পায়রা আলোকচিত্র

পায়রা আলোকচিত্র একপ্রকার আকাশ হতে চিত্রগ্রহণ পদ্ধতি যা জুলিয়াস নুব্রোনার নামক এক জার্মান ঔষধবিক্রেতা ১৯০৭ সালে আবিষ্কার করেন। তিনি পায়রার সাহায্যে ঔষধ বিপণন করতেন। একটি হোমার পায়রার সাথে একটি এলুমিনিয়াম ফলক সংযুক্ত করা হয় এবং এর সাথে একটি স্বল্প ওজনের সময়-নির্দিষ্ট ক্যামেরা যুক্ত করা যেতো। নুব্রোনারের জার্মান পেটেন্ট আবেদন প্রাথমিকভাবে নামঞ্জুর করা হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার পায়রা দ্বারা সঠিক ছবি প্রস্তুত করতে সক্ষম হলে তার আবেদন মঞ্জুর করা হয়। তিনি তার পদ্ধতি ১৯০৯ সালের ড্রেসডেন আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করেন, এবং ফ্র্যাংফুর্ট আন্তর্জাতিক উড্ডয়ন প্রদর্শনীত ও ১৯১০ ও ১৯১১ সালের প্যারিস বিমান মহড়ায় তার ধারনকৃত কিছু ছবি পোস্টকার্ড হিসেবে বিক্রি করেন।

জার্মান ক্যামেরা যুক্ত পায়রা, সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তুলা ছবি

প্রাথমিকভাবে, পায়রা আলোকচিত্রের সামরিক উপযোগীতা আকর্ষণ সৃষ্টি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষা ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়। এই সময়ে মাঠপর্যায়ে অস্থায়ী পায়রার খোপের প্রযুক্তি অতিশয় ফলপ্রসূ প্রামানিত হয়। তবে যুদ্ধকালীন সময়ে আকাশযান প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন পায়রা আলোকচিত্রের প্রতি আগ্রহ কমায় এবং নুব্রোনার তার পরীক্ষানিরীক্ষা পরিত্যাগ করেন। পায়রা আলোকচিত্র পুনরায় ১৯৩০ সালে এক সুইস ঘড়িপ্রস্তুতকারকের মাধ্যমে সাময়িকভাবে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে, এবং একাধিক প্রতিবেদন অনুসারে জার্মান এবং ফ্রেঞ্চ সামরিক বাহিনিও এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়। যদিও ২য় বিশ্বযুদ্ধে পায়রার মোতায়েন ব্যাপক হারে লক্ষ্য করা যায়, এটা স্পষ্ট নয় এসব পায়রার ঠিক কতটুকু অংশ আকাশ হতে চিত্রগ্রহণে নিয়োজিত ছিলো। মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) পরবর্তীতে পায়রার সাহায্যে গোয়েন্দা নজরদারীর জন্য ব্যাটারি-চালিত ক্যামেরা প্রস্তুত করে; যার ব্যাবহারের বিস্তারিত তথ্য এখনো গোপনীয়।

পায়রা আলোকচিত্র পদ্ধতির গুরুতর সমস্যাগুলো হলো সময় নিয়ন্ত্রণযোগ্য যথেস্ট ছোট এবং হালকা ওজনের ক্যামেরা তৈরি করা, এবং পায়রাগুলোকে প্রয়োজনীয় ওজন বহনের প্রশিক্ষন দেয়া। একই সাথে পায়রাদের অবস্থানের উপর সীমিত নিয়ন্ত্রণ, দিকনির্দেশনা এবং চিত্রগ্রহণের সময় চলার গতি ইত্যাদি বাধা সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) লাইভ চিত্রগ্রহণের জন্য বাজ এবং চিলের সাথে খুদে ক্যামেরা জুড়ে দেয়। বর্তমানে কিছু গবেষক, আগ্রহী ব্যক্তি এবং শিল্পীরা একইভাবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সাথে ক্রিটারক্যাম ব্যবহার করে।

আবির্ভাব

চার বছর বয়সী হোমার পায়রা যেটি ভুমি হতে একটি বেলুনে ১৫ বার আসা যাওয়া করে[১]

