ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো

ষষ্ঠ দলাই লামা

ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো (তিব্বতি: ཚངས་དབྱངས་རྒྱ་མཚོওয়াইলি: tshangs dbyangs rgya mtsho), (১লা মার্চ, ১৬৮৩ – ১৫ই নভেম্বর, ১৭০৬) তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মসম্প্রদায় দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের ষষ্ঠ দলাই লামা ছিলেন।

ষষ্ঠ দলাই লামা ঙ্গাগ-দ্বাং-ব্লো-ব্জাং-র্গ্যা-ম্ত্শো

জন্ম

ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো ১৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ তাওয়াং অঞ্চলের উর্গেলিং বৌদ্ধবিহারে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত।[১] জাতিগত ভাবে তিনি ছিলেন মোনপা জাতির অন্তর্ভুক্ত। তার পিতার নাম ছিল ব্ক্রা-শিস-ব্স্তান-'দ্জিন (ওয়াইলি: bkra shis bstan 'dzin) এবং মাতার নাম ছিল ত্শে-দ্বাং-ল্হা-মো (ওয়াইলি: tshe dbang lha mo)।[২]

দলাই লামা হিসেবে চিহ্নিতকরণ

১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম দলাই লামা ঙ্গাগ-দ্বাং-ব্লো-ব্জাং-র্গ্যা-ম্ত্শো মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু তার প্রধান মন্ত্রী সাংস-র্গ্যাস-র্গ্যা-ম্ত্শো (ওয়াইলি: sangs rgyas rgya mtsho) এই ঘটনার কথা প্রায় পনেরো বছর ধরে সকলের নিকট লুকিয়ে রাখেন। কারণ এই সময় তিনি পোতালা প্রাসাদের নির্মাণ সম্পূর্ণ করে নিতে এবং তিব্বতের শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় করে নিতে চেয়েছিলেন।[৩]:১৭৫ তিনি এই সময় পঞ্চম দলাই লামার নতুন পুনর্জন্ম খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পরবর্তী দলাই লামা হিসেবে ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোকে চিহ্নিত করা হলেও লাসা শহর থেকে দূরে ম্ত্শো-না (ওয়াইলি: mtsho na) নামক স্থানে সপরিবারে ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোকে ঘরবন্দী করে রাখা হয়। সাংস-র্গ্যাস-র্গ্যা-ম্ত্শোর পক্ষে পঞ্চম দলাই লামার মৃত্যুর খবর গোপণ রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ায় ১৬৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোকে ষষ্ঠ দলাই লামা রূপে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়[n ১] এবং লাসা শহরে এনে পঞ্চম পাঞ্চেন লামা ব্লো-ব্জাং-য়ে-শেস কর্তৃক শিক্ষার্থীর শপথ প্রদান করা হয়।[২]

গ্রেপ্তার

১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে কোশোত মঙ্গোল নেতা ল্হাজাং খান তিব্বতের রাজপ্রতিনিধি সাংস-র্গ্যাস-র্গ্যা-ম্ত্শোকে হত্যা করে লাসা শহরকে নিজের অধিকারে নিয়ে আসেন। এই সময় ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো পঞ্চম পাঞ্চেন লামার নিকট ভিক্ষুর শপথ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। পঞ্চম পাঞ্চেন লামা তাকে ব্ক্রা-শিস-ল্হুন-পো বৌদ্ধবিহারে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। কিন্তু ষষ্ঠ দলাই লামা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং বেশি চাপ দিলে আত্মহত্যা করবেন বলে হুমকি দেন। এর ফলে পঞ্চম পাঞ্চেন লামা পিছিয়ে আসেন এবং ষষ্ঠ দলাই লামার শপথ ফিরিয়ে নেন। ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো ছিলেন একমাত্র দলাই লামা যিনি সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন। শুধু তাই নয়, তিনি মদ্যপান করতেন, প্রেমের কবিতা লিখতেন ও শোল গ্রামের নিষিদ্ধপল্লীতে যাতায়াতও করতেন।[৫][৬] ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোর এই সব সিদ্ধান্তে বেশ কিছু তিব্বতী পঞ্চম দলাই লামার পুনর্জন্ম রূপে ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এই সুযোগে ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুন ল্হাজাং খান তার নিজের পুত্র মোনপা পেকার দ্জিনপাকে ষষ্ঠ দলাই লামা রূপে তুলে ধরেন। পঞ্চম পাঞ্চেন লামা মোনপা পেকার দ্জিনপাকে ষষ্ঠ দলাই লামা রূপে মেনে নেন ও তার নতুন নাম রাখেন ঙ্গাগ-দ্বাং-য়ে-শেস-র্গ্যা-ম্ত্শো। দ্গে-লুগ্স সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ভিক্ষু এই বিতর্কে মঙ্গোল বংশীয় এই নতুন দলাই লামাকে স্বীকৃতি দান করেননি।[৭][৮] এই দিন ল্হাজাং খান ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোকে গ্রেপ্তার করেন।[২]

