অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস

অস্ট্রেলিয়ান ইতিহাস

অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস হল অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ভূমি ও মানুষের গল্প। ৫০,০০০ থেকে ৬৫,০০০ বছর আগে অস্ট্রেলীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠী সামুদ্রিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সমুদ্রপথে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে আসে। ধীরে ধীরে তারা উত্তরে রেইনফরেস্ট থেকে শুরু করে মধ্য অষ্ট্রেলিয়ার মরুভূমি পর্যন্ত এই মহাদেশের সমস্ত অংশে প্রবেশ করে। এছাড়াও তারা তাসমানিয়া এবং বাস প্রণালীর উপ-অ্যান্টার্কটিক দ্বীপপুঞ্জ গুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান শিল্প, সঙ্গীত এবং আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যগুলি মানব ইতিহাসে দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকা ঐতিহ্যগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রথম টোরেস স্ট্রেইট দ্বীপবাসী জনগোষ্ঠী আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের থেকে জাতিগতভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা ছিল। প্রায় ২,৫০০ বছর আগে এখনকার পাপুয়া নিউ গিনি থেকে তারা এখানে এসে টরেস প্রণালী এবং কেপ ইয়র্ক উপদ্বীপের দ্বীপগুলিতে বসতি স্থাপন করেছিল।

১৬০৬ সালে প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে, ডাচ নাবিক জন্সজুন অস্ট্রেলিয়ায় অবতরণ করেন। সেই বছরের শেষের দিকে, স্প্যানিশ অভিযাত্রী লুইস ভাজ দে টোরেস টোরেস প্রণালী এবং তার আশেপাশের দ্বীপে পৌছান।[১] ২৯ জন অন্যান্য ডাচ নেভিগেটর ১৭ শতকে পশ্চিম ও দক্ষিণ উপকূল অন্বেষণ করেন এবং মহাদেশের নাম দেন ‘নিউ হল্যান্ড’। অন্যান্য ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা ১৭৭০ সাল পর্যন্ত অনুসরণ করেন, লেফটেন্যান্ট জেমস কুক গ্রেট ব্রিটেনের জন্য অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলকে পছন্দ করেছিলেন। তিনি বোটানি উপসাগর (এখন সিডনিতে অবিস্থিত) উপনিবেশ স্থাপনের অভিপ্রায় নিয়ে লন্ডনে ফিরে যান।

১৭৮৮ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ জাহাজের প্রথম নৌবহর অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে প্রথম উপনিবেশ পেনাল কলোনি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে বোটানি উপসাগরে পৌছায়। পরবর্তী শতাব্দীতে, ব্রিটিশরা মহাদেশের অন্যান্য স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করে। ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা এর আরো গভীরে প্রবেশ করে। রোগ বালাই এবং উপনিবেশবাদীদের সাথে সংঘর্ষের কারণে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের সংখ্যা হ্রাস পায়।

স্বর্ণ সন্ধান এবং কৃষি শিল্প অষ্ট্রেলিয়ায় সমৃদ্ধি আনে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে ছয়টি ব্রিটিশ উপনিবেশ জুড়ে স্বায়ত্তশাসিত সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার পথে এগোতে থাকে। উপনিবেশগুলি ১৯০১ সালে একটি ফেডারেশনে একত্রিত হওয়ার জন্য গণভোটের মাধ্যমে ভোট দেয় এবং আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার জন্ম হয়। অস্ট্রেলিয়া দুই বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইম্পেরিয়াল জাপানের হুমকির মুখেও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী মিত্র ছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এশিয়ার সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অভিবাসন কর্মসূচির আওতায় অষ্ট্রেলিয়া প্রতিটি মহাদেশ থেকে ৬.৫ মিলিয়নেরও বেশি অভিবাসী গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের পর থেকে শুরু করে ২০২০ সালের মধ্যে ২৫.৫ মিলিয়নেরও বেশি বেড়েছে। যাদের ৩০ শতাংশের জন্ম অষ্ট্রেলিয়ার বাইরে।

প্রাগৈতিহাসিক কাল

Rock painting at Ubirr in Kakadu National Park. Evidence of Aboriginal art in Australia can be traced back some 30,000 years.

আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানরা ৫০,০০০ থেকে ৬৫,০০০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় আসে বলে মনে করা হয়।[২][৩] তারা একটি শিকারী-সংগ্রাহক জীবন যাপন পদ্ধতি গড়ে তুলেছিল। আদি এই সব সমাজে আধ্যাত্মিক, শিল্পের উপস্থিতি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল। ব্রিটিশ বসতি স্থাপনের সময় আদিবাসী জনসংখ্যার ছিল অনুমানিক ৫০০,০০০ থেকে এক মিলিয়ন পর্যন্ত।[৪][৫]

