হাতশেপসুত

হাতশেপসুত বা হতশেপসুত (মিশরীয় চিত্রলিপি:

F4
X1
A51X1
Z2

 ; ḥ3.t-šps.wt;[৪] রোমান লিপি: Hatshepsut; ১৫০৭ - ১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রাচীন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের পঞ্চম ফেরাউন ছিলেন। তার নামের অর্থ "মহৎ নারীদের প্রধান"[৪]। প্রাচীন মিশরবিদরা তাকে সাধারনভাবে সর্বাপেক্ষা সফল ফেরাউনদের একজন হিসেবে গণ্য করেন। মিশরীয় রাজবংশের অন্যান্য নারীদের থেকে তার রাজত্বকাল ছিল দীর্ঘতর।

ঐতিহাসিকভাবে তিনি দ্বিতীয় মহিলা ফেরাউন ছিলেন। প্রথম মহিলা ফেরাউন ছিলেন সোবেকনেফেরু.[৫]। হাতশেপসুত ১৪৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের সিংহাসনে বসেন। তিনি দ্বিতীয় থুতমোসের প্রধান স্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয় থুতমুসের মৃত্যুর পর মিশরের শাসনভার অর্পিত হয় তার পুত্র তৃতীয় থুতমোস এর উপর। কিন্তু তৃতীয় থুতমোসের বয়স তখন মাত্র দুই বছর। বিমাতা হাতশেপসুত তৃতীয় থুতমোস এর সাথে যৌথভাবে মিশরের শাসনভার গ্রহণ করেন।

হাতশেপসুত প্রথম থুতমোস এবং তার প্রধান স্ত্রী আহমোসের একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন।[৬] তার স্বামী দ্বিতীয় থুতমোস, প্রথম থুতমোস এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী মুতনোফ্রেতের সন্তান ছিলেন। মুতনোফ্রেত রাজকন্যা হিসেবে অভিহিত হতেন। ধারণা করা হয় তিনি প্রথম আহমোসের কন্যা ছিলেন। হাতশেপসুত এবং দ্বিতীয় থুতমোসের নেফেরুরে নামে কন্যা সন্তান ছিল। তৃতীয় থুতমোসের মায়ের নাম আইসেত। তিনি দ্বিতীয় থুতমসের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন।

মিশরবিদদের মতে হাতশেপসুত ফেরাউনদের মধ্যে সবচেয়ে সফল শাসক ছিলেন এবং মিশরীয় রাজবংশের অন্য কোন নারীর অপেক্ষা দীর্ঘতর সময় শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। মিশরবিদ জেমস হেনরি ব্রেস্টেড বলেন, হাতশেপসুত, "ইতিহাসের প্রথম মহীয়সী নারী যার সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি।"[৭]

ব্যক্তিগত তথ্য

হতশেপসুত কথাটির অর্থ "মহৎ নারীদের প্রধান" অথবা কার্নাকের মন্দিরে ফেরাউনদের যে তালিকা পাওয়া গেছে তাতে যেভাবে তা চিত্রিত হয়েছে, সেই অনুসারে "অভিজাত রমনীদের মধ্যে প্রধানা, যিনি আমুনের আলিঙ্গনধন্যা"।

তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ হল -

  • পিতা: প্রথম থুতমোসে
  • মাতা: রাণী আহমোসে
  • ভ্রাতা: আমুনমোসে ও ওয়াদ্‌জমেস
  • ভগ্নী: নফ্রুবিতি
  • সৎ ভ্রাতা ও স্বামী: দ্বিতীয় থুতমোসে (মাতা: সৎ মা মুতনোফ্রেত)

হাতশেপসুত ও দ্বিতীয় থুতমোসের দুই মেয়ে ছিল। বড় মেয়ের নাম নেফেরুরে। ছোট মেয়ের নাম মেরিতরে হতশেপসুত। এই দ্বিতীয় মেয়ের বিষয়ে বহুদিন পর্যন্ত যথেষ্ট বিতর্ক ছিল ঐতিহাসিকদের মধ্যে। এর কারণ তার উল্লেখ আমরা পাই মূলত ফেরাউন তৃতীয় থুতমোসের স্ত্রী এবং ফেরাউন দ্বিতীয় আমেনহোটেপের মা হিসেবে। হাতশেপসুতের মেয়ে হিসেবে তাকে জানার প্রধান সূত্র তার নাম ও প্রখ্যাত প্রাচীন মিশরীয় অমাত্য আহমোসে পেন-নেখবেতের আত্মজীবনীতে নেফেরুরেকে "বড় মেয়ে" বলে উল্লেখ।[৮][৯] মিশরের সে' সময়ের রীতি অনুযায়ী বড় মেয়ের নাম দেওয়া হত সাধারণত তার দিদিমার নামানুসারে, কিন্তু তারপরের মেয়ের ক্ষেত্রে মায়ের নামানুসারে নাম রাখারই চল ছিল।

