রাজীব গান্ধীর গুপ্তহত্যা
ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী (Rajiv Gandhi) ১৯৯১ সালের ২১ মে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের শ্রীপেরামবুদুরে এক আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে নিহত হন। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। উক্ত বিস্ফোরণে রাজীব ছাড়াও আরও চৌদ্দ জন নিহত হয়েছিলেন।[১]
রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেন তেনমোঝি রাজারত্নম নামে লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম বা এলটিটিই-এর এক সদস্যা। উল্লেখ্য, এই সময় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সঙ্গে বিজড়িত ছিল।
দুটি তদন্ত কমিশন এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বটি উদঘাটিত করে। এই হত্যা একটি জাতীয় সরকারের পতনের কারণ হয়। এলটিটিই প্রথমে রাজীব-হত্যার দায় অস্বীকার করলেও পরে মুখপাত্র অ্যান্টন বালাসিংহমের একটি বক্তব্যের মাধ্যমে তা স্বীকার করে নেয়।
রাজীব-হত্যা
১৯৯১ সালের ২১ মে, চেন্নাই (তদনীন্তন মাদ্রাজ) শহর থেকে ৩০ মাইল দূরে শ্রীপেরামবুদুর শহরে রাজীব গান্ধীর শেষ জনসভাটির আয়োজন করা হয়েছিল। এই জনসভায় তিনি তামিলনাড়ুর শ্রীপেরামবুদুর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী শ্রীমতী মারাগতাম চন্দ্রশেখরের সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারে উপস্থিত হয়েছিলেন।[২] এখানেই এলটিটিই জঙ্গী তেনমোঝি রাজারত্নমের আত্মঘাতী বোমার হামলায় রাজীব নিহত হন। তেনমোজি রাজারত্নমের অপর নাম ছিল ধানু। পরবর্তীকালে আত্মঘাতী বোমারুর প্রকৃত নাম জানা যায় গায়ত্রী।
হত্যার দুই ঘণ্টা পূর্বে রাজীব চেন্নাই শহরে উপস্থিত হন। একটি সাদা অ্যাম্বাস্যাডারের কনভয়ে তিনি যাত্রা করেন শ্রীপেরামবুদুরের উদ্দেশ্যে। মাঝে কয়েকটি নির্বাচনী প্রচারস্থলে তার কনভয় থেমেছিল। শ্রীপেরামবুদুরে যাওয়ার সময়ে তার গাড়িতে এক বিদেশি সাংবাদিক তার যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি রাজীবের একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। শ্রীপেরামবুদুরে তিনি গাড়ি থেকে নেমে সভামঞ্চের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেন। সেখানে তার বক্তৃতাদানের কথা ছিল। এই সময় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, কংগ্রেস দলীয় সমর্থক ও স্কুল ছাত্রছাত্রী তাকে মালা পরিয়ে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। রাত দশটা দশ মিনিটে হত্যাকারী তানু তার দিকে এগিয়ে যায়। সে রাজীবকে অভিবাদন জানায়। তারপর তার পাদস্পর্শ করার আছিলায় পোষাকের নিচে বাঁধা আরডিএক্স ভর্তি বেল্টটি ফাটিয়ে দেন। পরমুহূর্তেই বিস্ফোরণে প্রাণ হারান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সহ বেশ কয়েকজন। হত্যার দৃশ্যটি এক স্থানীয় সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। এই ক্যামেরা ও তার ফিল্ম ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া যায়। সেই ক্যামেরাম্যান নিজেও সেই বিস্ফোরণে মারা যান।
ঘটনাস্থলে নির্মিত রাজীব গান্ধী স্মারকটি বর্তমানে এই ছোটো শিল্পশহরটির অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ।
বিচার
রাজীব গান্ধী হত্যামামলা শুরু হয়েছিল টাডা আইনের অধীনে। চেন্নাই-এ গঠিত বিশেষ টাডা আদালত মোট ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। এর ফলে সারা দেশে ঝড় বয়ে যায়। এমনকি আইনবিশেষজ্ঞরাও স্তম্ভিত হয়ে যান।[৩] বিচার নিরপেক্ষ হয়নি বলে দাবি করে মানবাধিকার সংস্থাগুলি প্রতিবাদ শুরু করে।[৪][৫] বিচার হয়েছিল ক্যামেরা আদালতের বন্ধ দরজার আড়ালে। সাক্ষীদের পরিচয় জানানোর ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছিল। অভিযুক্ত কুমারী এ অতিরাই গ্রেফতার হওয়ার সময় মাত্র সতেরো বছর বয়স্ক ছিলেন। টাডা আইন অনুযায়ী অভিযুক্তরা একমাত্র সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারেন। এই কারণে তাদের সাধারণ আইন অনুসারে মাদ্রাজ হাইকোর্টে আপিল করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।