আদিবাসীরা কোন পথে অষ্ট্রেলিয়ার পৌছায় সে বিষয়ে প্রত্নতাত্বিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। বরফ যুগে যখন নিউ গিনি এবং তাসমানিয়া পরস্পরের সাথে যুক্ত ছিল তখন প্রগৈতিহাসিক এসব মানুষ অষ্ট্রেলিয়ায় আগমন করেছিল। তবে সমুদ্রপথ ছাড়া অন্য কোন পথ না থাকায় তারা যে বিশ্বের প্রথম দিকের নাবিক ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।[৬] যদি তারা প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে পৌঁছে থাকে তবে তারা তিমুর থেকে জলপথ অতিক্রম করে এসেছিল। যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অনেক কম ছিল। কিন্তু তারা যদি এর পরে আসে, সময়টা যদি আনুমানিক প্রায় ৫০,০০০ বছর পূর্বে হয় তবে মোলুকাসের মধ্য দিয়ে নিউ গিনিতে আসার সম্ভাবনাই বেশি।[৭]

অস্ট্রেলিয়ায় মানব বসতির প্রাচীনতম স্থানগুলির অন্যতম ছিল মহাদেশের উত্তরে অবস্থিত আর্নহেম, যা প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৬৫,০০০ বছর আগের বলে অনুমান করা যায়। ক্রমে জনসংখ্যা মহাদেশটির বিভিন্ন পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৪৭,০০০ থেকে ৩৯,০০০ বছর আগে, মহাদেশের একদ দক্ষিণ-পশ্চিমে ডেভিলস লেয়ার এবং তাসমানিয়ায় তারা ছড়িয়ে পড়েছিল।[৮] জনসংখ্যার এই বিস্তার পরিবেশের পরিবর্তন করেছিল। ৪৬,০০০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে আগুনের ব্যবহারের প্রমাণ রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অনেক এলাকায় আগুন ব্যাবহার করা হতো গাছপালা পরিষ্কার করার জন্য, যাতায়াতকে সহজ করার জন্য এবং শীকারের প্রাণীকে ফাঁদের দিকে তাড়িয়ে নেবার জন্য। এছাড়া চারণভূমি আর খাদ্যের উৎসের সন্ধানে তৃণভূমি তৈরি করতে আগুনের ব্যাবহার করা হতো।[৯] অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী জগতের একটি বিশাল অংশ, প্রায় ৬০ টিরও বেশি প্রজাতির প্রাণী ১০,০০০ আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গবেষকরা বিভিন্নভাবে এই বিলুপ্তির জন্য শিকার এবং লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করার অনুশীলন, জলবায়ু পরিবর্তন বা এই সব কারণগুলিকে দায়ী করেছেন। [১০]

Kolaia man wearing a headdress worn in a fire ceremony, Forrest River, Western Australia. Aboriginal Australian religious practices associated with the Dreamtime have been practised for tens of thousands of years.

এসব আদিবাসীরা বিভিন্ন পরিবেশকে নিজেদের কাজে লাগানোর জন্য অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যাবহার করত। ৪০,০০০ বছর পূর্বে নৌকা এবং মাছ ধরার কৌশল তারা জানত। ৩৫,০০০ বছর আগে কাঠের হাতলে বাঁধা কুঠার ব্যাবহার করতো। পরবর্তী সময়ে সেখানে আরও ব্যাপক বাণিজ্য নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে।[১১] ৩৫,০০০ বছর পূর্বের পাথরের উপর প্রাচীন হাতের ছাপ, বৃত্ত, লাইন খোদাই করা শিল্পকর্মের নিদর্শন সেখানে পাওয়া গিয়েছে। প্রায় ২০,০০০ বছর আগে আদিবাসী শিল্পীরা মানুষ এবং প্রাণীদের চিত্রিত করছিলেন। [১২] তবে, এসকল সময়ের ধারণা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। তবে কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে, আদিবাসী শিলা শিল্পের পরিচিত উদাহরণ সম্ভবত আরও সাম্প্রতিক।[১৩] আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু এবং পরিবেশের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রায় ৩০,০০০ বছর আগে, সমুদ্রের স্তর কমতে শুরু করলে, মহাদেশেটির দক্ষিণ-পূর্বে তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যায় এবং অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরে আবহাওয়া আরও শুষ্ক হয়ে ওঠে। প্রায় ২০,০০০ বছর আগে নিউ গিনি এবং তাসমানিয়া অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সাথে সংযুক্ত ছিল যা আকারে আজকের তুলনায় এক চতুর্থাংশেরও বেশি বড় ছিল।[১৪] প্রায় ১৯,০০০ বছর আগে তাপমাত্রা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে শুরু করে। তাসমানিয়া প্রায় ১৪,০০০ বছর আগে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।৮,০০০ থেকে ৬,০০০ বছর আগে টোরেস প্রণালী এবং অস্ট্রেলিয়ার উপকূলের আশেপাশে হাজার হাজার দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছিল।[১৪] [১৫]

২০১২ সালে একটি জেনেটিক গবেষণার ফলাফল দেখে ধারণা করা হয়েছিল যে প্রায় ৪,০০০ বছর আগে, কিছু ভারতীয় অভিযাত্রী অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং স্থানীয় জনসংখ্যার সাথে মিশে গিয়েছিল।[১৬] তবে, সাম্প্রতিক গবেষণা এই মতামত সমর্থন করে না।[১৭]