১৪৭৯ বা ১৪৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় থুতমোসের পর তৃতীয় থুতমোসে ফেরাউনের পদ লাভ করেন। কিন্তু তখন তার বয়স ছিল খুবই কম, মাত্র দুই থেকে চার বছরের মধ্যে। পূর্বতন ফেরাউনের প্রধানা রাণী ও বর্তমান ফেরাউনের বিমাতা হিসেবে এই সময় হাতশেপসুত তৃতীয় থুতমোসের নামে শাসনভার গ্রহণ করেন ও ১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত যৌথভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেন।[১০] আধুনিক মিশরবিদদের মতে অবশ্য তিনি প্রকৃত ফেরাউনের ক্ষমতারই অধিকারী ছিলেন।[১১]

জন্ম

যতদূর জানা গেছে, ১৪৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তার জন্ম হয়।[১২]

দইর আল বাহারির স্মৃতিমন্দিরে রাণী আহমোসের উপর একটি লেখা পাওয়া গেছে, যার বঙ্গানুবাদ মোটামুটি নিম্নরূপ –

দেবতা আমুন রে একদা থিবিস নগরীতে অসামান্যা সুন্দরী এক রমনীকে দেখতে পান। আমুন রে তখন তার খবর নিতে [চন্দ্রদেবতা] থৎকে পাঠান। খবর পেয়ে আমুন রে থিবিসে যান ও তার স্বামীর রূপ ধরেন। তিনি তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পান, কিন্তু দেবতার গন্ধে তার ঘুম ভেঙে যায়। আমুন রে তাকে প্রেম নিবেদন করেন, তার কাছে আসেন এবং রাণী আহমোসে তার মধ্যে দেবতা আমুন রে’র রূপ প্রত্যক্ষ করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁকে চুম্বন করে এবং বলে, ‘সত্যি, এ’ আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনার মুখদর্শন করতে পারছি; আমার স্বামীকে তা যেন এক জ্যোতির মতোই ঘিরে আছে।’ আমুন রে তার উত্তরে বলেন, ‘তুমি নিজের মুখে যেমন বলেছ, আমার মেয়ে, যাকে আমি তোমার দেহে বপন করেছি, তার নামও হবে তেমনই ‘’হতশেপসুত’’[অভিজাত রমনীদের মধ্যে প্রধানা, যিনি আমুনের আলিঙ্গনধন্যা]। এই হতশেপসুতই একদিন সমগ্র দেশে সম্রাটের দরবার সামলাবে ও দায়িত্বপালন করবে।’


মিশরবিদদের মতে এই লেখাটি আসলে স্রমাজ্ঞী হাতশেপসুতের প্রশাসনকে বৈধতাপ্রদানের উদ্দেশ্যে পরে খোদাই করা; এর রচনাশৈলী যদিও পুরনো রাজত্বের ৪র্থ৫ম রাজবংশের সময়ের অনুরূপ। হয়তো ভেস্টকার প্যাপাইরাসে (সময়কাল ৪র্থ রাজবংশ) বর্ণিত সূর্যদেবতার তিন সন্তানের আখ্যানকে অনুসরণ করেই এই লেখাটি খোদিত হয়েছিল। উক্ত আখ্যানেও আমরা ফেরাউন খেওপকে তার বংশ ও উত্তরাধিকার হিসেবে দেবতার সন্তানদের নির্বিবাদেই মেনে নিতেই দেখি।[১২]

দইর আল বাহারির আলেখ্যেও আমরা দেখতে পাই যে হাতশেপসুত এখানে তার জন্মের ক্ষেত্রে পার্থিব পিতা প্রথম থুতমোসের বদলে সুকৌশলে অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করছেন তার ছদ্মবেশে আসা দেবতার উপর; একমাত্র রাণীই তাকে দেবতা হিসেবে চিনতে পারেন ও তার সাথে দেবতা তার স্বামীর ছদ্মবেশের বাইরে গিয়ে কথোপকথনেও ব্যাপৃত হন। অর্থাৎ, হাতশেপসুতের জন্মসংক্রান্ত এই আখ্যানটির সমস্ত উপাদানই মিশরীয় পুরাণের সাথে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। মিশরীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী মিশরের ফেরাউনরা সাক্ষাত দেবতার বংশধর। এই আখ্যান দেখায় ফেরাউন প্রথম থুতমোসের সন্তান হিসেবে শুধুমাত্র দ্বিতীয় থুতমোসেই নয়, স্রমাজ্ঞী হাতশেপসুতও সমানভাবেই দেবতার সাক্ষাত বংশধর, এমনকি দেবতার সাক্ষাত বংশধর হিসেবে তার যোগ্যতা দ্বিতীয় থুতমোসের থেকেও অপেক্ষাকৃত বেশিই।[১২]


শাসন কাল

অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে জাহাজে করে পান্ট থেকে গাছ মিশরে নিয়ে আসা হচ্ছে লাগানোর জন্য—হাতশেপসুতের সমাধি মন্দির থেকে প্রাপ্ত

