ভূ-চ্যুতি
ভূতত্ত্ববিদ্যায় ভূ-চ্যুতি হল এক প্রকার মসৃণ ফাটল অথবা শিলার আয়তনের এমন পার্থক্য, যার দরুন শিলার দৃশ্যমান স্থানচ্যুতি হয় এবং শিলার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। ভূত্বকে অবস্থিত বৃহৎ চ্যুতিগুলো প্লেট টেকটোনিক বলের ক্রিয়ায় ফলে সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে প্লেটগুলোর সীমানার দিক থেকে যেমন সাবডাকশন জোন অথবা রূপান্তরিত চ্যুতি থেকে এর উৎপত্তি ঘটে। সক্রিয় চ্যুতির দ্রুত অবস্থার পরিবর্তনের দরুন নির্গত শক্তি অধিকাংশ ভূমিকম্প সৃষ্টির জন্য দায়ী।
চ্যুতিরেখা হল এমন এক ধরনেত সমতল, যা ভূচ্যুতিতে সৃষ্ট ফাটলের পৃষ্ঠতলকে নির্দেশ করে। চ্যুতিচিহ্ন বা চ্যুতিরেখা হল এমন একটি স্থান যা কোন স্থানে দেখা যায় বা চিহ্নিত করা যায়। ভূ-চ্যুতি দেখানোর জন্য সাধারণত ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রে একটি চ্যুতিচিহ্ন দেওয়া হয়ে থাকে।[১][২]
ভূ-চ্যুতিগুলো সাধারণত একটি এবং পরিষ্কার ফাটল রূপে বিদ্যমান থাকে না, সেজন্য ভূতত্ত্ববিদরা কোনো স্থানে চ্যুতির সমাবেশ বোঝাতে চ্যুতি এলাকা নামের শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করেন।
ভূ-চ্যুতি গঠন প্রক্রিয়া
শিলার ঘর্ষণ ও কাঠিন্যের দরুন ভূ-চ্যুতির দুইপাশ কখনো সহজভাবে হড়কায় না বা একটার সামনে যেতে পারে না। ফলশ্রুতিতে, মাঝেমাঝে শিলাগুলোর চলাচল থেমে যায়। ভূ-চ্যুতি তলের উচ্চ ঘর্ষণের তলে চলাচল থেমে গেলে তাকে "রুক্ষতা" নামে অভিহিত করা হয়। যখন একটি ভূ-চ্যুতির ঘটনা থেমে যায়, তখন চাপ বৃদ্ধি পায় এবং যখন একটি ভূ-চ্যুতির সহ্যক্ষমতার সর্বোচ্চ মানকে অতিক্রম করে, তখন ভূ-চ্যুতির বিদারণ ঘটে এবং কর্ষণ শক্তির সৃষ্টি হয় ভূকম্পন তরঙ্গ রূপে, যা ভূমিকম্পের জন্য দায়ী।
কর্ষণের সৃষ্টি হয় একীভূতভাবে না হঠাৎ করে। এটি নির্ভর করে শিলার তরল অবস্থার উপরে। নিচের নমনীয় খাঁজ ও ম্যান্টলের আকৃতির পরিবর্তন সৃষ্টি হতে পারে সংকোচনকারী বলের প্রতিক্রিয়া হিসেবে; সেখানে উপরে থাকা ভঙ্গুর খাঁজের মাঝে ফাটলের পর প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। হঠাৎ করে চাপ বৃদ্ধির দরুন ভূ-চ্যুতিতে দেখা যেতে পারে প্রতিক্রিয়া। কর্ষণের মান অনেক বেশি হলে নমনীয় শিলায় থাকা খাঁজের মাঝেও দেখা যেতে পারে প্রতিক্রিয়া।
হড়কানো, উত্তোলন, নিক্ষেপণ
