মেরুজ জলবায়ু

মেরুজ জলবায়ু অঞ্চলগুলো সাধারণত উষ্ণ গ্রীষ্মকালের অনুপস্থিতির দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। মেরু জলবায়ু অঞ্চলে প্রতি মাসের গড় তাপমাত্রা ১০ °সে (৫০ °ফা) এরও কম থাকে। পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় ২০% অঞ্চল জুড়ে মেরু জলবায়ু অঞ্চল অবস্থিত। এই অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগই নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে দূরে অবস্থিত। শীতকালে এই অঞ্চলের দিনের দৈর্ঘ্য খুব কম এবং গ্রীষ্মকালে দিনের দৈর্ঘ্য তুলনামূলক বেশি। মেরু জলবায়ু অঞ্চলে শীতল গ্রীষ্মকাল এবং অত্যন্ত ঠাণ্ডা শীতকাল থাকে, যার ফলে অঞ্চলটি জুড়ে বৃক্ষহীন তুন্দ্রা, হিমবাহ বা বরফের স্থায়ী বা আধা-স্থায়ী স্তর থাকে।

কোপেন জলবায়ু শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী মেরুজ জলবায়ু।
  তুন্দ্রা জলবায়ু
  বরফছানি জলবায়ু
সূর্যরশ্মি মেরু অঞ্চলে তির্যকভাবে আলো দেওয়ায় মেরুতে সূর্যের বিকিরণের তীব্রতা কম। এছাড়াও সূর্যের আলো বেশি বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করে ভূমিতে পৌঁছায়।[১]

প্রকারভেদ

মেরুজ জলবায়ু প্রধানত দুই প্রকার, যথাক্রমে তুন্দ্রা জলবায়ু এবং বরফ আচ্ছাদন জলবায়ু (আইস ক্যাপ জলবায়ু)। কোন স্থানে কমপক্ষে এক মাসের গড় তাপমাত্রা ০ °সে (৩২ °ফা) এর বেশি হলে তাকে তুন্দ্রা জলবায়ু বলা হয়। অন্যদিকে বরফ আচ্ছাদন জলবায়ুতে কোনো মাসের গড় তাপমাত্রা ০ °সে (৩২ °ফা) এর উপরে থাকে না।[২] তুন্দ্রা জলবায়ুতে গাছ বাড়তে পারে না, তবে অন্যান্য বিশেষ অভিযোজিত উদ্ভিদ বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে বরফ আচ্ছাদন জলবায়ুতে কোনও গাছপালাই জন্মাতে পারে না এবং ধীরে ধীরে বরফ জমা হয়। পৃথিবীতে অনেক উচ্চ স্থানেই মাসিক গড় তাপমাত্রা ১০ °সে বা তার বেশি হয় না। উচ্চতার এই তাপমাত্রা হ্রাস পায় বলে, এই জলবায়ুকে আলপাইন জলবায়ু বলা হয়। আলপাইন জলবায়ু তুন্দ্রা ও বরফছানি জলবায়ু উভয় ধরনের জলবায়ুর মতো হতে পারে।

