এক ফসলী চাষ

কৃষির আলোচনায় এক ফসলী চাষ বা এক ফসলী কৃষি বলতে একটি জমিতে প্রতিবারে একই সময়ে মাত্র একটি করে ফসলের প্রজাতি চাষ করার চর্চাকে বোঝায়। একে ইংরেজি পরিভাষায় "মনোকালচার" (ইংরেজি: Monoculture) বা "মনোক্রপিং" (ইংরেজি: Monocropping) বলে।

একটি এক ফসলী আলুর ক্ষেত

নিবিড় খামার ব্যবস্থা এবং জৈব খামার ব্যবস্থা – উভয় ব্যবস্থাতেই এক ফসলী চাষ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন কোনও নিবিড় খামারে ১০০০ হেক্টর পরিমাণ ভুট্টাক্ষেত ও জৈব খামারে ১০ হেক্টর পরিমাণ কেল শাকের ক্ষেত উভয়ই এক ফসলী চাষ হিসেবে গণ্য হবে। এক ফসলী চাষ কৃষকদেরকে রোপণ, ব্যবস্থাপনা এবং ফসল সংগ্রহে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এছাড়া এক ফসলী চাষের সুবাদে এইসব কর্মকাণ্ডে কৃষিযন্ত্র ও নিত্যনতুন বিশেষায়িত কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা নেওয়া যায়, ফলে ফসল আরও সহজে পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয়। এক ফসলী চাষে মৃত্তিকা ও স্থানীয় জলবায়ুর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং এর ফলে ফলনের পরিমাণ সর্বোচ্চ হয়। তাই কোনও ফসল ফলানোর জন্য যদি বিশেষ জলবায়ু ও মৃত্তিকার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটিকে প্রায়শই এক ফসলী পদ্ধতিতে চাষ করা হয়ে থাকে, যেমন নিম্ন জলাভূমিতে ধান চাষ, বা সৌরালোকোজ্জ্বল সমভূমিতে গম চাষ, ইত্যাদি। এক ফসলী চাষের মাধ্যমে কৃষকেরা বিশেষায়িত কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন, তাই তারাএকটি মাত্র ফসলের সাথে সংশ্লিষ্ট অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক সমস্যার পেছনে অর্থ ব্যয় করেন, ফলে তাদের মুনাফা বৃদ্ধি পায়।

সময়ের সাথে সাথে শস্য আবর্তন, শস্যের ক্রম, ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করে শস্যের প্রজাতিতে কালিক বৈচিত্র্য আনা যেতে পারে। আবার একই জমিতে বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ফসল চাষ করা যেতে পারে, যাকে বহুফসলী চাষ (ইংরেজিতে পলিকালচার Polyculture বা মাল্টিক্রপিং Multicropping) বলে। কিংবা একই সময়ে একই জমিতে একাধিক ফসল চাষ করা যেতে পারে (ফসলগুলি এমনভাবে নির্বাচিত করা হয়, যেন তা সব ফসলের জন্যই উপকারী হয়), যাকে আন্তঃফসলী চাষ (ইংরেজিতে ইন্টারক্রপিং Intercropping) বলে। বহুফসলী চাষ ও আন্তঃফসলী চাষ - এই দুই কৌশলের মাধ্যমে কৃষিতে স্থানিক বৈচিত্র্য আনা যেতে পারে। বহুফসলী চাষের কিছু প্রকারভেদ আছে। যেমন এক জমিতে বছর জুড়ে দুইটি ফসলের প্রজাতি চাষ করাকে দো-ফসলী চাষ (ইংরেজিতে ডাবল ক্রপিং Double cropping) বলে। বছর জুড়ে দুইয়ের অধিক কতিপয় ফসলের প্রজাতি চাষ করে শস্যের আবর্তন করাকে কতিপয় ফসলী চাষ (ইংরেজিতে অলিগোকালচার Oligoculture) বলে, যা বিশ্বের একাধিক অঞ্চলে জনপ্রিয়। বছরের পর বছর একই প্রজাতি বারবার চাষ করলে তাকে অবিরাম এক ফসলী চাষ বলে। মার্কিন কৃষি মন্ত্রণালয় পরপর তিন বছর একই ফসল চাষ করাকে এক ফসলী চাষ (মনোকালচার) কিংবা অবিরাম এক ফসলী চাষ (কন্টিনিউয়াস সেম ক্রপ) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে।[১]

