রোম্যান্স উপন্যাস

রোম্যান্স উপন্যাস বা রমন্যাস[১] পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে, বিশেষত ইংরেজি-ভাষী জগতে বিকশিত একটি সাহিত্যধারা। এই বর্গের উপন্যাসগুলির মূল উপজীব্য দুই ব্যক্তির প্রেম ও প্রণয়সম্পর্ক, যার পরিসমাপ্তি হবে “সর্বদা মানসিকভাবে সন্তুষ্টিবিধায়ক ও আশাব্যঞ্জক”।[২] বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে এই উপন্যাসগুলিকে দুটি প্রধান বাণিজ্যিক বিভাগে বিভক্ত হতে দেখা যায় : (১) ক্যাটেগরি রোম্যান্স, যেগুলি ছোটো আকারের বই এবং মাত্র একমাস দোকানে পাওয়া যায় এবং (২) সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্স, যেগুলি সাধারণত বৃহদাকার ও অনেক বেশি দিন দোকানে পাওয়া যায়। বিষয়গত বৈচিত্র্যের দিক থেকে অবশ্য রোম্যান্স বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যথা : সমসাময়িক, ঐতিহাসিক, কল্পবিজ্ঞান বা অতিলৌকিক রোম্যান্স।

ক্যাথলিন উইডিউইস রচিত উপন্যাস দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ারের প্রচ্ছদ

১৭৪০ সালে রচিত স্যামুয়েল রিচার্ডসনের পামেলা, অর ভার্চু রিওয়ার্ডেড উপন্যাসটি প্রথম যুগের রোম্যান্স উপন্যাসের একটি নিদর্শন। দুইটি কারণে এই বইখানি ছিল যুগান্তকারী : প্রথমত, সমগ্র উপন্যাসটির উপজীব্য বিষয় ছিল কোর্টশিপ বা প্রণয়-যাঞ্ছা এবং দ্বিতীয়ত, বইটির মূখ্যচরিত্র ছিলেন এক নারী, যাঁর দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখক গল্পটি উপস্থাপনা করেন। পরবর্তী শতকে জেন অস্টিন এই শাখাটিকে পরিবর্ধিত করেন। তার রচিত প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস উপন্যাসখানিকে রোম্যান্স সাহিত্যধারার সর্বোৎকৃষ্ট কীর্তি বলে মনে করা হয়। অস্টিনের রচনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জর্জেট হেয়ার ১৯২১ সালে ঐতিহাসিক রোম্যান্সের সূচনা ঘটান। এর প্রায় এক দশক পর থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি মিলস অ্যান্ড বুন প্রথম ক্যাটেগরি রোম্যান্স উপন্যাস প্রকাশ করতে শুরু করেন। উত্তর আমেরিকায় হারলেকুইন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড এই বইগুলি পুনরায় বিক্রি করতে থাকেন। এর ফলে পাঠকদের কাছে এই বইগুলির প্রত্যক্ষ বাজার সৃষ্টি হয় এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও বইগুলি বিক্রি করতে থাকেন।

১৯৭২ সালে অ্যাভন বুকস প্রকাশিত ক্যাথলিন উইডিউইস রচিত দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ার উপন্যাসটি আধুনিক রোম্যান্সের সূচনা করে। এটিই ছিল মূল পেপারব্যাক আকারে প্রকাশিত প্রথম সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্স উপন্যাস। ১৯৮০-এর দশকে এই ধারাটি সমৃদ্ধিলাভ করে। অনেকসংখ্যক ক্যাটেগরি উপন্যাসের পাশাপাশি সিঙ্গল-টাইটেল উপন্যাসের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। জনপ্রিয় লেখকগণ এই ধারার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্লট ও চরিত্রচিত্রণে আধুনিকতার ছোঁওয়া লাগে।

উত্তর আমেরিকায় ২০০৪ সালে বিক্রীত সমস্ত পেপারব্যাক বইয়ের ৫৫% রোম্যান্স উপন্যাস। এই অঞ্চলে আধুনিক সাহিত্যে জনপ্রিয়তম ধারা তাই এইটিই। ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়াতেও এই ধারা বিশেষ জনপ্রিয়। ৯০টি ভাষায় প্রকাশিত হয় রোম্যান্স উপন্যাস। এর অধিকাংশই অবশ্য ইংরেজিভাষী দেশগুলিতে অ্যাংলো-স্যাক্সন দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত। জনপ্রিয়তা ও বহুল বিক্রি সত্ত্বেও এই সাহিত্যধারাটি ব্যাপকভাবে উপহাসিত, নিন্দিত ও সমালোচিত হয়ে থাকে।

সংজ্ঞা

আমেরিকার রোম্যান্স লেখকদের মতে, একটি রোম্যান্স উপন্যাসের কেন্দ্রীয় প্লট অবশ্যই দুজনের প্রেম ও প্রণয়সম্পর্ককে ঘিরে গড়ে উঠতে হবে। উপন্যাসের সংঘাত বা কনফ্লিক্ট ও সংকট বা ক্লাইম্যাক্স এই প্রেমসম্পর্ক গড়ে ওঠার মূল থিমটির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকবে। যদিও এই মূল গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত নয় এমন সাবপ্লট বা উপকাহিনির অবতারণা উপন্যাসে থাকতেই পারে। অধিকন্তু রোম্যান্স উপন্যাসের পরিসমাপ্তিতে হবে “সর্বদা মানসিকভাবে সন্তুষ্টিবিধায়ক ও আশাব্যঞ্জক”। এদিকে বার্কলে বুকস গোষ্ঠীর কর্ণধার লেসি জেলম্যান সহ অনেকেই অপেক্ষাকৃত ছোটো সংজ্ঞা ব্যবহারের পক্ষপাতী। তাদের মতে, “(রোম্যান্স) গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু হবে... নায়ক ও নায়িকার প্রণয়সম্পর্ক।[৩] সাধারণভাবে, রোম্যান্স উপন্যাসে সৎ চরিত্রগুলি পায় পুরস্কার ও অসৎ চরিত্রগুলি পায় শাস্তি। আর যে প্রণয়ীরা তাদের সম্পর্কে বিশ্বাস রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যায়, তারা পায় নিঃশর্ত প্রেমের পারিতোষিক।[২] “বইগুলি প্রেমে পড়া, আবেগবিহ্বলতা, পারস্পরিক সম্পর্কবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং যা কিছু আমরা সত্যিই চাই, তার উদ্‌যাপন।” রোম্যান্স উপন্যাসকে এইভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন জনপ্রিয় লেখিকা নোরা রবার্টস।[৪] চিক লিট সহ মেয়েলি কথাসাহিত্য অবশ্য রোম্যান্স সাহিত্যবর্গের কোনো প্রত্যক্ষ উপবর্গ নয়। কারণ মেয়েলি সাহিত্যে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নায়িকার সম্পর্ক, নায়কের সঙ্গে তার সম্পর্কের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।[৩]

কোনো কোনো রোম্যান্স রচয়িতা ও পাঠক বিশ্বাস করেন, রোম্যান্স উপন্যাস ধারায় গল্পের প্রথম দিকে নায়ক-নায়িকার মিলন, ব্যভিচার এড়িয়ে চলা সংক্রান্ত কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। আবার কেউ কেউ বাধ্যতামূলক মিলনান্তক সমাপ্তি বা সমলিঙ্গ সম্পর্ক প্রদর্শনেরও বিরোধী। পাঠকদের কেউ কেউ মিলনান্তক সমাপ্তি ছাড়াও শুধুমাত্র প্রধান দুই চরিত্রের প্রেমসম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো কোনো রচনাকে রোম্যান্স শ্রেণিভুক্ত করেন (যেমন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট)। অপর একদল মনে করেন, রোম্যান্স উপন্যাসের সংজ্ঞা কঠোরভাবে বিষমকামী প্রেমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়া উচিত। বেশিরভাগ রোম্যান্স উপন্যাস সংজ্ঞা ক্ষেত্রের এই সব বিধিনিষেধ মেনে চললেও, এসব নিয়মের লঙ্ঘনও একাধিক ক্ষেত্রে দেখা যায়। তাই আরডাব্লিউএ ও প্রকাশকদের মতোই এর সাধারণ সংজ্ঞা শুধুমাত্র কাহিনির মুখ্য প্রণয়সম্পর্ক নির্মাণ ও আশাব্যঞ্জক সমাপ্তির প্রবণতাটিকে কেন্দ্র করেই নির্ধারণ করা হয়।[৫][৬]

এই দুই নিকষে আবদ্ধ একটি রোম্যান্স উপন্যাস যে কোনো সময়-ক্ষেত্রে যে কোনো পটভূমিতে রচিত হতে পারে। এই ধরনের উপন্যাসে কি অন্তর্ভুক্ত হবে আর কি হবে না, সে নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই।[২] ধর্ষণ, গার্হস্থ হিংসা, নেশাগ্রস্থতা ও প্রতিবন্ধীসংক্রান্ত এযাবৎকালের বিতর্কিত বিষয়গুলিও রোম্যান্স উপন্যাসে স্থান পায়।[৭] সময় কাঠামো, পটভূমি ও প্লটের বিষয়বস্তু রোম্যান্স উপন্যাসকে বিভিন্ন উপবর্গে বিভক্ত করতে সাহায্য করে।[২] গঠনের এই বৈচিত্র্যসম্ভাবনা সত্ত্বেও মূল ধারার অনেক পাঠকই মনে করেন, “সবই (রোম্যান্স উপন্যাস) পড়তে লাগে এক ধাঁচের।” [৮] রোম্যান্স সাহিত্যবর্গের ছাঁচ বা স্টিরিওটাইপ প্রচুর। উদাহরণ স্বরূপ, কেউ কেউ মনে করেন, সব রোম্যান্স উপন্যাসই ড্যানিয়েলা স্টিল-এর মতো ধনী ও গ্ল্যামারাস ব্যক্তিদের বিদেশভ্রমণের কাহিনি।[৯] অনেক পাঠক মনেই করেন না যে স্টিল আদৌ রোম্যান্স রচয়িতা ছিলেন। কারণ তার রচনাশৈলী ছিল মূল ধারার সাহিত্যের অনুসারী।[১০]