নিজস্ব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পাশাপাশি কিছু প্রযুক্তি প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও অষ্ট্রেলিয়ায় এসেছিল। আদি অষ্ট্রেলিয়ার জনগন প্রায় ১,২০০ বছর পূর্বে ঝিনুক দিয়ে বানানো মাছ ধরার বড়শি ব্যবহার করতো। সম্ভবত টরেস প্রণালী বা পলিনেশিয়ান নাবিকরা এর প্রবর্তক ছিল। ১৬৬০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইন্দোনেশিয় মাছ ধরার নৌকাগুলো সি কিউকম্বার সংগ্রহ করার জন্য অষ্ট্রেলিয়া উপকূলে নিয়মিত ভ্রমণ করতো। অষ্ট্রেলিয় আদিবাসীরা ইন্দোনেশিয়ানদের কাছ থেকে ডিঙি নৌকা, হরপুন বানানোর কৌশল শিখেছিল।[১৮]

প্রতিবেশী সংস্কৃতির সাথে মেলামেশা করলেও, অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সমাজের মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তিত ছিল। পরিবারগুলো মোটামুটি ২৫ জনের ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। সে সব গোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট এলাকায় খাবার সংগ্রহের জন্য বিচরণ করতো। এসব গোষ্ঠীগুলি আবার বৃহত্তর উপজাতি বা জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইউরোপীয়দের আগমনের সময় প্রায় ৬০০ টি উপজাতি বা জাতি এবং ২৫০ টি স্বতন্ত্র ভাষা ছিল। এসব ভাষার বিভিন্ন উপভাষা ছিল। [১৯][২০] আদিবাসী সমাজ সমতাবাদী ছিল। কোনো আনুষ্ঠানিক সরকার বা প্রধান ছিল না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ্য বা প্রবীণদের হাতেই কর্তৃত্ব ছিল। গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্তগুলি সাধারণত বড়দের ঐকমত্যের মাধ্যমে নেওয়া হত। অর্থনীতি ছিল সমবায়মূলক। পুরুষরা সাধারণত বড় প্রাণী শিকার করত। মহিলারা ছোট প্রাণী, শেলফিশ, শাকসবজি, ফল, বীজ এবং বাদামের মতো খাবার সংগ্রহ করত। সংগৃহীত খাবার গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ করা হতো। বিনিময়ও করা হতো।[২১]

আদিম গোষ্ঠীগুলি আধা-যাযাবর ছিল, সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে তাদের বাস করতো। একটি গোষ্ঠীর সদস্যরা বিবাহ এবং আত্মীয়তার জন্য বা অন্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে আমন্ত্রিত হয়ে অন্যের এলাকায় প্রবেশ করতো। [২২][২০] কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী কতটা কৃষিপ্রধান ছিল তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। পশ্চিম ভিক্টোরিয়ার লেক কনডাহ অঞ্চলে বাসিন্দারা ঈল মাছ শিকার করতে বিশাল ফাঁদ ব্যবহার করতো। শিকার মৌসুমে শত শত আধা-স্থায়ী পাথর এবং বাকল কুঁড়েঘর তৈরী করে সেখানে থাকতো। তবে, এই গোষ্ঠীগুলি অন্যান্য মৌসুমী খাদ্য উৎসের সন্ধানে তাদের নিজের এলাকা জুড়ে চলাচল করতো।[২৩] আধা-শুষ্ক এলাকায়, বাজরা সংগ্রহ করে, স্তুপ করে মাড়াই করা হতো। সেখান থেকে পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য বীজ সংরক্ষণ করা হয়।[২৪]

প্রাথমিক ইউরোপীয় আগমন

ডাচদের অষ্ট্রেলিয়া আবিষ্কার

Exploration by Europeans until 1812
  1606 Willem Janszoon
  1606 Luis Vaez de Torres
  1616 Dirk Hartog
  1619 Frederick de Houtman
  1644 Abel Tasman
  1696 Willem de Vlamingh
  1770 James Cook
  1797–99 George Bass
  1801–03 Matthew Flinders
অ্যাবেল তাসমান, প্রথম ইউরোপীয় যিনি ভ্যান ডাইমেন’স ল্যান্ড আবিষ্কার করেছিলেন, যা এখন তাসমানিয়া নামে পরিচিত

যদিও ১৫২০-এর দশকে পর্তুগিজ আবিষ্কারের একটি তত্ত্ব প্রচলিত থাকলেও তার পিছনে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাব রয়েছে।[২৫][২৬][২৭][২৮] ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ, ডুইফকেন, উইলেম জানসজুনের নেতৃত্বে, ১৬০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে অষ্ট্রেলিয়ায় অবতরণ করেছিল। [২৯]একই বছর, একদল স্প্যানিশ অভিযাত্রী জলপথে পর্তুগিজ ন্যাভিগেটর পেড্রো ফার্নান্দেস ডি কুইরোসের নেতৃত্বে নিউ হেব্রাইডে অবতরণ করে। তারা পৌরানিক কাহিনীতে বর্ণিত দক্ষিণ মহাদেশ ধরে নিয়ে এর নামকরণ করেছিল "অস্ট্রেলিয়া দেল এসপিরিতু সান্টো" (দক্ষিণ ভূমি পবিত্র আত্মা), অস্ট্রিয়ার তার রানী মার্গারেটের সম্মানে, স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের স্ত্রীর নামে নাম করে।[৩০][৩১][৩২][৩৩]