হড়কানো হল এমন ধরনের অবস্থার পরিবর্তন, যেখানে ভূ-চ্যুতিতলের দু পাশেই স্থানান্তর সম্পন্ন হয়। ভূ-চ্যুতির হড়কানোর চেতনা বলতে দুপাশেই এক পাশের তুলনায় স্থানান্তরের আপেক্ষিক স্থানান্তর বোঝানো হয়ে থাকে।[৩] আনুভূমিক ও উল্লম্ব পৃথকীকরণ মাপার ক্ষেত্রে নিক্ষেপণ হল ভূ-চ্যুতির উল্লম্ব অংশ এবং উত্তোলন হল আনুভূমিক অংশ; এজন্য "উত্তোলন উপরে এবং নিক্ষেপণ বাইরে" বলা হয়ে থাকে।[৪]
হড়াকানোর ভেক্টর স্তরের অনুসারী ভাঁজ থেকে নির্ণয় করা সম্ভব।[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] এটি ভূ-চ্যুতির দুই পাশ থেকেই দেখা যেতে পারে। উত্তোলন ও নিক্ষেপণের দিক ও বিস্তার শুধুমাত্র ভূ-চ্যুতির দুই পাশের সাধারণ মিলিত বিন্দু (ছেদনকারী বিন্দু নামে পরিচিত) থেকে পাওয়া সম্ভব। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, সাধারণর শুধু হড়কানোর ক্ষেত্রের দিক নির্ণয় করা যায়, উত্তোলন ও নিক্ষেপণের ভেক্টরের ক্ষেত্রে ভেক্টরের মানের নিকটবর্তী মান বের করা সম্ভব।
প্রলম্বিত বেষ্টন ও পাদদেশ বেষ্টন
উল্লম্ব নয় এমন ভূ-চ্যুতির দুইপায়া প্রলম্বিত বেষ্টন ও পাদদেশ বেষ্টন নামে পরিচিত। প্রলম্বিত বেষ্টন দেখা যায় ভূ-চ্যুতির তলের উপরে এবং পাদদেশ বেষ্টন দেখা যায় ভূ-চ্যুতি তলের নিচে।[৫] এই শব্দগুচ্ছের আবির্ভাব ঘটেছে খনিবিদ্যা থেকে: স্তরীভূত খনিজ পদার্থের খনিতে খনিশ্রমিকের পায়ের নিচের অংশ পাদদেশ বেষ্টন এবং উপরের অংশ প্রলম্বিত বেষ্টন নামে পরিচিত।[৬]
ভূ-চ্যুতির প্রকারভেদ
ভূ-চ্যুতির দিক অনুসারে ভূ-চ্যুতিকে নিম্নোক্তভাগে ভাগ করা যায়:
- অভিঘাত- হড়কানো, যেখানে সম্মুখভাগ তুলনামূলকভাবে আনুভূমিক, এটি ভূ-চ্যুতি গমনপথের সমান্তরাল।
- নিম্নমুখী-হড়কানো, সম্মুখভাগ তুলনামূলকভাগে আনুভূমিক এবং/অথবা ভূ-চ্যুতি গমনপথের উপর লম্ব।
- আড়-হড়কানো, অভিঘাত ও নিম্নমুখী চ্যুতির সংমিশ্রণ।
অভিঘাত-হড়কানো চ্যুতি
অভিঘাত-হড়কানো ভূ-চ্যুতিতে (মচকানো ভূ-চ্যুতি, ,বিদীর্ণ ভূ-চ্যুতি বা পরিবর্তিত গতি ভূ-চ্যুতি নামেও পরিচিত),[৭] ভূ-চ্যুতি পৃষ্ঠ (তল) আনুভূমিক অংশের উপর লম্ব এবং এর পাদদেশ বেষ্টন ডানে বা বামে আনুভূমিকভাবে খুব সামান্য স্থানান্তরিত হয়। বাম দিকে গতিবিশিষ্ট অভিঘাত-হড়কানো ভূ-চ্যুতি বামাবর্ত ভূ-চ্যুতি ও ডান ডিকে গতিবিশিষ্ট ভূ-চ্যুতি ডানাবর্ত ভূ-চ্যুতি নামে পরিচিত।[৮] দুইটির প্রকারভেদ করা হয়েছে ভূমিতে ভূ-চ্যুতির স্থানান্তর থেকে যা নির্ধারণ করা হয় ভূ-চ্যুতির বিপরীত পাশে থাকা পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণ থেকে।
