৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্ন্যুৎপাত
ভিসুভিয়াস পর্বত হলো বর্তমান ইতালির একটি বহুস্তর-বিশিষ্ট আগ্নেয়গিরি যার অগ্নৎপাত ঘটে ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। এটি ইউরোপিয় ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত ও মারাত্মক অগ্নুৎপাতগুলির একটি, যে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ ও নথিভুক্ত করেন প্লাইনি দ্য ইয়াংগার নামক এক রোমান কবি এবং প্রশাসক।[১]
৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্ন্যুৎপাত | |
---|---|
আগ্নেয়গিরি | ভিসুভিয়াস পর্বত |
তারিখ | আগস্ট ২৪–২৫ বা অক্টোবর-নভেম্বর, ৭৯ খ্রিষ্টাব্দ |
ধরণ | পিলিনিয়ান |
স্থান | কাম্পানিয়া, ইতালি ৪০°৪৯′ উত্তর ১৪°২৬′ পূর্ব / ৪০.৮১৭° উত্তর ১৪.৪৩৩° পূর্ব |
VEI | ৫ |
প্রভাব | পম্পেই, হেরকুলেনিয়াম, ওপলন্টিস এবং স্টাবিয়েই সহ বেশ কিছু রোমান জনবসতির বিলুপ্তি। |
ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্নুৎপাতের কারণে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার (২১ মা) উঁচু পর্যন্ত উঠেছিলো অতি অতি উচ্চ তাপমাত্রার টেফরা এবং গ্যাসের মারাত্মক মেঘ, যা থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১.৫ মিলিয়ন টন পরিমাণ বিগলিত শিলা, বিচূর্ণ ঝামা পাথর ও আগ্নেয়ভস্ম নির্গত হয়, এ থেকে অনুমেয় যে এই উদ্গিরণের দ্বারা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলার চাইতে ১০০,০০০ গূণ বেশি তাপশক্তি উৎপন্ন হয়েছিলো।[২]
সুবিশাল পিওরোক্লাস্টিক স্ফীতির নিচে এবং ছাইস্তুপে বেশ কিছু রোমান জনবসতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং চাপা পড়ে, যার মধ্যে পম্পেই এবং হেরকুলেনিয়াম উল্লেখযোগ্য। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে উক্ত স্থানগুলির প্রাক্তন অধিবাসীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়, ফলে স্থানটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র, একই সাথে যা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান ও ভিসুভিয়াস জাতীয় উদ্যানের অংশ।
উল্লেখিত দুইটি শহরের মোট বাসিন্দা ছিলো ১৬,০০০-২০,০০০ জন। এখন পর্যন্ত ১৫০০ মরদেহের অবশিষ্টাংশ পম্পেই এবং হেরকুলেনিয়ামে পাওয়া গিয়েছে, যদিও সর্বমোট মৃত্যু তালিকাটি এখনো অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট। মূলত এই ঘটনা থেকেই ভিসুভিয়ান অগ্নুৎপাতের নামকরণ করা হয়েছে, উচ্চ তাপমাত্রার ছাই ও গ্যাসের স্তম্ভ সৃষ্টি হওয়া এধরনের অগ্নুৎপাতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলা যায় যা স্ট্র্যাটোমন্ডল পর্যন্ত পৌঁছায়, এছাড়াও এই অগ্নুৎপাতে পাইরোক্লাস্টিক স্ফীতির সাথে পেলিয়ান ধরনের উদ্গিরণও যুক্ত ছিলো।
ঘটনার পূর্বাভাস
৭৯ খ্রিষ্টাব্দের অগ্নুৎপাতের সতেরো বছর পুর্বে ৫ ফেব্রুয়ারি, শক্তিশালী ভূমিকম্প নেপল উপসাগরের নিকটবর্তী এলাকায় বড় রকমের ক্ষতিসাধন করে, যার অনেকটাই পম্পেইকে সইতে হয়।[৩] এমনকি এই ভূমিকম্পে হওয়া অনেক ক্ষয়ক্ষতি ভিসুভিয়াস উদ্গিগরণের আগ পর্যন্তও মেরামত করা সম্ভব হয়নি।[৪] সেনেকা দা ইয়াংগারের দেওয়া তথ্যমতে ওই সময়ে পম্পেইয়ের আশেপাশের এলাকায় “দূষিত বাতাসের” দরুন ৫০০ ভেড়া মারা যায়, যা ভলকানোলজিস্ট হেরালডর সিগুরসন তুলনা করেছেন আইসল্যান্ডে ভলকানিক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে মারা যাওয়া ভেড়াগুলোর সাথে, এর থেকে ধারণা করা যায় যে ৬২ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্প মাউন্ট ভিসুভিয়াসের গতিবিধির সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলো।[৫]
ক্ষুদ্রতর একটি ভূমিকম্প ঘটে ৬৪ খ্রিষ্টাব্দে; নিরোর[৬] জীবনী নিয়ে লেখা তার প্রবন্ধে এটা তুলে ধরেন সুতোনিয়াস, এবং টাকিটাস এর বর্ণণা দেন আনালেস গ্রন্থে, কেননা এই দুর্যোগটি ঘটে যখন নিরো নেপসলে ছিলেন আর প্রথমবারের মতো গণমঞ্চে প্রদর্শনী করছিলেন।[৭] সুতোনিয়াস বর্ণনা করেন যে ভূমিকম্প চলাকালীন সম্রাট গাইছিলেন এবং তার গান শেষ হবার আগে থামেন নি, অপরদিকে টাকিটাস লিখেছেন যে সবাইকে বের করে দেবার কিছু সময় পরেই মঞ্চটি ধসে পড়ে।