প্রথম আকাশ হতে আলোকচিত্রগুলো ফ্রেঞ্চ চিত্রশিল্পী নাদার ১৮৫৮ সালে গ্রহণ করেন, এবং ১৮৬০ সালে আমেরিকান চিত্রগ্রাহক জেমস ওয়ালেস ব্ল্যাক বর্তমানে সংরক্ষিত সবচেয়ে পুরাতন আকাশচিত্রগুলি একটি বেলুন হতে ধারণ করেন।[২] চিত্রগ্রহণ পদ্ধতির উন্নয়নের সাথে সাথে ১৯শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ কিছু বৈপ্লবিক চিত্রশিল্পী স্বয়ংক্রিয় আকাশযানে ক্যামেরা স্থাপন শুরু করেন। ১৮৮০ সালে ফ্রেঞ্চ চিত্রগ্রাহক আর্থার বাটুট ঘুড়ির সাহায্যে চিত্রগ্রহণের গবেষণা চালান। অনেকেই তার পদ্ধতি অনুসরন করেন, এবং উইলিয়াম এবনার ১৮৯৬ সালে এই পদ্ধতিতে বোস্টন শহরের কিছু উচ্চ মানসম্পন্ন ছবি তুলেন যা অনেক সুনাম কুড়ায়। আমেদি ডেনিস ১৮৮৮ সালে একটি ক্যামেরার সাথে রকেট এবং প্যারাসুট যুক্ত করেন, এবং আলফ্রেড নোবেলও ১৮৯৭ সালে রকেট চিত্রগ্রহণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন।[৩][৪]

হোমার পায়রা ১৯শ এবং ২০শ শতাব্দীর শুরুতে বেসামরিক পায়রা ডাক ব্যবস্থা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে বহুল ভাবে ব্যবহৃত হতো।[৫] ১৮৭০ সালে সংঘটিত ফ্র্যাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে বিখ্যাত "প্যারিস পায়রা ডাক" দখলকৃত রাজধানীতে প্রতি পায়রা উড্ডয়নে ৫০০০০ মাইক্রোফিল্ম টেলিগ্রাম বহন করতো। এভাবে সাকুল্যে ১৫০০০০ পৃথক ব্যক্তিগত টেলিগ্রাম এবং রাস্ট্রীয় তথ্য পরিবহন হয়। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে জার নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ার কারিগরি সমিতি কর্তৃক সেন্ট পিটার্সবার্গে সংঘটিত একটি গবেষণায় রুশ বেলুন কোরের প্রধান বেলুন হতে কিছু আলোকচিত্র ধারণ করেন এবং তা ডেভেলপ করে ছবির নেগেটিভগুলো পায়রার সাহায্যে ভুমিতে প্রেরন করেন।[৬]

জুলিয়াস নুব্রেনার

জুলিয়াস নুব্রেনার (১৯১৪)

১৯০৩ সালে জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুর্টের নিকটবর্তী ক্রোনবার্গ শহরের জুলিয়াস নুব্রেনার নামক এক ঔষধবিক্রেতা তার পিতার অর্ধশতাব্দী পুর্বে শুরু করা কার্যক্রমে অংশ নেন এবং নিকটবর্তী ফালকেনস্টেইন শহরের এক স্যানেটোরিয়াম হতে পায়রা ডাকের মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন পরিবহন করেন।[৬] পায়রা ডাকব্যবস্থাটি ৩ বছর পরে স্যানেটোরিয়াম বন্ধ হয়ে গেলে একই সাথে বন্ধ হয়ে যায়। তিনি পায়রার সাহায্যে ৭৫ গ্রাম (২.৬ আউন্স) পর্যন্ত ঔষধ পরিবহন করতেন, এবং দ্রুত পরিবহনের সুবিধার জন্য ফ্র্যাঙ্কফুর্টে অবস্থিত তার পাইকারী বিক্রেতার কাছেও তিনি কিছু পায়রা রাখতেন। একপর্যায়ে যখন তার একটি পায়রা কুয়াশায় দিক হারায় এবং রহস্যজনকভাবে ৪ সপ্তাহ পর সুস্থ অবস্থায় ভরপেট খেয়ে ফিরে আসে, তখন খেলাচ্ছলে পায়রার পথ চিহ্নিত করার জন্য ক্যামেরা ব্যবহারের কথা নুব্রেনারের মাথায় আসে। এই ভাবনা তাকে তার পরিবহন পায়রা এবং অপেশাদার চিত্রগ্রহণ দুইটি শখ একত্রিত করে "দ্বৈত খেলা" গঠনের অনুপ্রেরণা দেয়। (নুব্রেনার পরে জানতে পারেন যে তার নিখোজ পায়রাটি ওয়েজবাডেন শহরের এক রেস্তোরার বাবুর্চির হেফাযতে ছিলো)[৭]

