কারাল সভ্যতা

কারাল সভ্যতা বা কারাল-সুপে সভ্যতা এখনও পর্যন্ত জানা সবচেয়ে প্রাচীন আন্দীয় সভ্যতাদক্ষিণ আমেরিকার সুপ্রাচীন এই সভ্যতা বহু ক্ষেত্রে নর্তে চিকো সভ্যতা নামেও পরিচিত।[পা ১] প্রথম নামটি এসেছে পেরুর সুপে উপত্যকায় অবস্থিত কারাল অঞ্চলের নাম থেকে। এইস্থানেই এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তূপটি আবিস্কৃত হয়েছে। তাছাড়া এই অঞ্চলটি, যতদূর বোঝা গেছে, এই সভ্যতায় একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান বলেও বিবেচিত হত।[২] অন্যদিকে পেরুর এই অঞ্চলকে কথ্য ভাষায় বর্তমানে নর্তে চিকো (স্পেনীয়, অর্থ উত্তরের ছোট্ট স্থান) বলা হয়। তার থেকেই এই দ্বিতীয় নামটির সৃষ্টি। খ্রিস্টজন্মের ৯০০০ বছর আগেই এই সভ্যতার সূচনা হয়।[৩] তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ - ১৮০০ অব্দকে এই সভ্যতার সবচেয়ে বেশি বিকাশের সময় বলে মনে করা হয়।[৪] উত্তর-মধ্য পেরুর সমুদ্র উপকূলে এই সভ্যতার অন্তত ৩০টি কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কারাল, আসপেরো, উয়ারিকাঙ্গা, কাবালেত, প্রভৃতি স্থলে খননকার্যের মাধ্যমে এই সভ্যতার প্রচূর নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে পাথরে তৈরি সম্ভাব্য বড় বড় মন্দিরের উঁচু প্ল্যাটফর্ম, বসবাসের জন্য তৈরি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, বেশ কিছু ঢিবি, প্ল্যাটফর্মের উপর খাওয়াদাওয়ার চিহ্ন, হাড়ের তৈরি বেশ কিছু বাঁশি, প্রভৃতি। তবে নব্যপ্রস্তর যুগের এই সভ্যতায় ধাতুর ব্যবহার জানা ছিল না। এমনকী মৃৎপাত্র তৈরি বা ব্যবহারের কোনও নিদর্শনও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে এখানে যথেষ্ট জটিল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। কালের বিচারে এই সভ্যতার সর্বোত্তম বিকাশের সময়টি ছিল পুরনো পৃথিবীর সুমের সভ্যতার থেকে হাজার বছর পরে, কিন্তু মিশরে যে সময়ে পিরামিডগুলি নির্মাণ হয়, তার সমসাময়িক। পশ্চিম গোলার্ধের অপর প্রাচীন সভ্যতা কেন্দ্র মেসোআমেরিকার থেকে এই সভ্যতা অন্তত ২০০০ বছর প্রাচীন।[৫][৬]

প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল থেকে ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে শুষ্ক সুপে উপত্যকায় ৫০০০ বছরের পুরনো দুটি কারাল পিরামিড।

পৃথকভাবে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, পৃথিবীর এমন ছটি কেন্দ্রের অন্যতম ও আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো নগরসভ্যতা এই কারাল সভ্যতার কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। সাধারণভাবে অত্যন্ত শুষ্ক এই অঞ্চলের বুক দিয়ে বয়ে গেছে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা প্রায় ৫০টি ছোট ছোট নদী। এদের ধার বরাবর প্রতিষ্ঠিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিরও মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। কিন্তু তারা চাষ করতো কোনও খাদ্যদ্রব্য নয়, মূলত তুলো। সেই তুলো দিয়ে মাছ ধরার জাল তৈরি করে সরবরাহ করা হত সমুদ্রতীরে অবস্থিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিতে। এই কেন্দ্রগুলিতে সংগৃহীত মাছ ও সামুদ্রিক নানা খাদ্যদ্রব্যই ছিল এই সভ্যতার মানুষের মূল খাদ্যদ্রব্য। জালের সাথে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ই ছিল সেই অর্থে এই সভ্যতার ভিত্তি। অবশ্য সঙ্কীর্ণ নদী উপত্যকাগুলিতে কিছু ফল ও সব্জিচাষের নিদর্শনও পাওয়া যায়। এই ধরনের সভ্যতার অন্য কোনও প্রাচীন নিদর্শনের কথা এখনও পর্যন্ত জানা নেই।[৫]

