বাকস্বাধীনতা

বাকস্বাধীনতা হচ্ছে স্বতন্ত্র্য ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের; নির্ভয়ে, বিনা প্রহরতায় বা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা, অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যতা ব্যতিরেকে নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার সমর্থিত মুলনীতি।[২][৩][৪][৫] "মত প্রকাশের স্বাধীনতা" (freedom of expression) শব্দপুঞ্জটিকেও কখনও কখনও বাকস্বাধীনতার স্থলে ব্যবহার করা হয়, তবে এক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার সাথে মাধ্যম নির্বিশেষে তথ্য বা ধারণার অন্বেষণ, গ্রহণ এবং প্রদান সম্পর্কিত যেকোন কার্যের অধিকারকেও বুঝিয়ে থাকে।

এলেনর রুজভেল্ট এবং মানবাধিকার সনদ (১৯৪৯) এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- "প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা জ্ঞাপন করার অধিকার"।[১]
১৯৭৪ সালে লণ্ডনের স্পিকার্স কর্নারে একজন বাগ্মী বক্তৃতা দিচ্ছেন

বেসামরিক ও রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিয়ার) মানবাধিকার সনদ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে "প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যম দ্বারা জ্ঞাপন করার অধিকার"। এই ১৯ নং অনুচ্ছেদ পরবর্তীতে আইসিসিপিয়ার দ্বারা সংশোধিত হয়, উদ্ধৃতিতে বলা হয়; এইসব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে; তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মান হানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়।[৬]

বাকস্বাধীনতাকে চূড়ান্ত হিসেবে স্বীকার নাও করা হতে পারে। মর্যাদাহানি, কুৎসা রটানো, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা, আক্রমণাত্মক শব্দ এবং মেধাসম্পদ, বাণিজ্যিক গোপনীয়তা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা যদি অন্য কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বা কারও অপকার করে তবে অপকার নীতির মাধ্যমে বাকস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে। এই অপকার নীতির ধারণাটি প্রণয়ন করেছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল তার অন লিবার্টি নামক গ্রন্থে। সেখানে তিনি বলেন, "একটি সভ্য সমাজে কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তার উপর তখনই ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করা যায়, যখন তা অন্য কোন ব্যক্তির উপর সংঘটিত অপকারকে বাঁধা দেয়ার জন্য করা হয়।"[৭] অবমাননা নীতির ধারণাও বাকসীমাবদ্ধতার ন্যায্যতা প্রতিপাদনে ব্যবহৃত হয়, এক্ষেত্রে যেসব কথায় সমাজে অবমাননার সৃষ্টি করে সেগুলোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে বক্তব্যের পরিমাণ, সময়, বক্তার উদ্দেশ্য, কতটা সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় - এসব বিবেচনায় আনা হয়।[৮] ডিজিটাল যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন উপায় আবিষ্কৃত হওয়ায় বাকস্বাধীনতার প্রয়োগ ও এর বিধিনিষেধ ব্যবস্থার বিতর্ক আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন চীন সরকারের উদ্যোগে নেয়া গোল্ডেন শিল্ড প্রোজেক্টে জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয় সাম্ভাব্য অসন্তোষজনক তথ্যকে দেশের বাইরে যেতে বাঁধা দান করে।

জনসম্মুখে অপরিচিত ব্যক্তির অনুমতি ব্যতীত ছবি তোলার ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার যে অধিকার তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।[৯][১০]

স্বাধীন অভিব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতার উৎপত্তি

স্বাধীন অভিব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতার একটি দীর্ঘ পুরাতন ইতিহাস আছে; সে ইতিহাসের পালাবদলে সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল।[১১] এটি অনুমান করা হয় যে ৬ষ্ঠ খৃষ্টপূূর্বের শেষে বা ৫ম খৃষ্টপূূর্বের প্রথমার্ধে প্রাচীন এথেনের গনতান্ত্রিক মতবাদে বাক স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটেছিল।[১২] প্রজাতন্ত্রী রোমানের মূল্যবোধে বাক স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।[১৩]

পূর্বের মানবাধিকার দলিলপত্রে মানবাধিকারের ধারণা পাওয়া গিয়েছিল।[১১] ইংল্যান্ডের সংসদে ১৬৮৯ বিলে সাংবিধানিকভাবে বাকস্বাধীনতাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়; যার প্রভাব সমাজে এখনো বিদ্যমান।[১৪] ১৭৮৯ তে ফরাসি বিপ্লবের সময় নাগরিকের অধিকার মুলক আইন বলবৎ করা হয়; যেখানে বাক স্বাধীনতাকে অনিবার্য অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।[১১] সেই ঘোষণায় ১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়:

নিজের চিন্তাভাবনা ও মতামতকে মুক্তভাবে বিনিময় করা; নাগরিকের মুল্যবান অধিকার। প্রত্যেক নাগরিক স্বাধীনতা অনুযায়ী বলতে, লিখতে এবং তথ্য প্রকাশ করতে পারে কিন্তু সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করলে তার জন্য সে দায়ী থাকবে, আর এই অপব্যবহার আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত থাকবে।[১৫]

১৯৪৮ সালে মানবাধিকার সনদে ১৯ নং অনুচ্ছেদ সংযোজিত হয়। যেখানে বলা হয়েছেঃ

প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা জ্ঞাপন করার অধিকার।[১৬]

বর্তমানে বাকস্বাধীনতা ও মতের স্বাধীন প্রকাশকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে মানবাধিকার বলে অভিহিত করা হয়।আন্তর্জাতিক বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্মেলনের ১৯ নং অনুছেদ, ইউরোপীয় মানবাধিকার সম্মেলনের ১০ নং অনুচ্ছেদ,মার্কিন মানবাধিকার সম্মেলনের ১৩ নং অনুচ্ছেদ এবং আফ্রিকান জন ও মানবাধিকারের ৯ নং অনুচ্ছেদে এই অধিকারকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।[১৭] জন মিল্টনের যুক্তির উপর ভিত্তি করে বলা যায়; এটা একটি বহুমুখী অধিকার। যেখানে শুধুমাত্র চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দেওয়াটাই মুখ্য নয়। তথাপি এ সংক্রান্ত তিনটি স্বতন্ত্র্য বিষয় আছে, যা নিম্নরূপ:

  1. তথ্য এবং ধারণা অন্বেষণ করার অধিকার
  2. তথ্য এবং ধারণা পাওয়ার অধিকার
  3. তথ্য এবং ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়ার অধিকার

আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং জাতীয় মানদন্ডে এই বাকস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যেকোনো মাধ্যম, মৌখিক, লিখিত, প্রকাশনা, ইন্টারনেট দ্বারা অথবা চিত্রকলার মাধ্যমে এই অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশ করা যেতে পারে।[১৭]

ইন্টারনেট প্রহরতা

গণতন্ত্র এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া

স্থায়ী মুক্তবাকের দেওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়

গণতন্ত্রে মুক্তবাক একটি মৌলিক নীতি। অভিব্যক্তির স্বাধীনতার মূলনীতি এতটাই গভীর যে, এমনকি ইমার্জেন্সি সময় ও বিতর্ক পুরোপুরি বন্ধ করা উচিত নয়।[১৮] মুক্তবাক এবং গণতন্ত্রের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী অন্যতম প্রবক্তা হচ্ছেন আলেক্সাণ্ডার মেইকলেজন। তিনি বলেছেন গণতন্ত্রের যে ধারণা তা হলোঃ জনগণের দ্বারা স্ব নিয়ন্ত্রিত সরকার থাকবে। প্রজ্ঞার কাজটি হলোঃ মুক্ত তথ্য এবং ধারণার বিস্তারে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না। [১৯]

সীমাবদ্ধতাসমূহ

ওয়েস্টবোরো বাপ্টিস্ট চার্চের সদস্যগণকে (২০০৬ সালে তোলা) কটূক্তির জন্য কানাডায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়[২০]

আইনগত ব্যবস্থাগুলো কখনও কখনও বাকস্বাধীনতার নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে, বিশেষ করে যখন বাকস্বাধীনতা অন্যান্য স্বাধীনতাগুলোর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, যেমন মর্যাদাহানি, কুৎসা রটানো, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা, আক্রমণাত্মক শব্দ এবং মেধাসম্পদের বেলায় বাকস্বাধীনতার সাথে অন্যান্য স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব দেখা যায়। "অপকার নীতি" বা "অবমাননা নীতির" সাহায্যে বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়। বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা আইনগত অনুমোদন বা সামাজিক নিষেধাজ্ঞা বা উভয়ের সাহায্যে হয়ে থাকে।[৭] নির্দিষ্ট কিছু সরকারী প্রতিষ্ঠান বাকস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করার জন্য নীতিমালা কার্যকর করতে পারে, যেমন স্টেট স্কুলের স্পিচ কোড।