তবে এর বিপরীতে এক ফসলী চাষের কিছু সমস্যাও আছে। যেমন এর কারণে কোনও ঝুঁকিপ্রবণ ফসলের মধ্যে অধিক দ্রুত কীটপতঙ্গ ও রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার ঘটতে পারে। এক ফসলী জমিতে অন্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির অভাবের কারণে প্রাকৃতিকভাবে কীটপতঙ্গ শিকার ও রোগবালাই দূর করা সম্ভব হয় না। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কীটনাশক ও আগাছানাশক প্রয়োগ করতে হয় এবং সেগুলি চুঁইয়ে ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠস্থ নদী ও জলপ্রবাহগুলি দূষিত হয়। কৃষিতে রাসায়নিক পদার্থের নিবিড় ব্যবহারের কারণে পাখিদের খাদ্য হিসেবে কেঁচো ও কীটপতঙ্গের পরিমাণও হ্রাস পায়। একই ফসল বারংবার চাষ করলে মাটিতে নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ হ্রাস পায় ও মৃত্তিকা অবসাদের সৃষ্টি হয়। হৃত পুষ্টি উপাদান রাসায়নিক বা জৈব সার দিয়ে পূরণ করা গেলেও তাতে ব্যয় বেশি। এক ফসলী চাষে কৃষিযন্ত্রের অধিক ব্যবহারের কারণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণও বেশি হয়, যা পরিবেশের উপর একটি নেতিবাচক প্রভাব।

মৎস্যচাষের আলোচনায় একই পুকুর বা জলাশয়ে একটি মাত্র প্রজাতির মাছ চাষ করলে তাকে "একক মাছ চাষ" বলে। একাধিক প্রজাতির মাছ চাষ করলে তাকে "মিশ্র মাছ চাষ" বলে।

ইতিহাস

যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ মানববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফ্রাং উকোটারের মতে এক ফসলী চাষের জমিগুলি বৃহৎ আকারের হয়, একটি মাত্র কৃষিজাত দ্রব্যের উপর কেন্দ্রীভূত থাকে ও দূরবর্তী কোনও বাজারে বিক্রয়ের জন্য সম্পাদন করা হয়। তাঁর মতে প্রায় ১৮শ শতক পর্যন্ত কৃষকেরা তাদের জমিতে পরিবারের খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য একাধিক ফসল চাষ করতেন। দুর্যোগের জন্য ফসলের সংগ্রহ রেখে দিতেন। এরপরেও কিছু উদ্বৃত্ত থাকলে তা বিক্রি করতেন। বাণিজ্যের বিকাশের সাথে সাথে দূরবর্তী বাজারগুলিতে প্রবেশাধিকার সহজ হয়ে আসলে বিশেষায়িত ফসল বা কৃষিদ্রব্যের উৎপাদন বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে। বিশেষায়নের ফলে ফসল রোপণ ও তোলার প্রক্রিয়াগুলি আরও দক্ষ হয়ে ওঠে, কেননা একক ফসলের জন্য অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও শ্রমিকের দরকার হয়। বাণিজ্যিকীকরণের ধাপগুলি অনুসরণ করা ও এ সংক্রান্ত নিয়মকানুনগুলি মেনে চলাও সহজ হয়। কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদনশীলতা ও মুনাফাও বৃদ্ধি পায়। এছাড়া সরকারও এক ফসলী চাষকে প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রদান করে। এভাবে এক ফসলী চাষ বিগত দুই শতকে উত্তরোত্তর বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮০% কৃষিদ্রব্যই বর্তমানে এক ফসলী চাষ থেকে আসে।[২]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