লাক্সর মন্দির
লাক্সর মন্দির (আরবি: معبد الاقصر) হল প্রাচীন মিশরে নীল নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত প্রাচীন থিবস (অধুনা লাক্সর) শহরের এক সুবৃহৎ মন্দির চত্বর। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দ নাগাদ এটি নির্মিত হয়। মিশরীয় ভাষায় স্থানটি ইপেত রেসিত ("দক্ষিণী পুণ্যস্থান") নামে পরিচিত। লাক্সর এলাকায় নীল নদের পূর্ব ও পশ্চিম তীরে একাধিক বৃহদায়তন মন্দির অবস্থিত। প্রাচীন পর্যটকগণ এখানে চারটি প্রধান শবাগার মন্দির পরিদর্শন করেছিলেন। এগুলি হল: গুরনাহ্-এর প্রথম সেতির শবাগার মন্দির, দেইর এল বাহরিতে হাতশেপসুতের মন্দির, দ্বিতীয় রামেসিসের মন্দির (রামেসিয়াম) এবং মেদিনেত হাবুতে তৃতীয় রামেসিসের মন্দির। নদীর পূর্ব তীরে দু’টি প্রাথমিক কাল্ট-মন্দির কারনাক ও লাক্সর নামে পরিচিত।[১] থিবসের অন্যান্য মন্দিরগুলি কোনও না কোনও কাল্ট-দেবতা বা মরণোত্তরকালে দেবত্বারোপিত কোনও ফ্যারাওর প্রতি উৎসর্গিত হলেও লাক্সর মন্দিরের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি; এই মন্দির উৎসর্গ করা হয়েছিল রাজপদের পুনর্যৌবনলাভের উদ্দেশ্যে। মিশরের অনেক ফ্যারাও সম্ভবত এখানেই বাস্তবে বা তত্ত্বগতভাবে রাজ্যাভিষিক্ত হয়েছিলেন। তাত্ত্বিক রাজ্যাভিষেকের একটি উদাহরণ হল আলেকজান্ডারের রাজ্যাভিষেক। তিনি দাবি করেছিলেন যে, লাক্সরেই তাঁর রাজ্যাভিষেক ঘটে। কিন্তু বাস্তবে অধুনা কায়রো শহরের নিকটস্থ মেমফিসের দক্ষিণে তিনি কখনই যাত্রা করেননি।
অবস্থান | লাক্সর, লাক্সর গভর্নরেট, মিশর |
---|---|
অঞ্চল | উচ্চ মিশর |
স্থানাঙ্ক | ২৫°৪২′০″ উত্তর ৩২°৩৮′২১″ পূর্ব / ২৫.৭০০০০° উত্তর ৩২.৬৩৯১৭° পূর্ব |
ধরন | পবিত্র স্থান |
যার অংশ | থিবস |
ইতিহাস | |
প্রতিষ্ঠিত | খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দ |
স্থান নোটসমূহ | |
প্রাতিষ্ঠানিক নাম | লাক্সর মন্দির |
এর অংশ | প্রাচীন থিবস ও সমাধিক্ষেত্র |
মানদণ্ড | সাংস্কৃতিক: (i), (iii), (vi) |
সূত্র | 87-002 |
তালিকাভুক্তকরণ | 1979 (৩য় সভা) |
আয়তন | ৭,৩৯০.১৬ হেক্টর (২৮.৫৩৩৬ মা২) |
নিরাপদ অঞ্চল | ৪৪৩.৫৫ হেক্টর (১.৭১২৬ মা২) |
লাক্সর মন্দিরের সম্মুখভাগে অষ্টাদশ রাজবংশের তৃতীয় আমেনহোটেপ ও আলেকজান্ডার নির্মিত উপাসনাস্থল বিদ্যমান। মন্দিরের অন্যান্য অংশগুলি নির্মিত হয়েছিল তুতানখামুন ও দ্বিতীয় রামেসিস কর্তৃক। রোমান যুগে এই মন্দির ও তার চারপাশের এলাকা ছিল সামরিক দুর্গের অন্তর্গত এবং এখানেই গড়ে উঠেছিল স্থানীয় রোমান সরকারের কার্যালয়। মন্দিরের অভ্যন্তরে দেবী মুতের প্রতি উৎসর্গিত উপাসনাস্থলটি এই যুগেই টেট্রার্কি কাল্টের উপাসনাস্থলে এবং পরবর্তীকালে একটি গির্জায় রূপান্তরিত হয়। [২]
নির্মাণশৈলী
লাক্সর মন্দিরটি দক্ষিণ-পশ্চিম মিশরের গেবেল এল-সিলসিলা অঞ্চলের বেলেপাথরে নির্মিত।[৩] এই অঞ্চলের বেলেপাথরকে নুবীয় বেলেপাথর বলা হয়।[৩] উচ্চ মিশর অঞ্চলের স্মারক নির্মাণে এবং অতীতে ও বর্তমানে পুনর্নির্মাণের কাজে এই বেলেপাথর ব্যবহৃত হয়েছে।[৩]
