ব্রোঞ্জ
ব্রোঞ্জ এক প্রকারের সংকর ধাতু। সাধারণত তামার সাথে বিভিন্ন অনুপাতে টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জ প্রস্তুত করা হয়। তবে অনেক সময় টিন ছাড়াও এতে দস্তা, ম্যাঙ্গানিজ,অ্যালুমিনিয়াম, নিকেল, প্রভৃতি ধাতুও মিশানো হয়। ব্রোঞ্জ বেশ শক্ত ও নমনীয় এবং নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এটি ব্যবহার করা সম্ভব। মানব সভ্যতার ইতিহাসের একটি পর্যায়কে ব্রোঞ্জ যুগ বলে অভিহিত করা হয়, কারণ সে সময় ব্রোঞ্জের অস্ত্র ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল।
সাধারণত ব্রোঞ্জে তামার ভাগ থাকে অন্তত ৬০ শতাংশ; এর সাথে টিনের ভাগ থাকে ১২% ও তার সাথে মিশেল থাকে আরও অন্যান্য নানা ধাতু (উপরে উল্লিখিত) ও এমনকী নানা অধাতব পদার্থ ও ধাতুকল্পও, যেমন - আর্সেনিক, ফসফরাস, সিলিকন, প্রভৃতি। অর্থাৎ, ধাতুবিজ্ঞানের ভাষায় ব্রোঞ্জ একটি নির্দিষ্ট সংকর ধাতু নয়, বরং তামা ও টিনের সাথে বিভিন্ন অনুপাতে অন্যান্য পদার্থের মিশ্রণে তৈরি একগুচ্ছ সংকর ধাতুকে একত্রে 'ব্রোঞ্জ' বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
প্রাগৈতিহাসিক মানুষ নব্যপ্রস্তরযুগের শেষে এসে যখন ধাতুর ব্যবহার শেখে, সেই সময় থেকে লোহার ব্যবহার বহুল প্রচলিত হওয়ার আগে পর্যন্ত, সবচেয়ে শক্ত অথচ নমনীয় এবং ব্যবহারযোগ্য পদার্থ হিসেবে ব্রোঞ্জের ব্যবহারই হয়ে উঠেছিল সর্বাধিক প্রচলিত। এই সময়কেই ইতিহাসে ব্রোঞ্জ যুগ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। নিকট প্রাচ্যে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে সুমের সভ্যতার উত্থানের সাথে সাথে ব্রোঞ্জ যুগের সূচনা বলে ধরা হয়; চীন এবং ভারতীয় উপমহাদেশেও মোটামুটি ঐ একই সময়ে ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর তা ধীরে ধীরে ইউরেশিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ নিকট প্রাচ্যে লোহার ব্যবহার শুরু হলে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তা ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরেশিয়াতেই ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ব্রোঞ্জ যুগের অবসান হয়ে লৌহ যুগের সূচনা হয়। তবে তখনও ব্রোঞ্জের ব্যবহার আজকের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণেই চালু ছিল।
ব্যুৎপত্তি
ব্রোঞ্জ শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত। এগুলি হল -
- ত্রয়োদশ, চতুর্দশ শতাব্দীতে ইতালিতে 'ব্রোঞ্জো' বলে একটি শব্দ প্রচলিত ছিল, যার মানে 'ঘণ্টা তৈরির পদার্থ' বা 'পিতল'। এই শব্দটিই পরে ফরাসি ভাষায় 'ব্রোঞ্জ'রূপে অধিগৃহীত হয়। মধ্যযুগীয় লাতিনে শব্দটি 'ব্রোঞ্জিয়াম' (bronzium) হিসেবে উল্লিখিত হত। এর থেকেই শব্দটি পরবর্তীকালে বিভিন্ন আধুনিক ভাষায় প্রচলিত হয়ে ওঠে। এই মতটিই বর্তমানে সর্বাধিক গ্রাহ্য।
- আরেকটি মত হল, পারসিক ভাষায় পূর্বে 'ব্রিঞ্জি' (برنج) বলে একটি শব্দ প্রচলিত ছিল, যার অর্থ 'পিতল' বা 'তামাজাত পদার্থ' (আধুনিক ফার্সিতে এর রূপ বেরেঞ্জ )।[১] এই শব্দটি থেকেই পরবর্তীকালে সার্বো-ক্রোয়েশীয় ভাষায় 'পিরিনাচ' (পিতল)[২], জর্জীয় ভাষায় 'বিরিঞ্জাও' (আধুনিক অর্থে 'ব্রোঞ্জ') ও আর্মেনীয় ভাষায় 'প্লিঞ্জ' (তামা) শব্দগুলির উৎপত্তি। আধুনিক 'ব্রোঞ্জ' শব্দটিও এই সূত্রেই প্রচলিত হয়ে ওঠে।