জন স্টুয়ার্ট মিল তার অন লিবার্টি (১৮৫৯) গ্রন্থে লেখেন, "... নৈতিক নিয়মের বিষয় হিসেবে কোন কিছু স্বীকার করতে বা আলোচনা করতে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক, তাকে যতই কোন মতবাদ অনুসারে অনৈতিক হিসেবে বিবেচিত হোক না কেন।"[৭] মিল যুক্তি দেন, প্রকাশের পূর্ণ অধিকার দরকার বক্তব্যকে তাদের সামাজিক বিব্রতকর অবস্থা নয়, বরং যৌক্তিকতার সীমায় নিয়ে আসার জন্য। যাইহোক, মিল অপকার নীতি (Harm principle) সম্পর্কেও আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন, যা স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে আসে। তিনি বলেন, "একটি সভ্য সমাজে কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তার উপর তখনই ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করা যায়, যখন তা অন্য কোন ব্যক্তির উপর সংঘটিত অপকারকে বাঁধা দেয়ার জন্য করা হয়।"[৭]

১৯৮৫ সালে জোয়েল ফাইনবার্গ আরেকটি শব্দের সাথে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন, যার নাম হল "অবমাননা নীতি" (offense principle)। তিনি যুক্তি দেন, মিলের অপকার নীতি অন্য ব্যক্তির অনিষ্টকর কার্য থেকে মানুষকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারে না। ফাইনবার্গ লেখেন, "কোন প্রস্তাবিত অপরাধের শাস্তিকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে এটা সবসময়ই একটি উত্তম কারণ যে, সেই শাস্তির ফলে কার্যনির্বাহী অপরাধী তার নিজেকে ছাড়া ভিন্ন কোন ব্যক্তির কোন গুরুতর অনিষ্ট (offense) (কেবল আহত করা বা অপকার করা নয়) করতে পারবে না।"[২১] ফাইনবার্গ বলেন, কিছু ধরনের মত প্রকাশ আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ হয় যেগুলো খুবই অবমাননাকর হয়, কিন্তু কোন ব্যক্তিকে অবমাননা করা, কারও অপকার করার চেয়ে কম গুরুতর বলে অপকার করার শাস্তি বেশি হওয়া উচিত।[২১] অন্যদিকে মিল অপকার নীতির ভিত্তিতে না হওয়া আইনগত শাস্তিকে সমর্থন করেন না।[৭] যেহেতু অবুমাননার মাত্রা ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন হয়, বা কোন ব্যক্তি তার অন্যায্য কুসংস্কারের কারণে কোন মত প্রকাশকে অবমাননা বলে মনে করতে পারেন, তাই ফাইনবার্গ অবমাননা নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনার প্রয়োজন বোধ করেন, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বক্তব্যের পরিমাণ, সময়কাল এবং সামাজিক মূল্য, কতটা সহজে বক্তব্যটিকে এড়িয়ে চলা যায়, বক্তব্যপ্রদানকারীর উদ্দেশ্য, অবমানিত ব্যক্তির সংখ্যা, অবমাননার মাত্রা এবং বৃহৎ পরিসরে সমাজের সাধারণ স্বার্থ।[৭]

জ্যাসপার ডুমেন বলেন, অপকারকে প্রতিটি ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা উচিত, একে কেবলমাত্র শারীরিক অপকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়, যেহেতু অ-শারীরিক অপকারও জড়িত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি ফাইনবার্গের দেয়া অপকার ও অবমাননার পার্থক্যকে সমালোচনা করেন।[২২]

১৯৯৯ সালে বার্নার্ড হারকোর্ট লেখেন, "আজ অপকার সম্পর্কিত বিতর্ককে কোনরকম সমাধানের উদ্দেশ্য ছাড়া একরকম উদ্দেশ্যহীন হট্টগোল বলেই মনে হচ্ছে। এই বিতর্কের গঠনে অপকার সম্পর্কিত পরষ্পর প্রতিযোগিতাপূর্ণ দাবীগুলোর মাঝে কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আসল অপকার নীতিতে কখনই অপকারগুলোর তুলনামূলক গুরুত্ব বর্ণনা করা হয় নি।"[২৩]

বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতায় অপকার নীতি ও অবমাননা নীতির ব্যাখ্যা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন হয়ে এসেছে। যেমন রাশিয়ায় অপকার ও অবমাননা নীতিকে এলজিবিটি সম্পর্কিত মত প্রকাশ ও আন্দোলনগুলোকে বন্ধ করার জন্য রাশ্যান এলজিবিটি প্রোপাগান্ডা আইন এর ন্যায্যতা প্রতিবাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। কয়েকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রে যেখানে সেই সব রাষ্ট্রে বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য গর্ব করা হয়, সেখানেও হলোকাস্ট ডিনায়াল জাতীয় মত প্রকাশ করা (যেখানে বলা হয় ইহুদিহত্যা নাজি জার্মানির উদ্দেশ্য ছিলনা ইত্যাদি) নিষিদ্ধ। এইসব দেশের মধ্যে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিক, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইজরায়েল, লিকটেনস্টাইন, লিথুনিয়া, নেদারল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভাকিয়া এবং সুইজারল্যান্ড।[২৪]