অন্যান্য মিশরীয় স্থাপত্যের মতো লাক্সর মন্দিরের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত একটি সাধারণ পদ্ধতি হল প্রতীকবাদ বা দৃষ্টিবিভ্রমবাদ।[৪] উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন মিশরীয় আনুবিস শৃগালাকৃতি পুণ্যস্থানগুলি ছিল সাক্ষাৎ আনুবিসের প্রতিরূপ।[৪] লাক্সর মন্দিরের প্রবেশপথের দুই পাশে দু’টি ওবেলিস্ক ছিল (পশ্চিমের অপেক্ষাকৃত ছোটো ওবেলিস্কটি এখন প্যারিসের প্লেস দে লা কনকর্ডে রক্ষিত)। ওবেলিস্ক দু’টির উচ্চতা এক না হলেও মন্দিরটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে সেগুলিকে সমউচ্চতাবিশিষ্ট বলে ভ্রম হয়।[৪] এই দৃষ্টিবিভ্রমবাদের প্রয়োগ ঘটিয়ে আপেক্ষিক দূরত্ব বৃদ্ধি করা হত, যাতে সেগুলিকে পিছনের দেওয়ালের সঙ্গে সমউচ্চতাবিশিষ্ট মনে হয়। উচ্চতা ও দেওয়ালের থেকে দূরত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করার জন্য এটি একটি দৃশ্যগত ও ব্যাপনস্থল-সংক্রান্ত প্রতীকী প্রভাব সৃষ্টি করত এবং তার ফলে মধ্যবর্তী পথটিকে বড়ো মনে হত।[৪]
খননকার্য
মধ্যযুগে লাক্সর মন্দির এলাকায় মুসলমান সম্প্রদায়ের বসতি গড়ে ওঠে। ক্রমে সেই জনবসতি মন্দিরপার্শ্বস্থ ঢিবির দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হয়।[১] সুদূর অতীতে লাক্সর মন্দিরের আশেপাশে ঘরবাড়ি বিশেষ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে মন্দিরে এবং তার আশেপাশে মানুষের বসতি স্থাপিত হলে শত শত বছর ধরে নুড়িপাথর সঞ্চিত হয়ে স্থানটি প্রায় ১৪.৫ থেকে ১৫ মিটার (৪৮-৫০ ফুট) উচ্চতাবিশিষ্ট একটি কৃত্রিম পাহাড়ে পরিণত হয়।[১] ১৮৮৪ সালে অধ্যাপক গ্যাস্টন মাসপেরোর নেতৃত্বে এই মন্দির চত্বরে খননকার্য শুরু হয়।[১] এরপর ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে খননকার্য চলে।
বহুকাল ধরে সঞ্চিত নুড়িপাথর লাক্সর মন্দিরের এক-তৃতীয়াংশ নিমজ্জিত করে ফেলেছিল। এই নিমজ্জিত অংশেই মন্দিরের দরবার ও স্তম্ভসারিগুলি অবস্থিত ছিল। আর এইখানেই আধুনিক গ্রামের আরব-অর্ধের কেন্দ্রস্থলটি গড়ে ওঠে। মাসপেরো আগেই এই স্থানটি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন এবং ১৮৮১ সালে কাজটি শেষ করার জন্য মারিয়েট পাশার স্থলাভিষিক্ত হন। শুধু নুড়িপাথরের স্তুপই নয়, এখানে গড়ে ওঠা ব্যারাক, দোকানপাট, বাড়িঘর, কুঁড়েঘর, পায়রা মিনারগুলিও খননকার্যের স্বার্থে অপসারিত করা হয়। তবে মন্দির চত্বরের মধ্যে এখনও একটি মসজিদ রয়ে গিয়েছে। অন্য সব ঘরবাড়ি সরানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রয়োজনীয় অর্থ মাসপেরো সংগ্রহ করেছিলেন মিশরের তদনীন্তন পূর্তমন্ত্রীর কাছ থেকে।
উৎসব
লাক্সর মন্দিরটি ছিল থিবীয় ত্রয়ী (আমুন, মুত ও খোনসু) কাল্টের কেন্দ্র। বাৎসরিক ওপেত উৎসবের জাঁকজমক বৃদ্ধি করার জন্য নতুন রাজ্যের সমসাময়িক কালে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। এই উৎসবে আমুনের কাল্ট মূর্তিটি শোভাযাত্রা-সহকারে নীল নদের উপর দিয়ে নিকটবর্তী কারনাক মন্দিরে (ইপেত-সুত) নিয়ে যাওয়া হত। সেখানে উর্বরতার উৎসব উদযাপনের উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণ আমুনের মূর্তি তাঁর স্ত্রী মুতের মূর্তির সঙ্গে রাখা হত। সেই থেকেই এই ওপেত নামটির উৎপত্তি। অবশ্য একটি লিপিসমীক্ষক দলের গবেষণার ফলে লাক্সর মন্দির ও সেখানকার বিখ্যাত বাৎসরিক উৎসব সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন এক ব্যাখ্যা উঠে এসেছে।