অভিঘাত-হড়কানো ভূ-চ্যুতি প্লেট সীমানা তৈরি করলে রূপান্তরিত ভূ-চ্যুতি হিসেবে পরিচিতি পায়। এই ধারায় ব্যাপ্তিশীল কেন্দ্র যেমন মধ্য সমুদ্রের শৈলশিরার সাথে মিল পাওয়া যায় এবং তুলনামূলক অমিল দেখা যায় মহাদেশীয় অশ্মমণ্ডল যেমন মধ্যপ্রাচ্যের মৃত সাগর রূপান্তর বা নিউজিল্যান্ডের আলপাইন ভূ-চ্যুতির সাথে। রূপান্তরিত ভূ-চ্যুতি সংরক্ষণশীল প্লেট সীমানার সাথে সম্পর্কযুক্ত কেননা অশ্মমণ্ডল এখানে তৈরিও হয় না আবার ধ্বংসও হয় না।
নিম্নমুখী-হড়কানো ভূ-চ্যুতি
নিম্নমুখী-হড়কানো ভূ-চ্যুতিকে সাধারণ ("প্রসারিত") বা উল্টানো বলে ডাকা যেতে পারে।
সাধারণ ভূ-চ্যুতিতে প্রলম্বিত বেষ্টন পাদদেশ বেষ্টনের তুলনায় নিচের দিকে গমন করে। দুই দিকের সাধারণ ভূ-চ্যুতির তুলনায় নিচে নেমে যাওয়া ভূ-চ্যুতিকে নিম্নাংশ বলে অভিহিত করা হয়। এর দুপাশের উঁচু অংশকে উঁচু অংশ বলে অভিহিত করা হয়। টেকটোনিক গুরুত্ববিশিষ্ট অল্প কোণের সাধারণ ভূ-চ্যুতিকে বিচ্ছিন্ন ভূ-চ্যুতি বলে ডাকা যেতে পারে।
উল্টানো ভূ-চ্যুতি হল সাধারণ ভূ-চ্যুতির বিপরীত—এখানে প্রলম্বিত বেষ্টন পাদদেশ বেষ্টনের তুলনায় উপরে স্থানান্তরিত হয়। এই ধরনের ভূ-চ্যুতিতে চাপের প্রভাবে অল্প কঠিন আবরণ দৃশ্যমান হয়। উল্টানো ভূ-চ্যুতির নিম্নমুখী অংশ অপেক্ষাকৃত খাড়া, এর মান ৪৫° এর বেশি। উল্টানো ও সাধারণ এই ধারণাটি এসেছে যুক্তরাজ্যের কয়লাখনিগুলো থেকে। সেখানে সাধারণ ভূ-চ্যুতি বেশি দেখা যায়।[৯]
আচ্ছাদিত ভূ-চ্যুতির গঠন উল্টানো ভূ-চ্যুতির মত হলেও এখানে নিম্নমুখী অংশের ক্ষেত্রে কোণের মান হয় ৪৫° এর কম।[১০][১১] এই ধরনের ভূ-চ্যুতি সাধারণত ঢালু পথ, সমভূমি ও ভূ-চ্যুতি বেষ্টনকারী (প্রলম্বিত বেষ্টনী ও পাদদেশ বেষ্টনী) ভূ-ভাজ দেখা যায়।
আচ্ছাদিত ভূ-চ্যুতি তলের সমতল অংশ "সমতল ভূমি" ও নিম্নমুখী অংশ "ঢালু ভূমি" নামে পরিচিত। বাস্তবে, সমতল ভূমি ও ঢালু ভূমি সৃষ্টির মাধ্যমে ভূ-চ্যুতি তল স্থানান্তরিত হয়ে থাকে।
ভূ-চ্যুতি বেষ্টনকারী ভূ-ভাজ তৈরি হয়ে থাকে প্রলম্বিত বেষ্টনের অসমতল ভূ-চ্যুতি পৃষ্ঠের উপর দিয়ে চলার মাধ্যমে এবং এর সাথে পরিবর্তিত ভূ-চ্যুতি ও আচ্ছাদিত ভূ-চ্যুতির সম্পর্ক বিদ্যমান।
ভূ-চ্যুতিগুলো পরবর্তী সময়ে আসল দিকের বিপরীত দিকে স্থানান্তরিত হবার মাধ্যমে সক্রিয় হতে পারে যা ভূ-চ্যুতি বিপর্যয় নামে পরিচিত। যার দরুন একটি সাধারণ ভূ-চ্যুতি উল্টানো ভূ-চ্যুতি বা অন্যান্য কিছুতে পরিণত হতে পারে।
আচ্ছাদিত ভূ-চ্যুতি বৃহৎ আচ্ছাদন বেষ্টনকারী অংশে আচ্ছাদন আবরণ ও আচ্ছাদিত আবরণের ক্ষয়প্রাপ্ত অংশ তৈরি করে থাকে। নিম্নস্খলিত এলাকা আচ্ছাদিত ভূ-চ্যুতির অংশ। এটি বৃহৎ ভূ-চ্যুতি ও বৃহৎ ভূমিকম্প সৃষ্ট জন্য দায়ী। উঁচু খাড়া পাহাড়ে এই ধরনের নিদর্শন দেখা যেতে পারে।
