রুশ সংস্কৃতি

রুশ সংস্কৃতি হল প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রসমূহ এবং বর্তমান রাশিয়ার সংস্কৃতি। রুশ সংস্কৃতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। রাশিয়া শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় দীর্ঘ ঐতিহ্য বজায় রেখেছে,[১] বিশেষ করে, সাহিত্যে[২] এবং দর্শন, ধ্রুপদী সঙ্গীত[৩][৪]ব্যালে,[৫] স্থাপত্য ও চিত্রকলা, চলচ্চিত্র[৬]অ্যানিমেশন এবং রাজনীতিতে। বিশ্ব সংস্কৃতিতে এই সকল শাখার প্রভাব রয়েছে। দেশটির বস্তুবাদী সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিগত ঐতিহ্যও রয়েছে।

রুশ সংস্কৃতি ইউরোপের দূর প্রাচের পূর্ব স্লাভদের থেকে তাদের পৌত্তলিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে। প্রারম্ভিক রুশ সংস্কৃতিতে পার্শ্ববর্তী ফিনো-উগরিক সম্প্রদায় এবং পন্তিক সোপানের যাযাবর জাতির (মূলত কিপচাক ও ইরানীয় বংশোদ্ভূত) প্রভাব রয়েছে। ১ম শতাব্দীর শেষের দিকে ভারাঞ্জিয়ানরা (সম্ভবত স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাইকিং) কিয়েভান রুস রাজ্য গঠনে ভূমিকা পালন করে। প্রাচ্য গোঁড়া খ্রিস্টান মিশনারিগণ ৯ম শতাব্দীতে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য থেকে কিয়েভান রুসে আসা শুরু করে এবং ৯৮৮ সালে গোঁড়া খ্রিস্টানে পরিবর্তিত হয়। ফলে পরবর্তী শতাব্দীর রুশ সংস্কৃতি স্লাভিক ও বাইজেন্টাইন সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে।[৭]

পশ্চিমা ও দূর প্রাচ্যের রাষ্ট্রসমূহের ২০,০০০ মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বর্তমানে রুশ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নেশন ব্র্যান্ড্‌স ইনডেক্সে সপ্তম স্থান অধিকার করছে। বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক পর্যটনে যুক্ত হতে দেরী হওয়ার কারণে রুশ সংস্কৃতির অনেক বিষয়, যেমন রুশ কৌতুক এবং রুশ শিল্পকলা বিদেশিদের কাছে অজানা রয়ে গেছে।[৮]

ভাষা

১০৫৬ সালের অস্ত্রমিরভ ইভাঙ্গিলিয়ে হল প্রাপ্ত দ্বিতীয় প্রাচীন পূর্ব স্লাভিক ভাষার বই, রুশ জাতীয় লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত।

রাশিয়ায় ১৬০টি নৃগোষ্ঠী রয়েছে যারা ১০০ রকমের ভাষার ব্যবহার করে থাকে।[১] ২০০২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১৪২.৬ মিলিয়ন মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলে, ৫.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে এর পরেই অবস্থান তাতার ভাষার, এবং ১.৮ মিলিয়ন মানুষ ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলে।[৯] রুশ ভাষা একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা, কিন্তু সংবিধান রুশ ভাষার পর স্থানীয় ভাষাকে সহ-দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে।[১০] বিভিন্ন ভাষা থাকার পরও রুশ ভাষা সমগ্র রাশিয়ায় একই রকমের। রুশ ভাষা হল ভৌগলিকভাবে ইউরেশিয়ার সবচেয়ে বিস্তৃত অঞ্চলের ভাষা এবং স্লাভিক ভাষার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা।[১১] রুশ ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং পূর্ব স্লাভিক ভাষা গোষ্ঠীর এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত ভাষার একটি, অন্যগুলো হল বেলারুশীয় ও ইউক্রেনীয়। প্রাচীন পূর্ব স্লাভিক (প্রাচীন রুশ) ভাষার লিখিত নথি পাওয়া যায় ১০ম শতাব্দীর পর থেকে।[১২]

লোকাচার

নব্য রুশ লোকাচারের ভিত্তি গড়ে ওঠে প্রাচীন স্লাভদের পৌত্তলিক বিশ্বাস থেকে, যা এখনো রুশ রূপকথায় দেখতে পাওয়া যায়। রুশ মহাকাব্য বুলিনাসমূহ স্লাভিক পুরাণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিয়েভান সময়ের প্রাচীনতম বুলিনাগুলো বেশিরভাগ উত্তর রাশিয়া, বিশেষ করে, কারেলিয়া, থেকে সংগৃহীত। এখান থেকেই বেশিরভাগ ফিনীয় জাতীয় মহাকাব্য কালেভালা সংগৃহীত হয়েছে।