অনেক সময় রোম্যান্স উপন্যাস অভিহিত হয়ে থাকে স্মাট বা মেয়ে পর্নোগ্রাফি নামে।[১১][১২] কিছু কিছু উপন্যাসে অধিক মাত্রায় যৌন-উদ্দীপক বিষয়বস্তু সংযোজিত হয়। আবার কিছু কিছু উপন্যাসে সতীসাধ্বীর চুম্বনের বেশি কিছুই প্রদর্শিত হয় না। কোনো কোনো উপন্যাস আবার এই দুই চূড়ান্ত পর্যায়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে।[১৩] রোম্যান্স উপন্যাসের পাঠক বিশেষত মহিলারা। তাই গল্পগুলি বলা হয়ে থাকে মেয়েলি দৃষ্টিকোণ থেকে, হয় প্রথম পুরুষে, নয় তৃতীয় পুরুষে।[১৪]

শ্রেণিবিভাজন

উপরের ডান কোনে প্রথম লাইনটি দ্রষ্টব্য। এই লাইনটি নির্দেশ করছে যে বইটি ডেল ক্যান্ডেললাইট এক্সট্যাসি ক্যাটেগরির প্রথম প্রকাশন।

রোম্যান্স উপন্যাস দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা, ক্যাটেগরি রোম্যান্স (যা সিরিজ রোম্যান্স নামেও পরিচিত) এবং সিঙ্গল টাইটেল রোম্যান্স।[২] অনেক লেখক এই দুটি শ্রেণির যে কোনো একটিতে লেখেন। আবার জাইন অ্যান ক্রেনজ বা জেনিফার ক্রুজ-এর মতো কোনো কোনো লেখক দুইটি শ্রেণিতে লিখেই খ্যাতি অর্জন করেছেন।[১৫]

ক্যাটেগরি রোম্যান্স

ক্যাটেগরি রোম্যান্সগুলি ক্ষীণকায়। এগুলির দৈর্ঘ্য সাধারণত ২০০ পৃষ্ঠা বা ৫৫,০০০ শব্দের অধিক হয় না।[১৬][১৭] বইগুলি স্পষ্টতর ব্যাখ্যামূলক একটি লাইনের শিরোনামায় প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো বই প্রতিমাসে একই লাইনের শিরোনামায় প্রকাশিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই লাইনগুলিকে সংখ্যাযুক্ত করে পূর্বাপরত্ব বজায় রাখা হয়।[২] এই উপন্যাসগুলি বিশ্বব্যাপী পরিবেশিত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে একটি একক মুদ্রণ ততক্ষণ পর্যন্ত বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়, যতক্ষণ না এগুলির সবকটি বিক্রি হচ্ছে, অথবা পরের মাসের প্রকাশনাটি তার জায়গা দখল করছে।[১৫] ক্যাটেগরি রোম্যান্সের বৃহত্তম প্রকাশক হলেন হারলেকুইন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (হারলেকুইন/মিলস অ্যান্ড বুন)। এদের বই ছাব্বিশটি ভাষায় অনূদিত হয়ে ১০০টির মতো আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রিত হয়।[১৮]

এই শ্রেণিতে একটি সার্থক উপন্যাস লিখতে হলে “লেখককে গল্পের সারবস্তুটি পৃথক করে নিয়ে বলতে হবে। সাবপ্লট ও অপ্রধান চরিত্রগুলি হয় বাদ দিতে হবে, নয়তো সেগুলি পূর্বকথায় ফিরিয়ে দিতে হবে।” [১৭] যদিও ক্যাটেগরি রোম্যান্স উপন্যাসের শিরোনাম একই পটভূমি, চরিত্র, সময়কাল, ইন্দ্রিয়সুখের স্তর বা সংঘাতের ধরন দ্বারা চিহ্নিত হয়ে থাকে। প্রকাশকেরা প্রতিটি শিরোনামার সহায়িকা বা গাইডলাইন প্রকাশ করেন, যার দ্বারা উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে অবহিত হওয়া যায়।[১৯][২০][২১] বাজারের চাহিদা ও পাঠকের রুচি অনুসারে প্রকাশকেরা বর্তমান লাইনটি সমাপ্ত করে নতুন লাইন শুরু করে থাকেন। অতিসম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী রিজেন্সি রোম্যান্স লাইনের বদলে যৌন-উদ্দীপক ও খ্রিস্টান লাইনের চল হয়েছে।[২২]

সিঙ্গল টাইটেল রোম্যান্স

প্রকাশকের ক্যাটেগরিতে যে রোম্যান্স উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয় না, সেগুলি সিঙ্গল টাইটেল রোম্যান্স নামে পরিচিত। এগুলি ক্যাটেগরি রোম্যান্সের থেকে আকারে বৃহৎ। পৃষ্ঠাসংখ্যা সাধারণত ৩৫০-৪০০।[১৬] বিক্রির হার ও বিজ্ঞাপন-প্রচারের কারণে প্রকাশকেরা এগুলি কম সময়ের ব্যবধানে প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু গড়ে লেখকরা বছরে লেখেন ১.৫টি করে উপন্যাস ও তা প্রকাশিত হয়ে এক বছর ধরে।[৩][২৩] সিঙ্গল টাইটেল রোম্যান্স কতদিন বুকস্ট্যান্ডে থাকবে তা নির্ধারণ করেন দোকানদাররাই।[২৪]

নামে একক শিরোনাম হলেও, এই জাতীয় উপন্যাসগুলি সবসময়ই যে স্বতন্ত্র বই হয়, তা নয়। অনেক লেখকই পরস্পর সংযুক্ত উপন্যাস লেখা পছন্দ করেন, যার দৈর্ঘ্য ট্রিলজি বা ত্রয়ী থেকে বহুসংখ্যক বইয়ের সিরিজ হতে পারে। কোনো কোনো সিরিজের সেটটি “অমুক সিরিজের ১ নং বই” – এই জাতীয় শিরোনামেও প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাদের সিরিজ রোম্যান্স মনে করা হয় না, কারণ তারা কোনো নির্দিষ্ট লাইনের অংশ নয়।[২৫]

বর্গবিভাজন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়তার নিরিখে উপবর্গগুলির অবস্থান (২০০৬)[২৬]
উপবর্গবাজার (%)
ক্যাটেগরি রোম্যান্স৪০%
ঐতিহাসিক রোম্যান্স১৭%
সমসাময়িক রোম্যান্স১৬%
অতিলৌকিক রোম্যান্স৯%
রোম্যান্টিক সাসপেন্স৭%
অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স৬%
অন্যান্য সকল৫%

রোম্যান্স উপন্যাসের সংজ্ঞা এর প্লট উপাদান, সময় বা পটভূমির উপর কোনো প্রকার সীমাবদ্ধতা আরোপ করে না। আর সেই কারণেই এই ধারায় বস্তুগত বৈচিত্র্য ও উপজাত বিভিন্ন ধরনের উপবর্গের সমাহার দেখা যায়। এই উপবর্গগুলি অন্যান্য সাহিত্য উপবর্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। কোনো কোনো বই তো একই সঙ্গে রোম্যান্স ও অন্যান্য সাহিত্যবর্গের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, রোম্যান্টিক সাসপেন্স উপন্যাসগুলি গোয়েন্দা কাহিনি বা রহস্য কাহিনি, অপরাধ কাহিনিথ্রিলারের সমগোত্রীয়। আবার অতিলৌকিক রোম্যান্স কাহিনিগুলি কল্পবিজ্ঞানকল্পকাহিনি জাতীয় সাহিত্যধারা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে গড়ে ওঠে।

সমসাময়িক রোম্যান্স

সমসাময়িক রোম্যান্স রচিত হয় উত্তর-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পটভূমিকায়।[২৭] সাধারণভাবে রোম্যান্স উপন্যাস বলতে লোকে এই ধরনের উপন্যাসগুলিকেই বোঝে। রোম্যান্স উপন্যাস ধারায় বৃহত্তম এই উপবর্গটি রচনার সমসাময়িককালের সময় ও সমাজব্যবস্থাকেই প্রতিফলিত করে। ১৯৭০ সালের আগে পর্যন্ত রচিত রোম্যান্সগুলিতে দেখা যায় নায়িকারা কর্মরতা হতে না, হতেন প্রধানত বিবাহিত ও সন্তানের জননী। কিন্তু ১৯৭০ সালের পর থেকে দেখা যায় তারা কেরিয়ার বিষয়ে সচেতন।[২৮] পরবর্তীকালে প্লটসংগঠনে জটিলতা ও চরিত্রচিত্রণে বাস্তবতাবোধ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক রোম্যান্স ও মেয়েলি কথাসাহিত্যের মধ্যবর্তী সীমারেখাটি ক্ষীণ হয়ে আসে।[২৯]

বেশিরভাগ রোম্যান্স উপন্যাসই একেবারে সমসাময়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়। ফলে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের পাঠকদের কাছে বইটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং তা আউট অফ প্রিন্ট হয়ে যায়।[২৯] যে বইগুলি সময়ের চোখে অমরত্ব লাভ করে, তারাও ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক রোম্যান্সের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। যেমন, জেন অস্টিন রচিত উপন্যাসগুলি।[২৮]