বক্রভাবে হড়কানো ভূ-চ্যুতি
যখন কোনো ভূ-চ্যুতিতে নিম্নমুখী-হড়কানো ভূ-চ্যুতি এবং অভিঘাত-হড়কানো ভূ-চ্যুতির নিদর্শন দেখা যায়, তখন তা বক্রভাবে হড়কানো ভূ-চ্যুতি হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রায় সব ধরনের ভূ-চ্যুতিতেই এই নিদর্শন দেখা গেলেও একটি ভূ-চ্যুতি তখনই বক্রভাবে হড়কানো ভূ-চ্যুতি হিসেবে পরিচিতি পাবে, যখন সেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিম্নমুখী-হড়কানো ভূ-চ্যুতি ও অভিঘাত-হড়কানো ভূ-চ্যুতির নজির দেখা যাবে। কিছু বক্রভাবে হড়কানো ভূ-চ্যুতি পরিবর্তিত টান ও পরিবর্তিত চাপের ক্রিয়ার দরুন গড়ে উঠলেও অন্যান্য ভূ-চ্যতিগুলো গড়ে ওঠে তৈরি হবার সময়ের স্থানান্তর হবার পথের হ্রাস বৃদ্ধির দরুন (ভূ-চ্যুতির আদি গঠনকে সক্রিয় রেখে)।
ফাটল কোণ হল নিম্নমুখী কোণের একটি বিশেষ রূপ; এটি ভূ-চ্যুতি তল তো ভূ-চ্যুতির সমান্তরাল উল্লম্ব তলের মধ্যবর্তী কোণ।
লিস্ট্রিক ভূ-চ্যুতি
লিস্ট্রিক ভূ-চ্যুতি হল এক বিশেষ ধরনের ভূ-চ্যুতি। এটির তল বাঁকা হলে এর নিম্নমুখী অংশ পৃষ্ঠের নিকট খাড়া। গভীরতা বাড়ালে এর খাড়াত্ব কমে যায়। নিম্নমুখী অংশের আকৃতি সমতল হয়ে উপ-আনুভূমিক হড়কানো য়লে পরিণত হয়। এর দরুন আনুভূমিক হড়কানির সৃষ্টি হয় আনুভূমিক তলে। চিত্রে লিস্ট্রিক ভূ-চ্যুতিতে প্রলম্বিত বেষ্টনীর অবনতি দেখানো হয়েছে। যখন প্রলম্বিত বেষ্টনীর দেখা মেলে না, তখন পাদদেশ বেষ্টনীর অবনতির দরুন একাধিক লিস্ট্রিক ভূ-চ্যুতির সৃষ্টি হতে পারে।
বলয় ভূ-চ্যুতি
বলয় ভূ-চ্যুতি ক্যালডেরা ভূ-চ্যুতি নামেও পরিচিত এটি সংঘটিত হয় আগ্নেয়গিরির ক্যালডেরা ভেঙে পড়ার দরুন ও উল্কাপাতের দরুন (যেমন সেসাপিক বে ইম্প্যাক্ট জ্বালামুখ)।[১২] বলয় ভূ-চ্যুতি কিছু সাধারাণ ভূ-চ্যুতির অধিক্রমণের দরুন সৃষ্ট বৃত্তাকার ভূ-চ্যুতি থেকে গড়ে ওঠে। এ ধরনের ভূ-চ্যুতিতে সৃষ্ট ফাটল বাঁধ বেষ্টনীর মাধ্যমে পূরণ হতে পারে।[১২]
সমন্বয়ী ভূ-চ্যুতি এবং বিপরীত ভূ-চ্যুতি
সমন্বয়ী ভূ-চ্যুতি ও বিপরীত ভূ-চ্যুতিতে বিভিন্ন ধরনের বড় ভূ-চ্যুতি ও ছোট ভূ-চ্যুতি নিয়ে গঠিত ভূ-চ্যুতি নিয়ে আলোচনা করে থাকে। সমন্বয়ী ভূ-চ্যুতির ক্ষেত্রে একই দিকে নিম্নমুখী অংশ দেখা দেখা গেলেও বিপরীত ভূ-চ্যুতিতে আলাদা দিকে অবস্থান করে নিম্নমুখী অংশ। এই ধরনের ভূ-চ্যুতিগুলোতে বিশেষ ধরনের ধনুকাকৃতি লাইনের দেখা মেলে। নাইজার বদ্বীপ ভূমিতে এই ধরনের নিদর্শন দেখা যায়।
চ্যুতি শিলা