উক্ত এলাকার রোমানরা ছোটোখাটো ভূমিকম্পে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে; প্লাইনি দা ইয়াংগার লিখেছেন যে তারা "বিশেষভাবে বিচলিত হতো না কারণ এগুলো (ছোটখাটো ভূ-কম্পণ) কাম্পানিয়ায় অহরহ ঘটতো”। অনুরূপ ছোট ছোট কম্পণ অগ্নুৎপাতের চারদিন আগে থেকে ক্রমেই বাড়ছিলো বলে জানা যায়, কিন্তু এগুলোকে সতর্কবাণী হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি।[৮]
অগ্নুৎপাতের ধরণ
ভিসুভিয়াস উদ্গিরণ ঘটনাটির বিভিন্ন আধুনিক পূর্ণগণনায় কিছু খুঁটিনাটি তথ্য একে অপর থেকে যথেষ্ট ভিন্ন হওয়া সত্যেও মূল বিষয়গুলো এক। অগ্নুৎপাতের সময়কাল ছিলো দুই দিন। প্রথম দিন সকালের ঘটনাবলী স্বাভাবিক ছিলো বলে ধারণা পাওয়া যায় প্লাইনি দা ইয়ঙ্গারের কাছে, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যার লেখনিই একমাত্র যেটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্লাইনি উক্ত সময়ে মিসেনামে ছিলেন, যা নেপলস উপসাগরের অপরদিকে ভিসুভিয়াস হতে প্রায় ২৯ কিলোমিটার (১৮ মা) দূরে অবস্থিত। দূরত্বজনিত কারণে খুব সম্ভবত প্লাইনি দুর্যোগের প্রাথমিক চিহ্নগুলো খেয়াল করতে পারেন নি এবং তার পক্ষে পরবর্তী দুইদিনে পম্পেই বা হেরকুলেনিয়ামবাসী কারো কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করাও সম্ভব ছিলো না (তিনি তার চিঠিগুলোতে পম্পেইয়ের নাম উল্লেখ করেন নি)।
দুপুর একটা নাগাদ ভিসুভিয়াস পর্বত তীব্রভাবে উদ্গিরণ করে, যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় একটি উচ্চতাসম্পন্ন স্তম্ভ যা থেকে পাথর ও ছাই পতিত হয়ে সম্পূর্ণ জায়গাটিকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। বেশিরভাগ উদ্ধারকাজ ও পলায়ন এই সময়টুকুতে সম্ভব হয়েছিলো। ওই দিবাগত রাতে বা পরবর্তী ভোর নাগাদ আগ্নেয়গিরিতে পাইরোক্ল্যাস্টিক স্ফীতি শুরু হয়। পাহাড়ের ওপর দেখতে পাওয়া আলোকে আগুন ভেবে মিসেনাম পর্যন্ত মানুষ প্রাণভয়ে পালাতে থাকে। স্ফীতিসমূহ ছিলো দ্রুতগতির এবং প্রচণ্ড উতপ্ত, এগুলো বাকি জনসমষ্টিকে দগ্ধ বা শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে এবং পথের সকল স্থাপনা ও বসতি আংশিক বা পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে এগোতে থাকে। স্ফীতিসমূহ এলাকার ভৌগোলিক চিত্র বদলে দেয়, এমনকি উপকূলেও আনে ব্যাপক পরিবর্তন। পরবর্তী সন্ধ্যা নাগাদ উদ্গিরণ সমাপ্ত হয়, রেখে যায় আকাশে কেবল একটি আবছায়া যা ভেদ করে সূর্যের অনুজ্জ্বল আলো দৃশ্যমান হয়।
প্লাইনি দা ইয়াংগার ঘটনাটির বর্ণনা এভাবে দেন :
ভিসুভিয়াসের স্থলে স্থলে জ্বলে উঠছিলো রাক্ষুসে অগ্নিশিখা, সেগুলোর দীপ্তি রাতের নিকষ অন্ধকারে দেখাচ্ছিলো আরো প্রকট... সূর্যালোক তখন ছিলো পৃথিবীর অন্য কোথাও, কিন্তু এখানে এই রাতের অন্ধকার ছিলো অন্য সকল রাতের চেয়ে গাঢ়।[৯]
স্তরীয় গবেষণা
খনন ও ভূমি জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে সিগুরসন, ক্যাশডলার এবং স্পার্কস মিলে আগ্নেয়গিরির ছাইস্তুপের একটি বিস্তারিত স্তরীয় গবেষণা পরিচালনা করেন, যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। তারা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিসুভিয়াস অগ্নুৎপাত দুইটি দশায় ঘটে, ভিসুভিয়ান এবং পেলিয়ান, যেগুলো ছয়বার পর্যায়ান্বিত হয়েছিলো।[১০]
প্রথমত ঘটে প্লিনিয়ার অগ্ন্যুৎপাত, যা গঠিত মূলত আগ্নেয় ভগ্নাবশেষের স্তম্ভ ও উতপ্ত গ্যাসিয় পদার্থ দিয়ে, এগুলো বায়ুমন্ডলের স্ট্র্যাটোমন্ডলের ১৫ কিলোমিটার (৯.৩ মা) থেকে ৩০ কিলোমিটার (১৯ মা) পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত হয়, এই উদ্গিরণ চলে আঠারো থেকে বিশ ঘণ্টা এবং আগ্নেয়গিরির দক্ষিণ বরাবর ভস্মীভূত শিলা ও ছাইয়ের বর্ষণ ঘটায়, এগুলো পম্পেই নগরে জমা হয়ে ২.৮ মিটার (৯ ফু ২ ইঞ্চি) পর্যন্ত উঁচু স্তুপ গড়ে তোলে।
এরপর পেলিয়ান উদ্গিরণ দশায় পাইরোক্লাসটিক স্ফীতির সাহায্যে বিগলিত পাথর ও উতপ্ত গ্যাস ভূমির ওপর ওপর ঢেউ আকারে আসতে থাকে যা মিসেনাম পর্যন্ত পৌঁছায়, এগুলো পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে জমা হতে থাকে। দুইটি এরকম স্ফীতি সমস্ত পম্পেইকে গ্রাস করে নেয়, বাকি থেকে যাওয়া সকল জীবীতদের দগ্ধ বা শ্বাসরোধ করে। হেরকুলেনিয়াম এবং ওপলন্টিস উভয়েই এরূপ স্ফীতিতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং চাপা পড়ে মিহি পাইরোক্লাসটিক গুঁড়া, ভস্মীভূত শিলা এবং লাভাস্তরের নিচে। পম্পেই নগরীর ধ্বংস এবং ভূগর্ভস্থ হবার কারণ হিসেবে গবেষকগণ ৪ ও ৫ নং স্ফিতিকে দায়ী করেন।[১১] এইসব স্ফিতিসমূহ ফলআউট হতে ভিন্ন কেননা এখানে ক্রস-বেডিং ফরমেশন দেখতে পাওয়া যায়।