[৫] এই দলের মতে, লাক্সরের মন্দিরটি উৎসর্গিত হয়েছিল দেবত্বারোপিত মিশরীয় শাসকদের, বা আরও সঠিকভাবে বললে, রাজকীয় কা কাল্টের উদ্দেশ্যে।[৫] মন্দিরের তোরণের সামনে ও প্রবেশপথে দেবত্বারোপিত দ্বিতীয় রামেসিসের অতিকায় মূর্তিটি রাজকীয় কা কাল্টের একটি উদাহরণ। এছাড়া মন্দিরের স্তম্ভসারিগুলিও স্পষ্টতই কা-মূর্তি অর্থাৎ রাজকীয় কা-এর প্রতীকস্বরূপ রাজার কাল্ট মূর্তি।
বিরাম মঞ্চ
কারনাক ও লাক্সর মন্দিরের মধ্যবর্তী পথে উৎসব শোভাযাত্রায় দেবতাদের বজরাগুলির বিশ্রামের জন্য ছয়টি বজরা বেদি স্থাপিত হয়েছিল।[৬] এই পথেই ওপেত ইত্যাদি উৎসবের জন্যও মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছিল, যার ফলে মন্দিরটির গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছিল।[৬] প্রত্যেকটি মঞ্চের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। যেমন, চতুর্থ মঞ্চটি ছিল কামারে-র মঞ্চ। এটি আমুনের বৈঠা ঠান্ডা করার কাজে ব্যবহৃত হত।[৬] কামারে-র পঞ্চম মঞ্চটি ছিল আমুনের সৌন্দর্য গ্রহণের মঞ্চ[৬] এবং ষষ্ঠ মঞ্চটি ছিল পবিত্র সিঁড়িরূপী আমুনের বেদি।[৬] ১২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম নেকটানেবোর দরবারে ছোটো ইটের ছোটো একটি মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল। সেরাপিস ও আইসিসের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত এই মঞ্চটি রোমান সম্রাট হেড্রিয়ানকে তাঁর জন্মদিনে উপহার দেওয়া হয়েছিল।[৭]
আবু হাগ্গাগ মসজিদ
লাক্সর মন্দির চত্বরের প্রাচীন স্তম্ভগুলির মাঝে অবস্থিত আবু হাগ্গাগ মসজিদটি (আরবি: مسجد أبو الحجاج بالأقصر) অদ্যাবধি সক্রিয় রয়েছে। মন্দিরের এই অংশটি ৩৯৫ সালে একটি গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে সেটিকে আবার মসজিদে পরিণত করা হয়। এইভাবে এই অংশটি টানা ৩৪০০ বছর ধরে ধর্মীয় উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[৮] এই জন্য লাক্সর মন্দির হল বিশ্বের প্রাচীনতম ভবন যেটি অন্তত আংশিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক বা পর্যটনের উদ্দেশ্য ছাড়াও সক্রিয়।
বিকৃতিকরণ
২০১৩ সালে এক চীনা ছাত্র লাক্সর মন্দিরের একটি ভাস্কর্যের গায়ে চীনা ভাষায় "ডিং জিনহাও এখানে এসেছিল" (চীনা: 丁锦昊到此一游) লেখা একটি খোদাইকরা দেওয়ালচিত্র সেঁটে দিয়ে যায়। এই ঘটনা ও অন্যান্য বিকৃতিগুলি যে এক চীনা ছাত্রের করা সেই ব্যাপারে গণমাধ্যম নিশ্চিত হওয়ার পর এখানে ক্রমবর্ধমান পর্যটন নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। তারপর সেই খোদাইচিত্রটি আংশিকভাবে অপসারিত হয়।[৯]
চিত্রাবলি
- তৃতীয় আমেনহোটেপের সূর্য দরবার
- প্রথম তোরণে মহামতি রামেসিসের অতিকায় মূর্তি
- স্ফিংক্স সরণির রাতের দৃশ্য
- দ্বিতীয় রামেসিসের দণ্ডায়মান মূর্তি, বর্তমান সময়ে
- দ্বিতীয় রামেসিসের দণ্ডায়মান মূর্তি, খননকার্যের আগে
- তৃতীয় আমেনহোটেপের শোভাযাত্রা স্তম্ভসারি
- আবু আল-হাল্লাজ মসজিদ, দ্বিতীয় রামেসিসের দরবার থেকে দৃষ্ট
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
টেমপ্লেট:লাক্সরের দর্শনীয় স্থান