হক-আই প্রযুক্তি
'হক-আই' হলো একটি ত্রিমাত্রিক কম্পিউটার ভিশন ব্যবস্থা, যা ক্রিকেট, টেনিস, ফুটবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, রাগবি প্রভৃতি খেলায় বলের গতিপথ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। অতীতে প্রযুক্তির নানা জটিলতায় ক্রীড়াক্ষেত্রে ফলাফল নির্ধারণে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো, যা বর্তমানে হক-আই প্রযুক্তির জন্য সম্ভব হয়েছে।
সূচনা
ক্রীড়াজগতে হক-আই প্রযুক্তির যাত্রা শুরু ২০০১ সালে ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে। ইংল্যান্ডের রোমসি'তে অবস্থিত রোক ম্যানর রিসার্চ লিমিটেড এর ইঞ্জিনিয়ারদের হাত ধরেই হক-আই এর বিকাশ হয়। পল হকিঙ্কস এবং ডেভিড শেরী এই প্রযুক্তির স্বত্বাধিকার (পেটেন্ট) ধারণ করছেন।
২০০১ সালের ২১ এপ্রিল লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড এর টেস্ট ম্যাচে সর্বপ্রথম হক-আই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।পরবর্তীতে ২০০৬ সালের ইউএস ওপেনে এটি টেনিস খেলায় সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়। তখন থেকেই হক-আই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বর্তমানে হক-আই প্রযুক্তির ব্যবহার অন্যান্য ক্রীড়াক্ষেত্রেও দেখা যায়। ২০০৯ সাল থেকে ক্রিকেটে "আম্পায়ার সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা পদ্ধতি" নামে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফুটবলে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে ২০১৩-১৪ প্রিমিয়ার লীগ মৌসুমে। [১] আর ডিসেম্বর ২০১৪ সালে বুন্দেসলিগা ফুটবল কমিটিও সিধ্বান্ত নেয় যে, ২০১৫-১৬ মৌসুমে লীগটি হক-আই প্রযুক্তির সহায়তা নিবে। [২]
কার্যপদ্ধতি
হক-আই প্রযুক্তি মূলত ত্রিভঙ্গীকরণ নীতি (ট্রাই-অ্যাঙ্গুলেশন তত্ত্ব) এর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। ট্রাই-অ্যাঙ্গুলেশন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে অজানা একটি বিন্দুর সাপেক্ষে নির্দিষ্ট দুটি বিন্দুর মধ্যবর্তী কোণ পরিমাপ করা হয় এবং অজানা বিন্দুটি নির্ণয় করা হয়।
হক-আই প্রযুক্তি মুলত দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে। সেগুলো হলোঃ
- ট্র্যাকিং সিস্টেম; যার সাথে ক্যামেরা এবং স্পীড গান জুড়ে দেয়া হয়।
- ভিডিও রিপ্লাই সিস্টেম; যা মূলত যেকোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে, খেলার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে।
বিবরণ
আবহমানকালে ক্রীড়াজগতে ক্যামেরার ব্যবহার শুধুমাত্র প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহৃত হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে এটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। আর হক-আই প্রযুক্তিতে ক্যামেরার ব্যবহার খানিকটা বেশিই জরুরি। যেহেতু হক-আই এর মাধ্যমে ত্রি-মাত্রিক সম্ভাব্য প্রতিচ্ছবি প্রদর্শন করা হয়, তাই মাঠের বিশেষ স্থানগুলোতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। সবগুলো ক্যামেরাই থাকে ময়দানের উপরের দিকে। ক্রীড়াবিশেষে এর ব্যবহার এবং কাজ ভিন্ন।
ক্রিকেট
ক্রিকেটে হক-আই এর ব্যবহার দেখা যায় ২১ এপ্রিল, ২০০১ সালের লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড এর টেস্ট ম্যাচে। তখন চ্যানেল ফোর এর তত্ত্বাবধানে হক-আই প্রযুক্তি পরিচালিত হয়। তখন থেকে হক-আই শুধুমাত্র টেলিভিশন নেটওয়ার্কের দ্বারা ব্যবহৃত হতো। তবে ২০০৮/০৯ এর শীতের মৌসুমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) হক-আই প্রযুক্তিকে বল ট্র্যাকিং এর জন্য বেঁছে নেয়, যা তখন এলবিডব্লিউ এর সিদ্ধান্তে অসীম ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।ক্রিকেটে মাঠের ছয়দিকে ছয়টি ক্যামেরা ব্যবহৃত হয়, যেগুলো ১০৬ ফ্রেম/সেকেন্ড এ ছবি তুলতে পারে। এই প্রযুক্তি ৩.৬ মিলিমিটার পরিসীমা পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে। এর বেশি হলে তার সিদ্ধান্ত "আম্পায়ারস কল" হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ ফিল্ড আম্পায়ারের রায়কেই তখন সবাইকে মেনে নিতে হয়।
হক-আই ক্রিকেটে যেসব কাজ পরিচালনা করে, সেগুলো হলোঃ
- বোলার কর্তৃক ছুঁড়ে দেয়া বলের গতিবেগ নির্ণয় করা।
