জাফলং

সিলেটের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত পর্যটনস্থল

জাফলং, বাংলাদেশের সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত, একটি পর্যটনস্থল। জাফলং, সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে[১], ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, এবং এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত। পর্যটনের সাথে জাফলং পাথরের জন্যও বিখ্যাত। শ্রমজীবী মানুষেরা পাথরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে সেই বহু বছর যাবত৷

জাফলং
পিয়াইন নদী, জাফলং, সিলেট
পিয়াইন নদী, জাফলং, সিলেট
জাফলং বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
জাফলং
জাফলং
স্থানাঙ্ক: ২৫°৬.২′ উত্তর ৯১°৫৩.৫′ পূর্ব / ২৫.১০৩৩° উত্তর ৯১.৮৯১৭° পূর্ব / 25.1033; 91.8917
দেশ বাংলাদেশ
সময় অঞ্চল+৬
জাফলং

বিবরণ

বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় জাফলং অবস্থিত। এর অপর পাশে ভারতের ডাউকি অঞ্চল। ডাউকি অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাওকি নদী এই জাফলং দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।[২] মূলত পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত।[১] সিলেট জেলার জাফলং-তামাবিল-লালাখাল অঞ্চলে রয়েছে পাহাড়ী উত্তলভঙ্গ। এই উত্তলভঙ্গে পাললিক শিলা প্রকটিত হয়ে আছে, তাই ওখানে বেশ কয়েকবার ভূতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।[৩]

বাংলাদেশে চার ধরনের কঠিন শিলা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে ভোলাগঞ্জ-জাফলং-এ পাওয়া যায় কঠিন শিলার নুড়ি।[৪] এছাড়া বর্ষাকালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী শিলং মালভূমির পাহাড়গুলোতে প্রবল বৃষ্টিপাত হলে ঐসব পাহাড় থেকে ডাউকি নদীর প্রবল স্রোত বয়ে আনে বড় বড় গণ্ডশিলাও (boulder)।[২] একারণে সিলেট এলাকার জাফলং-এর নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাথর পাওয়া যায়। আর এই এলাকার মানুষের এক বৃহৎ অংশের জীবিকা গড়ে উঠেছে এই পাথর উত্তোলন ও তা প্রক্রিয়াজাতকরণকে ঘিরে।

জাফলং-এ পাথর ছাড়াও পাওয়া গেছে সাদামাটি বা চীনামাটিও, যদিও সেখানে মাটি বা বালি পরিশোধন করার মতো কোনো অবকাঠামো নেই।[৫]

এই এলাকায় যেমন সাধারণ বাঙালিরা বসবাস করেন, তেমনি বাস করেন উপজাতিরাও। জাফলং-এর বল্লা, সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে ৫টি খাসিয়াপুঞ্জী।[৬] আদমশুমারী অনুযায়ী জাফলং-এ ১,৯৫৩ জন খাসিয়া উপজাতি বাস করেন।[৭]

ইতিহাস

ঐতিহাসিকদের মতে বহু হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীনে থাকা এক নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে খাসিয়া-জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটলেও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা পতিতও পড়েছিল। পরবর্তিতে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন, আর পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে একসময় গড়ে ওঠে নতুন জনবসতি।[১]

মুক্তিযুদ্ধে জাফলং

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণ কবর,তামাবিল, জাফলং

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল জাফলংয়ের সীমান্তের ওপারে ভারতের ডাউকিতে। ১৩ জুলাই ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের একটি সশস্ত্র দল জাফলংয়ে ঢোকে। পিয়াইন নদীর ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে রাজাকার আজিরউদ্দিনের বাড়িতে ছিল একদল পাকিস্তানি সেনা। উভয় পক্ষের মধ্যে দুই দফা যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর ৫ সেনা নিহত হলে পাকিস্তানিরা পলিয়ে যায়। একই সময় দুজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। এছাড়া জাফলংয়ের পাশে সারি নদীতেও বড় আকারের যুদ্ধ হয়। আর এভাবেই শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা পায় জাফলং। আর আজ জাফলং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থানের রূপ পরিগ্রহ করেছে।[৮]তামাবিল স্থল বন্দরের শুল্ক অফিসের পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণ কবর।

দর্শনীয় স্থান

বিজিবি ক্যাম্প থেকে পাহাড়ের দৃশ্য
জাফলং-এ নদীর মনোরম দৃশ্য
আখ্‌তা ঝরণা, জাফলং
সূর্যাস্তের সময় জাফলং