আজ থেকে প্রায় ৩৮০০ বছর আগে ভূমিকম্প বা এল নিনো জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই সভ্যতার পতন ঘটে বলে মনে করা হয়। অবশ্য অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় এ'জন্য কৃষিব্যবস্থার প্রচলন ও এই অঞ্চলের অনুর্বর জমি ও কৃষির প্রতিকূল আবহাওয়াকেও যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী করা হয়।[৭]

আবিষ্কার

পেরুর মানচিত্রে কারাল সভ্যতার তিনটি বড় বড় কেন্দ্র আসপেরো, কারাল ও এল পারাইসো'র অবস্থান সূচীত হয়েছে।

১৯০৫ সালেই পেরুর সমুদ্রতীরে ও কিছুটা অভ্যন্তরে সুপে উপত্যকায় এই সভ্যতার কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। সেই হিসেবে সমুদ্রতীরে আসপেরো ও সমুদ্র থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে কারালে প্রাচীন এই সভ্যতার নিদর্শনের কথা ১৯৪০'এর আগেই প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে যথেষ্ট সুপরিচিতই ছিল। কিন্তু সেই সময় এই নিদর্শনগুলির উপর তেমন কিছু গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।[৮] সে' সময় বিশেষ করে আসপেরোতে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মনে হয়েছিল নব্যপ্রস্তরযুগের এই মানুষরা এমনকী কৃষিকাজও জানতো না। ১৯৭৩ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ মাইকেল ই. মোজলি'র নেতৃত্বে আসপেরোতে যে খননকার্য চলে তাতেও মোটের উপর এই মতই সমর্থিত হয়। কিন্তু ১৯৯০'এর দশকে পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ রুথ শেডি সলিস'এর নেতৃত্বে সুপে উপত্যকায় কারাল ও অন্যান্য স্থানে যে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়, ২০০১ সালে তা প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হলে এই সভ্যতার প্রাচীনত্ব, উন্নতি ও ব্যাপকতা সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের ধারণা জন্মায়।[৯] ফলে আন্দীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে পূর্বের ধারণা অনেকটাই বদলে যায়। বোঝা যায় এই অঞ্চলে মানবসভ্যতা আরও অনেকটাই বেশি প্রাচীন। পূর্ববর্তী ধারণা অনুযায়ী যে চাভিন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে এতদিন এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার মর্যাদা দেওয়া হত, কারাল সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ করে এই অঞ্চলে মানব সভ্যতার বয়স তার থেকে হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। রেডিওকার্বন পরীক্ষাতেও কারাল সভ্যতার এই প্রাচীনত্বর প্রমাণ মেলে।[৩] তাছাড়া দেখা যায় এর উদ্ভব আন্দিজ পর্বতের কোনও উঁচু অঞ্চলে নয়, বরং সমুদ্র উপকূলের অপেক্ষাকৃত নিচু উপত্যকা অঞ্চলে। এছাড়া প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তরে কাসমা উপত্যকার সেচিন'এ বার্লিনের ফ্রাইয়ে (মুক্ত) বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা ১৯৯২ সাল থেকে যে খননকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন, সেখানেও এই সভ্যতার যোগসূত্র পাওয়া গেছে।[১০] এর থেকে কারাল সভ্যতার ব্যাপ্তি সম্বন্ধে ধারণাও আজ আরও স্পষ্ট হয়েছে। এই সবকিছু মিলিয়ে কারাল সভ্যতার গুরুত্ব আজ ঐতিহাসিকদের কাছে অনস্বীকার্য।

