জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান
প্রাচীনকালে জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান অভিন্ন বলে বিবেচিত হত (লাতিন: astrologia, অ্যাস্ট্রোলজিয়া)। পাশ্চাত্য সপ্তদশ শতকীয় দর্শনে ("যুক্তির যুগ") বিজ্ঞানীদের দ্বারা জ্যোতিষশাস্ত্র প্রত্যাখ্যাত হলে দু’টি বিদ্যা ক্রমে পৃথক হয়ে যায়। মধ্যযুগের পরবর্তী পর্যায়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে মনে করা হত সেই ভিত্তি যার উপর দাঁড়িয়ে জ্যোতিষবিদ্যার কাজ চলতে পারে।[১]
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে দু’টি জ্যোতিষবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান জ্ঞানের সম্পূর্ণ পৃথক দুই শাখা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। জ্যোতির্বিজ্ঞান হল বিজ্ঞানের একটি শাখা এবং এই শাখার উপজীব্য বিষয় হল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে অবস্থিত বস্তু ও ঘটনাবলির পর্যালোচনা।[২][৩][৪] এটি একটি বহুপঠিত বিষয়। অন্যদিকে জ্যোতিষবিদ্যা, যার উপজীব্য বিষয় মহাজাগতিক বস্তুগুলির আপাত অবস্থানের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ ঘটনাবলির অগ্রকথন, তা ভবিষ্যৎ কথন বিদ্যার একটি শাখা ও একটি ছদ্মবিজ্ঞান। এই বিদ্যার কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।[৫][৬][৭]
সাধারণ বিবরণ
প্রাক্-আধুনিক যুগে অধিকাংশ সংস্কৃতিতে জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য করা হত না, বরং জ্ঞানের এই দুই শাখাকে এক গণ্য করা হত। জ্যোতিষের জন্য খ্যাত প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ায় মহাজাগতিক ঘটনার পূর্বকথনকারী হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং সেগুলির ব্যাখ্যাদাতা জ্যোতিষীর পৃথক ভূমিকা ছিল না; একই ব্যক্তি দুই কাজ করতেন। এই সংযোগের অর্থ এই নয় যে সব সময়ই জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানকে এক ও অভিন্ন জ্ঞান করা হত। প্রাচীন গ্রিসে আনাক্সিমান্দার, জেনোফেনস, আনাক্সিমেনেস ও হেরাক্লিদেস প্রমুখ প্রাক্-সক্রেটিক চিন্তাবিদগণ গ্রহ ও নক্ষত্রের প্রকৃতি ও সারবস্তুর বিষয়গুলি অনুমান করেছিলেন। ইউদোজাস (প্লেটোর সমসাময়িক) প্রমুখ জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্রহীয় গতি ও চক্রগুলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং একটি ভূকেন্দ্রিক বৈশ্বিক মডেল উপস্থাপনা করেছিলেন। এই মডেলটি গ্রহণ করেছিলেন অ্যারিস্টটল। এই মডেলটি অন্তত টলেমির সময়কাল অবধি স্থায়ী হয়েছিল। মঙ্গল গ্রহের পশ্চাদমুখী আবর্তনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য টলেমি এর সঙ্গে অধিচক্র যোগ করেন। (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দ নাগাদ সামোসের অ্যারিস্টারকাস একটি প্রত্ন-সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব উপস্থাপনা করেন। কিন্তু অ্যারিস্টটলের ভূকেন্দ্রিক মডেলটির জনপ্রিয়তা বজায় থাকায় প্রায় কোপারনিকাসের আগে পর্যন্ত দুই সহস্রাব্দব্যাপী অ্যারিস্টারকাসের তত্ত্বটির পুনর্মূল্যায়ন করা হয়নি।) প্লেটোনিক ধারায় দর্শনের অঙ্গ হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা করা হল। কারণ, তাঁদের মতে মহাজাগতিক বস্তুগুলির গতি ছিল এক সুশৃঙ্খল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ মহাবিশ্বের পরিচায়ক। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রিসে ব্যাবিলনীয় জ্যোতিষশাস্ত্র উপস্থিত হয়। আকাদেমিক সংশয়বাদী কার্নিদেস ও মধ্য স্টোইক প্যানেটিয়াস প্রমুখ হেলেনীয় দার্শনিকগণ জ্যোতিষশাস্ত্রের সমালোচনা করেছিলেন। যদিও মহাবর্ষ (যখন সকল গ্রহ একটি চক্র পূর্ণ করে এবং তাদের আপেক্ষিক অবস্থানে ফিরে আসে) এবং চিরন্তন পুনরাবর্তনের ধারণাগুলি ছিল স্টোইক মতবাদ, যা ভবিষ্যৎ কথন ও নিয়তিবাদকে সম্ভব করে তুলেছিল।