ড্যানিশ কার্টুনিস্ট কার্ট ওয়েস্টারগার্ড ইসলামের নবী মুহম্মদকে নিয়ে একটি বিতর্কিত কার্টুন তৈরি করেছিলেন যেখানে নবীর পাগড়িতে একটি বোম্ব রাখা ছিল। এটি সারা দুনিয়ায় প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।[২৫]

রাজনৈতিক বিজ্ঞানের প্রফেসর এবং লেখক নরমান ফিংকেনস্টাইন তার নিজের মতামত ব্যক্ত করে বলেন, মুহম্মদকে নিয়ে শার্লে হেবদোর মর্যাদাহানিকর কার্টুনগুলো বাকস্বাধীনতার সীমাকে অতিক্রম করেছে, আর তিনি সেই কার্টুনগুলোকে জুলিয়াস স্ট্রেইচারের কার্টুনগুলোর সাথে তুলনা করেন, যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার লেখা ও আঁকা প্রকাশের জন্য ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।[২৬] ২০০৬ সালে ফরাসী রাষ্ট্রপতি জ্যাক শিরাক শার্লে হেবদোর সেই প্রকাশনাটির দ্বারা এভাবে প্রকাশ্য উত্তেজনা সৃষ্টির নিন্দা করেন। তিনি বলেন, "যাকিছু কোন ব্যক্তির বিশ্বাস, বিশেষ করে ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করবে সেগুলোকে পরিহার করা উচিত"।[২৭]

যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিষয়ক মামলা ব্রান্ডেনবার্গ বনাম ওহায়ো (১৯৬৯)[২৮]-তে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত প্রকাশ্যে হিংস্র কার্য কিংবা বিপ্লবের কথা বলার অধিকার বিষয়ক রায় দেন:

[Our] decisions have fashioned the principle that the constitutional guarantees of free speech and free press do not allow a State to forbid or proscribe advocacy of the use of force or law violation except where such advocacy is directed to inciting or producing imminent lawless action and is likely to incite or cause such action.[২৯]

ব্রান্ডেনবার্গের এই রায়ে বাকস্বাধীনতার অধিকার চূড়ান্ত হয়।[৩০][৩১] প্রথম সংশোধনীর দ্বারা হেট স্পিচ বা কটূক্তিও রক্ষিত হয় যা R.A.V. বনাম সিটি অফ সেইন্ট পল (১৯৯২) মামলায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত রুল জারি করে যে, কটূক্তি অনুমোদিত হবে, যদি না তা আসন্ন সহিংসতা সৃষ্টি করে।[৩২]

ইন্টারনেট এবং ইনফরমেশন সমাজ

মুক্ত বাকের প্রতীকস্বরূপ পতাকা; যা এএসিএস এনক্রিপশন কি কন্ট্রোভার্সারীর সময় ব্যক্তি স্বাধীনতার সমর্থনে প্রতীক হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল।[৩৩]

ইন্ডেক্স অন সেন্সরশিপের সম্পাদক জো গ্ল্যানভিল বলেছেন যে, "ইন্টারনেটে মুক্তবাকের চর্চার কারণে প্রহরতার বিরুদ্ধে এক প্রকার বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে।"[৩৪] আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং রাজ্যগত মানদন্ড অনু্যায়ী বাকস্বাধীনতার একটি অংশ হিসেবে অভিব্যক্তিকে ইন্টারনেট সহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশকে ধরা হয়।[১৭] ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কনগ্রেস ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফিককে নিয়ন্ত্রণের জন্য Communications Decency Act (CDA) নামক প্রথম বৃহত্তর পদক্ষেপ নেয়। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট Reno v. ACLU এর ক্ষেত্রে মাইলফলক সাইবার আইনকে আংশিকভাবে সংশোধন করে।[৩৫] তিনজন ফেডারেল বিচারকের একজন স্টুয়ার্ট আর. ডালজেল CDA কে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেন। তিনি তার মতামতে বলেন:[৩৬]