ভৌগোলিক অবস্থান

পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের উত্তর-মধ্য অঞ্চলে নর্তে চিকো অঞ্চলের অবস্থান, রাজধানী লিমা থেকে ১৫০ - ২০০ কিলোমিটার উত্তরে। এর দক্ষিণে লুরিন উপত্যকা ও উত্তরে কাসমা অঞ্চল। চারটি উপকূলীয় উপত্যকা উয়াউরা, সুপে, পাতিভিলচা ও ফোর্তালেজা নিয়ে এই অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে শেষের তিনটি উপত্যকা সমুদ্র উপকূল দিয়ে পরস্পর যুক্ত। কিন্তু এদের মিলিত আয়তন মাত্র ১৮০০ বর্গকিলোমিটার । অথচ এই স্বল্প জায়গাতেই কারাল সভ্যতার অনেকগুলি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এর থেকে বিশেষজ্ঞরা এই সভ্যতার যথেষ্ট ঘন জনবিন্যাসের কথা আন্দাজ করে থাকেন।[১১]

পেরুর এই উপকূলীয়় অঞ্চল প্রচণ্ড শুষ্ক একটি অঞ্চল। পূর্বে আন্দিজ পর্বতমালার অবস্থান ও পশ্চিমে সমুদ্র অভিমুখী প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্যবায়ু প্রবাহের ফলে এই অঞ্চলে একটি সঙ্কীর্ণ বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত যথেষ্ট কম। মাটিও অনুর্বর। তার উপর এই সঙ্কীর্ণ উপকূলীয় উপত্যকা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পূর্বের সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলে পুষ্ট অন্তত ৫০টি ছোট ছোট নদী বয়ে গেছে। ফলে উপত্যকাটি জায়গায় জায়গায় পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এইসব দিক বিবেচনা করে দেখলে পৃথিবীর অন্যত্র যেসব অঞ্চলে এইরকম সুপ্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাদের সাথে এই অঞ্চলের মিল যথেষ্ট অল্পই।[১২] তবু এই সব নদী থেকেই ছোট ছোট খাল কেটে এখানে সেচের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলে মানুষের হাতে তৈরি যেসব স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ এখনও দেখতে পাওয়া যায় ; দেখা যায় সেগুলিও বেশির ভাগই এইসব সেচখালের আশেপাশেই নির্মিত। এর থেকে বোঝা যায় এইসব ছোট ছোট নদী ও খালগুলি কারাল সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে একরকম প্রাণভোমরার কাজ করেছিল।[১৩]

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

কারালের একটি পিরামিড, কাছ থেকে

রেডিওকার্বন পরীক্ষার দ্বারা জানা গেছে, এই সভ্যতার বেশ কিছু নিদর্শনই (পরীক্ষার জন্য গৃহীত ৯৫টি নিদর্শনের মধ্যে অন্তত ১০টি) এমনকী ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অর্থাৎ আজ থেকে ৫৫০০ বছরের চেয়েও প্রাচীন। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটি ৯২৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তবে তা থেকে শুধু নব্যপ্রস্তরযুগের মানুষের বসতির কিছু ইঙ্গিতের চেয়ে বেশি কিছু খুব বোঝা যায় না। কিন্তু যে দুটি ক্ষেত্রে নিদর্শনগুলির বয়স নির্ধারিত হয়েছে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, সেগুলি থেকে সামাজিক স্থাপত্যের কিছু ইঙ্গিত মেলে। তবে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সময় থেকে সামাজিকভাবে নির্মিত ও ব্যবহৃত মানুষের হাতে তৈরি স্থাপত্যর পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। এর থেকে চার্লস মান প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে হয়তো ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বেই, না হলেও ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই নিশ্চিতভাবে এখানে সভ্যতার উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছিল।[১২] ফোর্তালেজা উপত্যকার উয়ারিকাঙ্গায় প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য বসতিটির বয়স জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নির্ধারণ করায় এখন সাধারণভাবে ওই সময়কেই কারাল সভ্যতার উন্মেষের নির্দিষ্ট সময় হিসেবে ধরা হয়।