অবস্থান

মেরু ভাল্লুক

পৃথিবীতে মেরু জলবায়ু অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশেই বরফ আচ্ছাদন জলবায়ু প্রধান। গ্রিনল্যান্ড দ্বীপের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়া বাকি স্থান বরফ আচ্ছাদন জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত। গ্রিনল্যান্ডের যেসব উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে স্থায়ী হিমস্তর নেই, সেখানে সম্ভাবাপন্ন তুন্দ্রা জলবায়ু রয়েছে। ইউরেশীয় ভূমির উত্তরতম অংশ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূল, পূর্বদিকে বেরিং প্রণালী, উত্তর সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং উত্তর আইসল্যান্ডে তুন্দ্রা জলবায়ু রয়েছে। এছাড়াও উত্তর কানাডা এবং উত্তর আলাস্কার বৃহত্তর অঞ্চলে তুন্দ্রা জলবায়ু রয়েছে। কানাডার সর্বোত্তরের অংশে আবার বরফ আচ্ছাদন জলবায়ু রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণের অংশ (তিয়ের্‌রা দেল ফুয়েগো ও সংলগ্ন ড্রেক জলপথ এলাকা) এবং বিভিন্ন সাব-অ্যান্টার্কটিক দ্বীপপুঞ্জ, যেমন দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ও ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে সামান্য পরিসরের তুন্দ্রা জলবায়ু রয়েছে, যেখানে কোনও মাসের তাপমাত্রা ১০ °সে পর্যন্ত উষ্ণ হয় না। এই সাব-অ্যান্টার্কটিক নিম্নভূমিগুলো আর্কটিক অববাহিকার উপকূলীয় তুন্দ্রাগুলোর তুলনায় নিরক্ষীয় অঞ্চলের কাছাকাছি পাওয়া যায়।

সুমেরু

আর্কটিকের মানচিত্র। মানচিত্রের লাল রঙের রেখাটি জুলাইয়ের ১০ °সে সমতাপীয় অঞ্চল নির্দেশ করে। সাদা অংশটি ১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মকালে সমুদ্রপৃষ্ঠে বরফ আচ্ছাদনের বিস্তার নির্দেশ করে।

সুমেরু বা আর্কটিকের কিছু অংশ সারা বছর বরফ (সমুদ্রের বরফ, হিমবাহ বা তুষার) দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে এবং আর্কটিকের প্রায় সমস্ত অংশেই দীর্ঘকাল ধরে বরফে ঢাকা থাকে। এই অঞ্চলে জানুয়ারি মাসের গড় তাপমাত্রা প্রায় −৪০ °সে থেকে ০ °সে (-৪০ °ফা থেকে ৩২ °ফা) পর্যন্ত হয়। আর্কটিকের বৃহৎ অংশের তাপমাত্রা শীতকালে −৫০ °সে (-৫৮ °ফা) এর নিচে নেমে যেতে পারে। জুলাইের গড় তাপমাত্রা প্রায় -১০ °সে থেকে ১০ °সে (১৪ °ফা থেকে ৫০ °ফা) এর মধ্যে থাকে। গ্রীষ্মে কিছু অঞ্চলের তাপমাত্রা কখনো কখনো ৩০ °সে এর বেশি হয়।

সুমেরু বা আর্কটিক সমুদ্র নিয়ে গঠিত যা কিছুটা ভূমি দ্বারা বেষ্টিত। আর্কটিকের বেশিরভাগ জলবায়ু সমুদ্রের জল দ্বারা প্রশমিত হয়, যার তাপমাত্রা কখনও তাপমাত্রা −২ °সে (২৮ °ফা) এর চেয়ে কম হতে পারে না। শীতকালে, এই অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জল উত্তর মেরুকে অপেক্ষাকৃত অধিক শীতল হতে বাধা দেয়। এ কারণেই উত্তর মেরু বা সুমেরু, দক্ষিণ মেরু বা কুমেরুর চেয়ে অধিক উষ্ণ। আবার গ্রীষ্মকালে নিকটবর্তী জলের উপস্থিতি উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে উষ্ণায়ন থেকেও বিরত রাখে।

কুমেরু

অ্যান্টার্কটিকা বা কুমেরুর জলবায়ু পৃথিবীর মধ্যে শীতলতম। অ্যান্টার্কটিকার প্রাকৃতিকভাবে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ভোস্টক স্টেশনে −৮৯.২ °সেন্টিগ্রেড।[৩] এটি অত্যন্ত শুষ্ক (প্রকৃতপক্ষে এটি একটি মরুভূমি)। এখানে প্রতি বছর গড়ে ১৬৬ মিলিমিটার (৬.৫ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত হয়।