২০০৪ সালের হিসেব অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত রোম্যান্স উপন্যাসের অর্ধেকের বেশিই সমসাময়িক রোম্যান্স (২,২৮৫টি বইয়ের মধ্যে ১,৪৬৮টি বই)।[৩০] কেলি রিপা দুইবার তার রিডিং উইথ রিপা বুক ক্লাবে ফিচার করার উদ্দেশ্যে সমসাময়িক রোম্যান্সকে নির্বাচন করেছিলেন।[৩১]

ঐতিহাসিক রোম্যান্স

ঐতিহাসিক রোম্যান্সের পটভূমি রচিত হয় প্রাক-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালে।[২৭] রিজেন্সি রোম্যান্স সহ একাধিক অন্যান্য উপবর্গসমূহও এই উপবর্গটির অন্তর্গত। ঐতিহাসিক রোম্যান্স উপন্যাসগুলি হার্ডকভারে খুব কমই প্রকাশিত হয়। প্রতিবছর এই স্ট্যাটাসে প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা হয় পনেরোরও কম এবং এই ফরম্যাটে প্রকাশিত সমসাময়িক রোম্যান্সের এক-পঞ্চমাংশ। ঐতিহাসিক রোম্যান্সগুলি যেহেতু মাস-মার্কেট অর্থাৎ সাধারণ বাজারের ফরম্যাটেই প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত হয়, তাই এগুলির ভাগ্যও সাধারণ বাজারের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ীই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। গ্রন্থবিক্রেতা ও বড় ব্যবসায়ীরা মাস-মার্কেট পেপারব্যাক প্রকাশের তুলনায় বাণিজ্যিক পেপারব্যাক ও হার্ডকভার প্রকাশ করাই বেশি পছন্দ করেন। এর ফলে সাধারণ বাজারের মূল্যে ঐতিহাসিক রোম্যান্স বড় একটা দেখা যায় না।[৩২]

২০০১ সালে ঐতিহাসিক রোম্যান্সের বিক্রি পূর্ববর্তী দশ বছরের মধ্যে সর্বাধিক ছিল। এই বছর ৭৭৮টি রোম্যান্স প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে এই সংখ্যাটি ৪৮৬তে নেমে আসে। যদিও এই সংখ্যা এখনও সামগ্রিকভাবে বিক্রিত রোম্যান্স উপন্যাসের ২০%। কেন্সিংটন বুকস দাবি করছে, তারা ঐতিহাসিক রোম্যান্সের প্রতি সাড়া খুব কমই পাচ্ছেন এবং এই ধারায় তাদের আগের লেখকরা এখন সমসাময়িক রোম্যান্স ধারায় চলে আসছেন।[৩০][৩২]

রোম্যান্টিক সাসপেন্স

রোম্যান্টিক সাসপেন্সে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে একটি ষড়যন্ত্র বা রহস্যের সমাধান করতে হয়।[২৭] সচরাচর দেখা যায়, নায়িকা নিজে অপরাধ বা অপরাধপ্রচেষ্টার শিকার হয় এবং নায়কের সঙ্গে একযোগে সে কাজ করে। নায়কের মূল কাজ হয় নায়িকার কাজে তাকে রক্ষা করা এবং সচরাচর নায়ক হন কোনো পুলিশ অফিসার, এফবিআই এজেন্ট, দেহরক্ষক বা নেভি সিল।[৩৩][৩৪] উপন্যাসের শেষ দিকে রহস্যের সমাধান হয়ে যায়। আর ততদিনে নায়ক-নায়িকার সম্পর্কটিও পাকাপোক্ত প্রণয়সম্পর্কে পরিণত হয়।[৩৩] প্রাথমিকভাবে এই উপন্যাসগুলি সমসাময়িক পটভূমিতে রচিত হয়। কিন্তু আমান্ডা কুইকের মতো কয়েকজন ঔপন্যাসিক ঐতিহাসিক সময়কাঠামোতেও এই ধরনের উপন্যাস লিখেছেন।[৩৫]

অন্যান্য সকল প্রকার রোম্যান্স উপন্যাসের মতো রোম্যান্টিক সাসপেন্সেও কাহিনির কেন্দ্রে থাকে প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে প্রণয়সম্পর্ক গড়ে ওঠার গল্প। এই সম্পর্কটিকে “প্রত্যেক সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব বিস্তার করতে হয় যাতে সাসপেন্সের মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। কাহিনির গতির জন্য সেটি খুবই প্রয়োজনীয়। অপর দিকে সাসপেন্সের ঘটনাগুলিকেও সম্পর্কের উপর প্রভাব বিস্তার করতে হয় যাতে কাহিনির গতি মসৃণ হয়।” [৩৬] রোম্যান্টিক উপন্যাসের ভাষা হয় সাধারণত অধিক ‘পরিষ্কার’। সাধারণ রোম্যান্সে যে ‘আবেগপূর্ণ, ঘনিষ্ঠ’ ভাষা প্রায়ই ব্যবহার করা হয়, এখানে তা করা হয় না।[৩৬] রহস্যটি যেহেতু প্লট-সংগঠনে অধিক গুরুত্বের অধিকারী হয়, সেহেতু গল্পগুলিও চরিত্রপ্রধান না হয়ে, অধিক পরিমাণে কাহিনিপ্রধান হয়।[৩৬]

১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে লেখা দশটি রোম্যান্টিক সাসপেন্স উপন্যাসে মেরি স্টিউয়ার্ট রোম্যান্স ও রহস্যের এই সংমিশ্রণটি সুনিপূণ করে তোলেন। স্টিউয়ার্ট তাদের প্রথম ঔপন্যাসিক, যাঁরা রহস্যের পূর্ণ আবহ বজায় রেখে একটি প্রেমকাহিনি খাড়া করার দুটি ধারাকে এক করে লিখতেন।[৩৭] তার উপন্যাসে রহস্য সমাধানের প্রণালীটি কেবল “আলোকিত করতে সাহায্য করত” নায়কের চরিত্র এবং নায়িকার তার প্রতি অনুরক্ত হওয়াকে।[৩৮]

অতিলৌকিক রোম্যান্স

অতিলৌকিক রোম্যান্স উপন্যাসে কল্পকাহিনি ও কল্পবিজ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটে। কল্পকাহিনি আবহ আমাদের পরিচিত জগতের বিপরীতে একটি বিকল্প জগৎ সৃষ্টি করে করা হয়ে থাকে। এই জগতে দেখা যায় ভ্যাম্পায়ার, দৈত্যদানব এবং/অথবা নেকড়েমানবদের। কখনও কখনও কাহিনির স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য বিশেষ মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, জাদুকর বা ভূতেদের নিয়েও উপন্যাস রচিত হয়। সময়-পর্যটন, ভবিষ্যতের কাহিনি বা গ্রহান্তরীদের কাহিনি নিয়ে রচিত রোম্যান্সগুলিও এই অতিলৌকিক বর্গের অধীনস্থ।[২৭][৩৯]

অনেক সময় কল্পকাহিনি থিমের মধ্যেই সাসপেন্স, রহস্য বা চিক লিট জাতীয় অন্যান্য উপবর্গের সঙ্গে এই রোম্যান্সকাহিনিগুলির সংমিশ্রণ ঘটে যায়।[৪০] কিছু কিছু অতিলৌকিক উপন্যাস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়। এগুলির গঠন অনেকাংশেই ঐতিহাসিক রোম্যান্সের মতো। অন্যান্য উপন্যাসগুলি রচিত হয় ভবিষ্যতের পটে, কখনও কখনও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতের প্রেক্ষাপটে। তবুও অন্যান্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সময়-পর্যটনের উপাদান থেকেই যায়, কারণ নায়ক বা নায়িকা অনেক সময় ভবিষ্যতে বা অতীতে ভ্রমণ করে।[৬] ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত অতিলৌকিক রোম্যান্স উপন্যাসের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে বছরে হয় ১৭০টি। এই ধারায় একটি জনপ্রিয় বইয়ের ৫০০,০০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়।[৪১]

অনেক অতিলৌকিক রোম্যান্সেই অতিজাগতিক ও জাদুশক্তিসম্পন্ন মানুষ ও অন্যান্য জীবের পাশাপাশি সমসাময়িক মার্কিন জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। কখনও এর মাঝে জাদুসচেতন এক বৃহত্তর সমাজের উল্লেখ পাওয়া যায়, আবার কখনও তা যায় না। কোনো কোনো অতিলৌকিক উপন্যাসে সাধারণ কল্পবিজ্ঞান বা কল্পকাহিনির মতো সৃজিত বিকল্প জগতের প্রতি মনোযোগ কম দেওয়া হয়, যাতে কাহিনির মূল থিম রোম্যান্সকে প্রাধান্য দেওয়া যায়।[৩৫] অন্যান্য উপন্যাসগুলিতে সুপরিকল্পিত জাদুব্যবস্থা ও অমানুষিক সংস্কৃতির মিশ্রণ এমন সুচারুভাবে করা হয় যে তারা বিকল্প বাস্তবতার আশ্চর্য জগৎ সৃষ্টি করে।

কল্পবিজ্ঞান রোম্যান্স

কোনো মূলধারার রোম্যান্স প্রকাশকের দ্বারা প্রকাশিত প্রথম ভবিষ্যকাহিনিমূলক রোম্যান্স হল জেইন অ্যান ক্রেনজ রচিত সুইট স্টারফায়ার। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি ছিল পৃথক একটি ছায়াপথের পটভূমিতে রচিত একটি “ক্ল্যাসিক রোড ট্রিপ রোম্যান্স”।[৪২] ২০০০ সালের পর থেকে এই উপবর্গটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ক্রেনজ মনে করেন এই ধারায় উপন্যাসগুলির জনপ্রিয়তার কারণ হল এগুলি “মূলত ধ্রুপদী ঐতিহাসিক উপন্যাস যা পৃথক কোনো জগতের পটভূমিকায় রচিত।” [৪২]

