অর্হত ও প্রথম ভিক্ষু হিসেবে পরিগণিত হন। বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ যে পাঁচজন সাধককে প্রথম তার শিক্ষা প্রদান করেছিলেন, কৌণ্ডিন্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।

কৌণ্ডিন্য ও তার চার সাধনসঙ্গীকে শিক্ষাদানরত গৌতম বুদ্ধ

প্রথম জীবন

কৌণ্ডিন্যের জন্ম সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মের পূর্বে ঘটে। তিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে কপিলাবস্তু নগরের নিকটে দোনাভত্তু নগরে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কম বয়সে তিনি বেদে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।[১] শাক্য প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রধান শুদ্ধোধন তার পুত্র সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মের পর পুত্রের ভবিষ্যদ্বাণীর উদ্দেশ্যে একদল ব্রাহ্মণের সঙ্গে এই যুবক পণ্ডিত ব্রাহ্মণকেও আমন্ত্রণ জানান। ভবিষ্যতে সিদ্ধার্থ গৌতম একজন রাজচক্রবর্তী সম্রাট অথবা একজন সিদ্ধ সাধক হবেন এইরকম মত অন্য সকল ব্রাহ্মণেরা দিলেও একমাত্র কৌণ্ডিন্যই স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেন যে, এই শিশু পরবর্তীকালে বুদ্ধত্ব লাভ করবেন।[২]:১২ সিদ্ধার্থ ভবিষ্যতে সাধনপথ নিলে কৌণ্ডিন্য তাঁকে অনুসরণ করবেন বলে শপথ করেন।[১] কৌণ্ডিন্যের ভবিষ্যদ্বাণীকে ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে শুদ্ধোধন পুত্রের জীবনকে বিলাসবহুল করে তুললেও উনত্রিশ বছর বয়সে রাজকুমার সিদ্ধার্থ তার প্রাসাদ ছেড়ে সর্বস্ব ত্যাগ করে সত্যানুসন্ধানের উদ্দেশ্যে তপস্বীর জীবনাযাপনের জন্য বেড়িয়ে পড়েন।[২]:২০,২৫

তপস্বী সিদ্ধার্থের সঙ্গলাভ

সিদ্ধার্থ তপস্যার মাধ্যমে সত্যানুসন্ধানের জন্য গৃহত্যাগ করে আলার কালামউদ্দক রামপুত্ত প্রভৃতি যোগীদের নিকট শিক্ষালাভ সম্পন্ন করলে কৌণ্ডিন্য ও ভদ্দিয়, বপ্প, মহানাম এবং অস্সজি নামক পাঁচজন তপস্বী তাঁকে অনুসরণ করেন ও উরুবিল্ব নামক স্থানে একসাথে ছয় বছর ধরে কঠোর তপস্যায় লিপ্ত হন। বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে এই পাঁচজন তপস্বী পঞ্চবগ্‌গীয় বা ভদ্রক পঞ্চবর্গীয় নামে পরিচিত। এই কঠোর তপস্যার ফলে অনশনক্লিষ্ট সিদ্ধার্থ গৌতম মরণাপন্ন হয়ে উপলব্ধি করেন যে, অনশনক্লিষ্ট দুর্বল দেহে শরীরকে অপরিসীম কষ্ট দিয়ে কঠোর তপস্যা করে বোধিলাভ সম্ভব নয়। ধর্মচক্রপ্রবর্তন সূত্রানুসারে, অসংযত বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং কঠোর তপস্যার মধ্যবর্তী একটি মধ্যম পথের সন্ধান করে বোধিলাভ সম্ভব বলে তিনি উপলব্ধি করেন।[৩] তিনি তাই আবার খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন ও সুজাতা নাম্নী এক স্থানীয় গ্রাম্য কন্যার কাছ থেকে তিনি এক পাত্র পরমান্ন আহার করেন।[৪] সিদ্ধার্থকে খাদ্য গ্রহণ করতে দেখে কৌণ্ডিন্য সহ সকল ভদ্রক পঞ্চবর্গীয় তার ওপর বিরক্ত হয়ে তাঁকে ছেড়ে বারাণসীর নিকট ঋষিপতনের মৃগ উদ্যানে যাত্রা করে চলে যান।[১][৫][৬][৭]

গৌতম বুদ্ধের নিকট শিক্ষালাভ

গৌতম বুদ্ধের নিকট হতে ধম্মচক্কপ্পবত্তন সুত্ত শিক্ষণরত কৌণ্ডিয় সহ সকল ভদ্রক পঞ্চবর্গীয়

সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করার পর ঋষিপতনের মৃগ উদ্যানে যাত্রা করে কৌণ্ডিন্য সহ তার বাকি চারজন সাধনসঙ্গীকে খুঁজে বের করে তাঁদেরকে তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও প্রথমে এই পঞ্চবগ্‌গীয় তপস্বীরা গৌতম বুদ্ধের সিদ্ধিলাভের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই তার নবলব্ধ জ্ঞান তাঁদের মুগ্ধ করে। গৌতম বুদ্ধ তাঁদের ধম্মচক্কপ্পবত্তন সুত্ত সম্বন্ধে শিক্ষা প্রদান করেন। পাঁচ দিন পরে গৌতম বুদ্ধ তাঁদের অনাত্তলক্ষন সুত্ত সম্বন্ধে শিক্ষাদান করেন। বুদ্ধের নিকট শিক্ষালাভের ফলে কৌণ্ডিন্য অর্হত হিসেবে উন্নীত হন।[৮] এরপর তিনি গৌতম বুদ্ধের নিকট ভিক্ষু হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে বুদ্ধ এহি ভিক্ষু বলে তার ইচ্ছাপূরণ হন। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে কৌণ্ডিন্য প্রথম ভিক্ষু হিসেবে গণ্য হন। পরবরতীকালে জেতবনে অবস্থিত সংঘ কৌণ্ডিন্যকে প্রথম ভিক্ষুদের মধ্যে সর্বপ্রথম বলে গণ্য করেন।[১]

শেষ জীবন

সংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কৌণ্ডিন্য গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে নিম্ন গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণ করেন। গৌতম বুদ্ধ যখন রাজগৃহে সম্রাট বিম্বিসারের নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন, সেই সময় কৌণ্ডিন্য কপিলাবস্তু নগরীতে যাত্রা করে তার ভ্রাতুষ্পুত্র পুন্নকে বুদ্ধের শিক্ষায় দীক্ষা প্রদান করেন।[৯]

জীবনের শেষ বারো বছর কৌণ্ডিন্য সংঘ জীবন ত্যাগ করে হিমালয়ে বসবাস করেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে এই বিষয়ে দুইটি কারণের উল্লেখ রয়েছে। প্রথম কারণ হল, গৌতম বুদ্ধের দুইজন প্রধান শিষ্য সারিপুত্ত ও মৌদ্গল্যায়নের পক্ষে কৌণ্ডিন্যের উপস্থিতি অস্বস্তিদায়ক ছিল। সর্বাপেক্ষা প্রবীণ ভিক্ষু হওয়ায় কৌণ্ডিন্য ভিক্ষার সময় সংঘকে নেতৃত্ব দিতেন, কিন্তু ধর্ম শিক্ষার সময় গৌতম বুদ্ধের দুই পাশে সারিপুত্ত ও মৌদ্গল্যায়ন আসন গ্রহণ করতেন এবং কৌণ্ডিন্য তাঁদের পশ্চাতে বসতেন। প্রবীণতম ভিক্ষু কৌণ্ডিন্যের সামনে বসায় সারিপুত্ত ও মৌদ্গল্যায়নের পক্ষে অস্বস্তিদায়ক ছিল। এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে কৌণ্ডিন্য সংঘ পরিত্যাগ করেন। অপর যে কারণটি বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লিখিত, তা হল সংঘ দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করায় তার নিভৃতে ধর্ম সাধনার ব্যাঘাত ঘটত বলে তিনি নিভৃত স্থানের সন্ধানে হিমালয় যাত্রা করেন।[১] সংযুত্ত নিকায় অনুসারে তিনি হিমালয়ের ছদ্দন্ত বনে মন্দাকিনী সরোবরের তীরে জীবনের শেষ বারো বছর অতিবাহিত করেন। সেখানে তার মৃত্যু ঘটলে গৌতম বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য অনুরুদ্ধ তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। সেখানে তার মরদেহ বিশাল চন্দনকাঠ নির্মিত চিতায় ভস্মীভূত করা হয় এবং অবশিষ্ট ভস্মকে বেলুবনে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষিত করে তার ওপর রৌপ্য নির্মিত একটি স্তূপ নির্মাণ করা হয়।[১]

বৌদ্ধ পুঁথিতে

গৌতম বুদ্ধের সর্বপ্রথম শিষ্য হওয়ায় বিভিন্ন বৌদ্ধ সাহিত্যে কৌণ্ডিন্যের সঙ্গে অন্যান্য ভিক্ষুদের মতবিনিময় ও ভাষ্য গুরুয়্ব সহকারে স্থান পেয়েছে। থেরগাথার ষোলটি শ্লোকে কৌণ্ডিন্যকে প্রশংসা করে কাব্য রচিত হয়েছে। কৌণ্ডিন্যে সচ্চকে চতুরার্য সত্য সম্বন্ধে শিক্ষাপ্রদানের পরে সচ্চ এই শ্লোকের প্রথম কয়েকটি আবৃত্তি করেন। উদান নামক বৌদ্ধ পুঁথিতে উল্লিখিত রয়েছে যে সকল জাগতিক তৃষ্ণা থেকে উদাসীন হওয়ায় গৌতম বুদ্ধ কৌণ্ডিন্যের প্রশংসা করেন।[১]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