অস্ট্রেলিয়ার উপকূল সম্পর্কে ইউরোপের জনগনের জ্ঞানের পিছনে ডাচদের অনেক অবদান রয়েছে।[৩৪] In 1616, Dirk Hartog, sailing off course, en route from the Cape of Good Hope to Batavia, landed on an island off Shark Bay, Western Australia.[৩৪]

১৬৪২ সালের আবেল তাসমানের সমুদ্রযাত্রা ভ্যান ডাইমেন’স ল্যান্ড (পরে তাসমানিয়া) এবং নিউজিল্যান্ডে পৌঁছান। এ গমন করেন। ১৬৪৪ সালে তার দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রায়, তিনি অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের মানচিত্র তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।

ব্রিটিশ এবং ফরাসি অভিযান

লেফটেন্যান্ট জেমস কুক, প্রথম ইউরোপীয় যিনি ১৭৭০ সালে অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলরেখার ম্যাপ তৈরী করেন। ন্যাথানিয়েল ডান্স-হল্যান্ডের চিত্রকর্ম।

উইলিয়াম ড্যাম্পিয়ার, একজন ইংরেজ জলদস্যু এবং পর্যটক ১৬৮৮ সালে এবং পুনরায় ১৬৯৯ সালে নিউ হল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবতরণ করেন। তিনি আদিবাসীদের চমৎকার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করেছিলেন।[৩৫]

১৭৬৯ সালে, এইচএমএস এন্ডেভারের অধিনায়ক, লেফটেন্যান্ট জেমস কুক শুক্র গ্রহের ট্রানজিট পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করতে তাহিতিতে যান। কথিত দক্ষিণ মহাদেশটি সনাক্ত করার জন্য প্রধান নৌসেনাপতির দফতরের গোপন নির্দেশ কুকের সাথে ছিল।[৩৬]

১৯ এপ্রিল ১৭৭০ সালে রাজকীয় জাহাজ এন্ডেভার নিউ হল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে পৌঁছে এবং দশ দিন পরে বোটানি বে-তে নোঙর করে। কুক উপকূলটিকে তার উত্তরের সীমারেখায় চিহ্নিত করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ২১/২২ আগস্ট ১৭৭০ তারিখে কেপ ইয়র্ক উপদ্বীপের পশ্চিম উপকূল এবং নিউ হল্যান্ডের পূর্ব উপকূল দখল করেন। [৩৭] কুক নিউ হল্যান্ডের পূর্ব উপকূল জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেন, এই মহাদেশের একমাত্র বড় অংশ যার মানচিত্র ডাচ নেভিগেটররা তেরী করেনি।[৩৮]

১৭৭২ সালের মার্চ মাসে দু্ইটি ফরাসি জাহাজ, মার্ক-জোসেফ মেরিয়ন ডু ফ্রেসনের নেতৃত্বে, তাহিতি এবং দক্ষিণ সাগরে যাওয়ার পথে ভ্যান ডাইমেনের ভূমিতে জমিতে পৌঁছায়। এই দলের সাথে আদিবাসী তাসমানিয়ানদের সংঘর্ষ হয়েছিল। এই সংঘর্ষে ইউরোপিয়রা একজন আদিবাসীকে হত্যা করেছিল।[৩৯] একই বছরে, লুইস অ্যালেনো দে সেন্ট অ্যালোয়ার্ন এর নেতৃত্বে একটি ফরাসি অভিযান অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূলের উপর আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌমত্ব দাবি করে। কিন্তু পরে আর সেখানে পুর্নাঙ্গ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করার কোন চেষ্টা করা হয়নি।[৪০]

উপনিবেশ

১৭৮৮ সালের আগে উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা

Two of the Natives of New Holland, Advancing To Combat (1770), sketched by Cook's illustrator Sydney Parkinson

যদিও ১৭৮৮ সালের আগে অস্ট্রেলিয়ার উপনিবেশ স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকটি প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু কোনোটিই শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করা হয়নি। ১৭১৭ সালে জিন-পিয়েরে পুরি বর্তমান দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার একটি এলাকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে একটি পরিকল্পনা পাঠান। কোম্পানি অবশ্য অতিরিক্ত খরচ ও সেই তুলনায়ে লাভের কোন সম্ভবনা না দেখতে পেয়ে তা নাকচ করে দিয়েছিল।[৪১] অপরদিকে, ইমানুয়েল বোয়েন, ১৭৪৭ সালে, লেখালেখির মাধ্যমে অষ্ট্রেলিয়ায় দেশটির উপনিবেশ স্থাপনের সুবিধার দিকগুলো প্রচার করেন।[৪২] জন ক্যাল্যান্ডার ১৭৬৬ সালে ব্রিটেনের কাছে দক্ষিণ সাগরে বা টেরা অস্ট্রালিসে নির্বাসন দন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য একটি উপনিবেশের জায়গা খুঁজে বের করার জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করেন।[৪৩]