উঁচু প্ল্যাটফর্ম বা বেদী, কারাল

রেডিওকার্বন পরীক্ষা থেকে আরও জানা গেছে, প্রথম দিকে এই সভ্যতার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলি ও দেশের অভ্যন্তরের অঞ্চলগুলি সমান্তরালেই বিকাশলাভ করছিল। কিন্তু ২৫০০ - ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালে, এই সভ্যতার সবচেয়ে ব্যাপ্তির সময়ে, দেশের অভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলিরই বেশি উন্নতি ঘটতে দেখা যায়। এই কেন্দ্রগুলির এই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধিরও যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারাল, প্রভৃতি দেশাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলির এইসময়েই উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের উপর মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যের উপর এরা তখনও যথেষ্টই নির্ভরশীল ছিল।[৩] এর একটি সম্ভাব্য কারণ হয়তো এই অঞ্চলের উপকূল অংশে প্রায়শই এল নিনোজনিত সুদীর্ঘকালীন তীব্র খরার প্রাবল্য, আবার কখনও বা হঠাৎ হঠাৎ সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছাস; এর ফলেই হয়তো অধিবাসীরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পরবর্তীকালে কিছুটা দেশের অভ্যন্তরে একটু উঁচু জায়গায় বসতিস্থাপন করে। কিন্তু খাদ্যের জন্য তাদের সমুদ্র নির্ভরতা থেকে যাওয়ায় সমুদ্র থেকে খুব দূরে তারা সরে যায়নি।

১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলি পরিত্যক্ত হয়। এর সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। একদল মনে করেন, ভূমিকম্প, এল নিনো বা এই জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই এর কারণ। আবার অপর দলের মতে উপকূল অঞ্চল বরাবর উত্তরে ও দক্ষিণে ও পূর্বে আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতে এইসময় আরও কতগুলি শক্তিশালী কেন্দ্রের উত্থান লক্ষ্য করা যায়। এইসব অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তরে নানা খালের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারা যায়, সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থা সেখানে গড়ে উঠেছিল। ফলে কারাল সভ্যতার মানুষ হয়তো বেশি খাদ্য নিরাপত্তাজনিত কারণেই এইসময় তাদের পুরনো অঞ্চল ছেড়ে আরও উর্বর অঞ্চলের দিকে সরে যায়, আর সঙ্গে নিয়ে যায় তাদের এতদিনের সঞ্চিত সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থার জ্ঞান।[৭]

খাদ্যাভ্যাস

কারাল সভ্যতার মানুষের খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে যা সুনির্দিষ্টরূপে জানতে পারা গেছে, তা নিম্নরূপ -