কল্পবিজ্ঞান রোম্যান্স এমনই একটি কাহিনিধারা যা রোম্যান্সের পাশাপাশি কল্পবিজ্ঞান কাহিনি হিসেবেও অভিহিত হতে পারে।

ফ্যান্টাসি রোম্যান্স

রোম্যান্স কল্পকাহিনির অপর নাম রোম্যান্টিক ফ্যান্টাসি। এটি কল্পকাহিনিমূলক সাহিত্যের একটি উপবর্গ। এই ধরনের লেখায় রোম্যান্স উপন্যাসের অনেক উপাদান ও প্রথা অনুসরণ করে কল্পকাহিনি লেখা হয়ে থাকে। রোম্যান্টিক ফ্যান্টাসি রোম্যান্স ও কল্পকাহিনি উভয় শাখার প্রকাশকেরাই প্রকাশ করে থাকে। কোনো কোনো প্রকাশক “ফ্যান্টাসি রোম্যান্স”কে কল্পকাহিনির উপাদানের ভিত্তিতে লেখা সমসাময়িক রোম্যান্স এবং “রোম্যান্টিক ফ্যান্টাসি”কে অধিকতর ফ্যান্টাসি উপাদানের উপর আরোপিত-গুরুত্ব কাহিনি হিসেবে চিহ্নিত করে উভয়ের মধ্যে পার্থক প্রতিপাদন করেন।[৪৩]

সময়-পর্যটনমূলক রোম্যান্স

ধ্রুপদী “জলের বাইরে মাছ” ধাঁচের গল্পগুলির একটি পাঠ হল সময়-পর্যটনমূলক রোম্যান্স। এই ধরনের গল্পে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নায়িকা একালের মেয়ে এবং সে অতীতকালে ভ্রমণ করছে নায়কের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। খুব অল্প ক্ষেত্রে দেখা যায়, অতীতবাসী নায়ক সময় ভ্রমণ করে ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে নায়িকার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। একটি সফল সময়-পর্যটনমূলক রোম্যান্স লিখতে গেলে চরিত্রগুলিকে দিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা অনুসারে যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করাতে হবে। যে জগতে চরিত্রগুলি বাস করে এবং যে জগতে তারা যাত্রা করছে সেই দুই জগতের রূপগত ও বৌদ্ধিক পার্থক্যগুলি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো কোনো ঔপন্যাসিক এই ধরনের উপন্যাসের শেষে দেখান যে চরিত্রগুলি বিভিন্ন সময়কালে বন্দী হয়ে পড়েছে ও তারা মিলিত হতে পারছে না। এই ধরনের সমাপ্তি পাঠকদের অসন্তোষের কারণ হয়।[৪৪]

অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স

বর্তমান বাজারে বিদ্যমান অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স উপন্যাসগুলি খ্রিস্টান ভাবধারা ও প্রণয়সম্পর্কের বিকাশ কেন্দ্রিক কাহিনির সংমিশ্রণ।[২৭] ২০০৪ সালে, এই উপবর্গে ১৪৭টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল।[৩০] এই উপন্যাসে সাধারণত অপ্রয়োজনীয় হিংসাত্মক কার্যকলাপ বা অশ্লীল বাক্যাদি ব্যবহৃত হয় না। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির প্রণয় হয় সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। যৌনতার উল্লেখ যদি বা থাকে, তবে তা ঘটে বিবাহের পর এবং তার বিস্তারিত বর্ণনাও বাদ রাখা হয়। অনেক উপন্যাসেই নায়ক বা নায়িকার বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়। যার হলে প্রেমকাহিনিটি পরিণত হয় “নায়ক, নায়িকা ও ঈশ্বরের সহিত তাদের সম্পর্ক নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ত্রিভূজ”-এ।[৪৫] ক্ষমা, সততা ও বিশ্বাস এই উপবর্গের সাধারণ কয়েকটি থিম।[৪৬]

১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর শিলোট তাদের শিলোট ইন্সপিরেশন্যাল লাইন প্রকাশ করলে প্রথম অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স প্রকাশিত হয়। বইগুলির লক্ষিত পাঠক ছিলেন পুনর্জাত খ্রিস্টানরা এবং বইগুলি পাওয়া যেত কেবলমাত্র ধর্মীয় পুস্তকের দোকানে। ১৯৮৪ সালে শিলোট অলাভজনক ঘোষিত হলে হার্লেকুইন শিলোট অধিগ্রহণ করে। তখন শিলোট ইন্সপিরেশন্যাল লাইনও বন্ধ হয়ে যায়।[৪৭] যদিও খ্রিস্টান প্রকাশকেরা ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক রোম্যান্স উপন্যাস প্রকাশ করতে থাকেন।

বহুকৃষ্টিগত রোম্যান্স

বহুকৃষ্টিগত রোম্যান্স সাধারণত গড়ে ওঠে কোনো আফ্রিকান-আমেরিকান নায়ক অথবা/এবং নায়িকাকে কেন্দ্র করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এশীয়, হিসপ্যানিক বা আন্তঃজাতিগত সম্পর্ককে কেন্দ্র করেও এই ধরনের কাহিনি গড়ে উঠতে দেখা যায়।[৪৮] ১৯৯৪ সালে কেনসিংটন বুকস প্রথম বহুকৃষ্টিগত রোম্যান্স উপন্যাসের লাইন অ্যারাবেস্ক প্রকাশ করেন। ১৯৯৮ সালে বিইটি বুকস এই লাইনটি কিনে নেন এবং প্রতিবছর তাদের প্রকাশিত উপন্যাসের লেখকের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে। বিইটি কিছু কিছু অ্যারাব্যাস্ক উপন্যাসকে টেলিভিশনের উপযুক্ত চলচ্চিত্রেও ধরে রেখেছে।[৪৯]

১৯৯৯ সালে কেনসিংটন প্রথম লাতিনো রোম্যান্স উপন্যাসের লাইন এনক্যান্টো প্রকাশ করেন। এনক্যান্টো উপন্যাসগুলি দু-ভাবে প্রকাশিত হত – ইংরেজি/স্প্যানিশ দ্বিভাষিক সংস্করণ ও শুধুমাত্র স্প্যানিশ সংস্করণ। ২০০১ সালে লাইনটি থামিয়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত মাসে দুটি করে উপন্যাস প্রকাশিত হত। লাইনটির অবলুপ্তির পরেও সিলভিয়া মেন্ডোজা, ট্রেসি মন্টোয়া, ক্যারিড্যাড পিনেরো, বার্টা প্ল্যাটাস, লারা রিওস ও লিন্ডা স্যান্ডোভ্যালের মতো এনক্যান্টো ঔপন্যাসিকেরা এই ধারায় উপন্যাস লিখে চলেন।

এই ধরনের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে আফ্রিকান-আমেরিকান বা হিসপ্যানিকরা জনপ্রিয় হলেও এশীয় বা এশীয়-আমেরিকানদের নিয়ে কমই উপন্যাস লেখা হয়। লেখক টেস গেরিটসেন মনে করেন, এর কারণ এশীয়-আমেরিকান মহিলারা রোম্যান্স কম পড়েন: “প্রেমের ভাল দিকটি অনুভব করার জন্য আমরা রোম্যান্স পড়ি... এটা করতে হলে নায়িকার সঙ্গে পাঠিকার নিজের চরিত্রগত মিলটি খুঁজে পাওয়া আবশ্যক।” [৫০]

ইরোটিক রোম্যান্স

ইরোটিক রোম্যান্সকে কখনও কখনও রোম্যান্স ও ইরোটিকার মিশ্রণে রোম্যান্টিকাও বলা হয়। ইরোটিক রোম্যান্স উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হল তীব্রভাবে যৌন-উদ্দীপক বিষয়বস্তু। যদিও অন্যান্য রোম্যান্স উপবর্গগুলির উপাদানও এতে বিদ্যমান থাকে। ইরোটিকা রোম্যান্সের ভাষা অনেক বেশি খোলামেলা। সাধারণ উপন্যাসে যে অপ্রিয় বাক্যপ্রয়োগের বদলে কোমল উক্তি প্রয়োগ করা হয়, তা এই সব উপন্যাসে এড়িয়েই চলা হয়। এই ধরনের উপন্যাসে অধিক মাত্রায় যৌনদৃশ্য সংযোজিত থাকে। সনাতন প্রেমের দৃশ্যায়নের বদলে যৌনাচরণের দৃশ্যায়নকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেক অপ্রচলিত কার্যকলাপের দৃশ্যও সংযোজিত হয়।[৫১] তবে যৌন দৃশ্যায়নের এই প্রবণতা সত্ত্বেও পর্নোগ্রাফির সঙ্গে এই ধারাটিকে এক করে ফেলা উচিত নয়। কারণ পর্নোগ্রাফির একমাত্র উদ্দেশ্য যৌন দৃশ্যায়ন। অন্যদিকে ইরোটিক রোম্যান্সে যৌন দৃশ্যায়নের পাশাপাশি সুবিন্যস্ত চরিত্রায়ন ও কাহিনিবিন্যাস দেখা যায়।[৫২]

ইরোটিক রোম্যান্সের দৈর্ঘ্য হয় ছোটোগল্প থেকে সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্সের দৈর্ঘ্য পর্যন্ত। কোনো কোনো উপন্যাস ক্যাটেগরির অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়। যেমন হারলেকুইনের ব্লেজ। আবার কোনো কোনো উপন্যাস সংকলনের অংশ হিসেবে বের হয়। এগুলির আকার হয় বড়োগল্পের মতো। যদিও সিঙ্গল টাইটেল ইরোটিক রোম্যান্সও বড়োগল্পের মতো ক্ষুদ্রাকার হতে পারে।[৫১] বেশ কয়েকটি প্রকাশক সংস্থা বর্তমানে ইরোটিকা উপন্যাস প্রকাশ করছেন: ব্ল্যাক ল্যাশ, সামহেইন পাবলিশিং, অ্যাভন রেড, স্পাইস ও ইলোরাজ কেভ।