সুইডেনের রাজা তৃতীয় গুস্তাভ ১৭৮৬ সালে সোয়ান নদীতে তার দেশের জন্য একটি উপনিবেশ স্থাপনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিলেন।[৪৪] কিন্তু সে আকাঙ্খা আলোর ‍মুখ দেখেনি।

অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে কুকের পদার্পনের ষোল বছর পর, ব্রিটিশ সরকার বোটানি বে তে একটি উপনিবেশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধে (১৭৭৫-১৭৮৩) ব্রিটেন তার উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ উপনিবেশ হারিয়ে এবং তার জায়গায় নতুন উপনিবেশ খুঁজছিল। তাছাড়া ব্রিটেন ১৭১৮ থেকে ১৭৭৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০,০০০ জন শাস্তিপ্রাপ্ত আসামীকে এই নতুন জায়গায় পাঠিয়েছিল যাদের জন্যও একটি বিকল্প আবাস তারা খুঁজছিল। অস্থায়ী ভাসমান কারাগারগুলির ধারণ ক্ষমতার বেশী বন্দী হওয়ায় সেখানে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছিল।[৪৫][৪৬] বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস, জেমস কুকের ১৭৭০ সালের সমুদ্রযাত্রার সাথী ছিলেন। তিনি শাস্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের জন্য বোটানি বেকে সুপারিশ করেছিলেন। ব্যাঙ্কের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০ থেকে ৩০০ জন দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে বোটানি বে-তেনিজেদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে যাতে তাদের ভরণপোষনের দায়িত্ব আর ব্রিটিশ করদাতাদের উপর থাকবে না।[৪৭]

১৭৮৪ সালের নভেম্বরে লন্ডনের সংবাদপত্রগুলিতে সংবাদ ছাপা হয় যে, "নিউ হল্যান্ডে নতুন উপনিবেশ স্থাপনের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর ও মন্ত্রিপরিষদের কাছে পেশ করা হয়েছে। এই বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমি উর্বর .... প্রচুর উৎপাদন ও উন্নতি আশা করা যেতে পারে।"[৪৮]

বোটানি বে-র বিকল্প হিসাবে অপরাধীদের আফ্রিকায় পাঠানো যেতো। ১৭৮৩ সালে পিট সরকার গাম্বিয়ার একটি ছোট নদীা দ্বীপে দন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের নির্বাসিত করার একটি পরিকল্পনা বিবেচনা করে যেখানে তারা একটি স্ব-শাসিত এলাকা গঠন করতে পারে। এই পরিকল্পনা বাস্তিবায়িত হলে সরকারের কোনো খরচ ছাড়াই একটি "চোরের উপনিবেশ" গঠিত হত।[৪৯]

১৭৮৫ সালে লর্ড বিউচ্যাম্পের সভাপতিত্বে একটি সংসদীয় নির্বাচন কমিটি গাম্বিয়ার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সুপারিশ করেছিল, কিন্তু বোটানি বে-এর বিকল্প কোন প্রস্তাব করতেও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। একটি দ্বিতীয় প্রতিবেদনে, বিউচাম্প আধুনিক নামিবিয়ার উপসাগরে একটি অপরাধী কলোনি করার জন্য সুপারিশ করেন। ১৭৮৬ সালে সরেজমিনে তদন্ত করে অনুপযুক্ত বলে মনে হলে পরিকল্পনাটি বাদ দেওয়া হয়। দুই সপ্তাহ পরে, ১৭৮৬ সালের আগস্টে, পিট সরকার দন্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের বোটানি বেতে পাঠানোর অভিপ্রায় ঘোষণা করে।[৫০][৫১]

তবে এই উপনিবেশটি শুধুমাত্র দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের জন্য নির্মিত বিশেষ উপনিবেশ হবে না স্বাভাবিক সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত সাধারন উপনিবেশ হবে এই নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কিছু বিতর্ক হয়েছিল।

নিউ সাউথ ওয়েলসের উপনিবেশ

উপনিবেশ স্থাপন: ১৭৮৮ থেকে ১৭৯২

আর্থার ফিলিপ, নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রথম গভর্নর

ব্রিটেনের দাবিকৃত নিউ সাউথ ওয়েলস ভূখণ্ডে ১৩৫° পূর্বের মেরিডিয়ানের পূর্বদিকে সমগ্র অস্ট্রেলিয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর ফলে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের অর্ধেকেরও বেশি ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত হয়।[৫২] ১৭৮৮ সালের জানুয়ারিতে ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ১১টি জাহাজের বহর রাজকীয় প্রথম ফ্লিটের আগমনের মধ্য দিয়ে নিউ সাউথ ওয়েলসের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৭৭৮ জন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী (১৯২ জন মহিলা এবং ৫৮৬ জন পুরুষ) সহ এক হাজারেরও বেশি বসতিস্থাপনকারীদের নিয়ে এই উপনিবেশের গোড়াপত্তন হয়।[৫৩] বোটানি উপসাগরে পৌঁছানোর কয়েক দিন পর বহরটি বসতি স্থাপনের জন্য আরও উপযুক্ত স্থান পোর্ট জ্যাকসনে চলে যায়। ২৬ জানুয়ারী ১৭৮৮ সালে সিডনি কোভে ব্রিটিশ বসতি স্থাপন করা হয়।[৫৪] এই দিনটিই আধুনিক অষ্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবস। ১৭৮৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সিডনিতে গভর্নর ফিলিপ আনুষ্ঠানিকভাবে উপনিবেশটির পত্তনের কথা ঘোষণা করেন।