ভিসুভিয়াসের উদ্গিরণকে দেখা হয় মূলত ফ্রেয়াটোম্যাগমাটিক হিসেবে, যেখানে প্রধান শক্তির সরবরাহ এসেছিলো দীর্ঘদিন চুইয়ে আসা সমুদ্রের পানির বাষ্পে রূপান্তরের মাধ্যমে, যা ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ম্যাগমার সংস্পর্শে আসে মৃত্তিকার ফাটল দিয়ে।
বিস্ফোরণগুলোর কালনির্ধারণ
২০০২ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধে সিগুরসন এবং কেসি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে একটি প্রাথমিক বিস্ফোরণ দ্বারা ছাই ও শিলার বর্ষণ শুরু হয় পম্পেইয়ের দক্ষিণ-পূর্বে কিন্তু হেরকুলামে নয়, যার অবস্থান ছিলো বায়ু প্রবাহের বিপরীত দিকে।[১২] পরবর্তীকালে যখন উপস্থিত গ্যাসসমূহ জমাট বেধে ঘন হওয়া শুরু করে এবং বিদ্যমান কঠিন পদার্থের ভার বহন করতে অসমর্থ হয়, তখনই ছাই ও শিলার মেঘ ধসে পড়তে শুরু করে।
গবেষকরা ধারণা করেন যে নিচুমানের বিস্ফোরণের দ্বারা প্রথম ছাইস্তুপগুলোর পতন হয়েছিলো সকালের শুরুতে, যেগুলো মিসেনাম থেকে দেখতে পাওয়া যায় নি। রেকটিনা এই বিস্ফোরণগুলো দেখতে পেয়ে তার বার্তাবাহককে নেপলস উপসাগরের চারিদিকে খোঁজ নিতে পাঠান, এতদ্বারা বার্তাবাহকের প্লাইনির বাসভবনের নিকট প্রাথমিক উদ্গিরণের পরপরই দ্রুত উপস্থিত হবার যৌক্তিক কারণ পাওয়া যায়।
চৌম্বকীয় গবেষণা
জানেলা, গুরিওলি, পারেশচি এবং লানযা কর্তৃক পরিচালিত ২০০৬ সালের একটি গবেষণায় অগ্নুৎপাতের সাম্যাবস্থার তাপমাত্রা নির্ণয়ের জন্য উক্ত বিশেষজ্ঞগণ পম্পেই ও তার আশপাশ হতে প্রস্তরখন্ড, ছাদের টালি ও প্লাস্টার টুকরো সংগ্রহ করে তাদের চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করেন।[১৩] এই কল্কগুলো মূলত প্লিনিয়ান কলাম পতনের ফলস্বরূপ ঘন পাইরোক্লাসটিক ঢেউ (পিডিসি) দ্বারা জমা হয়। গবেষকগণ যুক্তি উপস্থাপন করেন যে যেসব প্রস্তরখন্ড ২–৫ সেন্টিমিটার (০.৭৯–১.৯৭ ইঞ্চি) বা তার থেকে বড়, সেগুলো পাইরোক্লাসটিক ঢেউয়ে যথেষ্ট সময় ধরে ছিলো না যার দরুন সেগুলোতে তাপমাত্রা পূর্ণভাবে সঞ্চারিত হয়নি যা আদতে আরো বেশি উতপ্ত ছিলো। এ থেকে বিশেষজ্ঞগণ দুই ধরনের তাপমাত্রা ও তাদের মধ্যকার পার্থক্য পান – অবক্ষেপন তাপমাত্রা যেটি তারা অনুমান করেন, এবং স্ফিতি দ্বারা গ্রাসকৃত বস্তুসমূহের তাপমা্ত্রা, যেটি বিভিন্ন রকম প্রস্তরের শীতলীকরণ হার ও আকার-আকৃতি বিবেচনায় নিয়ে অনুমান করা সম্ভব বলে গবেষকরা মনে করেন। অবক্ষেপনের ঠিক পূর্বে পাইরোক্লাস্টিক ঢেউয়ে থাকা প্রস্তরের তাপমাত্রা হিসাব করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তারা।[১৪]
সকল ধরনের ভূত্বকীয় প্রস্তর অয়শ্চুম্বকীয় কারণ এগুলো কিছু পরিমাণ লৌহ বা লোহা সমৃদ্ধ যৌগ বহন করে, এবং রোমান ছাদসমূহের টালি বা পলেস্তর এর ব্যতিক্রম ছিলো না। এসব বস্তু বিভিন্ন উৎসের সাহায্যে একধরনের রেসিডুয়াল ফিল্ড লাভ করতে পারে। চৌম্বকীয় দ্বিমেরু আছে এমন একক অণুগুলোকে যখন অচ্ছ কোনো গঠনে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়, তখন ক্ষুদ্র চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো একে অপরকে বলবৎ করে প্রস্তরটির রেসিডুয়াল ফিল্ড তৈরি করে।[১৫] এমতাবস্থায় বস্তুটিকে উতপ্ত করলে আরো স্থিতিশক্তি যোগ হয়। কুরি তাপমাত্রায় অণুসমূহের কম্পনই সারিবদ্ধ অবস্থা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট; এভাবে বস্তুটি রেসিডুয়াল চৌম্বকত্ব হারায় এবং সাময়িকভাবে যেকোনো বাহ্যিকভাবে প্রয়োগকৃত চৌম্বক ক্ষেত্র ধারণ করতে পারে। গবেষকগণ এই প্রক্রিয়াটির নাম দেন ‘আনব্লকিং’।
একটি প্রস্তর হলো নানান খনিজের মিশ্রণ, যার প্রত্যেকটির রয়েছে নিজস্ব কুরি তাপমাত্রা; বিশেষজ্ঞরা তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার খোঁজ না করে একাধিক তাপমাত্রার একটি বর্ণালী বের করার চেষ্টা করেন। আদর্শ নমুনায় পিডিসির তাপমাত্রা উচ্চতম ব্লকিং তাপমাত্রার চেয়ে অধিক হয় না। কিছু মৌলিক বস্তু গঠনের সময় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্রয়োগকৃত চৌম্বকত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়। পরীক্ষনের তাপমাত্রা নিম্নতম ব্লকিং তাপমাত্রা হতে বাড়ানো হলে কিছু বস্তু শীতলীকরণের সময় ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর যে চৌম্বকত্ব ছিলো তা অর্জন করে। নমুনাটির সামগ্রিক ক্ষেত্র ছিলো উচ্চতম ও নিম্নতম ব্লকিং বস্তুসমূহের ক্ষেত্রের ভেক্টর যোগফল।