ইরোটিক রোম্যান্সের অনেক প্রকাশকই হয় ছোটো প্রেসের প্রকাশক অথবা ইলেকট্রনিক বই প্রকাশক। কোন কোন ধরনের যৌন কার্যকলাপ গল্পে সংযোজন করা যায়, সেই প্রসঙ্গে ছাপাখানার প্রকাশকদের তুলনায় ইলেকট্রনিক প্রকাশকদের সঙ্গেই লেখকরা অনেক বেশি খোলামেলা হন।[৫১] এই ধরনের রোম্যান্সের বাজার দ্রুতহারে বাড়ছে, তাই অনেক প্রকাশকই এই ধারায় নতুন নতুন লাইন বাজারে আনছেন।[৫৩] তবে ইরোটিক রোম্যান্সের ক্ষেত্রেও সমস্ত প্রকাশকের কাছেই কয়েকটি বিষয় নিষিদ্ধ। যেমন, শিশুকাম, অজাচার বা আত্মীয়দের সঙ্গে যৌনাচরণ এবং পশুকাম।[৫১] ইলেকট্রনিক গ্রন্থ প্রকাশক ইলোরাজ কেভ রোম্যান্স রাইটার্স অফ আমেরিকা দ্বারা বিধিবদ্ধ প্রকাশক হিসেবে নিবন্ধীকৃত প্রথম ইলেকট্রনিক গ্রন্থ-প্রকাশক।[৫২]

ইতিহাস

বিকাশলাভ

স্যামুয়েল রিচার্ডসন রচিত পামেলা, অর ভার্চু রিওয়ার্ডেড প্রথম যুগের রোম্যান্স উপন্যাসগুলির অন্যতম। ১৭৪০ সালে প্রকাশিত পামেলা ছিল কোর্টশিপের ভিত্তিতে নায়িকার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি ছিল মিলনান্তক। উল্লেখ্য, সেই যুগে অনেক উপন্যাসই কিন্তু মিলনান্তক হত না। যা হোক, বইটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। প্রথম কয়েক মাসে এর পাঁচটি সংস্করণ মুদ্রিত হয়।[৫৪] যদিও রোম্যান্স উপন্যাস বর্গটি উনিশ শতকের আগে তার পূর্ণাঙ্গ রূপটি গ্রহণ করেনি।[৩]

অনেকেই মনে করেন, জেন অস্টিন ছিলেন রোম্যান্স উপন্যাসধারার এক অন্যতম শক্তিশালী সাহিত্যিক। ১৮১৩ সালে প্রকাশিত তার প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস উপন্যাসটি “সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রোম্যান্স উপন্যাস” হিসেবে বিবেচিত হয়।[৫৫] সমালোচকগণ যদিও এই মর্মে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন যে অস্টিনের রচনা চিরাচরিত লিঙ্গবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখা, যেখানে মেয়েদের বাধ্যতামূলকভাবে বিয়ে করতে হত।[৫৬] ব্রন্টি ভগিনীদের উপন্যাসগুলিও অস্টিনের ধারাতেই রচিত। ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত শার্লট ব্রন্টি রচিত জেন আয়ার উপন্যাসের নায়িকা ছিল এক অনাথা কিশোরী। গথিক সাহিত্য ও এলিজাবেথীয় নাট্যধারার মিশ্রণে রচিত জেন আয়ার “রোম্যান্স উপন্যাস রূপটির নমনীয়তারই পরিচায়ক”।[৫৭]

উনিশ শতকের পরেও এই ধারার জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকে। ১৯১৯ সালে যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত হয় এডিথ মড হুল রচিত উপন্যাস দ্য শেখ উপন্যাসটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে এটির চলচ্চিত্রায়ন করা হয়। ছবিটিতে অভিনয় করেন সে যুগের বিশিষ্ট অভিনেতা রুডলফ ভ্যালেনটিনো। এই উপন্যাসের নায়ক ছিল এক শ্লেষাত্মক আলফা পুরুষ যে নায়িকে অপহরণ করে জোর জবরদস্তির মাধ্যমে তার ভালবাসা জয় করে। প্রথম যে সব উপন্যাসে ধর্ষণ কল্পনা বা রেপ ফ্যান্টাসির দেখা মেলে, এই উপন্যাসটি তার মধ্যে অন্যতম। যদিও মেয়েরা ব্যক্তিজীবনে অনেক স্বাধীনতা সেই সময় পেতে শুরু করেছিল, তবুও প্রকাশকেরা মনে করত প্রাক্-বিবাহ যৌনতা একমাত্র ধর্ষণের ক্ষেত্রেই পাঠকগ্রাহ্যতা পেতে পারে। তাই এই উপন্যাসে ও এর অনুগামী উপন্যাসগুলিতে ধর্ষণকে একটি ফ্যান্টাসির আকারেই দেখানো হত। নায়িকার দ্বারা অনুভূত ভয়, উদ্বেগ ও ত্রাসের মাধ্যমেই তার প্রতিফলন ঘটত।[৫৮]

১৯১১ সালে ঐতিহাসিক রোম্যান্সের আবির্ভাব ঘটে। এই সময় জর্জেট হেয়ের ইংলিশ রিজেন্সির (১৮১১ – ১৮২০) প্রেক্ষাপটে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, এই সময়ে যুবরাজ রিজেন্ট তার অসুস্থ পিতা তৃতীয় জর্জের হয়ে রাজত্ব চালাচ্ছিলেন। হেয়ের অস্টিনের উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হন। অস্টিনও রিজেন্সির সময়কালে উপন্যাস লিখেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি তার নিজের সময়কালের সমাজ ও জীবনকেই সাহিত্যে প্রতিফলিত করেছিলেন, সেই হেতু তার রচনা সমসাময়িক রোম্যান্স হিসেবে গণ্য হত। তার হেয়ের যেহেতু তার সময়ের একশো বছর আগে তার কাহিনিকে নিয়ে ফেলেছিলেন, সেই হেতু পাঠকদের সুবিধার্থে তাকে অনেক বেশি বিস্তারিত বর্ণনা সংযোজিত করতে হত।[৫৯] এই পটভূমিটি হেয়ের কাহিনিবিন্যাসের অঙ্গ হিসেবেই স্থাপন করতেন, যা সেই সময়ের উপন্যাসে প্রচলিত ছিল না। তার চরিত্রগুলি কতকটা আধুনিক ভাবাপন্ন হত এবং সনাতন ধাঁচের চরিত্রদের দেখা যেত প্রেমের জন্য বিয়ে করতে চাওয়ার নায়িকার যে বাসনা তাকে পাগলামি বলে অভিহিত করতে।[৬০] হেয়ের ছিলেন বহুপ্রসূ লেখিকা। ১৯৭৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বছরে একটি অথবা দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে গেছেন তিনি।[৬১]

ক্যাটেগরি রোম্যান্সের উত্থান

১৯৩০-এর দশকে মিলস অ্যান্ড বুন হার্ডব্যাক রোম্যান্স উপন্যাস ছাপতে শুরু করে। সপ্তাহে দুই-পেনি লাইব্রেরিগুলির মাধ্যমে এই বই ব্রিক্রি হতে থাকে। বাদামি রঙের মলাটের জন্য বইগুলিকে “বুকস ইন ব্রাউন” বা “বাদামি বই” বলে অভিহিত করা হত। ১৯৫০-এর দশকে সমগ্র যুক্তরাজ্য জুড়ে কোম্পানি বইগুলি সংবাদপত্রবিক্রেতাদের মাধ্যমে বিক্রি করতে থাকে।[৬২]

১৯৫৭ সালে মিলস অ্যান্ড বুন প্রকাশিত বইগুলি উত্তর আমেরিকায় পরিবেশনার দায়িত্ব নেয় হার্লেকুইন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামে এক কানাডিয়ান কোম্পানি।[৬৩] হার্লেকুইনের প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড বনিক্যাসলের স্ত্রী মেরি বনিক্যাসল ও কন্যা জুডি বার্জেস হার্লেকুইন দ্বারা পুনঃপ্রকাশিত মিলস অ্যান্ড বুনের উপন্যাসগুলির উপর সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী ছিলেন। তাদের একটি “শ্লীলতা বিধি” বা “ডিসেন্সি কোড” ছিল। মিলস অ্যান্ড বুনের দেওয়া অধিক যৌন-উদ্দীপক বইগুলি তারা ছাপতেন না। এই ধারার জনপ্রিয়তার দিকটি দেখার পর রিচার্ড বনিক্যাসল একটি রোম্যান্স উপন্যাস পড়ার সংকল্প নেন। তিনি যে বইটি বেছে নেন সেটি বেশ খোলামেলা বিষয়ের উপর রচিত ছিল এবং তিনিও বইটি উপভোগ করেছিলেন। তার নির্দেশে কোম্পানি বইটি সম্পর্কের বাজারের রুচি যাচাই করে দেখে। তারা আবিষ্কার করেন একই ধরনের একটি ভদ্র উপন্যাসের চেয়ে এর জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।[৬৪] সর্বোপরি, উপন্যাসগুলি ছোটো ও ঘনপিনদ্ধ। এর নায়িকারা মিষ্টি, অনুভূতিপ্রবণ, পবিত্র ও নিষ্পাপ। দু-একজন নায়িকা যদি বা কর্মরত হন, তাদের কর্ম হয় মেয়েদের চিরকালীন কাজ; যেমন, নার্সিং, গভর্নেস বা সেক্রেটারির কাজ। প্রধান চরিত্রগুলির সতীসাধ্বী চুম্বন ছাড়া ঘনিষ্ঠতার কোনো বাড়াবাড়িও দেখা যেত না।[৬৩]