গভর্নর ফিলিপ উপনিবেশের বাসিন্দাদের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। তার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা এবং উপনিবেশের দান্ডাদেশ প্রাপ্তদের শৃঙ্খলানায়নের মাধ্যমে চারিত্রিক পরিবর্তন আনায়নের পাশাপাশি সংস্কারের চেষ্টা করা। ফিলিপ এবং তার বেশ কয়েকজন অফিসার - বিশেষত ওয়াটকিন টেঞ্চ - বসতিস্থাপনের প্রথম বছরগুলিতে দিনলিপিতে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা লিখে রেখে গেছেন। প্রায়শই ফিলিপের অফিসাররা নিউ সাউথ ওয়েলসের ভবিষ্যতের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়তেন। ১৭৮৮ থেকে ১৭৯২ সালের মধ্যে প্রায় ৩৫৪৬ জন পুরুষ এবং ৭৬৬ জন মহিলা কয়েদী সিডনিতে পৌছায়। তাদের অনেকে অসুস্থ বা কাজের জন্য অযোগ্য ছিল। অনেক সুস্থ কয়েদীরা শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রম এবং নতুন উপনিবেশের সুযোগ ‍সুবিধার অভাবের কারনে খারাপ হয়েছিল। ১৭৯০ সালে খাদ্য সংকট চড়মে পৌছায়। ১৭৯১ সাল থেকে ব্রিটেন থেকে নিয়মিত জাহাজের আগমন এবং অল্প কিছু ব্যবসায় বাণিজ্যের সূচনা সভ্য দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্নত থাকার অনুভূতি এবং সবরকম প্রয়োজনিয় জিনিষের সরবরাহের অবস্থার উন্নতি করে।[৫৫]

১৭৮৮ সালে ফিলিপ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের নরফোক দ্বীপে একটি সাবসিডিয়ারি উপনিবেশ স্থাপন করেন। সেখান থেকে তিনি নৌবাহিনীর জন্য কাঠ এবং শণ আহরণ করার আশা করেছিলেন। অবশ্য দ্বীপটিতে কোন নিরাপদ পোতাশ্রয় না থাকায়, বসতিটি পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং বসতি স্থাপনকারীরা ১৮০৭ সালে তাসমানিয়াতে চলে যায়।[৫৬][৫৭]

একত্রীকরণ: ১৭৯৩ থেকে ১৮২১

গভর্নর উইলিয়াম ব্লিগ

ফিলিপের প্রস্থানের পর, উপনিবেশের সামরিক কর্মকর্তারা জমি অধিগ্রহণ এবং ইউরোপ ও অন্যান্য স্থান থেকে আগত জাহাজের মাধ্যমে প্রাপ্ত ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে শুরু করে। প্রাক্তন আসামিরাও তাদেরকে দেয় জমি চাষ করে ব্যবসায় বানিজ্য শুরু করে। প্যারামাট্টা, উইন্ডসর এবং ক্যামডেনের উর্বর জমিতে কৃষিখামার গড়ে উফতে থাকে। ১৮০৩ সালের মধ্যে উপনিবেশটি খাদ্যশষ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যায়। ভ্রমণের প্রয়োজনে এবং উপকূলীয় জনবসতির সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য নৌকা তৈরি শুরু হয়। সিল এবং তিমি শিকার তখর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হয়ে ওঠে।[৫৮]

ইংল্যান্ডে, ১৭৮৯ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস কোর নামে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি স্থায়ী রেজিমেন্ট গড়ে তোলা হয়। এই বাহিনী প্রথম ফ্লিটের নৌসেনাদের স্থলে প্রতিক্ষার দায়িত্ব নেয়। এই বাহিনীর অফিসাররা শীঘ্রই কলোনীতে লাভজনক রাম ব্যবসায় জড়িত হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। গভর্নর উইলিয়াম ব্লিঘ (১৮০৬ - ১৮০৮) রাম বাণিজ্য এবং রাজকীয় ভূমির অবৈধ ব্যবহারকে দমন করার চেষ্টা করেছিলেন, যার ফলে ১৮০৮ সালের ’রাম বিদ্রোহ’ সংগঠিত হয়েছিল। সেনাসদস্যরা সদ্য প্রতিষ্ঠিত উল ব্যবসায়ী জন ম্যাকার্থারের সাথে আঁতাত করে সামরিকবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। ব্লিগকে পদচ্যুত করা হয়। এবং অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে একমাত্র সামিরক ক্যু এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটে। ১৮১০ সালে ব্রিটেন থেকে গভর্নর ল্যাচলান ম্যাককুয়ারির আগমনের আগে পর্যন্ত এই সংক্ষিপ্ত সামরিক শাসন বহাল থাকে।[৫৯][৬০]