এধরনের নমুনা দ্বারা নিম্ন আনব্লকিং তাপমাত্রা অনুমান করা সম্ভব হয়ে ওঠে। ক্ষেত্রের দিকনিরূপণ এবং বিভিন্ন তাপমাত্রায় শক্তি যাচাইয়ের জন্য বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে গবেষকগণ নমুনাটির তাপমাত্রা ৪০° সেলসিয়াস (৭০° ফারেনহাইট) করে বাড়াতে থাকে যতক্ষণ না সেটির তাপমাত্রা ১০০° সেলসিয়াস (২১০° ফারেনহাইট) থেকে নিম্ন আনব্লকিং তাপমাত্রায় না পৌছাঁয়।[১৬] সামগ্রিক ক্ষেত্রটির দিক পরিবর্তিত হয় এর একটি উপাদানের অভাবে। প্রতিবার তাপ বৃদ্ধিতে চৌম্বকত্বের দিক পরিবর্তিত হয়, এ থেকে ঠিক কোন বৃদ্ধিতে নমুনার চৌম্বকত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো তা নির্ণয় করা যায়।[১৭] এটাই অবক্ষেপনের সাম্যাবস্থার তাপমাত্রা। গবেষকগণ এতদ্বারা নিরূপন করেন যে পম্পেই তুলনামূলকভাবে একটি উতপ্ত ক্ষেত্রের মধ্যে শীতলতর স্থান ছিলো, যাকে তারা নগরীটির ভিত্তিকাঠামোর স্ফীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে গণ্য করেন।[১৮]
তদন্তকারীরা উদ্গিগরণের ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে ধরেন নিম্নরূপে। অগ্নুৎপাতের প্রথম দিন বিভিন্ন ক্ষুদ্র টুকরোর সমন্বয়ে গঠিত সাদাপাথরের বর্ষণ চলে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী এবং তৈরি করে ৩ সেন্টিমিটার (১.২ ইঞ্চি) পর্যন্ত উঁচু একটি আস্তরণ।[১৯] ছাদের টালিসমূহ ১২০-১৪০° সেলসিয়াস (২৫০-২৮০° ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় উতপ্ত হয়।[২০] এই সময়টুকুই উক্ত এলাকা থেকে পালানোর শেষ সুযোগ ছিলো। পরবর্তীতে একটি ধূসর পাথর স্তম্ভ গঠিত হয় এবং ১৮ ঘণ্টা ধরে এর বর্ষণে প্রায় ১০ সেন্টিমিটার (৩.৯ ইঞ্চি) এর একটি স্তর মাটির ওপর তৈরি হয়। এই দুই বর্ষণ ছিলো প্লিনিয়ান দশার অন্তর্ভূক্ত। এসকল মেঘের ধারগুলোর পতনই প্রথম মিশ্রিত পিডিসি আনায়ন করে, যা হারকিউলানেউমের জন্য প্রলয়ংকারী হলেও পম্পেইতে প্রবেশ করেনি।
দ্বিতীয় দিনের সকালে ধূসর মেঘসমূহ বৃহত্তর মাত্রায় পতিত হওয়া শুরু করে, দুইটি বড় ভূমি-স্ফীতির আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় পম্পেই। হেরকুলেনিয়াম এবং তার অধিবাসী সকলের পরিণতি হয় করুণ। প্রথম স্ফীতিটির তাপমাত্রা ছিলো ১৮০ থেকে ২২০° সেলসিয়াসের (৩৬০-৪৩০° ফারেনহাইট) মধ্যে, এবং দ্বিতীয়টির ছিলো ২২০ থেকে ২৬০° সেলসিয়াস (৪৩০-৫০০° ফারেনহাইট)। প্রথমটির অবক্ষেপণের তাপমাত্রা ছিলো ১৪০-৩০০° সেলসিয়াস (২৮০-৫৭০° ফারেনহাইট)।[২১]
প্রথম স্ফীতির তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে বিভিন্ন স্থাপনার সাথে আন্ত:ক্রিয়ার ফলে। কোনো ঘরবাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মানুষজনের পালানোর কোনো উপায় ছিলো না, কেননা শহরটির চারিদিকে তখন উচ্চ তাপমাত্রার গ্যাস বিরাজ করছে যা মুহুর্তেই কাউকে দগ্ধ করতে সক্ষম। সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিলো ধসে পড়া ছাদের নিম্নে থাকা কক্ষগুলোর, প্রায় ১০০° সেলসিয়াস (২১০° ফারেনহাইট) যা পানির স্ফুটনাংকের সমান।[২২] গবেষকরা ধারণা করেন যে পাইরোক্লাসটিক ঢেউয়ের নিচের অংশটি স্থানীয় জমির অবিধির কারণে প্রধান ঢেউ থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায় এবং আশেপাশের বাতাসের সংস্পর্শে এসে শীতল হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় স্ফীতি নাগাদ অবিধিসমূহ লোপ পায়, যার ফলে নগরীটির সকল স্থান বাইরের ন্যায় সমান উতপ্ত হতে থাকে।
অত্যন্ত লঘু শেষ স্ফীতিতে সম্পূর্ণ এলাকাটির ওপর আরো এক মিটারের অবক্ষেপণ পতিত হয়।[২৩]
দুইজন প্লাইনি