  1. রুথ শেডি সলিস কারালে খননকার্য পরিচালনার সময় খননস্থল থেকে সেইসময়ে ব্যবহৃত কিছু কিছু শস্যফল উৎপাদনকারী ও কন্দজাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্বর প্রমাণ পান। এগুলি হল স্কোয়াশ, কয়েকরকমের বিনস, পেয়ারা, লুকুমা, মিষ্টি আলু, প্রভৃতি।[১৪] পরবর্তীকালে জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা আরও উত্তরে কিছু খননস্থলেও এই উদ্ভিদগুলির খোঁজ পান। তার সঙ্গে তারা আভোকাডো, আচিরা, প্রভৃতি আরও কিছু উদ্ভিদের ব্যবহারেরও প্রমাণ পান। বর্তমানে এই সভ্যতার বিভিন্ন খননস্থলগুলি থেকে সে' সময় মেইজেরও যে প্রচলন ছিল, তা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারা গেছে।[১৫]
  2. কিন্তু সামুদ্রিক বা সমুদ্রজাত খাদ্যের আধিক্য এই সভ্যতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রোপকূল ও দেশাভ্যন্তর - সর্বত্রই এই ধরনের খাদ্য ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। কারালে খননকার্য চলাকালীন রুথ শেডি সলিস লক্ষ্য করেন "অসংখ্য প্রাণীজ ভুক্তাবশেষ, যার প্রায় পুরোটাই সামুদ্রিক"। এর মধ্যে শামুক বা ঝিনুকের খোল থেকে শুরু করে অ্যাঙ্কোভি, সার্ডিন, প্রভৃতি মাছের কাঁটা ও হাড়, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।[১৪] বিশেষ করে অ্যাঙ্কোভি মাছের অবশেষ থেকে পরিষ্কার যে এই মাছ দেশাভ্যন্তরেও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত।[১২] এর থেকে সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই সভ্যতার মানুষ খাদ্যের জন্য মূলত সমুদ্রজাত বিভিন্ন খাদ্যের উপরই নির্ভর করতো। অবশ্য জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ সমুদ্রজাত খাদ্যনির্ভরতার এই তত্ত্বের সাথে সাহমত্য প্রকাশ করেননি।[১১]
  3. ১৯৯০'এর দশকের অনুসন্ধানের ফলে কারাল সভ্যতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই আসপেরো, প্রভৃতি সমুদ্রোপকূলের প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলগুলিতে অনুসন্ধানের ফলে মাইকেল এডওয়ার্ড মোজলি প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল সমুদ্রজাত খাদ্য। শস্যজাতীয় খাদ্য সিদ্ধ করার উপযোগী কোনওরকম মৃৎপাত্রের অনুপস্থিতি তাদের এই সিদ্ধান্তকেই আরও জোরদার করে। খনন অঞ্চলে উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর পাওয়া ছোট ছোট ঢিবি বা স্তূপ থেকে তারা আন্দাজ করেন এগুলি আসলে প্রাণীজ খাদ্য প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত উনুনজাতীয় বস্তুরই অবশেষ মাত্র।[১৬]

দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থলে উল্লিখিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে 'আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা'র তত্ত্ব[১৭][১৮] বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আবার তা তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্কেরও জন্ম দেয়। কারণ সাধারণভাবে দেখা গেছে, কোনও জায়গায় সভ্যতার উত্থানের পিছনে সেখানকার মানুষের কৃষিনির্ভরতা, বিশেষ করে অন্তত একটি শস্যের ব্যাপক চাষের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ উদ্বৃত্ত খাদ্য ব্যতীত জনঘনত্ব বৃদ্ধি ও কিছু সংখ্যক মানুষের সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার সুযোগ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ফলে অপেক্ষাকৃত জটিল সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের জন্য অন্তত একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কৃষির উন্নতি খুবই প্রয়োজন। এই কারণেই 'আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা'র তত্ত্ব ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের জন্ম দেয়। তবে চার্লস মান প্রমুখ বিশেষজ্ঞ এই তত্ত্বর সত্যতার সম্ভাবনার পক্ষেই মতপ্রকাশ করেছেন।[১২]

