রস সাগর
রস সাগর হল অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণ মহাসাগরে একটি গভীর উপসাগর। এটি রস খাড়ির অন্তস্থিত এবং ভিক্টোরিয়া ল্যান্ড ও মেরি বিয়ার্ড ল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর দক্ষিণতম সাগর। এই সাগরের নামকরণ হয়েছে ব্রিটিশ অভিযাত্রী জেমস রসের নামে। তিনি ১৮৪১ সালে এই অঞ্চলটি পরিদর্শন করেছিলেন। এই সমুদ্রের পশ্চিমে রস দ্বীপ এবং ভিক্টোরিয়া ল্যান্ড, পূর্বে রুজভেল্ট দ্বীপ এবং মেরি বিয়ার্ড ল্যান্ডের সপ্তম এডওয়ার্ড উপদ্বীপ। এর দক্ষিণ দিকের অংশটি রস হিম স্তর দ্বারা আচ্ছাদিত এবং দক্ষিণ মেরু থেকে প্রায় ২০০ মাইল (৩২০ কিমি) দূরে অবস্থিত। এর সীমানা এবং অঞ্চলটি নির্ধারিত করেছে নিউজিল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক রাসার্চ। অঞ্চলের বিস্তৃতি ৬,৩৭,০০০ বর্গকিলোমিটার (২,৪৬,০০০ মা২)।[১]
রস সাগর | |
---|---|
অবস্থান | অ্যান্টার্কটিকা |
স্থানাঙ্ক | ৭৫° দক্ষিণ ১৭৫° পশ্চিম / ৭৫° দক্ষিণ ১৭৫° পশ্চিম |
ধরন | Sea |
ব্যুৎপত্তি | জেমস রস |
প্রাথমিক বহিঃপ্রবাহ | দক্ষিণ মহাসাগর |
চক্রাকার গভীর জল প্রবাহ তুলনামূলকভাবে উষ্ণ, নোনতা এবং খণিজ সমৃদ্ধ জল-ভর। এই জল মহাদেশীয় স্তরের নির্দিষ্ট জায়গায় প্রবাহিত হয়।[২][৩] রস সাগর বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে।[৪]
পুষ্টিতে ভরপুর জল প্রচুর প্লাঙ্কটন প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখে এবং তাই এই অঞ্চল সামুদ্রিক প্রাণিতে সমৃদ্ধ। কমপক্ষে দশটি স্তন্যপায়ী প্রজাতি, ছয়টি পাখির প্রজাতি এবং ৯৫টি মাছের প্রজাতি এবং অন্যান্য অনেকগুলি অমেরুদণ্ডী প্রাণী এখানে দেখতে পাওয়া যায়। মানব ক্রিয়াকলাপ দ্বারা এই সমুদ্রাঞ্চল অপেক্ষাকৃত অপ্রভাবিত। নিউজিল্যান্ড দাবি করে যে রস অধীনক্ষেত্রের অংশ হিসাবে সমুদ্রটি তাদের আইনগত অধিকারে আছে। সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীরা এই সমুদ্রে উচ্চ স্তরের জৈব বৈচিত্র্য আছে বলে মনে করেন এবং এটি অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্থান। এও স্থানটি কিছু পরিবেশবিদ দলের ক্রিয়া-কেন্দ্র, যারা এই অঞ্চলটিকে বিশ্ব সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করার জন্য প্রচার চালিয়েছিল। ২০১৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী এই অঞ্চলটি সামুদ্রিক উদ্যান হিসাবে ঘোষিত হয়েছিল।[৫]
বর্ণনা
১৮৪১ সালে, রস অভিযানে এই সাগরটি আবিষ্কৃত হয়। রস সাগরের পশ্চিমে আছে রস দ্বীপ, যেখানে আছে এরেবুস পর্বত আগ্নেয়গিরি, পূর্বে আছে রুজভেল্ট দ্বীপ। দক্ষিণ অংশটি রস হিম স্তর দ্বারা আচ্ছাদিত।[৬] ১৯১১ সালে,রুয়াল আমুনসেন হিম স্তরে অবস্থিত তিমি উপসাগর থেকে তাঁর দক্ষিণ মেরু অভিযান শুরু করেছিলেন। রস সমুদ্রের পশ্চিমে, ম্যাকমুরডো খাঁড়ি হল একটি বন্দর অঞ্চল, যেটি গ্রীষ্মকালে সাধারণত বরফমুক্ত থাকে। রস সাগরের দক্ষিণতম অংশটি গোল্ড কোস্ট, যা ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু থেকে প্রায় দুশ মাইল দূরে।
ভূতত্ত্ব
মহাদেশীয় স্তর