সব ধরনের ভূ-চ্যুতিই মাপা যায় এমন পুরুত্ব বিশিষ্ট। এগুলো হরেক রকম পরিবর্তিত শিলা দিয়ে তৈরি যা ভূত্বকে পাওয়া যায় (এখানেই ভূ-চ্যুতি ঘটে থাকে)। শিলার রূপান্তর ঘটে প্রকৃতিতে খনিজ প্রবাহী পদার্থের উপস্থিতিতে। চ্যুতি শিলার শ্রেণিবিন্যাস করা হয়ে থাকে তাদের গঠনবিন্যাস ও তৈরি হবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অশ্মমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর দিয়ে গমনকারী ভূ-চ্যুতিতে হরেক রকম শিলা দেখা যায় যার বিকাশ ঘটে এর পৃষ্ঠতেই। চলমান নিম্নমুখী-হড়কানো স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পাশাপাশি অবস্থানকারী চ্যুতি শিলায় বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্য দেখা যেতে পারে। এতে আরো দেখা যেতে পারে আলাদা স্তর। এর প্রভাব বিচ্ছিন্ন ভূ-চ্যুতি ও আচ্ছাদিত ভূ-চ্যুতিতে।
উল্লেখযোগ্য চ্যুতি শিলাগুলো হল:
- ক্যাটাক্লাসাইট– একটি বিশেষ ধরনের চ্যুতি শিলা যা দুর্বল অভ্যন্তরীণ গঠনে গড়ে ওঠে বা সমতলীয় তলের অনুপস্থিতি দেখা যায় বা যা সংযোগশীল, সাধারণত কৌণিক ক্লাস্টের সাহায্যে বর্ণনা করা হয় এবং ম্যাট্রিক্সে অবস্থিত শিলাখণ্ড আকার সুষম ও একই গঠন বিশিষ্ট।
- টেকটোনিক বা চ্যুতি ব্রেসিয়া – একটি মাধ্যম, যাতে সুষম নয় এমন আকারের ক্যাটাক্লাসাইটে ৩০% এর বেশি দৃশ্যমান খণ্ড বিদ্যমান।
- চ্যুতি বাটালি – সংযুক্তশীল নয় এমন ক্যাটাক্লাসাইট। কণার আকার খুব সুষম। এতে ৩০% এর বেশি দৃশ্যমান খণ্ড বিদ্যমান। এর মাঝে রক ক্লাস্ট দেখা যেতে পারে।
- কর্দম লেপন - কর্দম বিশিষ্ট চ্যুতি বাটালি যাতে পললের উপস্থিতি বিদ্যমান যা সৃষ্টি করে উচ্চ পরিমাণ পলল বিশিষ্ট স্তর। এই স্তরের চ্যুতি বাটালির নিকট আকৃতি পরিবর্তন ও বিভক্তি ঘটে।
- মিলোনাইট – একটি বিশেষ ধরনের চ্যুতিশিলা যা সংযোগশীল এবং এটিকে সুগঠিত সমতল কাঠামো দ্বারা চেনা যায় যা গড়ে ওঠে কণার আকৃতির হ্রাসের মাধ্যমে। এটি গড়ে ওঠে গোল পোরফাইলোক্লাস্টের মাধ্যমে ও ম্যাট্রিক্সে একই খনিজ উপাদান বিশিষ্ট শিলা খণ্ডের মাধ্যমে।
- সিউডোটাচিলিট– খুব সুষম গঠন বিশিষ্ট কাঁচের মত দেখতে এক রকম শিলা যার দেখতে সাধারণত কালো ও চকমকি পাথরের ন্যায় হয়ে থাকে। এটি হয়ে থাকে পারলা সমতলীয় ফাটলে, ফাটলের ভিতরে প্রবেশের মাধ্যমে বা ম্যাট্রিক্স, সিউডোকংলোমেরেটস বা ব্রেসিয়ার মাধ্যমে যা যেখানে গড়ে উঠেছে সে শিলায় প্রসারিত গর্ত ভর্তি করে থাকে।
জনগণ ও অবকাঠামোর উপর প্রভাব
ভূ-কারিগরি প্রকৌশল অনুসারে, ভূ-চ্যুতি যখন চলমান অবস্থার অবসান ঘটায়, তখন তা মাটি, শিলার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের (যেমন, শক্তিমত্তা, রূপান্তর ইত্যাদি) পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এটি টানেল, ইমারতের ভিত্তি বা ঢাল তৈরিতে প্রভাব ফেলে।