ইন্টারনেট হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যা ধীরে ধীরে সংবাদপত্র, ভিলেজ গ্রিন অথবা মেইল থেকেও বিস্তৃত হচ্ছে। এই সিডিস প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যে কণ্ঠস্বর তা রোধ করছে। এটা সাংবিধানিক ভাবে অসহনীয় পরিস্থিতি। ইন্টারনেটে কিছু আলোচনার সীমা কতটুকু হতে পারে, তা নিশ্চিত ভাবে পরীক্ষা করা উচিত। ইন্টারনেটে থাকা বিষয় গুলো অপরিশোধিত, অমার্জিত এবং অপ্রচলিত হতে পারে, যা অনুভূতিকে আঘাত করতে পারে, যৌনতার বিষয়কে উষ্কে দিতে পারে, হতে পারে অভব্য বিষয় দ্বারা পরিপূর্ণ- এককথায় অশোভন। কিন্তু আমরা এটা আশা করতেই পারি, সমাজের প্রতিটা শ্রেণির মানুষের কথা বলার জন্য মাধ্যম থাকতে হবে। মানুষের এই স্বায়ত্তশাসনকে আমাদের রক্ষা করতে হবে[...]। আমি আমার বিশ্লেষণ থেকে এটা বলছি না, সরকারকে শিশুদের বিপজ্জনক ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকার শিশুদের পর্নোগ্রাফি থেকে দুরে রাখতে আইনগত সকল ব্যবস্থা নিতে পারে। [...] শিক্ষা ব্যবস্থায় এই নব মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা এবং অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিশদ বিবরণ থাকা উচিত। যা সরকার নিজেই দায়িত্ব নিতে পারে। [৩৬]

ওয়ার্লড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (WSIS) ২০০৩ সালের ঘোষণায় "ইনফরমেশন সোসাইটির" অভিব্যক্তির গুরুত্বের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে বলেঃ

আমরা ইনফরমেশন সোসাইটির প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পুনঃনিশ্চিত করছি, ১৯ নং অনুচ্ছেদের অংশ হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার আছে স্বাধীনভাবে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করার এবং তথ্য অন্যত্র ছড়িয়ে দেওয়ার ও পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে তা গ্রহণ করার। যোগাযোগ হচ্ছে যেকোনো সামাজিক প্রক্রিয়া মুলনীতি, মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সকল সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মুলভিত্তি। এটিই ইনফরমেশন সোসাইটির মুলভিত্তি প্রত্যেকেরই সেখানে অংশগ্রহণ করার এবং উপকার পাওয়ার অধিকার আছে। কাওকে এখান থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়।[৩৭]

তথ্যের স্বাধীনতা

তথ্যের স্বাধীনতা হচ্ছে বাকস্বাধীনতারই একটি সংযোজিত রুপ। যেখানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তথ্যের স্বাধীনতাকে ইন্টারনেট ও ইনফরমেশন টেকনোলজিতে নিরাপত্তার অধিকার হিসেবে সুচিত করা হয়। বাকস্বাধীনতার সাথে সাথে নিরাপত্তার অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং তথ্যের স্বাধীনতা এই অধিকারেরই বিস্তৃত রুপ।[৩৮] তথ্যের স্বাধীনতা ইনফরমেশন টেকনোলজি পাঠে (ওয়েব কন্টেন্টে বাধা অথবা প্রহরতা ছাড়া প্রবেশের সক্ষমতা) প্রহরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।[৩৯]

কানাডার অন্টারিওর ফ্রিডম অব ইনফরমেশন & প্রটেকশন অব প্রাইভেসি এক্ট দ্বারা বিশদভাবে নিয়ন্ত্রিত।[৪০]

ইন্টারনেট প্রহরতা

রাজ্যের ইন্টারনেটে নজরদারী, প্রহরতা সৃষ্টি, বা নিরীক্ষণের জন্য তথ্যের স্বাধীনতার ধারণাটির প্রবর্তন ঘটেছে। ইন্টারনেট প্রহরতা বলতে বুঝানো হয়, ইন্টারনেটে কোনো তথ্য প্রকাশ বা সাইটে প্রবেশ করাকে নিয়ন্ত্রণ করা।[৪১]গ্লোবাল ইন্টারনেট ফ্রিডম কন্সোর্টিয়াম এই ধরনের ব্লক সাইটে প্রবেশ করতে নানান ধরনের সাহায্য করে।[৪২] রিপোর্টাস উইথ আউট বর্ডার্সের (RWB) মতে নিম্নোক্ত রাষ্ট্রগুলো ইন্টারনেট প্রহরতা মাত্রাতিরিক্ত হারে সৃষ্টি করে; এবং এরা ইন্টারনেটের শত্রু: চীন, কিউবা, ইরান, মায়ানমার/বার্মা, উত্তর কোরিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, এবং ভিয়েতনাম.[৪৩]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