ভিসুভিয়াস উদ্গিরণের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা পাওয়া যায় তখন ১৭ বছর বয়সী[২৪] কনিষ্ঠ প্লাইনির লেখা দুইটি চিঠিতে, ওই ঘটনার প্রায় ২৫ বছর পর যা তিনি লেখেন ঐতিহাসিক টাকিটাসের কাছে।[২৫][২৬] তার লেখা একটি চিঠিতে তার চাচার (এল্ডার প্লাইনি) নৌবহর দ্বারা চালানো উদ্ধারকার্যের এবং তা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের বর্ণণা দেওয়া হয়।[২৭] অপর লেখনীতে প্লাইনি দা ইয়াংগার ওইদিনের নিজের পর্যবেক্ষণসমূহ তুলে ধরেন।[২৮]
কনিষ্ঠ প্লাইনি
প্লাইনি দা ইয়াংগার পর্বতের ওপর একটি অস্বাভাবিক ধরনের ঘন মেঘ দ্রুতবেগে উঠতে দেখেন।[২৭]
আমি একটি পাইন গাছের সাথে তুলনা করে এর (মেঘটির) বর্ণনা সবচেয়ে নিখুঁতভাবে দিতে পারি; একটি গাছের কান্ডের ন্যায় এটি ভূমি হতে বহুদূর ওপরে উঠে যায়, যার ওপরের অংশটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে কোনো গাছের শাখাপ্রশাখার মতো। [...] কখনো তা ছিলো অতি উজ্জ্বল, কখনোবা অন্ধকার ও দাগযুক্ত, কেননা এটি মূলত ছাই আর মাটির মিশ্রণ দ্বারা তৈরি হয়েছিলো।
উক্ত ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতে পেরে এবং বাহক মারফত খবর পেয়ে এল্ডার প্লাইনি তার নৌবহরের সাহায্যে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করার জন্য রওনা দেন। তার ভাইপো প্লাইনি দা ইয়াংগার দিনটাকে স্বাভাবিকভাবে কাটানোর লক্ষ্যে নিজের কাজ করতে থাকেন, কিন্তু সেই রাতেই একটি ভূ-কম্পন তাকে এবং তার মাকে ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করে। ভোরের দিকে আরেকটি কম্পণের পর তাদের মফস্বলের সবাই-ই নিজ বসতি পরিত্যক্ত করে পালিয়ে যায়। বর্ণনা অনুসারে “সমুদ্রটিকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন তার ঢেউ পড়ছে নিজের ওপরই আঘাত করে, এবং পালাচ্ছে উপকূল হতে”, যা ইঙ্গিত করে সুনামির লক্ষণসমূহের দিকে। যদিও সমুদ্রের ঢেউ দ্বারা উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হবার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কালো মেঘের আচ্ছাদনে ঢেকে গিয়েছিলো ভোরের আলো, যা থেকে ক্ষণে ক্ষণে দৃশ্যমান হচ্ছিলো আলোর ছটা। মেঘগুলো মিসেনাম এবং উপকূলের অপর দিকে কাপ্রাইয়া (ক্যাপ্রি) দ্বীপ পর্যন্ত অন্ধকার করে রেখেছিলো। প্রাণভয়ে ওই দুই এলাকার জনমানুষ একে অপরকে সাবধান করে এবং উপকূল থেকে যত দূরে সম্ভব পালানো শুরু করে। প্লাইনির মাতা তাকে (প্লাইনিকে) পালিয়ে যেতে বলেন, কেননা তিনি নিজে বয়সের কারণে দুর্বল ও পালাতে অসমর্থ ছিলেন, কিন্তু প্লাইনি তাকে নিয়েই যাবার চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায় আকাশ থেকে শুরু হয় ছাইবর্ষণ। চাপা পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে প্লাইনিকে একটু পর পর ছাইগুলো ঝাড়ার জন্য থামতে হচ্ছিলো। বেলাশেষে ছাইয়ের বৃষ্টি থামে আর সূর্য দুর্বলভাবে কিরণ দিতে শুরু করে, যা দেখে প্লাইনি এবং তার মা বাড়িতে ফিরে যাবার উৎসাহ পান, যেখানে প্লাইনি দা এল্ডারের উদ্ধারকার্য সম্পর্কে জানার জন্য তারা অপেক্ষা করেন। চিঠিতে এই ছাইয়ের বর্ষণকে তুষারপাতের সাথে তুলনা করা হয়। এ বর্ণনা থেকে জানা যায় যে ওই এলাকায় ভূমিকম্প এবং সুনামির ঝাপ্টা তাদের বাড়িটির বড় কোনো ক্ষতি করার মতো তীব্র ছিলো না।
জৈষ্ঠ প্লাইনি
প্লাইনির চাচা জৈষ্ঠ প্লাইনি ছিলেন মিসেনামে অবস্থিত রোমান নৌবহরের দায়িত্বে, এবং ভিসুভিয়াস অগ্নুৎপাতের প্রথম নিদর্শন পাবার সাথে সাথেই তিনি ছোট জাহাজে করে বিষয়টা খতিয়ে দেখতে যান। জাহাজটি নিয়ে রওনা দেবার কিছু আগে তার বন্ধু রেকটিনার (বাসুসের স্ত্রী) তরফ থেকে একজন বার্তাবাহক এসে হাজির হয় এবং তাকে অবগত করে যে একটি ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের ঘটনা ঘটেছে, যা থেকে কেবলমাত্র নৌপথে পলায়ন সম্ভব।[২৯] বার্তাবাহক জৈষ্ঠ প্লাইনির নৌবহরের সাহায্য চাইলে তিনি তৎক্ষণাৎ তার জাহাজগুলোকে উপকূলে উদ্ধারকার্য শুরু করতে প্রেরণ করেন।[২৯]
তিনি নিজে তার ছোট জাহাজ নিয়ে উপসাগর বরাবর অগ্রসর হতে থাকলে সম্মুখীন হন ঘন ছাই ও পাথরবর্ষণের। তার সাথীরা ফিরে যাবার পরামর্শ দিলে তিনি তাদের মনে করিয়ে দেন যে ‘ভাগ্য সাহসীদের সহায় হয়’ এবং স্টাবিয়েই (পম্পেই হতে ৪.৫ বা ২.৮ মাইল দূরে) বরাবর যাত্রা অব্যাহত রাখেন, যেখানে পম্পোনিয়াউস ছিলেন।[২৯] পম্পোনিয়াউস ইতিমধ্যেই একটি জাহাজে নিজের মালপত্র নিয়ে প্রস্থান করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কিন্তু যে হাওয়ায় পাল তুলে প্লাইনি উক্ত জায়গায় আসতে পেরেছিলেন ওই একই বিরূপ বাতাসে কারণে কেউ ওই উপকূল ছেড়ে বের হতে পারছিলেন না।[২৯]