- এই প্রসঙ্গে আরও একটি প্রচলিত মত হল, মধ্যযুগীয় বা বাইজান্টাইন গ্রিক ভাষায় দ্বাদশ শতাব্দীতে একটি প্রচলিত শব্দ ছিল 'ব্রন্তেসিওন' বা 'ব্রিন্দিসি'তে প্রাপ্য। দক্ষিণ ইতালির অ্যাড্রিয়াটিক সাগর কূলে অবস্থিত এই ব্রিন্দিসি শহরটি ছিল ব্রোঞ্জের জন্য বিখ্যাত। সেই ব্রন্তেসিওন শব্দটিই প্রথমে রূপান্তরিত হয়ে পরিণত হয় 'ব্রনৎসিওন'এ; এর থেকেই পরবর্তীকালে 'ব্রোঞ্জ' শব্দটি গড়ে ওঠে।[৩][৪]
আকরিক
যেসব আকরিক থেকে সাধারণভাবে ব্রোঞ্জ নিষ্কাশন করা হয় সেগুলির অনেকগুলিই সালফাইড জাতীয় জটিল যৌগ। এগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল নিম্নরূপ -
- টেট্রাহেড্রাইট; Cu12[S|(SbS3)4] - এটি একটি কপার অ্যান্টিমনি সালফো লবণ। গাঢ় বর্ণের এই আকরিকে তামা (Cu)-র পরিমাণ থাকে মোটামুটি ২৫ - ৪৫%, ০.৫ - ৩২% রুপো (Ag) , ৩ - ৬% দস্তা (Zn)ও অ্যান্টিমনি (Sb) - র পরিমাণ ২৫ - ৩০%।
- টেনানটাইট: Cu12[S|(AsS3)4] - আর্সেনিকবহনকারী যৌগ। হালকা বর্ণের এই আকরিকে তামা (Cu)-র পরিমাণ থাকে মোটামুটি ৩০- ।৫৩% ও আর্সেনিক (As)-এর পরিমাণ ১৫ - ২০%।
- ফ্রাইবের্গাইট: (Ag,Cu)10(Fe,Zn)2[S|((Sb,As)S3)4] - এটিও একটি সালফাইড লবণ। এর বিভিন্ন উপাদানগুলি হল রুপো (Ag) ৪০%, তামা (Cu), লোহা (Fe), অ্যান্টিমনি (Sb) এবং আর্সেনিক (As)।
- জার্মানাইট: Cu13Fe2Ge2S16
- কোলাসাইট: Cu13V(As,Sn,Sb)3S16[৫]
এই সব আকরিকের অনেকগুলিই মধ্য ইউরোপে ও ককেশাস অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের পরিচিত ছিল বলে জানা গেছে।[৬][৭] এছাড়াও টিনঘটিত (Sn) যেসব আকরিক ব্রোঞ্জ নিষ্কাশনে কাজে লাগে, তার মধ্যে প্রধান ক'টি হল -
- কাসিটারাইট: SnO2 ও
- স্ট্যানাইট: Cu2FeSnS4
রাসায়নিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন ধরনের টিন-ব্রোঞ্জ ও তাদের রাসায়নিক গঠন
আধুনিকযুগে সাধারণভাবে ব্রোঞ্জে তামা (Cu)-র পরিমাণ থাকে ৮৮% ও বাকি ১২% টিন (Sb)। কিন্তু ব্রোঞ্জ বলতে শুধুমাত্র এই নির্দিষ্ট সংকর ধাতুটিকেই বোঝায় না, বরং তামা ও টিন সংবলিত এক বিশেষ শ্রেণীর অনেক সংকর ধাতুকে বোঝাতেই এই শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আসলে তামা ও টিন আলাদা আলাদা অনুপাতে যুক্ত হয়ে পৃথক পৃথক গলনাঙ্ক সংবলিত বিভিন্নধরনের মিশ্র কেলাস গঠন করে থাকে। এর মধ্যে প্রথমটি আলফা মিশ্র কেলাস; সাধারণভাবে এটি আলফা ব্রোঞ্জ নামে পরিচিত। এটি বাস্তবে তামার সাথে টিনের একধরনের কঠিন দ্রবণ। এই কঠিন দ্রবণ বা মিশ্র কেলাসে টিনের পরিমাণ থাকে মাত্র ৪ - ৫%। বিশুদ্ধ তামার মতোই এর কেলাসও পৃষ্ঠতলকেন্দ্রিক ঘনাকার (fcc = face centered cubic)। এর গলনাঙ্কও প্রায় বিশুদ্ধ তামার মতোই - ১০৮৩° সে। নানাধরনের মূদ্রা, টারবাইন, স্প্রিং, ফলা (ব্লেড), প্রভৃতি তৈরিতে এই ব্রোঞ্জ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অপরদিকে বিটা মিশ্র কেলাসে টিনের পরিমাণ থাকে অনেক বেশি, প্রায় ২৪%; এর কেলাসগুলি মধ্যবিন্দুকেন্দ্রিক ঘনাকার (bcc = body centered cubic)। গামা মিশ্র কেলাসে টিনের পরিমাণ থাকে ৩০% বা তারও বেশি। এ' ক্ষেত্রেও কেলাসগুলি হয় মধ্যবিন্দুকেন্দ্রিক ঘনাকার। আবার আলফা ও বিটা এবং বিটা ও গামা মিশ্রকেলাসগুলি তাপে ও চাপে পরস্পর যুক্ত হয়ে একাধিক ধরনের ব্রোঞ্জ তৈরি করে থাকে। এর মধ্যে ব্যবহারোপযোগিতার দিক থেকে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ব্রোঞ্জে টিনের পরিমাণ থাকে মোটামুটি ২২%। আবার ডেল্টা ফেজে পৌঁছেও আমরা আরেকধরনের ব্রোঞ্জ পাই, যেখানে টিনের পরিমাণ থাকে ৩২.