একটি টিকা হাতঘড়ি ক্যামেরা রেলগাড়ি এবং স্লেডে পরীক্ষা করার পর নুব্রেনার পায়রার বক্ষে স্থাপনযোগ্য ছোট আকৃতির ক্যামেরা উদ্ভাবনে নিয়োজিত হন।[৭] ৩০ হতে ৭৫ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের কাঠের তৈরি ক্যামেরা প্রতিকৃতি দ্বারা পায়রাদের ভারবহনের প্রশিক্ষন দেয়া হয়।[৮] আকশ হতে চিত্রগ্রহণের জন্য নুব্রেনার একটি পায়রাকে ১০০ কিলোমিটার (৬০ মাইল) পরিবহন করতেন, সেখানে একে ক্যামেরা যুক্ত করে ছেড়ে দেয়া হতো।[৯] পায়রাটি ভারী ওজন দ্রুত ত্যাগ করতে ৫০ হতে ১০০ মিটার উচ্চতায় (১৬০ হতে ৩৩০ ফিট) সোজা পথে বাড়ি ফিরে যেত।[১০] বিশেষায়িত ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্যামেরার চিত্রগ্রহণের সময় নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। ভারবাহী পায়রার স্থানসংকুলানের জন্য পায়রার খোপ বড় করে বানানো হতো এবং বড় প্রবেশদ্বার করা হতো।[৮]

উপরে বামেঃ স্কোলোস্তেল ক্রোনবার্গের আকাশ হতে গৃহীত আলোকচিত্র। বামের নিচে ও মাঝেঃ ফ্রাংকফুর্ট। বামেঃ ক্যামেরা যুক্ত পায়রা।
উপরেঃ পেটেন্টকৃত দ্বৈত লেন্সযুক্ত ক্যামেরার গঠন। নিচেঃ যান্ত্রিক ব্যবস্থা। ডানের প্রকোষ্ঠে বায়ূপুর্ন করে ক্যামেরা সচলো হতো। বায়ূ ধীরে ধীরে নিঃসরনের ফলে পিস্টন পিছনে সরে এক্সপোজার ঘটাতো
বাধনযুক্ত পেটেন্টকৃত ক্যামেরা

নুব্রেনার প্রকাশ করেন যে তার ক্যামেরার এক ডজন পৃথক মডেল ছিলো। ১৯০৭ সালে যথার্থ সাফল্যের ফলে তিনি পেটেন্ট আবেদন করেন। প্রাথমিকভাবে জার্মান পেটেন্ট অফিস তার উত্থাপিত "আকাশ হতে ভুপ্রকৃতির চিত্রগ্রহন প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি" অবাস্তব প্রতিয়মান হওয়ার অযুহাতে নামঞ্জুর হয়। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে নুব্রেনার সত্যায়িত ছবি উপস্থাপন করলে তার পেটেন্ট আবেদন মঞ্জুর হয়।[১১][১২] (পায়রার ভারবহন ক্ষমতা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকার কারণে প্রাথমিকভাবে আবেদন নামঞ্জুর হয়েছিলো)[৯]। উক্ত প্রযুক্তি ১৯০৯ সালের ড্রেসডেন আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী[১৩] এবং ১৯০৯ সালের ফ্র্যাংফুর্ট আন্তর্জাতিক উড্ডয়ন প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। ড্রেসডেনের দর্শকরা পায়রাদের আগমন পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন এবং পায়রাদের তোলা ছবি পোস্টকার্ড হিসেবে ক্রয় করতে পারতেন।[২][১৪] নুব্রেনারের আলোকচিত্র ড্রেসডেন এবং ১৯১০ ও ১৯১১ এর প্যারিস বিমান মহরায় পুরস্কার জিতে।[১৫][১৬]

১৯০৯ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় নুব্রেনার পাচটি ক্যামেরা মডেলের বর্ণনা দেন।