উপকূল ও দেশাভ্যন্তর

এই সভ্যতার খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত বিতর্কের সাথে সাথেই প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে আরেকটি বিতর্কও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে - উপকূল না দেশাভ্যন্তর, এই সভ্যতার মূল কেন্দ্র ছিল কোথায়? মোজলি প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদদের প্রস্তাবিত আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্ব অনুসারে এই সভ্যতার মূল কেন্দ্র হওয়া উচিত ছিল সবসময়েই সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চল। কিন্তু বিশেষ করে ৯০'এর দশকে কারাল অঞ্চলে ব্যাপক খননকার্য ও বিরাট একটি শহরের আবিষ্কার এই তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। সমুদ্র থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরের এই শহরটি শুধুমাত্র পেরুর নয়, সমগ্র আমেরিকা মহাদেশের মধ্যেই প্রাচীনতম।[৯] এর উপর ভিত্তি করেই ঐতিহাসিকরা এই অঞ্চলের সম্ভাব্য কৃষিজ উৎপাদনের উপর জোর আরোপ করা শুরু করেন ও তার সাক্ষপ্রমাণ খুঁজে বের করার তাগিদও তাদের মধ্যে জোরদার হয়ে ওঠে। তবে রেডিওকার্বন পরীক্ষায় দেখা যায় আসপেরো প্রভৃতি সমুদ্রোপকূলবর্তী কিছু কিছু অঞ্চল তুলনায় প্রাচীনতর।[১২] এর থেকে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদই মতপ্রকাশ করেন যে এই সভ্যতার সূচনা প্রথমে সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলে হয়ে থাকলেও পরে তা ধীরে ধীরে দেশাভ্যন্তরে সরে আসে। অর্থাৎ, পরের দিকে কৃষিব্যবস্থার কিছু প্রসার ঘটলেও অন্তত এই সভ্যতা গড়ে ওঠার সময়ে সমুদ্রজাত খাদ্যনির্ভরতাই ছিল প্রধান।[১৯] ফলে নতুন করে বিতর্ক চাগিয়ে ওঠে, ভিতরের বড় বড় কেন্দ্রগুলি উপকূলের কেন্দ্রগুলির উপর নির্ভরশীল ছিল, না উপকূলীয় ছোট ছোট গ্রামগুলিই আসলে ছিল অভ্যন্তরের বড় বড় কেন্দ্রগুলির নিছক বাইরের দিকের উপগ্রহমাত্র।[১৩]

তুলো

তবে একটা বিষয় সম্বন্ধে আজ ঐতিহাসিকরা অনেকটাই নিশ্চিত। শুরুতে যদি নাও হয়, পরে অন্তত উপকূলীয় অঞ্চলগুলির চেয়ে এই সভ্যতার ভরকেন্দ্র স্থলভাগের অভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলিতেই স্থানান্তরিত হয়। এর এক প্রধান কারণ ছিল তুলো (Gossypium barbadense; গসিপিয়াম বারবাডেন্স প্রজাতির)।[১১][১২] তুলো যদিও খাওয়া যায় না, কিন্তু এর থেকে তৈরি সুতো দিয়ে প্রস্তুত জাল ছাড়া সমুদ্রজাত খাদ্য সংগ্রহ ও মাছ ধরা অসম্ভব। তারউপর নানা ধরনের কাপড়, পোশাক ও থলি তৈরিতেও তুলো অপরিহার্য। এছাড়া একধরনের লম্বা ঘাস দিয়েও শক্ত থলি তৈরি হত, বিভিন্ন নির্মাণের ক্ষেত্রে পাথর বওয়ার কাজে যা ব্যবহৃত হত। কারাল অঞ্চলের খননকার্যে এইধরনের তৃণনির্মিত থলির নিদর্শন পাওয়া গেছে।[২০] অর্থাৎ, দেশাভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলির মূল ভিত্তি ছিল এই তুলো ও ঘাসের চাষ ও তার থেকে নানাধরনের প্রয়োজনীয় জাল, কাপড়, থলি, প্রভৃতির উৎপাদন বজায় রাখা। অন্যদিকে উপকূলীয় কেন্দ্রগুলির মূল উৎপাদন ছিল মাছ ও সমুদ্রজাত খাদ্য, যার উপর স্থলাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলিও নির্ভরশীল ছিল। বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করেই বর্তমানে উপকূল ও দেশাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলির এই পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্বই জোরদার হয়ে উঠেছে।

সমাজ ও রাজনীতি

যেহেতু এই সুপ্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কিত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ব্যতীত আর কোনও ঐতিহাসিক উপাদানই আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি, তাই কারাল সভ্যতার মানুষের সমাজ, সামাজিক সংগঠন, রাজনীতি, প্রশাসন, ধর্মাচরণ, অর্থনীতি, প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান স্বভাবতই সীমিত। প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলিকে যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করে এইসব ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা যতটুকু তথ্য আহরণ করতে এখনও পর্যন্ত সক্ষম হয়েছে তা নিয়ে নিচে আলোচনা করা হল।

এখন প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে মূলত তিন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে পরোক্ষে মানব পরিচালিত প্রশাসনের উদ্ভবের আন্দাজ করা হয়ে থাকে। এগুলি হল -