ম্যাককুয়ারি ১৮১০ থেকে ১৮২১ সাল পর্যন্ত নিউ সাউথ ওয়েলসের সর্বশেষ গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নতুন কলোনির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তার আমলে নিউ সাউথ ওয়েলস, দন্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের উপনিবেশ থেকে একটি উদীয়মান নাগরিক সমাজে রূপান্তরিত হয়। তিনি সেখানে একটি ব্যাংক, এবং একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সেখানে পৃথক মুদ্রারও প্রচলন করেন। তাঁর আমলে সিডনির রাস্তার লেআউট ডিজাইন করার জন্য একজন নগর পরিকল্পনাকারীকে নিয়োগ করা হয়। তিনি তাকে রাস্তা, ঘাঁট, গীর্জা এবং ভবন নির্মাণের দায়িত্ব দেন।

সম্প্রসারণ: ১৮২১ থেকে ১৮৫০

১৮২০ সালে, ব্রিটিশ বসতি মূলত সিডনির চারপাশে ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এবং ভ্যান ডাইমেনের কেন্দ্রীয় সমভূমিতে সীমাবদ্ধ ছিল। মূল ভূখণ্ডে জনসংখ্যা ছিল ২৬,০০০ এবং ভ্যান ডাইমেনস ল্যান্ডে ৬,০০০ জন। ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের পর দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের আগমন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই সাথে মুক্ত বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়।[৬১] ১৮২১ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত, ৫৫,০০০ জন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী নিউ সাউথ ওয়েলসে এবং ৬০,০০০ জন ভ্যান ডাইমেনস ল্যান্ডে এসেছিলেন। ১৮৩০ সালের মধ্যে, মুক্ত বসতি স্থাপনকারী এবং স্থানীয়ভাবে জন্মগ্রহণকারীরা নিউ সাউথ ওয়েলসের আসামীদের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়।[৬২] ১৮২৫ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের পশ্চিম সীমানা ১২৯° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। এটাই পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সীমানা। ফলস্বরূপ, নিউ সাউথ ওয়েলসের ভূখণ্ড আধুনিক কুইন্সল্যান্ড, ভিক্টোরিয়া, তাসমানিয়া, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তরাঞ্চলের এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।[৬৩]

আরও উপনিবেশ স্থাপন

ভ্যান ডাইমেন ল্যান্ড

১৮০২ সালে সিডনিতে নিকোলাস বাউডিনের ফরাসি নৌ অভিযানের পর, গভর্নর ফিলিপ গিডলি কিং ১৮০৩ সালে ভ্যান ডাইমেনস ল্যান্ডে (আধুনিক তাসমানিয়া) একটি নতুন বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। সম্ভাব্য ফরাসি বসতি স্থাপন ঠেকাতে এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রথম দুই দশক ধরে বসতিটি দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের শ্রম, ক্ষুদ্র চাষবাদ, মেষপালস, সিল ও তিমি শিকার এবং "কুকুর এবং ক্যাঙ্গারু" নির্ভর অর্থনীতির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল।[৬৪][৬৫]

১৮২০-এর দশক থেকে অভিবাসীরা যে মূলধন সাথে করে আনবে তার অনুপাতে বিনামূল্যে ভূমি বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। এই দশকে প্রায় 2 মিলিয়ন একর জমি বিনামূল্যে বসতি উৎসাহী স্থাপনকারীদেরকে দেওয়া হয়েছিল। সেই সাথে দ্বীপে ভেড়ার সংখ্যা ১৭০,০০০ থেকে এক মিলিয়নে হয়েছিল। এই ভূমি অনুদানের ফলে বৃহৎ জমির মালিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিহীন প্রাক্তন আসামী ও মুক্তিবাদী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সামাজিক বিভাজন তৈরি করে।[৬৬][৬৭]

ভ্যান ডাইমেনস ল্যান্ড ১৮২৫ সালের ডিসেম্বরে নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে পৃথক হয়ে যায়।১৮৩০-এর দশকে কৃষিকাজ, মেষপালন এবং তিমি শিকারের উপর ভিত্তি করে এর অর্থনীতি গড়ে ওঠে। ১৮৪০ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসে দন্ডপ্রাপ্ত বন্দী পাঠানো স্থগিত করা হলে শুধুমাত্র ভ্যান ডাইমেন ল্যান্ডেই আসামীদের পাঠানো হতে থাকে। ১৮৫৩ সালে ভ্যান ডাইমেন ল্যান্ডে আসামী প্রেরণ বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৫৬ সালে উপনিবেশটির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে তাসমানিয়া করা হয়।[৬৮]