  • পেটেন্টে বর্নিত "দ্বৈত-ক্যামেরা" তে বিপরীতমুখী ৪০ মিলিমিটার ফোকাল দৈর্ঘ্যযুক্ত দুইটি লেন্স ছিলো। এদের পরিচালনা করতো একটি একক ফোকাল-প্লেন শাটার। ক্যামেরাটি দুটি সমসাময়িক ছবি তুলবে যার এক্সপোজার টাইম নির্দিষ্ট।
  • স্টেরিওস্কোপিক ক্যামেরাও একই প্রকৃতির তবে এতে ব্যবহৃত দুটি লেন্সই একই দিকে মুখ করে থাকে।
  • একটি মডেল ফল্ম পরিবহন এবং একই সময়ে একাধিক এক্সপোজার নিতে পারতো।
  • একটী মডেলে লেন্স একটি হাপরের সাথে যুক্ত ছিলো, যার ফলে একটি ৬ সেমি x ৯ সেমি এক্সপোজার ৮৫ মিলিমিটার ফোকাল দৈর্ঘ্যে নেয়া যেত।
  • প্যানারমিক মোডে লেন্সের ১৮০° ঘুর্নন দ্বারা ফোকালে-প্লেন শাটার প্রতিস্থাপিত হয়।[৮] এই মডেলের ভিত্তিতেই ডপেল-স্পোর্ট প্যানারমিক ক্যামেরা বানানো হয় যা ১৯১০ সালে নুব্রেনার বাজারজাত করার চেস্টা করেন। তবে এটি কখনোই ব্যাপক হারে উৎপাদিত হয়নি।[১৭]

১৯২০ সালে প্রকাশিত একটি পত্রে নুব্রেনার তার সর্বশেষ মডেলের ওজন ৪০ গ্রাম (১.৪ আউন্স) এবং ১২ টি এক্সপোজার নিতে সক্ষম বলে উল্লেখ করে।[১১] ২০০৭ সালে একজন গবেষক উল্লেখ করেন যে নুব্রেনারের ক্যামেরার লেন্স, শাটার এখন ফটোগ্রাফিক মিডিয়ায় তথ্য পাওয়া যায়, তবে তিনি ক্যামেরার ফিল্ম এডিওএক্স নামক প্রতিষ্ঠান হতে সংগ্রহ করতেন। এই ক্যামেরার জন্য তিনি ফিল্ম গতি ISO 25/15° – 40/17° এবং শাটার গতি 1/60 s – 1/100 s বলে ধারণা করেন। এই ফিল্মকে কেটে ৩০ মিমি x ৬০ মিমি আকারে এনে অবতল আকারে বাকানো হতো।[১৫]

নুব্রেনার ১৯২০ সালে অনুধাবন করেন যে তার দশ বছরের পরিশ্রম এবং অর্থলগ্নি শুধুমাত্র তার নাম কিছু বিশ্বকোষে অন্তর্ভুক্ত করেছে।[১১] নুব্রেনারের প্যানারমিক ক্যামেরা বার্লিনের "জার্মান প্রযুক্তি যাদুঘর" এবং মিউনিখের "ডয়েচ যাদুঘর" এ প্রদর্শিত রয়েছে।[১৮][১৯]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

১৯০৯ সালে প্রদর্শিত নুব্রেনারের ভ্রাম্যমাণ পায়রার খোপ ও ডার্করুম

নুব্রেনারে উদ্ভাবনের পেছনে এর সামরিক ব্যবহারের সম্ভাবনা কিছুটা হইলেও উৎসাহ যুগিয়েছে। সেসময়ে আকাশ হতে চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের তথ্য জোগাড় সম্ভব ছিলো তবে প্রক্রিয়াটি অতি জটিল ছিলো। এতে বেলুন, ঘুড়ি ও রকেট ব্যবহৃত হতো।[১১] রাইট ভাতৃদ্বয়ের ১৯০৩ সালের প্রথম উড্ডয়ন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালেই পর্যবেক্ষক বিমানের আগমন ঘটে। তবে পায়রা আলোকচিত্র পদ্ধতি জটিলতা সত্বেও বিমান অপেক্ষা স্বল্প উচ্চতা হতে চিত্রগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে।[১১]