অনেক রুশ রূপকথা ও বুলিনা অবলম্বনে অ্যানিমেশন ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে বিখ্যাত পরিচালক আলেক্সান্দ্র্‌ পতুশ্‌ক নির্মিত ইলিয়া মুরোমেৎসসাদকো এবং আলেক্সান্দ্র্‌ রও পরিচালিত মোরোজ্‌কোভাসিলিসা প্রেক্রাস্নায়া উল্লেখযোগ্য। কয়েকজন রুশ কবি, যেমন পিওতর ইয়ের্শভ ও লেওনিদ ফিলাতভ বেশ কিছু ধ্রুপদী রুশ রূপকথার কাব্যিক অনুবাদ করেছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে, যেমন আলেক্সান্দ্‌র পুশকিন নিজেই সম্পূর্ণ মৌলিক রূপকথাধর্মী কবিতা রচনা করেছেন, যা খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

সাহিত্য

রুশ সাহিত্য কিছু বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম সংবলিত বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও উন্নত সাহিত্য।[২] রাশিয়ার সাহিত্যের ইতিহাস শুরু হয় ১০ম শতাব্দী থেকে এবং ১৮শ শতাদবীতে মিখাইল লোমোনোসভ ও দেনিস ফনভিজিনের রচনার মাধ্যমে তা বিকাশ লাভ করে এবং ১৯শ শতাব্দীর শুরুর দিকে আধুনিক রীতির উদ্ভবের ফলে কয়েকজন সর্বকালের সেরা লেখকের আবির্ভাব ঘটে। এই যুগ এবং রুশ কাব্যের স্বর্ণ যুগ শুরু হয় আলেক্সান্দ্‌র পুশকিনের হাত ধরে। পুশকিনকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের স্থপতি বলা হয় এবং তাকে "রুশ শেকসপিয়র" বা "রুশ গ্যোটে" বলে অভিহিত করা হয়।[১৩]

দৃশ্যমান শিল্পকলা

স্থাপত্য

রুশ স্থাপত্য প্রাচীন স্লাভদের কাঠের তৈরি দালান নির্মাণের মাধ্যমে শুরু হয়। কিয়েভান রুস সময়ে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার সময় থেকে কনস্তান্তিনোপলের পতন পর্যন্ত কয়েক শতাব্দী ধরে রুশ স্থাপত্য বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। দুর্গ নির্মাণ ছাড়া প্রাচীন রুসের পাথরের দালানসমূহ ছিল অনেক গম্বুজসহ গোঁড়া চার্চ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চার্চগুলো সোনার পাত দিয়ে গিল্টি করা থাকত বা উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করা হত। আরিস্তোতেলে ফিওরাভেন্তি ও অন্যান্য ইতালীয় স্থপতিরা রাশিয়ায় রেনেসাঁর ধারা নিয়ে আসেন। ১৬শ শতাব্দীতে সেন্ট বাসিল্‌স ক্যাথেড্রালে তাবুর ন্যায় চার্চের বিকাশ দেখা যায়। এই সময়ে পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজের নকশা বিকাশ লাভ করে। ১৭শ শতাব্দীতে মস্কো ও ইয়ারোস্লাভ্‌লে কোপন আকৃতির অলঙ্করণ বৃদ্ধি পায়, যা ধীরে ধীরে ১৬৯০ এর দশকে নারুশ্‌কিনের বারোকে রূপান্তরিত হতে থাকে। মহান পিটারের পরবর্তী সময়ের সংস্কার রাশিয়াকে পশ্চিমা সংস্কৃতির নৈকট্য এনে দেয়, এবং এই পরিবর্তনের ফলে স্থাপত্য শৈলী পশ্চিম ইউরোপের রূপ ধারণ করতে শুরু করে।