১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর হার্লেকুইন মিলস অ্যান্ড বুন কিনে নেয়। এর প্রেক্ষিতে গ্রেট ব্রিটেনে রোম্যান্স উপন্যাস ধারাটি “অধিক আগ্রহশীল পাঠকের কাছে পরিবেশিত ও জনপ্রিয় হয়।” উত্তর আমেরিকায় মিলস অ্যান্ড বুনের জনপ্রিয়তার ধারাটি নকল করার লক্ষ্যে হার্লেকুইন পরিবেশনা ও বাজারকরণের পদ্ধতিটি সমুন্নত করে তোলে।[৬৫] “যেখানেই মহিলারা” সেখানেই তারা বই বিক্রি করার পন্থা নেয়। ফলে অনেক মাস-মার্কেট মার্জেন্ডাইজার ও সুপারমার্কেটও বই বিক্রি করতে শুরু করে। বইগুলির সবকটিই ঠিক ১৯২ পাতার হতো। এর পরে হার্লেকুইন পাঠক পরিষেবা বা রিডার সার্ভিস শুরু করে। এর মাধ্যমে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সংখ্যায় বই কিনতে ইচ্ছুক পাঠকদের কাছে সরাসরি বই বিক্রি করা হতে থাকে।[৬৬]

আধুনিক রোম্যান্সের জন্ম

১৯৭২ সালে অ্যাভন বুকস ক্যাথলিন উডিউইস রচিত দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ার প্রকাশ করলে আধুনিক রোম্যান্সের জন্ম হয়। এটিই ছিল “শয্যাকক্ষের নীতি (অনুসরণকারী) প্রথম উপন্যাস”।[৬৭][৬৮] উপাদান ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণে বইটি ছিল যুগান্তকারী। এটিই প্রথম সিঙ্গল টাইটেল রোম্যান্স যা ক্যাটেগরি রোম্যান্সের রীতি লঙ্ঘন করে হার্ডব্যাকের বদলে প্রথমে পেপারব্যাক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। ঔষধ-বিক্রেতা এমনকি অনেক সাধারণ দোকানিও বইটি দোকানে রাখতেন।[৬৯] বইটির ২.৩৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল।[৭০] এর পরপরই অ্যাভন উডিউইসের দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য উলফ অ্যান্ড দ্য ডোভ এবং নবাগত রোজমেরি রজার্স রচিত দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে ১৯৭৪ সালে। রজার্সের উপন্যাসদুটির মধ্যে একটি ছিল ডার্ক ফায়ারস। প্রথম তিন মাসে বইটির দুই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। ১৯৭৫ সালের পাবলিশার্স উইকলি প্রদত্ত রিপোর্ট অনুসারে "অ্যাভন ওরিজিন্যাল" উপন্যাসগুলি সম্মিলিতভাবে ৮ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়।[৬৯] পরের বছর প্রকাশিত ১৫০টি ঐতিহাসিক রোম্যান্সের ৪০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়।[৭০] এগুলির অনেকগুলিই ছিল পেপারব্যাক।

এই উপন্যাসগুলির জনপ্রিয়তা নতুন ধরনের রোম্যান্স লেখার প্রবণতার জন্ম দেয়। এগুলির দৃষ্টি প্রাথমিকভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাসে নিবদ্ধ থাকত। নায়কের কারণে নায়িকা এখানে বিপদে পড়ত। এবং নায়কই নায়িকাকে বিপন্মুক্ত করে আনত। নায়ক ও নায়িকার একগামী কাহিনিই এখানে মূল উপজীব্য ছিল।[৭] এই উপন্যাসগুলির প্রচ্ছদে দেখা যেত স্বল্পবাস নায়িকাকে নায়ক জড়িয়ে ধরে আছে। সেই কারণে এই বইগুলিকে বলা হয় “বডিশ-রিপার” বা “উর্ধ্ববাস-ছিন্নকারী”।[৬৭] ১৯৮০ সালে একটি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল নিবন্ধে এই ধরনের বডিশ রিপার সম্পর্কে বলা হয় : “বিগ ম্যাককে দেওয়া প্রকাশকের উত্তর: এগুলি রসালো, সস্তা, গতানুগতিক এবং এগুলির ভক্তেরা এগুলিকে গোগ্রাসে পড়ে।” [৭১] অনেক রোম্যান্স প্রকাশনা শিল্পে এখন এই বডিশ-রিপার শব্দটি ঘৃণাবাচক বলে বিবেচিত হয়।[৬৭]

এই ধরনের নতুন ঐতিহাসিক রোম্যান্সে নায়িকারা ছিলেন স্বাধীন ও দৃঢ়চেতা। এদের নায়কেরা অনেক সময়েই হতেন সেই ধরনের পুরুষ যারা ভালবাসতে জানেন ও অনুভূতিপ্রবণ।[৭২] এটি সমসাময়িক রীতির লঙ্ঘন বলে গণিত হত। প্রচলিত রীতিতে দেখা যেত দুর্বল মেয়েরা বদরাগী আলফা পুরুষদের প্রেমে পড়ছে।[৭৩] প্লটে এই নায়িকাদের ভূমিকা মুখ্য হলেও “নায়কের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরা ছিল গৌণ”।[৭৪] সমগ্র উপন্যাসধারায় দেখা যেত নায়িকাদের বয়স ষোলো থেকে একুশের মধ্যে ও নায়কের বয়স তিরিশের কাছাকাছি। মেয়েরা ছিল কুমারী, যদিও পুরুষেরা কৌমার্যের ধার ধরত না। আর যুগলের দুই জনই হত সুদর্শন।[৭৫]

ক্যাটেগরি রোম্যান্সের রূপান্তর

ঐতিহাসিক রোম্যান্স উপবর্গটিকে স্থানচ্যুত করা কয়েকটি পরিবর্তন অনেক দেরিতে ক্যাটেগরি রোম্যান্সে গৃহীত হয়েছিল। একটি উত্তর আমেরিকান কোম্পানি মিলস অ্যান্ড বুন কিনে নিলেও এই ধারায় ১৯৭৫ সাল অবধি কোনো আমেরিকান লেখক উঠে আসেননি। এরপরই হার্লেকুইন জেনেট ডেইলে রচিত একটি উপন্যাস কিনে নেয়।[৭৬][৭৭] ডেইলের রোম্যান্স উপন্যাস সম্পর্কে বলা হয় এগুলি “মার্কিন অনুভূতি, ধ্যানধারণা, ইতিহাস, এবং সর্বোপরি মার্কিন প্রেক্ষাপটে লেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংঘটিত নায়ক, নায়িকা এবং কোর্টশিপের উপর আধারিত প্রথম রোম্যান্স।” [৭৮] এই ধরনের বইয়ের বাজার চাহিদা কি হবে তা নিয়ে হার্লেকুইনের দ্বিধা ছিল। তাই এই ধারাটিকে তারা সেইভাবে গ্রহণ করেনি। সত্তরের দশকের শেষের দিকে হার্লেকুইনের সম্পাদক সেই সময়কার সেরা বেস্টসেলিং লেখকদের একজন নোরা রবার্টস রচিত একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি এই মর্মে প্রত্যাখ্যান করে যে তাদের নিজস্ব মার্কিন লেখক আছে।[৭৯]

১৯৮০ সালে সিমোন অ্যান্ড স্কাস্টার একযোগে স্থাপন করে শিলোট বুকস। মার্কিন লেখকদের অনালোকিত প্রতিভার সুযোগ গ্রহণ করে তারা।[৮০] তারা অনেকগুলি ক্যাটেগরি রোম্যান্স চালু করে এবং অনেক বেশি দৃঢ়চেতা নায়িকা ও অপেক্ষাকৃত কম কর্তৃত্ববাদী নায়কদের সম্পর্কে লিখতে লেখকদের উৎসাহিত করে। স্থান বুঝে সমসাময়িক ইস্যুগুলিও তুলে ধরার কথা লেখকদের বলা হয়।[৮১] শিলোটের মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৪ সালে হার্লেকুইন তাদের কিনে নেয়। অধিগ্রহণ সত্ত্বেও শিলোট তাদের সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এবং বেশ কয়েকটি লাইন নিজেদের মুদ্রণ থেকে প্রকাশ করে।[৬৫]

পাঠকেরা যে অনেক খোলামেলা যৌনদৃশ্য সংবলিত রোম্যান্সের দিকে ঝুঁকছিল তা বুঝতে পারেনি হার্লেকুইন। ১৯৮০ সালে অনেক প্রকাশক ক্যাটেগরি রোম্যান্সের লাইনে চলে আসে এই ফাঁকটি পূরণ করার জন্য। এই বছর ডেল এমি লরিন রচিত দ্য টাউনি গোল্ড ম্যান সহ ক্যান্ডেললাইট এক্সট্যাসি লাইন প্রকাশ করেন। নায়িকাকে সতী হতেই হবে, সেই ধারণা এই লাইন থেকেই অচল হয়ে পড়ে। ১৯৮৩ সালের শেষাশেষি ক্যান্ডেললাইট এক্সট্যাসি লাইনের বিক্রি ছিল ৩০ মিলিয়ন ডলার। শিলোটও একই রকমের দুটি লাইন বাজারে আনে – ডিজায়ার (যৌন-উদ্দীপনামূলক) ও স্পেশাল এডিশন (যৌন-উদ্দীপনামূলক ও আড়াইশো পাতা অবধি বড় গল্প)। প্রতিটির বাজারে বিক্রির হার প্রতিমাসে ছিল ৯০-১০০%।[৮২]