- মাঠের পিচ'এ বলের ঘূর্ণন কিংবা বাউন্স এর সম্ভাব্য চিত্র প্রদর্শন করা।
- বলের বাউন্সের উচ্চতা পরিমাপ করা।
- উইকেটের কোন পাশে বল আঘাত করেছে, তা নির্ণয় করা।
- স্ট্যাম্পের কোথায় বলটি আঘাত করতে পারে, তার একটি সম্ভাব্য ছবি নির্ধারণ করা।
টেনিস
২০০৪ সালের ইউএস ওপেন এর কোয়াটার ফাইনাল ম্যাচে সেরেনা উইলিয়ামস এবং জেনিফার কাপ্রিয়াতি এর মধ্যকার লড়াই এ সেরেনা উইলিয়ামসের বিরুদ্ধে তিনটি লাইন কলস এর অভিযোগ উঠে, যা প্রকৃতপক্ষে ভুল প্রমাণিত হয়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে অপরিবর্তীত থেকে যায়। উক্ত সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে ২০০৫ সালে নিউ ইয়র্ক সিটিতে আন্তর্জাতিক টেনিস ফেডারেশন হক-আই প্রযুক্তির কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে এবং তা ব্যবহারের সম্মতি দেয়।
২০০৬ সালে ইউএস ওপেন এ এর যাত্রাকাল শুরু হয়। বর্তমানে এটি উইম্বলেন্ডন, কুইন'স ক্লাব চ্যাম্পিয়নশীপ, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ডেবিস কাপ, টেনিস মাস্টার'স ক্লাব, ইউএস ওপেন প্রভৃতি টুর্নামেন্টে ব্যবহৃত হয়।
অন্যান্য
জনপ্রিয়তার প্রারম্ভে হক-আই ক্রিকেট ও টেনিস এ ব্যবহৃত হত। তবে বর্তমানে এটি ফুটবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, রাগবি ইত্যাদিতে সাহায্য করছে। ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে ভিএআর নামে একটি পর্যালোচনা ব্যবস্থা গৃহীত হয় যা হক-আই প্রযুক্তির সাহায্যেই পরিচালিত হয়েছে।
হক-আই ইনোভেশন্স লিমিটেড
ইংল্যান্ডের রোমসিতে তৎকালীন রোক ম্যানর রিসার্চ লিমিটেডের (বর্তমানে সিমেন্স) ইঞ্জিনিয়ারগণ ২০০১ সালে হক-আই সিস্টেমটি বিকশিত করেছিলেন। পল হকিন্স এবং ডেভিড শেরি যুক্তরাজ্যে হক-আই তৈরির পেটেন্ট জমা দিয়েছিলেন; কিন্তু তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।[৩] ফলে সমস্ত প্রযুক্তি এবং এর জন্য ব্যবহৃত সামগ্রী হ্যাম্পশায়ারের উইনচেষ্টারে অবস্থিত হক-আই ইনোভেশন্স লিমিটেডের কব্জায় চলে আসে।
উইজডেন গ্রুপের নেতৃত্বে ১৪ ই জুন, ২০০৬ এ, বিনিয়োগকারীদের একটি দল এবং এর মধ্যে অন্যতম ' মার্ক গ্যাটি ' (ধনী আমেরিকান পরিবার এবং ব্যবসায়িক বংশের সদস্য) - এই সংস্থাটি কিনেছিল। উইজডেনের হক-আই ক্রয় - ক্রিকেটে এর উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করা এবং টেনিস এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক খেলায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়ারই মূল লক্ষ্য ছিল। হক-আইয়ের ওয়েবসাইট অনুসারে, টেলিভিশনে প্রদর্শিত সিস্টেমের চেয়ে সিস্টেমটি আরও অনেক বেশি ডেটা তৈরি করতে সক্ষম।
উইজডেন ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে বিক্রয়ের জন্য রেখেছিল, যা মার্চ ২০১১ সালে জাপানি জায়ান্ট কোম্পানি সোনির কাছে একটি সম্পূর্ণ সত্তা হিসাবে বিক্রি হয়। [৪][৫]
হক-আই সম্পর্কিত বিতর্ক
ক্রীড়াজগতে হক-আই প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে এক বিরাট অভূতপূর্ব সংযোজন। তবে সিদ্ধান্ত পর্যালোচনাকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো এটি বিতর্কিত হয়েছে। ক্রিকেট কিংবা টেনিস, সবক্ষেত্রে হক-আই কে নিয়ে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। ২০০৭ সালের উইম্বলেন্ডন চ্যাম্পিয়নশীপের একটি ম্যাচে হক-আই এর কারণে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা পুরো খেলাতেই প্রভাব ফেলেছিল।[৬] কিছু মন্তব্যকারী সিস্টেমটির ৩.৬ মি.মি. পরিসংখ্যানের মার্জিনের ত্রুটিটি খুব বড় সমস্যা হিসাবে সমালোচনা করেছেন। [৭] অন্যরা বলেছেন যে ৩.৬ মি.মি. অসাধারণভাবে সঠিক, তবুও তারা স্বীকার করেন যে, এই মার্জিনটি কেবল বলের প্রত্যক্ষদর্শী ট্র্যাজেক্টোরির জন্যই সমস্যা হয়। ২০০৮ সালে, পিয়ার-পর্যালোচিত জার্নালের একটি নিবন্ধ এই সমস্ত সন্দেহকে একীভূত করেছিল। লেখকরা সিস্টেমটির অবদান স্বীকার করেছেন, কিন্তু উল্লেখ করেছেন যে এটি সম্ভবত কিছুটা হলেও ত্রুটিযুক্ত। লেখকরা আরও যুক্তি দিয়েছিলেন যে। এর যথার্থতার সম্ভাব্য সীমাটি খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, ধারাভাষ্যকার বা দর্শকদের দ্বারা স্বীকৃত হয়নি।
২০০৮ সালের পার্থ টেস্টে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে ভুল সিদ্ধান্ত দেয়ার কারণে বহুলভাবে সমালোচিত হয়।