হস্তশিল্প

মাত্রিওশ্‌কা পুতুল।

মাত্রিওশ্‌কা পুতুল হল পাখির বাসার মত এক ধরনের রুশ পুতুল। মাত্রিওশ্‌কা পুতুলের কাঠের কাঠামোর ভিতর আরেকটি পুতুল বিদ্যমান থাকে যা থেকে আরও ছোট একই ধরনের পুতুল বেড়িয়ে আসে, এবং ছোট থেকে ছোটতর হয়ে এই রকম চলতে থাকে। এই সংখ্যা ছয় বা তার বেশি হতে পারে। এর আকার অনেকটা সিলিন্ডারের মত, উপরের দিকে মাথা বৃত্তাকার এবং নিচে ক্রমশ সরু হয়ে আসে। মূল কারুকার্য হল প্রতিটি পুতুলের চিত্রাঙ্কনে। এই পুতুলের মূল বিষয়বস্তু হল ঐতিহ্যবাহী পোশাকে কৃষাণ তরুণী, কিন্তু অন্য কিছুও হতে পারে, যেমন রূপকথা বা সোভিয়েত নেতা।

পরিবেশন শিল্পকলা

রুশ লোক সঙ্গীত

একটি বালালাইকা।

লোক সঙ্গীতে রুশদের ভিন্নধর্মী ঐতিহ্য রয়েছে। সাধারণ নৃতাত্ত্বিক রুশ সঙ্গীত সরঞ্জামসমূহ হল গুস্লি, বালালাইকা, ঝালেইকা, বালালাইকা কন্ত্রাবেজ, বায়ান আকর্ডিয়ান, জিপসি গিটার ও গারমশ্‌কা। রুশ ধ্রুপদী সুরকারদের মধ্যে লোক সঙ্গীতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, এবং আধুনিক সময়েও লোক সঙ্গীত কয়েকটি জনপ্রিয় লোক সঙ্গীত দল, যেমন গোল্ডেন রিং, উরালের নেশন চোয়ার, লুদ্‌মিলা জিকিনার অনুপ্রেরণার উৎস। সোভিয়েত সময়ের রুশ লোক গান ও দেশাত্মবোধক গানসমূহ রেড আর্মি চোয়ার ও অন্যান্য জনপ্রিয় রুশ দলের গানের ভাণ্ডার।

ধ্রুপদী সঙ্গীত

১৯শ শতাব্দীর রাশিয়ার সঙ্গীতে ধ্রুপদী সুরকার মিখাইল গ্লিঙ্কা ও মুগোচায়া কুচ্‌কা দলের অন্যান্য সদস্যরা তাদের সুরে রুশ জাতি সত্তার পরিচয় গ্রহণ এবং ধর্ম ও লোক উপাদান যুক্ত করে। সুরকার আন্তন ও নিকোলাই রুবিনস্তেনের সুরকৃত সঙ্গীতদল রুশ মিউজিক্যাল সোসাইটি রক্ষণশীল ছিল। রোম্যান্টিক যুগের অন্যতম সেরা সুরকার পিওতর ইলিচ তচাইকোভ্‌স্কির রোম্যান্টিক ধারা এর রুশ শব্দ ও সুর ও তালের জন্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০শ শতাব্দীতে সের্গেই রাচমানিনফ ইউরোপীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের রোম্যান্টিক ধারার শেষ বিখ্যাত সুরকার ছিলেন।[১৪]

রাশিয়ার চলচ্চিত্র

পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশসমূহে চলচ্চিত্র প্রথমে শ্রমিক শ্রেণীর জন্য সস্তা বিনোদন ও অবসরের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। রুশ চলচ্চিত্র নির্মাতাগণ ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পরে প্রসিদ্ধি লাভ করতে শুরু করেন যখন তারা আবিষ্কার করলেন চলচ্চিত্রের ভাবানুভূতি প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হল সম্পাদনা।[১৫] ১৯২৭ সালের বিপ্লবের পর রুশ এবং পরবর্তী সোভিয়েত চলচ্চিত্র ছিল উদ্ভাবনের প্রধান ক্ষেত্র এবং এই সময়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন নির্মিত হয়।[৬] সোভিয়েত যুগের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হলে সের্গেই আইজেনস্টাইনআন্দ্রেই তার্কভ্‌স্কি, যারা বিশ্বের সবচেয়ে সৃজনশীল ও প্রভাবশালী পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম।

আরও দেখুন

  • রাশিয়ার সাংস্কৃতিক প্রতীক
  • রাশিয়ায় বস্তু সংস্কৃতি
  • রুশ ব্যক্তিদের তালিকা
  • রাশিয়ার জাদুঘরের তালিকা
  • রুশ ভাষার কবিদের তালিকা
  • রুশ ভাষার ঔপন্যাসিকদের তালিকা
  • সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কৃতি
  • তারারস্তানের সংস্কৃতি

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

টেমপ্লেট:রুশ শিল্প আন্দোলন

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