১৯৮২ সালের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, রোম্যান্স ধারায় নতুন ধরনের লেখালিখি অনেক নতুন পাঠককে এই ধারার দিকে টেনে আনছে। সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৭৭ সালের পর থেকে রোম্যান্স পড়া শুরু করেছেন এমন পাঠক ৩৫%। ৩১% শতাংশ পাঠক ছয় থেকে দশ বছর রোম্যান্স পড়ছেন। অর্থাৎ, তারা রোম্যান্স পড়া শুরু করেছিলেন ১৯৭২ সালে উডিউইসের বিখ্যাত উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পর থেকে। এর অর্থ রোম্যান্স পাঠকদের দুই-তৃতীয়াংশই রোম্যান্সের প্রতি আকৃষ্ট হন পরিবর্তন আসার পর থেকে।[৮৩]

ক্যাটেগরি রোম্যান্স লাইনের সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। ১৯৮৫ সাল নাগাদ ১৬টি পৃথক লাইন ৮০টি উপন্যাস প্রকাশ করে।[৮৪] এর ফলে নতুন ধারায় লেখকদের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। এবং বাজার চাহিদা তুঙ্গে থাকার ফলে প্রকাশিত উপন্যাসগুলির মানও নিম্নগামী হতে শুরু করে। ১৯৮৪ সাল নাগাদ বাজার ক্যাটেগরি লাইনে ছেয়ে যায় এবং পাঠকরা প্লট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন।[৮৫] এই তীব্র অসন্তোষের ফলে পরের বছর থেকে সিরিজ রোম্যান্স লাইনে পঠিত উপন্যাসের সংখ্যা কমে যায়।[৮৬] হার্লেকুইনের রিটার্ন রেট যা ১৯৭৮ সালে ক্যাটেগরি রোম্যান্সের মুখ্য সরবরাহকারী থাকার সময় ২৫ শতাংশের কম ছিল তা ৬০ শতাংশ হয়ে যায়।[৮৭]

পরবর্তীকালের পরিবর্তন

আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে শেষভাগ পর্যন্ত সময়কালে এই ধারাটি আরও প্রসার লাভ করে। প্রকাশকেরা অনুভব করেন, যেসব লেখকরা বর্গের সীমানা উল্লঙ্ঘন করে লেখেন, তারাই জনপ্রিয়তা পান বেশি। ১৯৮৪ সালে লাভায়ারলে স্পেনসার রচিত একটি উপন্যাসে এক স্থুলকায় মধ্যবয়সী নায়কের ছবি আঁকা হয়, যে তার জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে নায়িকার মন জয় করেছিল। ১৯৮৭ সালে লেখা ডেইলের একটি উপন্যাসে এক কুদর্শন নায়ককে দেখা যায় এবং তার নায়িকা নিজের জন্মদাত্রীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।[৮৮] ১৯৮৬ সালে জেইন অ্যান ক্রেনজ রচিত উপন্যাস সুইট স্টারফায়ার-এ প্রথম ভবিষ্যকল্প রোম্যান্সের আবির্ভাব ঘটে। এতে সনাতন রোম্যান্স সাহিত্য ও কল্পবিজ্ঞানের মিশ্রণ ঘটেছিল।[৪২] নব্বই দশকে সম্পর্কেরও আধুনিককরণ করণ। এরপর থেকে খুব কমই দেখা যায় কেউ তার ভাবী স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে।.[৭৩]

আ নাইট ইন শাইনিং আরমার, প্রথম বই যেটি মাস-মার্কেট অরিজিন্যাল থেকে হার্ডব্যাকে রূপান্তরিত হয় রোম্যান্স লেখক কর্তৃক প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে নিউ ল্যান্ডস্কেপ কভার স্টাইল।

আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে শেষভাগ পর্যন্ত সমসাময়িক রোম্যান্সে মেয়েদের বেশি করে পুরুষ-প্রাধান্যশীল কাজগুলিতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। যেমন সামুদ্রিক তৈলক্ষেত্রের ইঞ্জিনিয়ার বা মহাকাশ গবেষক ইত্যাদি। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগের নায়িকারা আবার স্বনিযুক্ত। তাদের বয়ঃসীমাও বাড়তে থাকে। ৩০ বছর, এমনকি কোথাও কোথাও ৪০ বছর বয়সী নায়িকাও দেখা যায়। নায়কের চরিত্রায়নেও পরিবর্তন ঘটে। অনেক লেখকই অধিক অনুভূতিসম্পন্ন নায়কের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। প্লটের বৈচিত্র্য বাড়লেও কিছু কিছু ট্যাবু রয়েই যায়। প্রকাশকেরা সন্ত্রাস, যুদ্ধ বা পুরুষের খেলাধুলোর মতো কিছু বিতর্কিত বিষয়ে লিখতে লেখকদের নিষেধ করতে থাকেন।[৮৯] জুলি গারউড প্রথম ঐতিহাসিক রোম্যান্সের সঙ্গে হাস্যরসকে যুক্ত করার পর রোম্যান্স উপন্যাসে হাস্যরসের উপস্থাপনাও শুরু হয় এই নব্বই দশক থেকে।[৯০]

রোম্যান্স উপন্যাস অন্যভাবেও প্রসারিত হতে থাকে।[৯১] ১৯৮৯ সালে লেখক জ্যুড ডেভেরক্স অরিজিন্যাল মাস-মার্কেট পেপারব্যাক থেকে প্রকাশিত হার্ডকভার উপন্যাসের প্রথম লেখকের শিরোপা পান। তার উপন্যাস আ নাইট ইন শাইনিং আরমার একটি “স্বাভাবিক বেস্টসেলার”-এ পরিণত হয়।[৩] অনেক লেখকই সমসাময়িক সময়কালের পটে রচিত সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্স লিখে জনপ্রিয়তা পেতে থাকেন। তাই প্রকাশন জগৎগুলিও এই বর্গের সমৃদ্ধি ঘটানোয় মন দেয়। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত বলে আধুনিক নারীর সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক বিষয় এই উপন্যাসগুলিতে উঠে আসতে থাকে; যেমন – একক পিতৃত্ব/মাতৃত্ব, দত্তক নেওয়া বা নির্যাতন।[৯১]

২০০০ সালের পর থেকে স্বল্পবাস মেয়েদের ছবির বদলে প্রচ্ছদে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি চিত্রিত হতে থাকে।[৩]

মেয়েদের কেরিয়ারের প্রসঙ্গটি বাস্তব জীবনে যেমন পালটে যেতে থাকে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পালটে যায় উপন্যাসের চরিত্রাঙ্কনও। হার্লেকুইনের প্রথম দিকের উপন্যাসগুলিতে মেয়েরা ছিল নার্স বা সেক্রেটারি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে দেখা যেতে থাকে। রোম্যান্স নায়িকারাও সেই জীবন গ্রহণ করে।[৯২] আধুনিক রোম্যান্স উপন্যাসে নরনারীর অনেক বেশি ভারসাম্যযুক্ত সম্পর্ক প্রদর্শিত হয়।[৭]

বাজার

উত্তর আমেরিকা

১৯৮২ সালে দেখা যায় সার্বিক মন্দার বাজারেও যেহেতু একনিষ্ঠ পাঠকরা প্রতি মাসে ৪০ ডলার করে রোম্যান্স উপন্যাসের পিছনে খরচ করছেন, সেই হেতু এর বাজারও পোক্ত রয়েছে।[৯৩] সেই বছর আনুমানিক ২০ মিলিয়ন পাঠক মোট ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পেপারব্যাক রোম্যান্স কেনেন। একই বছরে ৬০০ নিয়মিত রোম্যান্স পাঠকের উপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, “তারা সকল বয়স, শিক্ষা, বৈবাহিক ও আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন।” অর্ধেক পাঠিকারা অন্ততপক্ষে কলেজ স্তর অবধি পড়াশোনা করেছেন; আবার ৪০% পাঠিকা পূর্ণ সময়ের জন্য কর্মরত। ৬০% মহিলা প্রত্যেক দুই দিনে একটি করে রোম্যান্স পড়েন। পাঠিকারা মনে করেন রোম্যান্স পাঠ মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয় এবং ইতিহাস তথা নতুন নতুন কেরিয়ার সম্পর্কে অবগত হতে সাহায্য করে।[৯৪]

রোম্যান্স উপন্যাসের বাজার বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে দেখা যায় সাধারণ বাজারে বিক্রিত পেপারব্যাকের ৪৬ শতাংশই রোম্যান্স। এই বাড়বৃদ্ধির কারণ ছিল হার্লেকুইনের অত্যাগ্রহী পাঠকরা মাসে ৩০টি করে রোম্যান্স কিনতে শুরু করেছিলেন। এই সময় বেশি সংখ্যক শিক্ষিত মানুষের মধ্যে রোম্যান্স পাঠের প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে। এঁদের ৪৫ শতাংশই তখন কলেজ ডিগ্রিধারী এবং অর্ধেকের বেশি বাড়ির বাইরে কর্মরত।[৯৫]