প্রুশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আগ্রহি ছিলো, এবং কিছু প্রাথমিক সন্দেহ পরবর্তীতে সফল মহড়ার মাধ্যমে দুর হয়। পায়রাগুলো বোমা বিস্ফোরনে বিচলিত হতো না, কিন্তু যুদ্ধের প্রয়োজনে পায়রাদের অস্থায়ী খোপের স্থান পরিবর্তন করতে হতো। পায়রাদের নতুন পরিবেশে খাপ খায়িয়ে নিতে সময় লাগতো।[১১] পরিবহন পায়রাদের নতুন স্থানে অভ্যস্ত হওয়ার ক্ষমতার অভাব দূর করার জন্য ইতালীয় সেনাবাহিনি কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করে।[২০] ফ্রেঞ্চ সামরিক বাহিনির ক্যাপ্টেন রেইনদ ভ্রাম্যমাণ খোপ তৈরি করে এ সমস্যা কিছুটা লাঘব করেন।[২১] নুব্রেনার এই পদ্ধতি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন কিনা তা জানা যায় না, তবে ধারণা করা হয় ভ্রাম্যমাণ খোপ নিয়ে তিনি অবশ্যই কিছু ধারণা রাখতেন কারণ তিনি পুর্বে সচল খোপ বানানোর চেস্ট করেছিলেন। ১৯০৯ সালের প্রদর্শনীতে তিনি একপ্রকার রংচঙ্গে চাকাযুক্ত খোপ প্রদর্শন করেন। এই সচল খোপের সাথে ডার্করুমও যুক্ত ছিল। মাসের পর মাস কঠোর পরিশ্রম করে তিনি খোপের স্থান পরিবর্তনের পরেও পায়রাদের খোপে ফিরে আসার প্রশিক্ষন দেন।[১১]

১৯১২ সালে[১৪] নুব্রেনার তার ১৯০৯ এ নির্দিষ্ট করা টেগেল পানিপথের চিত্রগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করেন। একাজে তিনি ভ্রাম্যমাণ খোপ ব্যবহার করেন। প্রায় ১০ বছরের যাচাই বাছাই ১৯১৪ সালে স্ট্রাসবুর্গে সরাসরি মহড়ার মাধ্যমে সফল হওয়ার কথা ছিলো। এরপর উদ্ভাবনটি জার্মান সরকার গ্রহণ করতো। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর ফলে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। নুব্রেনার তার প্রযুক্তি সামরিক বাহিনির কাছে হস্তান্তর করেন, যারা এটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আশাজনক ফলাফল পান। তবে পায়রা আলোকচিত্র পদ্ধতি বৃহৎ পরিসরে ব্যবহৃত হয়নি।[১১][২২]

বরং, স্বল্প পরিসরে যুদ্ধের ফলে, পায়রাগুলো তাদের স্বভাবসিদ্ধ বার্তা পরিবহন কাজে বেশি ব্যবহার হতে শুরু হয়। নুব্রেনারের ভ্রাম্যমাণ খোপ "ভার্দুনের যুদ্ধে" ব্যবহৃত হয়, এবং এর সাফল্যের জন্য পরবর্তীতে "সোমের যুদ্ধে" এর ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পায়।[১১] যুদ্ধের পরে, নুব্রেনারের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায় যে পায়রা আলোকচিত্র পদ্ধতির কোন ব্যবহারিক প্রয়োগ নেই এবং আরো বিস্তৃত পরীক্ষানিরীক্ষার কোন প্রয়োজন নেই।[১৪]

ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত "আন্তর্জাতিক গুপ্তচর যাদুঘরে" ১ম বিশ্বযুদ্ধে পায়রা পরিবহন এবং পায়রা আলোকচিত্রের জন্য একটি বিশেষায়িত কক্ষ আছে।[২৩]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