[৬] পুলিশ সুপারের কাছে অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তি টাডায় তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। টাডা আদালতে প্রমাণের দ্বারাই অভিযুক্তকে দোষীসাব্যস্ত করা যায়; যা সাধারণ আদালতে ভারতীয় আইন মোতাবেক যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয় না। রাজীব গান্ধী হত্যামামলায় অভিযুক্তদের যে স্বীকারোক্তিকে প্রমাণ বলে দাখিলের চেষ্টা করা হয়েছিল, অভিযুক্তরা পরবর্তীকালে অভিযোগ করেন যে তা জোর করে আদায় করা হয়।[৭] সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের ভিত্তিতে চার জনের মৃত্যুদণ্ড হয়। অন্যান্যরা বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ভোগ করে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি টমাস এই রায় দিয়েছিলেন যে এই হত্যাকাণ্ডের কারণ রাজীব গান্ধীর প্রতি এলটিটিই প্রধান প্রভাকরণের শত্রুমনোভাব। উক্ত রায়ে একটি অনশন ধর্মঘটে তিলিপানের মৃত্যু ও ১৯৮৭ সালের অক্টোবরে একটি জাহাজে ১২ জন এলটিটিই ক্যাডারের আত্মহত্যার কথাও উল্লেখিত হয়।
রায়ে অভিযুক্তদের চার জনের মৃত্যুদণ্ড ও বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। রায়ে জানানো হয় যে ষড়যন্ত্রকারীরা রাজীব গান্ধী ব্যতীত অন্য কাউকেই হত্যা করতে চাননি। যদিও বিস্ফোরণে অনেকেই নিহত হয়েছিলেন। বিচারপতি ওয়াধওয়া আরো জানান যে রাজীব গান্ধী হত্যার কারণ যে সরকারকে সচকিত করা, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই কারণে টাডা আইনের অধীনে এর বিচার অসঙ্গত।[৮][৯] বিচারপতি টমাসের মতে, ১৯৮৭ সাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে এই রাজীব গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্র চলে। ভারতের প্রধান তদন্ত সংস্থা সিবিআই-এর বিশেষ তদন্তকারী দল অবশ্য ঠিক কোন সময় রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তা নির্ণয় করতে পারেনি।
জৈন কমিশন ও অন্যান্য রিপোর্ট
জৈন কমিশনের রিপোর্টে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় যে একাধিক ব্যক্তি ও সংস্থা রাজীব-হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত। ধর্মগুরু চন্দ্রস্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের অর্থ জোগান দিয়েছিলেন।[১০][১১][১২] অন্যতম অভিযুক্ত রঙ্গনাথ চন্দ্রস্বামীকে গডফাদার ও অর্থের জোগানদার বলে উল্লেখ করেছিল।[১৩] শিখ সন্ত্রাসবাদীদেরও সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়।[১৪][১৫] জৈন কমিশনের অন্তর্বর্তী রিপোর্টে অভিযোগ করা হয় এই হত্যাকাণ্ডে করুণানিধি ও তামিলদের ভূমিকা ছিল। এর ফলে দেশজুড়ে বিতর্ক ওঠে। কংগ্রেস ইন্দ্রকুমার গুজরাল সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, বর্তমান কংগ্রেসশাসিত ইউপিএ সরকারের চেয়ারপার্সন তথা রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী করুণানিধিকে তার সরকারের শরিক করেছেন। এলটিটিই-র প্রতি তীব্র সহানিভূতিশীল ভাইকো নেতৃত্বাধীন মারুমালার্চি দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাগাজম এবং তোল. তিরুমাবলবান নেতৃত্বাধীন দলিত প্যান্থারস অফ ইন্ডিয়া ইতঃপূর্বে সোনিয়া গান্ধীকে সমর্থন করে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত মূলত শ্রীলঙ্কার ইস্যুতে ভাইকো সোনিয়া গান্ধীর সমর্থক ছিলেন। ২০০৬ সালে এলটিটিই মুখপাত্র অ্যান্টন বালসিংহম ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভিকে জানায় যে রাজীব হত্যাকাণ্ড “একটি বড় ট্রাজেডি, একটি হিমালয়প্রতিম ঐতিহাসিক ট্রাজেডি, যার জন্য আমরা সবাই দুঃখিত।”[১৬][১৭]
পাদটীকা
আরও দেখুন
- জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড
- মিশন নাইন্টি ডেজ (চলচ্চিত্র)