হেলেনীয় জগতে 'অ্যাস্ট্রোলজিয়া' ও 'অ্যাস্ট্রোনমিয়া' এই গ্রিক শব্দ দু’টি প্রায়শই পরস্পর বিনিময়ার্হে ব্যবহৃত হত। কিন্তু ধারণাগত দিক থেকে দু’টি একই অর্থ বহন করত না। প্লেটো 'অ্যাস্ট্রোনমিয়া' বিষয়ে শিক্ষা দিতেন এবং বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলতেন যে, গ্রহীয় ঘটনাগুলিকে একটি ভূকেন্দ্রিক মডেলের মাধ্যমে বর্ণনা করা উচিত। প্রথম সমাধানটি প্রস্তাব করেন ইউডোজাস। অ্যারিস্টটল একটি ভৌত পদ্ধতি অবলম্বনের পক্ষপাতী ছিলেন এবং তিনিই 'অ্যাস্ট্রোলজিয়া' শব্দটি গ্রহণ করেন। উৎকেন্দ্রিক ও অধিচক্রকে কার্যকর কল্পনা মনে করা শুরু হয়। জনসাধারণের কাছে পার্থক্যের নীতিটি সহজবোধ্য হয়নি এবং সেই কারণে দু’টি শব্দই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ব্যাবিলনীয় কোষ্ঠীবিচার পদ্ধতির ক্ষেত্রে যে শব্দ দু’টি নির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত হত, সেগুলি হল 'আপোতেলেসমা' ও 'কাতারচে'। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে এটি অ্যারিস্টটলীয় পরিভাষায় 'অ্যাস্ট্রোলজিয়া' শব্দটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
সেভিলের ইসিডোর তাঁর সংকলন গ্রন্থ এটিমোলোগিয়া-এ স্পষ্টভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র শব্দ দু’টির পার্থক্য নির্দেশ করেছেন (এটিমোলজিয়া, তিন, ২৮)। পরবর্তীকালের আরব লেখকদের গ্রন্থেও একই পার্থক্য লক্ষিত হয়।[৮] ইসিডোর দু’টি বিষয়কেই জ্যোতিষ-সংক্রান্ত শাখায় বিজড়িত হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং বিষয় দু’টিকে চিহ্নত করেন অ্যাস্ট্রোলজিয়া ন্যাচারালিস ও অ্যাস্ট্রোলজিয়া সুপারস্টিটিওসা নামে।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে জ্যোতিষশাস্ত্র বহুল চর্চিত হয়েছিল। এই সময় হেলেনীয় ও আরব জ্যোতিষীদের রচনা লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। পরবর্তী মধ্যযুগে এই বিদ্যার অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান নির্ভর করত ইউরোপের রাজ-দরবারগুলিতে এর অভ্যর্থনার উপর। ফ্র্যান্সিস বেকনের সময়কালেই প্রথম গবেষণামূলক অধিবিদ্যা হিসেবে জ্যোতিষশাস্ত্র প্রত্যাখ্যাত হয় এবং তা শুধুমাত্র প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণ হিসেবেই গৃহীত হয়। এরপর সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যে জ্যোতিষবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মধ্যে বিভাজন ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় সেখানকার অভিজাত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি জ্যোতিষশাস্ত্রকে অতিপ্রাকৃত বিজ্ঞান বা কুসংস্কার হিসেবে দেখতে শুরু করেন। দুই বিদ্যার সুদীর্ঘ একক ইতিহাসের নিরিখে আজও কখনও কখনও দু’টির পার্থক্য সম্পর্কে ভ্রম সৃষ্টি হয়ে থাকে। অনেক সমসাময়িক জ্যোতিষী অবশ্য জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে দাবি করেন না। বরং এটিকে তাঁরা আই-চিং শিল্পের মতো ভবিষ্যৎ কথনের একটি রূপ অথবা একটি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস মনে করেন। এই ধারণাটি প্রভাবিত হয়েছে নব্য-প্লেটোনবাদ, নব্য-প্যাগানবাদ, থিওসফি ও হিন্দুধর্মের মতো মতবাদগুলির দ্বারা।
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসমূহ
আরও দেখুন
- জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস
- জ্যোতিষশাস্ত্রের ইতিহাস
- কোষ্ঠী
- পঞ্চাঙ্গম্
- দ্য সোফিয়া সেন্টার
- ট্রিটিজ অন দি অ্যাস্ট্রোলেব
তথ্যসূত্র
আরও পড়ুন
- Eade, J. C. (১৯৮৪)। The Forgotten Sky: A Guide to Astrology in English Literature. । Oxford: Clarendon Press; New York: Oxford University Press।
- Losev, A. (২০১২)। "'Astronomy' or 'astrology': a brief history of an apparent confusion"। Journal of Astronomical History and Heritage। 15 (1): 42–46। arXiv:1006.5209 । বিবকোড:2012JAHH...15...42L।
- North, John David (১৯৮৮)। Chaucer's Universe। Oxford: Clarendon Press।
- "What's the difference between astronomy and astrology?"। American Astronomical Society। ১ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ আগস্ট ২০১৪।