রস সাগর (এবং রস হিম স্তর) একটি গভীর মহাদেশীয় স্তরের ওপর অবস্থিত। যদিও বিশ্বের মহাদেশীয় স্তরগুলির গড় গভীরতা (যেখানে স্তর বিরতি মহাদেশীয় ঢালে যুক্ত হচ্ছে) প্রায় ১৩০ মিটার,[৭][৮] রস হিম স্তরের গড় গভীরতা প্রায় ৫০০ মিটার।[৯] পশ্চিম রস সমুদ্রে (পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) এই স্তর পূর্বের (পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ) চেয়ে অগভীর।[৯] এই অতি-গভীর অবস্থাটি, বরফের চাদর সম্প্রসারণ এবং সংকোচনের সময় পলির ক্ষয় এবং পলল অধঃক্ষেপের চক্রের (অলিগোসিন) কারণে হয়।[১০] অ্যান্টার্কটিকার আশেপাশের অন্যান্য অঞ্চলেও এটি দেখতে পাওয়া যায়।[১১] স্তরের অভ্যন্তরভাগের দিকে ক্ষয় বেশি হয়েছিল এবং বহির্ভাগে পলল বেশি জমা হয়েছিল, তাই অভ্যন্তরীন স্তর বহির্ভাগের চেয়ে বেশি গভীর।[১০][১২]
বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এখানকার ভূমিকম্পের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করে রস সমুদ্রের ভূতত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি সামনে এসেছিল। [১৩] গভীরতম বা বুনিয়াদি শিলাগুলির চ্যুতির ফলে চারটি প্রধান চলমান গ্র্যাবেন প্রণালীর সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলি এখন পলল অধঃক্ষেপের অববাহিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অববাহিকাগুলির মধ্যে আছে পশ্চিম দিকে উত্তর এবং ভিক্টোরিয়া স্থল অববাহিকা, কেন্দ্রীয় অবনমন এবং পূর্ব অববাহিকা। কোলম্যান হাই- ভিক্টোরিয়া স্থল অববাহিকা এবং কেন্দ্রীয় অবনমনকে পৃথক করে রেখেছে এবং সেন্ট্রাল হাই- কেন্দ্রীয় অবনমন এবং পূর্ব অববাহিকাকে পৃথক করে রেখেছে। ভূত্বকীয় সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ চ্যুতি এবং তার ফলে গ্র্যাবেন গঠন, ঘটেছিল, অ্যান্টার্কটিকা থেকে জিল্যান্ডিয়া (মহাদেশ) দূরে চলে যাওয়ার সময়, ক্রিটেসিয়াস যুগে গন্ডোয়ানাতে।[১৪]প্যালিওজিন এবং নিওজিন যুগ এবং চ্যুতি ও সম্প্রসারণ ভিক্টোরিয়া স্থল অববাহিকা এবং উত্তর অববাহিকায় সীমাবদ্ধ ছিল।[১৫][১৬]
ভূতাত্ত্বিক খনন
সমুদ্র পৃষ্ঠে খনন করে সমুদ্রের পশ্চিম প্রান্ত থেকে শিলা মজ্জা উদ্ধার করা হয়েছে। সবচেয়ে আশাব্যাঞ্জক সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলি হল অন্তরীপ রবার্টস প্রকল্প (সিআরপি) এবং অ্যান্ডআরআইএল প্রকল্প[১৭][১৮][১৯] গভীর সমুদ্র খনন প্রকল্প (ডিএসডিপি) এর ২৮তম পর্বে সমুদ্রের মধ্য ও পশ্চিম অংশের জমিতে আরও অনেকগুলি গর্ত (২৭০-২৭৩) করা গেছে।[২০] এর ফলে বেশিরভাগ পুরানো হিমবাহের পরম্পরার স্তরদর্শন করা গিয়েছিল, যেগুলি ওলিগোসিন এবং নবীন পলল দিয়ে তৈরি। [২১][২২][২৩]
২০১৮ সালে, ইন্টারন্যাশানাল ওশান ডিসকভারি প্রোগ্রামের (আইওডিপি) ৩৭৪তম অভিযানে, নিওজিন এবং চতুর্মুখী বরফ চাদরের ইতিহাস নির্ধারণের জন্য রস সাগরের কেন্দ্রস্থলে অতিরিক্ত গর্ত (ইউ ১৫২১-১৫২৫) করা হয়েছিল।[২৪]
জীববৈচিত্র্য
রস সাগরে কমপক্ষে ১০টি স্তন্যপায়ী প্রজাতি, আধা ডজন প্রজাতির পাখি, ৯৫ প্রজাতির মাছ এবং এক হাজারেরও বেশি অমেরুদন্ডী প্রজাতির আবাসস্থল। রস সাগরের আশেপাশে বাসা বাঁধার কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে অ্যাডিলি পেঙ্গুইন, সম্রাট পেঙ্গুইন, অ্যান্টার্কটিক পেট্রেল, স্নো পেট্রেল এবং দক্ষিণ মেরুর স্কুয়া। রস সাগরের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে আছে অ্যান্টার্কটিক মিনকে তিমি, ঘাতক তিমি, ওয়েডেল সীল, কাঁকড়াভক্ষক সীল এবং চিতা সীল। এছাড়াও আরো জলজ প্রাণীদের মধ্যে আছে অ্যান্টার্কটিক টুথফিশ, অ্যান্টার্কটিক সিলভারফিশ, অ্যান্টার্কটিক ক্রিল, এবং ক্রিস্টাল ক্রিল।[২৫]