জার্মান খেলনা সৈন্য ও ক্যামেরাযুক্ত পায়রা
সুইস পেটেন্টের কারিগরি তথ্য

যদিও জার্মান যুদ্ধ মন্ত্রণালয় এই প্রযুক্তির বিমুখী ছিলো, কিন্তু ১৯৩২ সালে এ তথ্য জনসম্মুখ্যে আসে যে জার্মান আর্মি চিত্রগ্রহণের জন্য পায়রাদের প্রশিক্ষন দিচ্ছিলো, এবং জার্মানদের পায়রার ক্যামেরা এক উড্ডয়নে ২০০ এক্সপোজার নিতে পারতো।[২৪] এই বছরে ফ্রেঞ্চরা ঘোষণা দেয় যে তারা পায়রাদের জন্য ফিল্ম ক্যামেরা তৈরি করেছে এবং প্রশীক্ষিত কুকুরের সাহায্যে শত্রু সীমানার ভেতরে পায়রাদের অবমুক্ত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে।[২৫]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধএ পায়রা এবং ভ্রাম্যমাণ খোপের বহুল ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু এটা পরিষ্কার নয় এই পায়রাদের মধ্যে কতটুকু অংশ আকাশ হতে চিত্রগ্রহণে ব্যবহৃত হয়েছিলো। ১৯৪২ সালের একটি রিপোর্ট হতে জানা যায় যে সোভিয়েত সেনাবাহিনি কিছু পরিত্যাক্ত জার্মান ট্রাকের সন্ধান পায় যাতে পায়রাদের ব্যবহারের জন্য ক্যামেরা (যেগুলো ৫ মিনিট অন্তর এক্সপোজার নিতো) এবং বেশকিছু কুকুর যেগুলা ঝুড়িতে পায়রা বহনে প্রশিক্ষিত পাওয়া গেছিলো।[২৬] অপরদিকে মিত্রশক্তির দিকে তাকালে দেখা যায় যে, আমেরিকান সিগনাল কোরও ১৯৪৩ সালের দিকে এই পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা বিবেচনা করে।[২৭]

এটা নিশ্চিত যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পক্ষে পায়রা আলোকচিত্রের প্রচলন জার্মানীর ছোট ছোট খেলনা নির্মাতাদের মাধ্যমে হয়। ১৯৩৫ সাল হতেই জার্মান খেলনানির্মাতা "ইলাস্টোলিন" একটি সিগনাল কোরের সৈন্য ও একটি পায়রাবাহক কুকুরের পুতুল বিপণন শুরু করে। এতে দেখা যেত সৈন্যটি একটি বৃহদাকার ক্যামেরা যুক্ত পায়রাকে মুক্ত করে দিচ্ছে।[২৮]

সুইস Musée suisse de l'appareil photographique যাদুঘরের গবেষণা হতে একই সময়ে সুইস ঘড়িনির্মাতা ক্রিস্টিয়ান এড্রিয়ান মাইকেল কর্তৃক (১৯১২-১৯৮০)[২৯] পায়রা আলোকচিত্রের উন্নয়নের কথা জানা যায়। তিনি ১৯৩১ এ সুইস সেনাবাহিনির পরিবহন পায়রা বিভাগে যোগ দেন এবং ১৯৩৩ এ তিনি নুব্রেনারের প্যানারমিক ক্যামেরাকে ১৬ মিলিমিটার ফিল্মে অভিযোজনের জন্য কাজ করেন। তিনি এর প্রযুক্তিতে উন্নয়ন আনেন এবং প্রথম এক্সপোজারের আগে সময়ক্ষেপনের পদ্ধতি বের করেন। ১৯৩৭ সালে পেটেন্ট করা মাইকেলের ক্যামেরাটির[৩০] ওজন ছিলো মাত্র ৭০ গ্রাম এবং এটি হয়তো প্রথম ক্যামেরা ছিলো যার সময় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যান্ত্রিক ছিলো।[৩১]

মাইকেলের সুইস সেনাবাহিনির কাছে তার ক্যামেরা বিপণনের পরিকল্পনা সঠিক প্রস্তুতকারকের অভাবে ভেস্তে যায়। তার উদ্ভাবিত ক্যামেরা মাত্র ১০০ টির মত বানানো হয়।[১৭] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মাইকেল খোলক ও দড়ির বন্ধনীর সাহায্যে ফিল্ম গুচ্ছ পরিবহনের পেটেন্ট করেন।[৩২] ২০০২ হতে ২০০৭ সালের মাঝে তার ক্যামেরাগুলো লন্ডনের "ক্রিস্টি" এর মাধ্যমে নিলামে বিক্রয় হয়।[২৯]