জাফলং-এর বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়ালে ভারত সীমান্ত-অভ্যন্তরে থাকা উঁচু উঁচু পাহাড়শ্রেণী দেখা যায়। এসব পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া ভারতের ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতুও আকর্ষণ করে অনেককে।[৯] এছাড়া সর্পিলাকারে বয়ে চলা ডাওকি নদীও টানে পর্যটকদের। মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের ফলে ভারত সীমান্তে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীর স্রোত বেড়ে গেলে নদী ফিরে পায় তার প্রাণ, আর হয়ে ওঠে আরো মনোরম। ডাওকি নদীর পানির স্বচ্ছতাও জাফলং-এর অন্যতম আকর্ষণ।[২] পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে জাফলং-এ আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা।[১০] এই মেলাকে ঘিরে উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। বর্ষাকাল আর শীতকালে জাফলং-এর আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। বর্ষাকালে বৃষ্টিস্নাত গাছগাছালি আর খরস্রোতা নদী হয় দেখার মতো। তাছাড়া পাহাড়ের মাথায় মেঘের দৃশ্যও যথেষ্ট মনোরম।

জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য

জাফলং অঞ্চলের উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে খাটো জাতের পাম গাছ (Licuala species) দেখা যায়।[১১]

জাফলং-এ নারিকেল আর সুপারির গাছকে কেন্দ্র করে বাস করে প্রচুর বাদুড়। এছাড়া জাফলং বাজার কিংবা জাফলং জমিদার বাড়িতে আবাস করেছে বাদুড়। যদিও খাদ্যসংকট, আর মানুষের উৎপাতে, কিংবা অবাধ বৃক্ষনিধনে অনেক বাদুড় জাফলং ছেড়ে চলে যাচ্ছে জৈয়ন্তিয়া আর গোয়াইনঘাটের বেঁচে থাকা বনাঞ্চলে, কিংবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে।[১২]

পরিবেশ বিপর্যয়

জাফলং-এর পাথর শিল্প একদিকে যেমন ঐ এলাকাকে সকল অঞ্চলের কাছে পরিচিত করেছে, তেমনি এই পাথর শিল্পের যথেচ্ছ বিস্তারে এলাকার বাতাস হয়ে পড়েছে কলুষিত। যন্ত্রের সহায়তায় উন্মুক্ত উপায়ে পাথর ভাঙার কারণে ভাঙা পাথরের গুঁড়া আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে আর সাধারণ্যের শ্বাস-প্রশ্বাসকে ব্যাহত করছে। এছাড়া সরকারি বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে নদী থেকে যথেচ্ছ পাথর উত্তোলন নদীর জীববৈচিত্র্য আর উদ্ভিদবৈচিত্র্যকে করে তুলেছে হুমকির সম্মুখিন। এছাড়া অনুমোদনহীনভাবে ৩০-৩৫ ফুট গর্ত করে পাথর উত্তোলন নদী এবং নদী অববাহিকার ভূমিকে করছে হুমকির সম্মুখিন। এলাকার প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে ফেলার কারণে প্রায়ই সেখানে নানা রোগব্যাধির প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়।[১৩] তাছাড়া উজান থেকে নেমে আসা পাথর আর বালুতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় পিয়াইন নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ফলে হঠাৎই উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ক্ষতিগ্রস্থক্ষতিগ্রস্ত হয় নিকটবর্তি অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা; যেমন: ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ডাউকি সীমান্তে এরকমই উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে বিডিআর ক্যাম্পসহ বেশ কিছু এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মে তারিখেও অনুরূপ ঢলে ক্ষতিগ্রস্থক্ষতিগ্রস্ত হয় চা-বাগানসহ বস্তি।[১৪] এছাড়া নিষিদ্ধ "বোমা মেশিন" (স্থানীয় নাম) দিয়ে নদী থেকে পাথর উত্তোলনের কারণে স্থানীয় পিয়াইন নদী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে বিপুল সম্পদের অপচয়ও পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম একটি উদাহরণ (প্রেক্ষিত জুলাই ২০১২)।[১৫]

যাতায়াত ব্যবস্থা

১৯৮০'র দশকে সিলেটের সাথে জাফলং-এর ৫৫ কিলোমিটার সড়ক তৈরি হওয়ার মাধ্যমে দেশের অন্যান্য সকল অঞ্চল থেকে এই এলাকার সাথে সড়ক-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সড়কপথে সিলেট সদর থেকে এই স্থানের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। [১]জাফলং জিরো পয়েন্টে রয়েছে তামাবিল স্থল বন্দর, এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারতের সাথে পণ্য আমদানি রপ্তানী করা হয়। বিশেষ করে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করা হয়।

চিত্রশালা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

অভিধান

নথি

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