এখানকার উদ্ভিদ এবং জীবজন্তু দক্ষিণ অ্যান্টার্কটিকের অন্যান্য অঞ্চলের প্রানীর মতই বর্তমান। বিশেষত গ্রীষ্মে পুষ্টি সমৃদ্ধ সমুদ্রের জলে প্রচুর প্ল্যাঙ্কটোনিক জীবন বেঁচে থাকে। সেগুলি খেয়ে আবার বৃহত্তর প্রজাতি যেমন মাছ, সীল, তিমি, এবং সমুদ্রের ও তীরের পাখি বেঁচে থাকে।
আলবাট্রস ভ্রমণের জন্য বাতাসের উপর নির্ভর করে এবং শান্ত বায়ুতে এগোতে পারে না। পশ্চিমী বাতাস খুব দক্ষিণে পৌঁছোতে পারেনা এবং তাই আলবাট্রসও বেশি দূর যায়না। আলবাট্রস যদি কোনোভাবে প্রবাহী বরফে অবতরণ করে, বায়ু শান্ত থাকলে তারা সেখানে অনেক দিন ধরে এ আটকে থেকে যায়।[২৬]
সমুদ্রের উপকূলীয় অংশগুলিতে অ্যাডিলি এবং সম্রাট পেঙ্গুইনের বেশ কয়েকটি উপনিবেশ রয়েছে।[৬]
একটি ১০ মিটার (৩২.৮ ফুট) লম্বা, ৪৯৫ কিলোগ্রাম (১,০৯১ পাউন্ড) ওজনের কলোসাল স্কুইড ২০০৭ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি রস সাগরে ধরা পড়েছিল।[২৭][২৮][২৯][৩০][৩১]
আরও দেখুন
- Beaufort Island
- Iceberg B-15
- McMurdo Station
- Ross Canyon
- Ross Dependency
- Ross Gyre
- Ross Ice Shelf
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
উইকিমিডিয়া কমন্সে রস সাগর সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।
- World Database on Protected Areas - Ross Sea Region Marine Protected Area ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ আগস্ট ২০২০ তারিখে
- Commission for the Conservation of Antarctic Marine Living Resources, New Zealand and United States Delegation, 2015. A proposal for the establishment of a Ross Sea Region Marine Protected Area ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে
- J. Glausiusz, 2007, Raw Data: Beacon Bird of Climate Change. Discover Magazine.
- Gunn, B., nd, Geology The Ross Sea Dependency including Victoria-Land Ross Sea, Antarctica, Including the Ross Sea Dependency, the Sub-Antarctic Islands and sea, up to New Zealand from the Pole.
- K. Hansen, 2007, Paleoclimate: Penguin poop adds to climate picture. Geotimes.
- International Polar Foundation, 2007, Interview with Dr. Steven Emslie: The Adélie Penguins' Diet Shift. SciencePoles website.
- C. Michael Hogan. 2011. Ross Sea. Eds. P. Saundry & C. J. Cleveland. Encyclopedia of Earth. National Council for Science and the Environment. Washington DC
- Locarnini, R. A., 1995, the Ross Sea. Quarterdeck, vol. 1, no. 3.(Department of Oceanography, Texas A&M University, College Station, Texas.)
- "Nth Korean boats caught fishing in conservation area"। Radio New Zealand। সংগ্রহের তারিখ ৭ এপ্রিল ২০১১।
- http://www.antarcticocean.org/. International campaign to establish Marine Protected Areas in the Southern Ocean.
- [১]
- The Last Ocean, documentary film on the Ross Sea and the international debate over its fate.