Musée suisse de l'appareil photographique যাদুঘরে মাইকেলের ক্যামেরা হতে চিত্রিত ১০০০ এর কাছাকাছি আলোকচিত্র সংরক্ষিত আছে।[৩৩] এর বেশিরভাগই ১৬ মিলিমিটার অর্থোপ্যানক্রোম্যাটিক আগফা ফিল্মে গৃহীত যার গতি ISO 8/10°। যার ফলে ১০ মিলিমিটার x ৩৪ মিলিমিটার আলোকচিত্র গৃহীত হয়। এই মানের ফলে একে ১০ গুন সম্প্রসারণ করা যেতো।[৩১] ২০০৭ সালের "পায়রা আলোকচিত্র" প্রদর্শনীর পুস্তিকায় এই ছবিগুলোকে পরীক্ষামুলক আলোকচিত্র নামে অভিহিত করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে জানালা হতে, উচু স্থান হতে বা উড়োজাহাজ হতে হতে চিত্রিত আলোকচিত্র।[৩৩][৩৪]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়

মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) ব্যাটারি-চালিত পায়রার ক্যামেরা উদ্ভাবন করে যা এখন সিআইএর যাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। সিআইএর ওয়েবসাইট অনুসারে এই ক্যামেরার কার্যপ্রকৃতি এখনো গোপনীয়।[৩৫] বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, এই ক্যামেরাগুলো ৭০ এর দশকে ব্যবহৃত হতো,[৩৬] এবং এই পায়রাগুলো বিমান হতে মুক্ত করা হতো। এই পদ্ধতিটি ব্যর্থ হয়।[৩৭] ১৯৭৮ সালে সুইস পত্রিকা লে'ইলাস্ত্রেত বাসেলের একটি রাস্তার আলোকচিত্র প্রকাশ করে, যা একটি হাইড্রোকিল প্রযুক্তিযুক্ত ক্যামেরা যুক্ত পায়রা দ্বারা গৃহীত হয়েছিলো। ২০০২–০৩ এ শিল্পী এবং পায়রা পালক আমোস লেটেইয়ার আধুনিক চিত্রগ্রহণ পদ্ধতিতে পায়রার সাহায্যে কিছু আলোকচিত্র গ্রহণ করেন। তিনি এগুলো পরবর্তীতে পোর্টল্যান্ড, ওরেগনে একটি লেকচারে ব্যবহার করেন।[৩৮] ২০০৮ সালের ঘুমকুমারীর একটি ছায়াছবিতে জার্মান পরিচালক এরেন্ড এগথা পটভূমি হিসেবে পায়রা আলোকচিত্র ব্যবহার করেন, যেখানে রাজপুত্র পায়রা আলোকচিত্র উদ্ভাবন করেন এবং এর সাহায্যে ঘুমকুমারীর ছবি তুলেন।[৩৯]

৮০র দশকে রলফ ওবেরল্যান্ডার অল্পসংখ্যক উচ্চমানসম্পন্ন ডপেল-স্পোর্ট ক্যামেরার অনুকরন প্রস্তুত করেন। এর মধ্যে একটি ১৯৯৯ সালে ভেভেই এর সুইস ক্যামেরা যাদুঘর সংগ্রহ করে।[১৭]

আধুনিক প্রযুক্তি এই তত্বকে ভিডিও ক্যামেরার পথে অগ্রসর করে। ২০০৪ সালের বিবিসি প্রোগ্রাম "যন্তু ক্যামেরা" এ স্টিভ লেনার্ড ঈগল, বাজ ও চিলের সাথে খুদে টেলিভিশন ক্যামেরা যুক্ত করে চমৎকার আলোকচিত্র প্রস্তুৎ করেন এবং এই ছবি সরাসরি বেতারতরঙ্গের সাহায্যে প্রদর্শন করেন। এই ক্যামেরাগুলোর ওজন ছিলো ২৮ গ্রাম (১ আউন্স)।[৪০] ক্ষুদ্রাকৃতির রেকর্ডারও এইসব পায়রার সাথে যুক্ত করা সম্ভব।[৪১] ২০০৯ সালে গবেষকেরা এলবাট্রস পাখির সাথে খুদে ক্যামেরা যুক্ত করে সুনাম কুড়ান। লিপস্টিক আকারের ক্যামেরাগুলো প্রতি ৩০ সেকেন্ডে চিত্রগ্রহণ করতো।[৪২] এছাড়াও অন্যান্য প্রাণী যেমন বিড়াল ও কুকুরের সাথে ক্যামেরা সংযুক্ত করা হয়েছে।[৪৩]

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