প্লাইনি ও তার দল পাহাড়ের বিভিন্ন স্থান হতে আগুন নি:সরণ হতে দেখেছিলেন, যেগুলোর ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো পুড়ে গেছে বলে তারা ধারণা করেন। এক রাত থাকার পর তার দলকে উক্ত জায়গা ছাড়তে হয় কেননা জমা হতে থাকা বিভিন্ন পদার্থগুলো ক্রমেই বের হবার সকল রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছিলো।[২৯] তারা প্লাইনির ঘুম ভাঙায় যিনি ওই সময়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা মাঠ বরাবর চলা শুরু করবে, মাথায় বালিশ বেধে যাতে করে পড়ন্ত পাথর তাদের ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে উপকূল পর্যন্ত পৌঁছানোর পরে তারা দেখতে পান যে বাতাস অনুকূল হয়নি, ফলে সেই পথে বের হওয়া সম্ভব ছিলো না। প্লাইনি তীরে বিছানো একটা পালের ওপর শুয়ে পড়েন এবং তার সাথীদের সাহায্য নিয়েও আর উঠতে পারেননি, যারা সবিশেষে স্থলপথের মাধ্যমেই পালাতে বাধ্য হয়।[৩০] খুব সম্ভবত প্লাইনি সেখানেই মারা যান, যা ব্যাখ্যা করে কেনো তার সাথীরা তাকে রেখেই পালিয়ে আসে। যদিও সুতোনিয়াস একটি ভিন্নতর ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া রুখতে প্লাইনি তার এক ক্রীতদাসকে আদেশ দেন তাকে হত্যা করার। এমন কোনো ঘটনার বর্ণনা কনিষ্ঠ প্লাইনির চিঠিতে পাওয়া যায় না।
তাকিতাসের উদ্দেশ্যে রচিত প্রথম চিঠিতে জৈষ্ঠ প্লাইনির ভাতিজা অনুমান করেন যে তার মৃত্যু হয়েছিলো বিষাক্ত সালফার গ্যাসের মেঘের কারণে, যা তার দুর্বল ফুসফুস সহ্য করতে পারেনি।[২৯] কিন্তু স্টাবিয়েই এর অবস্থান ছিলো অগ্নু্ৎপাতের স্থান হতে ১৬ কিলোমিটার দূরে এবং প্লাইনির দলের আর কাউকে গ্যাসমেঘজনিত সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়নি। যা থেকে ধারণা করা যায় যে প্লাইনি অন্য কোনো কারণে মারা গিয়েছিলেন, যেমন স্ট্রোক বা হার্ট এ্যাটাক।[৩১] এমনকি এজমা এ্যাটাকও একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। কোনোরকম আপাত চোট ছাড়াই তার দেহ পাওয়া গিয়েছিলো এরপরের দিন, যখন মেঘ আর ধোয়া সরে গিয়েছিলো।
দুর্ঘটনায় হতাহত
প্লাইনি দা এল্ডারের পাশাপাশি এই ঘটনায় উল্লেখযোগ্য মৃত্যু ঘটে রোমান কর্মকর্তা আন্তোনিয়ো ফেলিক্সের স্ত্রী ইহুদী রাজকুমারী ড্রুসেলা এবং তার পুত্র আগ্রিপার।[৩২] ধারণা করা হয় যে কবি সিজিয়াস বাসুসও অগ্নুৎপাতের ঘটনায় মারা যান। [৩৩]
পম্পেই ও আর আশেপাশের এলাকা হতে ২০০৩ সাল নাগাদ ছাইয়ের নিচে মৃতদেহ চাপা পড়ে তৈরি হওয়া প্রায় ১০৪৪টি ছাঁচ উদ্ধার করা সম্ভব হয়, এবং বিক্ষিপ্ত দেহাবশেষ পাওয়া যায় আরো ১০০ জনের।[৩৪] হেরকুলেনিয়ামে পাওয়া গিয়েছে ৩৩২টি দেহাবশেষ (যার মধ্যে ৩০০টি কিছু খিলানযুক্ত ভল্টে ১৯৮০ সালে আবিষ্কৃত)।[৩৫] আবিষ্কৃত দেহগুলো মোট মৃতের কত শতাংশ তা সম্পূর্ণ অজানা।
১০৪৪ টি দেহের মধ্যে আটত্রিশ শতাংশ পাওয়া গিয়েছে ছাইস্তুপে, যার বেশিরভাগই বিভিন্ন স্থাপনার ভেতরে তৈরি হয়েছিলো। এদের মৃত্যু হয়েছিলো মূলত ছাদ ধসে পড়ার কারণে। কিছুসংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছেন স্থাপনাগুলোর বাইরে – ছাদ স্লেট ধসে পড়ার দরুন কিংবা আগ্নেয়গিরি দ্বারা নিক্ষিপ্ত বড় পাথরের আঘাতে। আধুনিক ঘটনাবলির সাথে এর পার্থক্য এখানেই, বিভিন্ন অগ্নুৎপাতে গত ৪০০ বছরে ছাইবর্ষণে মৃত্যু হয়েছে মা্ত্র ৪ শতাংশ নিহতের। পম্পেইতে প্রাপ্ত মৃতের বাকি ৬২% এর মৃত্যুর কারণ প্রধানত পাইরোক্লাসটিক স্ফীতিসমূহ[৩৪] কেননা স্ফীতি দ্বারা আলোড়িত স্থানগুলোতেই তাদের মরদেহ পাওয়া গিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিলো যে পম্পেই থেকে উদ্ধার করা মরদেহগুলোর অবস্থা ও তাদের দেহে কাপড়ের দ্বারা তৈরি হওয়া রেখা থাকার কারণে এটা অসম্ভাব্য যে উচ্চ তাপমাত্রা তাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। কিন্তু ২০১০ সালে করা একটি নিরীক্ষায় দেখা যায় যে চতুর্থ পাইরোক্লাসটিক স্ফীতির – যা পম্পেই পর্যন্ত পৌঁছানো প্রথম – তাপমাত্রা ছিলো ৩০০° সেলসিয়াস (৫৭২° ফারেনহাইট)। আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞ জিয়ুসেপ্পে মাস্ট্রোলরেঞ্জো, যিনি নিরীক্ষাটির নেতৃত্ব দেন, উল্লেখ করেন যে: “শত শত মানুষকে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মাঝে মেরে ফেলার জন্য এটা যথেষ্ট ছিলো”। দেহগুলোর কুঞ্চিত ধরন সম্পর্কে তিনি বলেন, “এরকমটা দীর্ঘসময় ধুকে ধুকে মৃত্যুর ফলে হয়নি, বরং এটি হৃদপিন্ডে শকের প্রভাবে ঘটেছে"।[৩৬]