হাতশেপসুতের রাজত্বের সময়সীমা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রাচীন নথিতে লিপিবদ্ধ থাকলেও আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে প্রাথমিক ধারণা ছিল হাতশেপসুত শুধুমাত্র আনুমানিক ১৪৭৯ থেকে ১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পর্যন্ত সহ-শাসক হিসাবে মিশরে রাজত্ব করেন এবং শাসনকালের সপ্তম থেকে একুশতম বৎসর পর্যন্ত শাসনভার তৃতীয় থুতমোসের ছিল।[১০] কিন্তু বর্তমানে মিশরবিদদের মতে হাতশেপসুত ফেরাউনের মত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।[১১][১৩]

হাতশেপসুত প্রায় ২২ বছর প্রাচীন মিশরে রাজত্ব করেছেন বলে মনে করা হয়। জোসেফাস এবং জুলিয়াস আফ্রিকানাস দুই জনেই মানেথোর রাজার তালিকায় অ্যামেসিস বা আমেনসিস নামক একজন মহিলার কথা উল্লেখ করেছেন। উক্ত বর্ণনা বিশ্লেষণ করলে তা হাতশেপসুত বলেই ধারণা করা হয়। জোসেফাস হাতশেপসুতের শাসন ২১ বছর নয় মাস [১৪] বলে উল্লেখ করেছেন। আফ্রিকানাস অবশ্য হাতশেপসুতের শাসনকাল ২২ বছর বলে উল্লেখ করেন। থুতমোসে ২২ বছর বয়সে প্রথমবারের মত বিদেশ অভিযানে লিপ্ত হন। ধারণা করা হয় হাতশেপসুতের শাসনামল এর আগেই সমাপ্ত হয়েছিল।[১৫]

যদিও হাতশেপসুতের শাসনামল কবে থেকে শুরু হয়েছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। ধারণা করা হয় তার পিতার শাসনামল শুরু হয় ১৫২৬ অথবা ১৫০৬ খ্রীস্টপূর্বে।[১৬] কিন্তু প্রথম এবং দ্বিতীয় থুতমোসের শাসনামলের স্থায়ীত্ব ঠিক কতদিন ছিল তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয় নি। যদি শাসনামল কম ধরা হয় তাহলে প্রথম থুতমোস বা তার পিতার [১৭] শাসনের পর তিনি ১৪ শাসন করেন। আর যদি শাসনামল দীর্ঘকাল ধরা হয় তাহলে তার পিতা রাজা হওয়ার পর ২৫ বছর।[১৬] সেই হিসেবে ধারণা করা হয় হাতশেপসুত ক্ষমতা ১৫১২ খ্রীস্টপূর্বে অথবা ১৪৭৯ খ্রীস্টপূর্বে গ্রহণ করেন।

ফেরাউন হিসাবে হাতশেপসুতের প্রথম পরিচয় প্রকাশ পায় রামোস এবং হাতনোফের সমাধিতে। এই সমাধিগুলোতে প্রাপ্ত ধন-সম্পত্তির মধ্যে একটি মাটির পাত্রে "সপ্তম বৎসর" কথাটি লেখা ছিল।[১৮]

একই সমাধি থেকে প্রাপ্ত আরেকটি পাত্রে "গডের স্ত্রী হাতশেপসুত" সিল ছাপা ছিল। আরও দুইটি পাত্রে "দি গুড গডেস মাৎকারে"[১৯]। যা থেকে এটাই অনুধাবন হয় যে শাসনামলের সপ্তম বছরে এসে হাতশেপসুত মিশরের রাণী হিসেবে নয় বরং রাজা হিসেবে পরিচিত হয়ে ছিলেন।[১৯]

মূখ্য অর্জন

বাণিজ্যপথ

হাতশেপসুত মন্দির সামনে একটি গাছ, পান্ট বাণিজ্য অভিযানে এই গাছ আনা হয়েছিল বলে মন্দিরের গায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

হিক্সসের আমলে (দ্বিতীয় অন্ত্রবর্তী আমলে) মিশরের যে বাণিজ্যপথগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে অষ্টাদশ রাজবংশের সম্পদ গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করেন হাতশেপসুত। তিনি পান্ট এ অভিযানের প্রস্তুতি এবং তহবিল গঠনে সহায়তা করেন। ধারণা করা হয় শাসনামলের নবম বৎসরে তিনি পান্টে বাণিজ্যিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তার নামে ৭০ ফুট (২১ মিটার) লম্বা পাঁচটি জাহাজে নাবিক এবং ৩০ জন বৈঠাবাহক সহ ২১০ জন পুরুষ পান্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পান্ট থেকে লোবান, গন্ধরস সহ অনেক বাণিজ্যিক পণ্য ক্রয় করা হয়।

হাতশেপসুতের অভিযাত্রীরা পান্ট থেকে ৩১টি গন্ধরসের গাছ নিয়ে আসেন। বিদেশ থেকে গাছ এনে রোপণের চেষ্টা এটাই প্রথম রেকর্ড। তিনি এই গাছগুলো তার সমাধি মন্দিরে লাগিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। মিশরিয়রা পান্ট থেকে আরও অনেক পণ্য নিয়ে আসেন যার মাঝে ছিল লোবানও।[২০] লোবান গুড়ো করে হাতশেপসুত চোখের কাজল তৈরি করতেন। এটাই ধূপের প্রথম নথিভুক্ত ব্যবহার বলে ধারণা করা হয়।[২১]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