২০০০ সাল নাগাদ আধুনিক সাহিত্যের জনপ্রিয়তম ধারা হয়ে ওঠে রোম্যান্স। ২০০৪ সালে মোট ২,২৮৫টি রোম্যান্স উপন্যাস প্রকাশিত হয় এবং মোট বাণিজ্য হয় ১.২ মিলিয়ন ডলার। ২০০৪ সালে মোট বিক্রিত পেপারব্যাকের ৫৫% ছিল রোম্যান্স এবং সকল প্রকার কথাসাহিত্যের মধ্যে রোম্যান্স বিক্রির হার সেই বছর ছিল ৩৯%। ২০০৪ সালে ৬৪ মিলিয়ন পাঠক দাবি করেছিলেন যে তারা বছরে অন্তত একটা রোম্যান্স পড়েছেন। এই সমীক্ষাটি চালান রোম্যান্স রাইটার্স অফ আমেরিকা। এবং এই সমীক্ষায় দেখা যায় ২০০১ সালের পর থেকে মোট ২৬% সার্বিক বৃদ্ধি ঘটেছে রোম্যান্সের ক্ষেত্রে। রোম্যান্স পাঠকের ২২% দেখা যায় পুরুষ এবং বিবাহিত ও অবিবাহিত এই দুই গোষ্ঠীতে সমগ্র রোম্যান্স পাঠককুলকে বিভক্ত দেখা যায়। সকল ধরনের মানুষই রোম্যান্স পড়ছিলেন তখন। তবে তাদের এক শতাংশের বয়স তখন তেরোর নিচে এবং ৪২% কমপক্ষে স্নাতক।[৩০]

আন্তর্জাতিক বাজার

হার্লেকুইন প্রতি সেকেন্ডে চারটে বই বিক্রি করে, যার অর্ধেকই বিক্রি হয় আন্তর্জাতিক বাজারে। লেখক হিথার গ্রাহাম পজেসার এর কারণ হিসেবে বলেছেন, “আবেগ খুব শীঘ্র অনূদিত হয়।” [৯৬] যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর বিক্রিত সামগ্রিক কথাসাহিত্যের ২০ শতাংশেরও বেশি রোম্যান্স।[৯৭] যদিও রোম্যান্স উপন্যাস প্রায় ৯০টি ভাষায় অনূদিত হয়,[৬৮] তথাপি এই ধারায় বেশিরভাগ লেখকই যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অল্পক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক।[৯৮] এমনকি ফ্রান্সে, যেখানে বছরে ১২ মিলিয়ন রোম্যান্স উপন্যাস বিক্রি হয়, সেখানেও বিক্রিত সব বইই অনূদিত গ্রন্থ।[৬৮] এর ফলে উপন্যাসে একটি অ্যাংলো-স্যাক্সন মানসিকতা প্রকট হয়ে পড়ে। যার ফলে ইউরোপীয় বাজারে এই বইগুলির সাফল্য মাঝে মাঝে ব্যাহত হয়। ইতালি, যে দেশ সিঙ্গল টাইটেল মুদ্রক রেড ড্রেস ইঙ্ক প্রকাশিত চিক লিটের সবচেয়ে শক্তিশালী বৈদেশিক বাজার, সে দেশেও কাউবয়দের নিয়ে লেখা গল্প খুব একটা বিক্রি হয় না; কারণ সেই ধরনের গল্প তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। অতিলৌকিক রোম্যান্স আবার পোল্যান্ড বা রাশিয়ার মতো দেশে জনপ্রিয় নয়, সেখানে বেশি চলে ঐতিহাসিক রোম্যান্স।[৯৮] অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স ইউরোপে চলে না। কিন্তু সেখানে শিশুদের সম্পর্কে লেখা রোম্যান্স বেশ জনপ্রিয়।[৬৮]

জার্মানিতে কোনো কোনো প্রকাশন সংস্থা তাদের রোম্যান্স লেখকদের স্বনামে লিখতে দেন না। তারা মনে করেন, লেখকের একটি অ্যাংলো-আমেরিকান ছদ্মনাম না থাকলে উপন্যাস বাজারে কাটবে না। জার্মান পাঠকরা ইরোটিক রোম্যান্স বেশি পছন্দ করেন।[৯৮] তাই কোনো কোনো শীর্ণকায় ইংরেজি রোম্যান্সের জার্মান অনুবাদ বাড়তি প্রেমের দৃশ্য দিয়ে বড় করে তোলা হয়। আবার উল্টোটিও দেখা যায়। কোনো কোনো জার্মান অনুবাদক প্রেমের দৃশ্য সেন্সর করে লেখেন।[৯৯]২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় রোম্যান্স উপন্যাসের বিক্রি পূর্ববর্তী বছরের থেকে ২৮% বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে নতুন প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রে বিক্রি বৃদ্ধি পায় ৪০-৫০%। হার্লেকুইন প্রতিবছর ২০,০০০ স্বেচ্ছাপ্রেরিত পাণ্ডুলিপি পেয়ে থাকেন।[১০০]

পুরস্কার

রোম্যান্স উপন্যাসের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার হল আরআইটিএ পুরস্কার। প্রতিবছর রোম্যান্স রাইটার্স অফ আমেরিকা বছরের শ্রেষ্ঠ রোম্যান্স লেখককে এই পুরস্কার প্রদান করে।[১০১]

সমালোচনা

পুরুষদের অ্যাডভেঞ্চার, কল্পবিজ্ঞান বা ওয়েস্টার্ন ইত্যাদি অন্যান্য জনপ্রিয় সাহিত্যধারার তুলনায় রোম্যান্স এতদিন সর্বসমক্ষে উপহাসিত ও সমালোচকদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েই আসছিল। সাম্প্রতিককালের ধ্যানধারণার পরিবর্তন ও অন্যান্য বর্গের সঙ্গে রোম্যান্সের সংযুক্তির ফলে এই ধারার প্রতি অসম্মানজনক মনোভাবটি শক্তিশালী হয়েই থেকে যায়। কারণ কেউ কেউ মনে করেন রোম্যান্স ক্রয় বা পাঠের কথা স্বীকার করা পাঠকদের কাছে খানিক বিব্রতকর।[৪] অবশ্যই এর অন্যতম কারণ বছরের পর বছর রোম্যান্স উপহাসিত, সন্দেহ ও সমালোচনার বিষয়বস্তু। কোনো কোনো সমালোচক এই ধারায় সাসপেন্সের ঘাটতির কথা বলেন। নায়ক বা নায়িকা যে রহস্য সমাধান করে ফেলবেন তা এই গল্পে অবধারিত থাকে। তাই কেউ কেউ এই রকম অসম্ভব গ্ল্যামারযুক্ত প্রেমকাহিনির পিছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করা মেয়েদের পক্ষে কতটা লাভজনক তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।[৪] লেখক মেলিসা প্রিচার্ডের মতে রোম্যান্স উপন্যাস সামান্য বিপজ্জনক উপজীব্য নিয়ে লেখা। এই উপজীব্যটি হল একটি নিখাদ প্রেমের কথা, যা পাঠককে নিজেকে ভালবাসার পরিমণ্ডল থেকে বের করে আনে।[১০২]

যদিও জনপ্রিয় সংস্কৃতিচর্চার সূত্রপাতের ফলে রোম্যান্স ও অন্যান্য জনপ্রিয় ধারা সম্পর্কেও আকাদেমিক দৃষ্টি আকর্ষিক হতে থাকে। যদিও এর সম্মান খুব একটা বাড়ানো যায়নি, তবুও জেনিস রাডওয়ে, ন্যান্সি চোডোরো এবং অ্যান ডগলাসের মতো গবেষক উপন্যাসগুলির বৃহত্তর সামাজিক দিকটি খতিয়ে দেখেন, যেমনটি অন্যান্য গবেষকরা সোপ অপেরা, ওয়েস্টার্ন উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান ও অন্যান্য জনপ্রিয় বিনোদনধারায় করে থাকেন। এই গবেষণার ফলে রোম্যান্সের আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যগুলি উঠে আসে। যেমন, পাঠকরা মনে করেন, এই ধারার যাবতীয় অসম্মানের কারণ এগুলি মেয়েরা কেবলমাত্র মেয়েদের জন্য লেখেন।[৪] কেউ কেউ বলেন রোম্যান্সের উপেক্ষিত হবার কারণ, গল্পগুলির তীব্র আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। রোম্যান্স ঔপন্যাসিক জেনিফার ক্রুজ এর বিপরীতে মনে করেন, একটি আধুনিক রোম্যান্স উপন্যাসে “এক নারী কেবল তখনই শর্তহীন প্রেম দ্বারা পুরস্কৃত হন, যখন তিনি নিজের প্রতি সত্যবদ্ধ থাকেন।” [৭৪] কিন্তু ঔপন্যাসিক সুসান এলিজাবেথ ফিলিপস মনে করেন রোম্যান্স উপন্যাসের জনপ্রিয়তার কারণ এই যে নায়িকা শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে শেষমেশ জিতে যান।[২৪]

গ্রন্থপঞ্জি

  • Ramsdell, Kristin (১৯৯৯), Romance Fiction: A Guide to the Genre, Englewood, CO: Libraries Unlimited, Inc., আইএসবিএন 1563083353 
  • Regis, Pamela (২০০৩), A Natural History of the Romance Novel, Philadelphia, Pennsylvania: University of Pennsylvania Press, আইএসবিএন 0812233034 
  • Thurston, Carol (১৯৮৭)। The Romance RevolutionUrbana and Chicago: University of Illinois Press। আইএসবিএন 0252014421 
  • Toth, Emily (১৯৯৮), Wilma Mankiller, Gwendolyn Mink, Marysa Navarro, Barbara Smith, and Gloria Steinem, সম্পাদক, The Reader's Companion to U.S. Women's History, Boston, Massachusetts: Houghton Mifflin Company, আইএসবিএন 0395671736 

আরও দেখুন

  • রোম্যান্টিক ঔপন্যাসিকদের তালিকা
  • পুরুষদের রোম্যান্স সাহিত্য
  • রোম্যান্স (বর্গ)
  • রোম্যান্স (উপন্যাস)
  • রোম্যান্স কমিকস
  • রোম্যান্স (দ্ব্যর্থতানিরসন পৃষ্ঠা)

বহিঃসংযোগ

পাদটীকা

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