৫%। এর রাসায়নিক সংকেত Cu31Sn8; এক্ষেত্রে ৪১৬টি অণু সংবলিত যে বিশালাকৃতি পৃষ্ঠতলকেন্দ্রিক ঘনাকার কেলাসগুলি আমরা পাই, তা খুবই কঠিন। পাশের ছকে তামা ও টিন বিভিন্ন উষ্ণতায় ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতে যুক্ত হয়ে কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ব্রোঞ্জ তৈরি করে তা দেখানো হল।
তামা ও টিনের সংকর ধাতুতে টিনের অনুপাত বৃদ্ধির সাথে সাথে তার শক্তি, স্থায়িত্ব ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই দুই'এর সংকর ধাতুতে টিনের পরিমাণ ১০ - ১৫% হলে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছয়। অপরদিকে টিনের অনুপাত বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশুদ্ধ তামার তুলনায় এদের সংকর ধাতুর স্থিতিস্থাপকতার সীমাও একরকম সমানুপাতে বাড়তে থাকে। টিনের অনুপাত ২০%-এর কাছাকাছি হলে তা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছয়। আবার বিশুদ্ধ তামা শুধু দামীই নয়, তা নরম ও ভঙ্গুর। কিন্তু তার সাথে ৫% বা তার বেশি অনুপাতের টিনের সংকর ধাতুতে এই ভঙ্গুরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। টিনের অনুপাত ২০ - ২৫% হলে এই ভঙ্গুরতা হ্রাস তার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছয়। টিনের অনুপাত বৃদ্ধির সাথে সাথে তার কাঠিন্যও বৃদ্ধি পায়। এছাড়া প্রতি ৬% টিনের অনুপাত বৃদ্ধির ফলে দেখা যায় নতুন সংকরের ঘনত্ব ০.১ গ্রাম/সেমি৩ হারে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। টিনের অনুপাত সংকরে ৮% হলে তার ঘনত্ব হয় ৮.৭৯ গ্রাম/সেমি৩।
ব্রোঞ্জের বিভিন্ন সংকর
টিন-ব্রোঞ্জ বলতে সাধারণত তামা ও টিনের বিভিন্ন সংকর ধাতুকে বোঝানো হয়ে থাকে। তবে চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে এর কয়েক প্রকার রকমফের আছে।
- উচ্চপ্রসারণশীল সংকর - এই ধরনের ব্রোঞ্জ সংকরে টিনের পরিমাণ থাকে সর্বাধিক ৯%। এরা নমনীয় ও উচ্চপ্রসারণশীল হয়ে থাকে, অর্থাৎ পিটিয়ে এদের নানারকম আকৃতি দান করা যায়। এরা কম ভঙ্গুর এবং বিভিন্ন ধরনের ধাতব পেটাই সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এরা সাধারণত উচ্চগলনাঙ্কবিশিষ্ট হয়ে থাকে।[৮]
- ঢালাই জাতীয় সংকর - এরা অপেক্ষাকৃত কম নমনীয় ও নিম্ন গলনাঙ্কবিশিষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু এদের কাঠিন্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি হয়। ব্রোঞ্জের এই সব সংকরে টিনের ভাগ থাকে ৯% - ১৩%।[৮]
- বেল বা ঘণ্টায় ব্যবহৃত সংকর - এই ধরনের ব্রোঞ্জে টিনের পরিমাণ হয় ২০% - ২২%।
এছাড়াও ব্রোঞ্জের উপর পরিবেশের প্রভাব রোধ করতে (অর্থাৎ, স্বাভাবিক আবহাওয়ায় তার যাতে জারণক্ষমতা কম থাকে), গলনাঙ্ক বাড়াতে বা কমাতে, প্রসারণশীলতা ও নমনীয়তা বৃদ্ধি বা হ্রাসের উদ্দেশ্য এর সাথে সামান্য পরিমাণ ফসফরাস, নিকেল, সিসা বা দস্তাও বিভিন্ন সময়ে যোগ করা হয়ে থাকে।
ব্যবহার
শোভাবর্ধন সামগ্রী,ভালব,গিয়ার,নাট ইত্যাদি তৈরিতে কাঁসা ব্যবহার করা হয়।
ইতিহাস
চিত্রকক্ষ
আরও দেখুন
- তামার বিভিন্ন সংকর
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
- Mineralienatlas - Fossilienatlas (জার্মান) সংগৃহীত ১৯ জুলাই, ২০১৬।