মৃত্যু

গ্রেপ্তার বরণের পর ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোকে চীনের বেইজিং শহরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিব্বতীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাকে সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে চীন পাঠানো হয়। এই দল আমদো অঞ্চলের কোকোনরে শিবির করে বলে জানা যায়। এরপরের ঘটনা সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কোন কোন মতে ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর জ্বরাক্রান্ত হয়ে কোকোনর অঞ্চলে তার মৃত্যু ঘটে।[৯] আবার, ঙ্গাগ-দ্বাং-ল্হুন-গ্রুব-দার-র্গ্যাস (ওয়াইলি: ngag dbang lhun grub dar rgyas) নামক এক ভিক্ষু রচিত রিগ-'দ্জিন-ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো'ই-গ্সুং-ম্গুর-দাং-গ্সাং-বা'ই-র্নাম-থার (ওয়াইলি: rig 'dzin tsangs dbyangs rgya mtsho’i gsung mgur dang gsang ba'i rnam thar) এবং ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো'ই-গ্সাং-বা'ই-র্নাম-থার-সোগ্স (ওয়াইলি: tshangs dbyangs rgya mtsho'i gsang ba'i rnam thar sogs) নামক দুইটি জীবনীগ্রন্থে বলা হয়েছে যে ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো কোকোনর অঞ্চল থেকে চীন বা মঙ্গোলিয়ায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে।[১০][১১] যাই হোক না কেন, তার মৃতদেহ কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায় নি।[২]

ভিন্ন তথ্য

ঙ্গাগ-দ্বাং-ল্হুন-গ্রুব-দার-র্গ্যাস (ওয়াইলি: ngag dbang lhun grub dar rgyas) রচিত রিগ-'দ্জিন-ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো'ই-গ্সুং-ম্গুর-দাং-গ্সাং-বা'ই-র্নাম-থার (ওয়াইলি: rig 'dzin tsangs dbyangs rgya mtsho’i gsung mgur dang gsang ba'i rnam thar) এবং ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো'ই-গ্সাং-বা'ই-র্নাম-থার-সোগ্স (ওয়াইলি: tshangs dbyangs rgya mtsho'i gsang ba'i rnam thar sogs) গ্রন্থে ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোকে ভিন্নরূপে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এই দুইটি জীবনী গ্রন্থানুসারে তাকে একজন ধর্মানুরাগী বৌদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যিনি চীনাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আলাশান নামক স্থানে জাগ্রোং বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেন। এছাড়াও তিনি তেরোটি বৌদ্ধবিহারের প্রধান ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। গুশ্রী খানের পৌত্র আবো ও তার স্ত্রী ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোর ছাত্র ছিলেন বলেও জানা যায়। ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো মাঞ্চু সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতেন যারা তাকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে উচ্চে স্থান দিতে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল।[১০][১১]

