একাদশী
একাদশী হল হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে মাসের শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষের একাদশতম চান্দ্র দিন (তিথি)।[১] প্রতিটি একাদশীর সময় চাঁদের অবস্থান অনুসারে নির্ণয় করা হয়।[২] এটি হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়ভাবে পালিত হয়। অনুগামীরা উপবাস করে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উপাসনা করে।[৩][৪] বছরে সাধারণত ২৪টি একাদশী থাকে, এবং কখনও কখনও অধিবর্ষে দুটি অতিরিক্ত একাদশী হয়।[৫] ভাগবত পুরাণ বিষ্ণুর ভক্ত অম্বরীষের একাদশী পালনের কথা উল্লেখ করেছে।[৬] একাদশী পুণ্যতিথি হিসেবে বিবেচিত।
হিন্দুধর্মের, একাদশীর উপবাসের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল মন ও শারীরিক ইন্দ্রিয়গুলির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করা এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে পরিচালিত করা। এছাড়াও, উপবাসের সাথে যুক্ত বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে।[৭][৮] একাদশীর দিন সূর্যোদয় থেকে পরের দিন সূর্যোদয় পর্যন্ত এই বিরতির সময়কাল উচ্চ প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার যেমন মটরশুঁটি এবং রবিশস্যের পরিবর্তে শুধুমাত্র ফল, শাকসবজি ও দুগ্ধজাত পণ্য খাওয়া হয়।[৯]
কিংবদন্তি
একাদশীর কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে, বিষ্ণু যখন শয়ন বা ধ্যানরত অবস্থায় ছিলো, তখন মুর্দানব রাক্ষস তাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। সেই সময়ে, বিষ্ণুর ১১ তম ইন্দ্রিয় (মন) থেকে একজন সুন্দরী নারীর জন্ম হয়। মোহগ্রস্ত মুর্দানব তাকে বিয়ে করতে চান, যার উত্তরে তিনি (নারী) বলেন যদি তাকে যুদ্ধে সে (মুর্দানব) পরাজিত করতে পরে তাহলেই বিয়ে হবে। তারা যুদ্ধ করে এবং মুর্দানব নিহত হয়। বিষ্ণু ঘুম থেকে জেগে উঠেন, এবং নারীকে একাদশী নাম দিয়ে আশীর্বাদ করেন, এবং বলেন যে কেউ যদি এই দিনে উপবাস করে তবে তার মোক্ষ লাভ হবে।।[৭][১০]
একাদশীর তালিকা
নীচের সারণীতে সময় ও একাদশীগুলি উল্লেখ করা হলো:[৫]
চন্দ্র মাস | অধিষ্ঠাত্রী দেবতা | কৃষ্ণপক্ষ একাদশী | শুক্লপক্ষ একাদশী |
---|---|---|---|
চৈত্র (মার্চ–এপ্রিল) | রাম/বিষ্ণু | পাপবিমোচনী একাদশী | কামদা একাদশী |
বৈশাখ (এপ্রিল–মে) | মধুসূদন (বিষ্ণু) | বারুথিনী একাদশী | মোহিনী একাদশী |
জ্যৈষ্ঠ (মে–জুন) | ত্রিবিক্রম (বিষ্ণু) | অপরা একাদশী | নির্জলা একাদশী |
আষাঢ় (জুন–জুলাই) | বামন | যোগিনী একাদশী | শয়নী একাদশী |
শ্রাবণ (জুলাই–আগষ্ট) | শ্রীধর | কামিকা একাদশী | শ্রাবণ পুত্রদা একাদশী |
ভাদ্র (আগষ্ট–সেপ্টেম্বর) | ঋষিকেশ[১১] | অন্নদা একাদশী | পার্শ্ব একাদশী |
আশ্বিন (সেপ্টেম্বর–অক্টোবর) | পদ্মনাভ | ইন্দ্র একাদশী[১২] | পাশঙ্কুশ একাদশী |
কার্তিক (অক্টোবর–নভেম্বর) | দামোদর | রমা একাদশী[১৩] | প্রবোধিনী একাদশী |
মার্গশির্ষ (অগ্রহায়ণ) (নভেম্বর–ডিসেম্বর) | কেশব | উৎপন্না একাদশী | মোক্ষদা একাদশী/বৈকুণ্ঠ একাদশী |
পৌষ (ডিসেম্বর–জানুয়ারি) | নারায়ণ | সফলা একাদশী | পৌষ পুত্রদা একাদশী/বৈকুণ্ঠ একাদশী |
মাঘ (জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি) | মাধব | শততীলা একাদশী | ভাইমী একাদশী / জয়া একাদশী |
ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি–মার্চ) | গোবিন্দ (কৃষ্ণ) | বিজয়া একাদশী | আমলকী একাদশী |
অধিকমাস (২-৩ বছরে একবার) | পুরুষোত্তম | পদ্মিনী বিশুদ্ধ একাদশী | পরম শুদ্ধ একাদশী |
নিয়মাবলি
একাদশী পালনের সাত্ত্বিক নিয়মগুলো হলো:
- সমর্থপক্ষে দশমীতে একাহার, একাদশীতে নিরাহার, ও দ্বাদশীতে একাহার।
- অসমর্থপক্ষে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার।
- এছাড়াও, একাদশীতে পঞ্চ রবিশস্য বর্জন করে ফলমূলাদি অনুকল্প গ্রহণ।
নিষিদ্ধ রবিশস্য
নিন্মে নিষিদ্ধ রবিশস্যসমূহ উল্লেখ করা হলো:[৯][১৪]
- ধানজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – চাউল, মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েস, খিচুড়ি, চালের পিঠা, খৈ ইত্যাদি।
- গমজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – আটা, ময়দা, সুজি, বেকারির রুটি বা সকল প্রকার বিস্কুট, হরলিক্স ইত্যাদি।
- যব বা ভুট্টাজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — ছাতু, খই, রুটি ইত্যাদি।
- ডালজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — মুগ, মাসকলাই, খেসারি, মসুরি, ছোলা, অড়হর, ফেলন, মটরশুঁটি, বরবটি ও সিম ইত্যাদি।
- সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, তিলের তেল ইত্যাদি। উপর্যুক্ত পঞ্চ রবিশস্যের যেকোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত নষ্ট হয়।
সতর্কতা
- একাদশীতে শরীরে প্রসাধনী ব্যবহার নিষিদ্ধ।
- সকল প্রকার ক্ষৌরকর্ম নিষিদ্ধ।
আরও দেখুন
- গুরুবায়ুর একাদশী
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- Gangadharan, N., Agni Purana, New Delhi: Motilala Banarsidass, 1985, Chapter 178.
- Iyer, N.P. Subramania, Kalaprakasika: The standard book on the election (mahoortha) system: with the original text in Devanagari and English translation, New Delhi: Asian Educational Services, 1982.