ইমারত, ট্যাংক, পাইপলাইনের জন্য জায়গা নির্ধারণ এবং জনগণ ও ইমারতের উপর ভূকম্পন ও সুনামির প্রভাব ভূ-চ্যুতির উপএ নির্ভর করে থাকে। সে জন্য ক্যালিফোর্নিয়ায় ভূ-চ্যুতির উপরে বা নিকটে নতুন ইমারত নির্মাণ নিষেধ। কোনো জায়গায় নতুন ইমারত তৈরির অনুমতি দেয়া হয় ঐ জায়গায় ১১,৭০০ বছরের (হলোসিন যুগ থেকে বর্তমান) ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস দেখে।[১৩] হলোসিন যুগ ছাড়াও যদি প্লেস্টোসিন যুগে (ছাব্বিশ লাখ বছর আগের যুগ) যদি ভূ-চ্যুতির কর্মকাণ্ড দেখা যায় তবে কিছু কিছু ক্ষেত্র যেমন বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঁধ, হাসপাতাল, বিদ্যালয় নির্মাণের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে ভালোভাবে ভাবা হয়। ভূতাত্ত্বিকরা অল্প মাটি খোঁড়ার মাধ্যমে ভূ-চ্যুতির বয়স বের করে থাকেন তারা এক্ষেত্রে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের সাহায্য নেন। তারা মাটিতে পুরোনো মাটিতে কার্বনেট নডুল, ক্ষয়প্রাপ্ত কর্দম, আয়রন অক্সাইডের অধিক উপস্থিতি আছে কি না তা দেখেন। আর নতুন মাটিতে দেখেন এর উল্টোটা। জৈব বস্তুর রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে সক্রিয়া ও সুপ্ত ভূ-চ্যুতির মাঝে পার্থক্য দেকগা যায়। এই ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে প্যালিওসিসমিলজিস্টরা কয়েকশ বছর পূর্বে সংঘটিত ভূমিকম্পগুলোর তীব্রতা ও পরবর্তী সময়ে ভূ-চ্যুতির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারেন।
ভূ-চ্যুতি ও খনিজ সম্পদের মজুদ
বিভিন্ন রকম খনিজ সম্পদের দেখা মেলে ভূ-চ্যুতিতে। এটি হবার কারণ হল ক্ষয়প্রাপ্ত চ্যুতি এলাকায় খনিজ পদার্থ বহনকারী প্রবাহী পদার্থ থাকলে কোনো বাধার সম্মুখীন হয় না। নিকটবর্তী-আনুভূমিক ভূ-চ্যুতির ছেদবিন্দুতে উল্লেখযোগ্য খনিজ পদার্থের দেখা মেলে।[১৪]
চিলির ডমিকো ভূ-চ্যুতিতে উচ্চমূল্যের পরফিরি তামার মজুদ দেখা যায়। যার দরুন চুকুইচামাতা, কোলাহুয়াসি, এল আব্রা, এল সালভাদোর, লা এস্কোন্দিদা ও পোত্রেরিলোসে তামার খনির দেখা মেলে।[১৫] দক্ষিণ চিলিতে অবস্থিত ল্পস ব্রোন্সেস ও এল তেনিতেন্তে অবস্থিত পরফিরি তামার খনির সৃষ্টি হয়েছে দুটি ভূ-চ্যুতির ছেদবিন্দুতে জমা হওয়া খনিজ পদার্থের দরুন।[১৪]
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- Allaby, Michael, সম্পাদক (২০১৫)। "Strike-Slip Fault"। A Dictionary of Geology and Earth Sciences (4th সংস্করণ)। Oxford University Press।