  1. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ
  2. ধর্মীয় আচার ও রীতিনীতি পালনের প্রমাণ
  3. প্রশাসনিক বাহুবলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির প্রমাণ

জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ কারাল সভ্যতায় এগুলির অন্তত দুটির যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন। সেইদিক দিয়ে এই সভ্যতাকে প্রাচীন পৃথিবীর সুপ্রাচীন দুই সভ্যতা (অন্যটি হল সুমের), যেখানে সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানায় স্বতন্ত্রভাবে প্রশাসনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে, তাদের অন্যতম বলে মেনে নিতে হয়। অবশ্য সমস্ত প্রত্নতত্ত্ববিদদের পক্ষে এই বিষয়ে এখনও ঐকমত্য্য গড়ে ওঠেনি।[১২]

প্রশাসন

চার্লস মান প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ মতপ্রকাশ করেছেন যে কারাল সভ্যতার প্রশাসন ছিল মূলত ধর্মভিত্তিক। সেখানে বিভিন্ন নির্মাণস্থল ও প্ল্যাটফর্মগুলিতে নিয়মিত ভোজসভার ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া গেছে, যেখানে গানবাজনা ও সম্ভবত সুরার প্রচলনও ছিল[পা ২]; এর থেকে আন্দাজ করা যায় সমাজে ইতোমধ্যেই এমনধরনের একটি অভিজাত নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছিল, যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দৈনন্দিকতার বাইরে গিয়েও কোনও উৎসব উপলক্ষে কোথাও জড়ো হতে পারত এবং সেই উৎসবে কিছুটা প্রাচূর্যর চর্চাও দেখা যেত। অর্থাৎ সমাজে উৎপাদনশীলতা ইতোমধ্যেই সেই প্রাচূর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।[১২] স্বভাবতই আন্দাজ করা যায়, এই প্রাচূর্যটুকু মূলত সমাজের সুবিধেভোগী ও ক্ষমতাবান অংশই ভোগ করতে সক্ষম ছিল। এর থেকে সমাজে একধরনের কর্তৃত্বর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এই কর্তৃত্বর আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বিভিন্ন বড় বড় নির্মাণগুলিকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে। এগুলির মধ্যে কতগুলি হল বিরাট, তৈরি হয়েছিল ধীরে ধীরে, দীর্ঘদিন ধরে; আবার কতগুলি, যেমন কারালে পাওয়া বিশাল প্ল্যাটফর্মগুলি, তৈরি হয়েছিল এক কি দুই দফায়।[১৪] কিন্তু এই উভয় ক্ষেত্রেই এই ধরনের নির্দিষ্ট ও বিপুল কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য দরকার প্রচূর শ্রমিকের এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক সংগঠনের। তাছাড়া অল্পসময়ের মধ্যে কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নির্দিষ্টরূপের বিপুল নির্মাণকার্য কখনওই সম্ভব নয়, আবার দীর্ঘকাল ধরে একটি নির্দিষ্ট নির্মাণকার্য পরিচালনাও একরকম অসম্ভব। অর্থাৎ এই সব বৃহৎ পিরামিড, সৌধের ভগ্নাবশেষ, স্তূপ ও প্ল্যাটফর্মগুলির অস্তিত্বই জানান দেয় কারাল সভ্যতায় একধরনের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের বিকাশ ঘটেছিল, যদিও সেখানে প্রশাসনিক কেন্দ্রিকতার কতটা বিকাশ ঘটেছিল তা বলা সম্ভব নয়। এছাড়াও উপাকাপাতিভিলচা খননস্থলদুটিতে কিছু গুদামজাতীয় নির্মাণের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে, যেগুলিতে সম্ভবত তুলো বা এইধরনের সে'সময়ের মূল্যবান সামগ্রী সঞ্চিত করে রাখা হত। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এও কারাল-সুপে সমাজে শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের উপস্থিতির এক অকাট্য প্রমাণ।[১২]