রচনা

ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো যে সমস্ত কবিতা রচনা করেছেন বলে মনে করা হয় সেগুলি ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো'ই-ম্গু-গ্লু (ওয়াইলি: tshangs dbyangs rgya mtsho'i mgu glu) এবং ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো'ই-গ্সুং-ম্গুর (ওয়াইলি: tshangs dbyangs rgya mtsho'i mgu glu) নামক দুইটি গ্রন্থে সংকলিত করা হয়েছে। তার সকল কবিতাই প্রেম, প্রকৃতি ও আধ্ম্যাত্মিক জীবনের ওপর ভিত্তি করে রচিত, যদিও এগুলির মধ্যে কতগুলি ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শোর নিজের রচিত সেই নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।[২] নিজের পুনর্জন্মের ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর ভিত্তি করে রচিত কবিতাটি তার রচিত কবিতাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত যেখানে তিনি মৃত্যুর পর লিতাং অঞ্চল থেকে ফিরে আসবেন বলে জানিয়েছেন।[n ২]

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

আরো পড়ুন

  • Ahmad, Zahiruddin. 1970. Sino-Tibetan Relations in the Seventeenth Century. Rome: Istituto italiano per il Medio ed Estremo Oriente.
  • Aris, Michael. 1989. Hidden Treasures and Secret Lives: A Study of Pemalingpa (1450-1521) and the Sixth Dalai Lama (1683-1706). London: Kegan Paul International.
  • Baker, Ian A. 2000. The Dalai Lama's Secret Temple: Tantric Wall Paintings from Tibet London: Thames and Hudson.
  • Cutillo, Brian and Rick Fields. 1998. The Turquoise Bee: The Lovesongs of the Sixth Dalai Lama San Francisco: HarperSanFrancisco.
  • Damdinsüren, Ts. 1981. “The Sixth Dalai Lama Tsangs-Dbyangs Rgya-mtsho,” trans Stanley Frye, The Tibet Journal, vol 6, no 4, pp. 32–36.
  • Gedun Chopel. 1940. “An Ill-Starred Dalai Lama,” Mahabodhi, vol 48, pp. 370–374.
  • Klafkowski, Piotr. 1979. The Secret Deliverance of the Sixth Dalai Lama, as Narrated by Dharmatāla. Vienna: Arbeitskreis für Tibetische und Buddhistische Studien.
  • Lo Bue, Erberto. “The Sixth Dalai Lama, Tsangyang Gyatso.” In The Dalai Lamas: A Visual History. Martin Brauen, ed. London: Serindia, pp. 93–101.
  • Mullin, Glenn H. (2001). The Fourteen Dalai Lamas: A Sacred Legacy of Reincarnation, pp. 238–271. Clear Light Publishers. Santa Fe, New Mexico. আইএসবিএন ১-৫৭৪১৬-০৯২-৩.
  • Petech, Luciano. 1965-1966. “Notes on Tibetan History of the 18th Century,” T’oung Pao, vol. 52, pp. 161–192.
  • Richardson, H.E. 1980. “The Fifth Dalai Lama’s Decree Appointing Sangs rgyas rGya mtsho as Regent.” Bulletin of the School of Oriental and African Studies, vol. 43. pp. 329–44.
  • Richardson, H.E. 1986. Tibet and its History. London: Shambhala.
  • Sørensen, Per K. 1990. Divinity Secularised: An Inquiry into the Nature and Form of the Songs Ascribed to the Sixth Dalai Lama. Vienna: Arbeitskreis füre Tibetische und Buddhistische Studien.
  • Wickham-Smith, Simon. 2006. “Ban-de skya-min ser-min: Tsangs-dbyangs rGya-mtsho’s complex, confused and confusing relationship with sDe srid Sangs rgyas rgya mtsho as portrayed in the Tsangs dbyangs rgya mtsho’i mgu glu.” In Bryan Cuevas and Kurtis Schaeffer (Eds) Tibet in the Seventeenth and Eighteenth Centuries. Leiden: Brill.
  • Wickham-Smith, Simon. 2011. The Hidden Life of the Sixth Dalai Lama Lanham, MD: Lexington Books.
পূর্বসূরী
ঙ্গাগ-দ্বাং-ব্লো-ব্জাং-র্গ্যা-ম্ত্শো
ত্শাংস-দ্ব্যাংস-র্গ্যা-ম্ত্শো
ষষ্ঠ দলাই লামা
উত্তরসূরী
ব্স্কাল-ব্জাং-র্গ্যা-ম্ত্শো
🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