হেরকুলেনাম, যা তুলনামূলকভাবে আগ্নেয়গিরির নিকটে ছিলো, টেফরা (আগ্নেয় পাথর) এর বর্ষণ হতে রক্ষা পায় বায়ুপ্রবাহের দিকের কারণে কিন্তু পাইরোক্লাসটিক স্ফীতির মাধ্যমে চাপা পড়ে ২৩ মিটার (৭৫ ফিট) নিচে। এটা সম্ভাব্য যে ওখানে মারা যাওয়া প্রায় সবাই-ই মৃত্যুবরণ করেন এই স্ফীতিগুলোর কারণে, যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় প্রাপ্ত মরদেহের মাঝে উচ্চ তাপমা্ত্রার চিহ্ন এবং স্থাপনাগুলোতে কার্বনজারিত কাঠ দেখে।
এই মানুষগুলোর সকলেই আটকা পড়েন তৎকালীন সমুদ্রতীরে এবং মারা যান তাপীয় শকের ফলে কিন্তু আগুনে পুড়ে নয়, যদিও অনেকেই পরবর্তীকালে আংশিকভাবে দগ্ধ হন। খিলানকরা ভল্ট যেখানে দেহসমূহ পাওয়া যায় সেগুলো খুব সম্ভবত ছিলো বোটহাউজ, যদিও সেখানে কোনো নৌকা পাওয়া যায়নি যা থেকে বোঝা যায় যে হয়তো অনেকে সেগুলোতে পালানোর সুযোগ পেয়েছিলো। সেখানে মানুষ জড়ো হয়েছিলো প্রতি বর্গমিটারে তিনজন করে। এখন পর্যন্ত উপকূলের মাত্র ৮৫ মিটার খনন করা হয়েছে, বাকি অংশটুকুতে এখনও হাজার হাজার মৃতদেহ থাকতে পারে।[৩৭]
উদ্গিরণের তারিখ
গত পাঁচ শতাব্দী ধরে প্রকাশিত হওয়া বিভিন্ন নিবন্ধে ভিসুভিয়াসে অগ্নুৎপাতের তারিখ হিসেবে ৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে আগস্টকে ধরা হয়েছে। এই তারিখটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫০৮ সালে মুদ্রিত প্লাইনি দা ইয়াংগার ও রোমান ইতিহাসবিদ টাকিটাসের মাঝে লেনদেন হওয়া চিঠিতে, যা লেখাই হয়েছিলো উদ্গিরণের ঘটনার ২৫ বছর পরে।[৩৮][৩৯] প্লাইনি এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং তিনিই একমাত্র যিনি এ সম্পর্কে লিখিত বর্ণনা রেখে গিয়েছেন। মুদ্রিত হবার আগে চৌদ্দশ বছর বছর ধরে তার লেখা চিঠিতে বারংবার হাতে অনুলিপিত হতে গিয়ে হয়তো আসল তারিখটি হারিয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে প্লাইনি কর্তৃক প্রদত্ত তারিখ হতে পারে: ২৪শে আগস্ট, ৩০শে অক্টোবর, পহেলা নভেম্বর বা ২৩শে নভেম্বর।[৪০] এরকম অদ্ভুত ও ছড়ানো-ছিটানো অনুমান এসেছে মূলত রোমানদের পঞ্জিকা গণনার বিশেষ নিয়মের কারণে। বিভিন্ন মধ্যযুগীয় অনুলিপিতে – যদিও সরাসরি কোনো রোমান লিপির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি – তারিখের যেসব তথ্য দেওয়া আছে যা কমবেশি ২৪শে আগস্টকেই নির্দেশ করে, এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলোর আবিষ্কার হবার পর একবিংশ শতাব্দীতে এই তারিখটিই সর্বজন স্বীকৃত হয়েছিলো এবং পম্পেই ও হেরকুলেনিয়াম নিয়ে রচিত প্রায় সকল পুস্তকেও এটাই উল্লেখিত।
কিন্তু, ২০১৮ সালের অক্টোবরে, ইটালিয় প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বিবৃত করেন যে সদ্যপ্রাপ্ত একটি লিপিতে ভিসুভিয়াস উদ্গিরণের তারিখ হিসেবে ১৭ অক্টোবরের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে, যা প্লাইনির চিঠির অনুলিপিতে ভুল তারিখ আসার তত্ত্ব সমর্থন এবং ২৪শে আগস্টের ধারণাকে বাতিল করে। [৪১]
ভিসুভিয়াস এবং এর প্রয়লংকারী উদ্গিরণের উল্লেখ পাওয়া প্রথম শতাব্দীর রোমান লেখালেখিতে, কিন্তু এগুলোর সবই তারিখ বহির্ভুত। উদাহরণস্বরূপ, জোসেফাস তার রচনা ইহুদীদের পুরাকীর্তিতে বিবরণ দেন এইভাবে যে অগ্নৎপাতটি ঘটেছিলো ‘টাইটাস সিজারের আমলে’।[৪২]
সুতোনিয়াস, দ্বিতীয় শতাব্দীর একজন ইতিহাসবিদ, তার রচনা টাইটাসের জীবন-এ বলেন যে, “তার (টাইটাসের) শাসনামলে কিছু ভয়াবহ দুর্যোগ সংঘটিত হয়, যেমন ক্যাম্পানিয়ায় ভিসুভিয়াসের উদ্গিরণ"।"[৪৩]
মুল ঘটনার এক শতাব্দী পরে রোমান ইতিআসবিদ ক্যাসিয়াস ডিও (লোয়েব ক্লাসিকাল লাইব্রেরি কর্তৃক ১৯২৫ সালে অনুবাদিত) লিখেছেন যে, “ক্যাম্পানিয়াতে কিছু উল্লেখযোগ্য এবং ভয়ানক ঘটনা ঘটে; গ্রীষ্মের একেবারে শেষদিকে আচমকা একটি বিশাল আগুনের সূত্রপাত হয়”। [৪৪]