অর্থনীতি

হাস, ক্রিমার, প্রমুখ বিশেষজ্ঞের মতে কারাল সভ্যতার অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল তুলো ও অন্যান্য খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চাষ ও তা থেকে উৎপন্ন ফসলের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং এগুলি নিয়ে বাণিজ্যের ক্রমবিস্তার। স্বভাবতই এইভাবে বিকশিত ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল এই সভ্যতার দেশাভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলি। হাস বলেছেন, কারাল-সুপে সভ্যতার সমুদ্রতীরবর্তী বড় কেন্দ্র হিসেবে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে মাত্র দুটি প্রত্নস্থলকে - আসপেরো ও বান্দুরিয়া। এছাড়া আরও দুটি কেন্দ্রকেও হয়তো একই মর্যাদা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তুলো থেকে তৈরি মাছ ধরার জাল ও খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চিহ্ন পেরুভীয় উপকূল রেখা ধরে উত্তরে ও দক্ষিণে বিস্তৃত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া গেছে। এর থেকে বোঝাই যায় এগুলিকে ভিত্তি করে একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলত। হয়তো বা দেশাভ্যন্তরের বড় বড় কেন্দ্রগুলিই এই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র ছিল।[১১]

অন্যদিকে রুথ শেডি সলিসের লাগাতার গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে কারালকে কেন্দ্র করে কারাল ও আসপেরোতে উৎপাদিত বস্তু পণ্য হিসেবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রফতানি করা হত ও বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী আমদানিও করা হত। এগুলির মধ্যে আমাজন অঞ্চল থেকে আনা ধোঁয়াহীন ঝিমুনি তামাক, ইকুয়েডরের সমুদ্রোপকূল থেকে আনা স্পন্ডাইলাস জাতীয় ঝিনুকের খোল, আন্দিজের উচ্চভূমি থেকে আনা উন্নত ধরনের রঙ, প্রভৃতি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[২১] শেডির কাজ থেকে আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মহাদেশের আরও অভ্যন্তরে জঙ্গল এলাকার অধিবাসী, এমনকী উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথেও কারালের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।[২২] অবশ্য এই বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার মতো প্রমাণ এখনও হাতে আসেনি।

ধর্ম ও নেতৃত্ব

প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে যেটুকু আন্দাজ করা যায়, তা হল কারাল সভ্যতায় ধর্মর স্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভিত্তিও ছিল অনেকাংশেই ধর্মই। এই সভ্যতার নেতৃত্ব ছিল সম্ভবত পুরোহিতদের হাতেই। দেবতা ও অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে তাদের যোগাযোগের আপাত ক্ষমতাই ছিল তাদের প্রতিপত্তির মূল।[১১] তবে স্বভাবতই কারাল সভ্যতায় প্রচলিত ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও পর্যন্ত খুবই সীমিত। খ্রিস্টপূর্ব ২২৫০ - ২৫০০ অব্দ নাগাদ সময়ের একটি প্রাচীন লাউ'এর খোল শুধু পাওয়া গেছে[২৩], যাতে দুই হাতে দণ্ডধারী এক মূর্তি অঙ্কিত আছে; এই ধরনের দণ্ডধারী দেবমূর্তি কাছাকাছি অঞ্চলের পরবর্তী বিভিন্ন আন্দীয় সভ্যতাতেও দেখতে পাওয়া যায়; তার থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, কারাল সভ্যতাতেও এই দেবতা পূজিত হত। উইনিফ্রেড ক্রিমার দাবি করেন, এই মূর্তি যে সত্যিই ঐ সভ্যতায় পূজিত দেবমূর্তি, তার নানা লক্ষণ পরিস্ফূট।

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

আরো পড়ুন

  • Shady Solís, Ruth; Kleihege, Christopher (২০০৮)। Caral: la primera civilización de América [The first civilization in the Americas.]। Lima: Logicorp SA Proyecto Especial Arqueológico Caral-Supe / INC Universidad de San Martin de Porres। আইএসবিএন 978-9972-33-792-5 

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