মহাদেশের বেশিরভাগ অংশে তুষার খুব কমই গলে এবং সংকুচিত হওয়ার পরে, হিমবাহ বরফে পরিণত হয় যা হিমস্তর তৈরি করে। অ্যান্টার্কটিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে খুব শীতল, সাধারণত অত্যন্ত শুষ্ক আবহাওয়া সহ একটি বরফ-ক্যাপ জলবায়ু থাকে (কোপেন শ্রেণিবিন্যাস)।

মেরুজ জলবায়ু পরিমাপ

মেরু জলবায়ু কেমন তা নির্ধারণের জন্য বহু চেষ্টা করা হয়েছে।

জলবায়ুবিজ্ঞানী ভ্লাদিমির কোপেন আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিক ট্রি লাইন এবং ১০ °সেন্টিগ্রেড গ্রীষ্মের আইসোথার্মের মধ্যে একটি সম্পর্ক প্রদর্শন করেছিলেন; অর্থাৎ, যে স্থানগুলোতে বছরের উষ্ণতম ক্যালেন্ডার মাসের গড় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৫০° ফা) এর নীচে থাকে সেগুলো বৃক্ষের জীবনধারণেত উপযোগী নয়।

অটো নর্ডেনস্কিওল্ডের মতে, শীতকালে তাপমাত্রাও একটি ভূমিকা পালন করে। তার সূত্রটি ছিল W = ৯ - ০.১ C, যেখানে W উষ্ণতম মাসের গড় তাপমাত্রা এবং C শীতলতম মাসের গড় তাপমাত্রা (উভয়ই ডিগ্রি সেলসিয়াস এককে)। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনও নির্দিষ্ট স্থানের সবচেয়ে শীততম মাসে গড় তাপমাত্রা −২০ °সে (−৪ °ফা) হয়, তবে উষ্ণতম মাসে গাছগুলোর বাঁচার জন্য গড় তাপমাত্রা, ৯ - ০.১ (−২০) = ১১ °সে হতে হবে। নর্ডেনস্কিওল্ডের রেখা উত্তর গোলার্ধের পশ্চিম উপকূল বরাবর কোপেন রেখার চেয়ে কিছুটা উত্তরে, মহাদেশীয় ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে কিছুটা দক্ষিণে বাঁক নেয়। তবে এশিয়া ও উত্তর আমেরিকা উভয় মহাদেশের পূর্ব উপকূল বরাবর উভয় রেখা একই অক্ষাংশ বরাবর গমন করে। দক্ষিণ গোলার্ধে সম্পূর্ণ তিয়ের্‌রা দেল ফুয়েগো নর্ডেনস্কিওল্ডের মেরু অঞ্চলের বাইরে অবস্থিত। অন্যদিকে দ্বীপপুঞ্জের অংশবিশেষ (আর্জেন্টিনার উসুয়াইয়াসহ) কোপেনের কুমেরু অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।

১৯৪৭ সালে লেসলি হোলরিজ জৈবতাপমাত্রা নিরূপনের মাধ্যমে এই বিবাদের কিছুটা সমাধান করেন। হোলরিজ ০ °সে বা ৩২ °ফা তাপমাত্রার নিচে (এবং ৩০ °সে বা ৮৬ °ফা তাপমাত্রার উপরে) সমস্ত তাপমাত্রাকে ০ °সে হিসেবে গণ্য করেন (কেননা এই পরিসীমার নিচে যেকোনো তাপমাত্রায় সমস্ত জৈবিক ক্রিয়াকলাপ নিষ্ক্রিয় থাকে)। অন্যদিকে গড় তাপমাত্রা ১.৫ °সে ও ৩ °সে এর মধ্যে থাকলে হোলরিজ তাকে উপমেরু জলবায়ুর (উচ্চতাজনিত কারণে নিম্ন তাপমাত্রা হলে আলপাইন জলবায়ু) অন্তর্ভুক্ত করেন।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