- Brodie, Kate; Fettes, Douglas; Harte, Ben; Schmid, Rolf (২৯ জানুয়ারি ২০০৭), Structural terms including fault rock terms, International Union of Geological Sciences, ১ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ৮ আগস্ট ২০১৯
- Davis, George H.; Reynolds, Stephen J. (১৯৯৬)। "Folds"। Structural Geology of Rocks and Regions (2nd সংস্করণ)। John Wiley & Sons। পৃষ্ঠা 372–424। আইএসবিএন 0-471-52621-5।
- Fichter, Lynn S.; Baedke, Steve J. (১৩ সেপ্টেম্বর ২০০০)। "A Primer on Appalachian Structural Geology"। James Madison University। ১২ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০১০।
- Hart, E.W.; Bryant, W.A., (১৯৯৭)। Fault rupture hazard in California: Alquist-Priolo earthquake fault zoning act with index to earthquake fault zone maps (প্রতিবেদন)। Special Publication 42.। California Division of Mines and Geology।
- Marquis, John; Hafner, Katrin; Hauksson, Egill, "The Properties of Fault Slip", Investigating Earthquakes through Regional Seismicity, Southern California Earthquake Center, ২৫ জুন ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০১০
- McKnight, Tom L.; Hess, Darrel (২০০০)। "The Internal Processes: Types of Faults"। Physical Geography: A Landscape Appreciation। Prentice Hall। পৃষ্ঠা 416–7। আইএসবিএন 0-13-020263-0।
- Park, R.G. (২০০৪), Foundation of Structural Geology (3 সংস্করণ), Routledge, পৃষ্ঠা 11, আইএসবিএন 978-0-7487-5802-9
- Tingley, J.V.; Pizarro, K.A. (২০০০), Traveling America's loneliest road: a geologic and natural history tour, Nevada Bureau of Mines and Geology Special Publication, 26, Nevada Bureau of Mines and Geology, পৃষ্ঠা 132, আইএসবিএন 978-1-888035-05-6, সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৪-০২
- USGS, Hanging wall Foot wall, ৮ মে ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০১০
- USGS, Earthquake Glossary – fault trace, সংগ্রহের তারিখ ১০ এপ্রিল ২০১৫
- USGS (৩০ এপ্রিল ২০০৩), Where are the Fault Lines in the United States East of the Rocky Mountains?, ১৮ নভেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ৬ মার্চ ২০১০