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক হতে প্রত্নতত্ত্ববিদগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রস্তাব করে আসছেন যে উদ্গিরণের সূচনা হয়েছিলো আগস্টের ২৪ তারিখের পর, হেমন্তের মাঝামাঝিতে, নতুবা অক্টোবর বা নভেম্বরে। ১৭৯৭ সালে গবেষক কার্লো রসিনি বিবরণ দেন যে পম্পেই এবং হেরকুলেনিয়ামের খনন হতে হেমন্তকালীন ফলের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে, গ্রীষ্মকালের নয়।
সাম্প্রতিককালে, ১৯৯০ ও ২০০১ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ পমেগ্রানেটের মতো হেমন্তকালের কিছু ফলের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন ধ্বংসস্তুপে, এছাড়াও নিহতদের গায়ে ছিলো ভারী পোশাক, পাওয়া গিয়েছিলো ওয়াইনপূর্ণ মাটির পাত্র। মদসংক্রান্ত এই আবিষ্কার ইঙ্গিত করে যে অগ্নুৎপাতের ঘটনাটি ঘটেছিলো ওই বছরের আঙুর চাষের পর কেননা আঙুর দিয়েই ওই মদ তৈরি করা হতো।[৪৫]
২০০৭ সালে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের দিক সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা যায় যে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছাই, পাথর ও ভস্ম পতনের ধরনটি হেমন্তকালীন বায়ুপ্রবাহে সাথে সামঞ্জসপূর্ণ, আগস্টের কোনো তারিখের সাথে নয়। জুন, জুলাই এবং আগস্টের সময়ে প্রধান বায়ুপ্রবাহ হয় পশ্চিম দিকে – দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমের সাথে বক্ররেখা তৈরি করে - প্রায় শতভাগ সময়েই।[৪৫] (এখানে উল্লেখ্য যে প্রথম শতাব্দীতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন ছিলো, অর্থাৎ রোমান ক্যালেন্ডারের মাসগুলো ছিলো ঋতুসমূহের সাথে সামঞ্জসপূর্ণ।)
ফ্লাভিয়ান রাজবংশের সম্রাট টাইটাস (শাসনকাল জুন ২৪, ৭৯ হতে সেপ্টেম্বর ১৩, ৮১) যুদ্ধক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য অর্জন করেন (তন্মধ্যে অন্যতম ছিলো জেরুজালেম উপাসনালয়ের দখল নেওয়া), তার প্রশাসন তাই এসব সদা বর্ধমান অর্জনের সম্মানে বিভিন্ন মুদ্রা তৈরি করে। প্রতিটি মুদ্রায় জায়গা কম থাকায় টাইটাসের কীর্তিগুলো রহস্যময় গুপ্তলিপির মাধ্যমে ছাপানো হতো। টাইটাসে শাসনামলের শুরুর দিকের এরকম দুইটি মু্দ্রা পাওয়া যায় পম্পেইয়ের ‘হাউজ অফ গোল্ডেন ব্রেসলেটে’। যদিও মুদ্রাগুলোর তৈরি করার সময় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে,[৪৫] ব্রিটিশ জাদুঘরের মুদ্রাবিশেষজ্ঞ রিচার্ড অ্যাবডির মতে পম্পেইয়ের ওখানে প্রাপ্ত মুদ্রাগুলোর মধ্যে সর্বশেষগুলো মুদ্রিত হয়েছিলো ২৪শে জুনে (টাইটাসের শাসনের প্রথম দিন) বা তার পরে এবং পহেলা সেপ্টেম্বর, ৭৯ সালের আগে। অ্যাবডি বর্ণনা দেন যে “এটা লক্ষণীয় যে দুটো মুদ্রাই ছাপা হবার দুই মাসের মধ্যে প্রচলিত হয়েছিলো এবং (ভিসুভিয়াস) উদ্গিরণের পূর্বেই পম্পেই পৌঁছেছিলো”।[৪৬]
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- Rolandi, G.; Paone, A.; De Lascio, M.; Stefani, G. (২০০৮)। "The 79 AD eruption of Somma: the relationship between the date of the eruption and the southeast tephra dispersion"। Journal of Volcanology and Geothermal Research। 169 (1): 87–98। ডিওআই:10.1016/j.jvolgeores.2007.08.020। বিবকোড:2008JVGR..169...87R।
- Sigurðsson, Haraldur (২০০২)। "Mount Vesuvius before the Disaster"। Jashemski, Wilhelmina Mary Feemster; Meyer, Frederick Gustav। The natural history of Pompeii। Cambridge UK: The Press Syndicate of the University of Cambridge। পৃষ্ঠা 29–36।
- Sigurðsson, Haraldur; Carey, Steven (২০০২)। "The Eruption of Vesuvius in AD 79"। Jashemski, Wilhelmina Mary Feemster; Meyer, Frederick Gustav। The natural history of Pompeii। Cambridge UK: The Press Syndicate of the University of Cambridge। পৃষ্ঠা 37–64।
- Zanella, E.; Gurioli, L.; Pareschi, M.T.; Lanza, R. (২০০৭)। "Influences of urban fabric on pyroclastic density currents at Pompeii (Italy): Part II: temperature of the deposits and hazard implications" (পিডিএফ)। Journal of Geophysical Research। 112 (112): B05214। ডিওআই:10.1029/2006JB004775। বিবকোড:2007JGRB..112.5214Z।
বহিঃসংযোগ
- "AD79 Destruction and Rediscovery"। AD79 Eruption। Information on the eruption, the locations destroyed, and subsequent rediscovery.