ভিক্টোরিয়া

ভ্যান ডাইমেনস ল্যান্ডের মেষপালকরা ১৮৩৪ সালে মূল ভূখণ্ডের পোর্ট ফিলিপ পশ্চাদ্ভুমিতে এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন। এ অঞ্চলের উর্বর তৃণভূমি পশুপালনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল। ১৮৩৫ সালে জন ব্যাটম্যান ‘কুলিন’ উপজাতির মানুষদের কাছ থেকে ১০০,০০০ একর জমি গ্রহণ করার জন্য একটি চুক্তি করে। সেই বছরই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক গভর্নর বোর্কে এক ঘোষণা জারি করে বলে যে উপনিবেশের সমস্ত খাস জমি রাজকীয় সম্পদ বলে বিবেচিত হবে। এমনকি তা যদি স্থানীয় আদিবাসীদের কর্তৃক ভোগদখলকৃত হয়ে থাকে তবুও। এই আদেশের ফলে, সরকারের ব্যতীত জমি দখলকারী যে কেউ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে গণ্য হবে।[৬৯]

১৮৩৬ সালে পোর্ট ফিলিপ, নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি জেলা হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়। একই সাথে বসতি স্থাপনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। মেলবোর্নের প্রতিষ্ঠিত উপনিবেশের প্রধান বসতিটি ১৮৩৭ সালে গভর্নর বোর্কের নির্দেশে একটি পরিকল্পিত শহর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভ্যান ডাইমেনস ল্যান্ড এবং নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে স্কোয়াটার (যারা খাস জমি ভোগ করত) এবং অভিবাসীরা শীঘ্রই প্রচুর সংখ্যায় এখানে আসতে থাকে। ১৮৫০ সালের মধ্যে এই জেলার জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫,০০০ ইউরোপীয়, ২,০০০ আদিবাসী এবং ৫ মিলিয়ন ভেড়া। ১৮৫১ সালে পোর্ট ফিলিপ জেলা নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে পৃথক হয়ে ভিক্টোরিয়ার উপনিবেশে পরিণত হয়।[৭০][৭১]

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় ফরাসিদের বসতি স্থাপন থেকে বিরত রাখার জন্য ১৮২৬ সালে, নিউ সাউথ ওয়েলসের গভর্নর, রাল্ফ ডার্লিং, কিং জর্জ সাউন্ড (পরবর্তী আলবানি শহর) এর কাছে একটি সামরিক গ্যারিসন পাঠান। ১৮২৭ সালে অভিযানের প্রধান, মেজর এডমন্ড লকিয়ার, আনুষ্ঠানিকভাবে মহাদেশের পশ্চিমাংশকে মূল ব্রিটিশ উপনিবেশের সাথে সংযুক্ত করেন।[৭২] ১৮২৯ সালে আজ যেখানে আধুনিক ফ্রেম্যান্টল এবং পার্থ, সেখানে ‘সোয়ান রিভার কলোনি’ স্থাপিত হয়। এটাই ছিল অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বেসরকারি কয়েদীমুক্ত উপনিবেশ। ১৮৫০ সালের মধ্যে সেখানে মাত্র ৫,০০০ জন বসতি স্থাপনকারী ছিল। যাদের অর্ধেক ছিল শিশু। শ্রমের তীব্র অভাবের কারণে কলোনি সেই বছর থেকে দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদীদের গ্রহণ করেছিল।[৭৩][৭৪]

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার প্রদেশটি ১৮৩৬ সালে এডওয়ার্ড গিবন ওয়েকফিল্ড প্রবর্তিত "পদ্ধতিগত উপনিবেশ" তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে, বেসরকারি অর্থায়নে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের খরচ ছাড়া ব্যক্তিগত বিনিয়োগের মাধ্যমে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। এর শাসন ক্ষমতা রাজপ্রশাসন এবং উপনিবেশের কমিশনার বোর্ডের মধ্যে ভাগ করা হয়েছিল। প্রায় ৩০০ জন শেয়ারহোল্ডারদের কাছে দায়বদ্ধ। এই কলোনিতে জমি, পুঁজি এবং শ্রমের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা ছিল। উপনিবেশটিকে সুশীল সমাজের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এবং পুরুষ ও মহিলা নাগরিকদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় নিমিত্তে কয়েদি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অ্যাডিলেড শহরটি বিশাল গীর্জা, প্রশস্থ পার্ক এবং উপযুক্ত স্কুলের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।[৭৫][৭৬][৭৭] ১৮৪১-৪৪ সালের মন্দার কারণে উপনিবেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গমের আবাদে অত্যধিক উৎপাদন এবং অবকাঠামোতে অতিরিক্ত বিনিয়োগ কলোনিকে প্রায় দেউলিয়া করে দিয়েছিল। আদিবাসী জমির মালিকদের সাথে বিরোধ শুরু হয়। ১৮৪২ সালে কলোনিটি ব্রিটিশরাজ কর্তৃক একজন গভর্নর এবং একটি আইন পরিষদ দ্বারা শাসিত একটি রাজকীয় কলোনীতে পরিণত হয়। ১৮৪৫ সাল থেকে অর্থনীতি কিছুটা সামলে ওঠে। গমের আবাদ, মেষপালণ এবং তামা খনি এই পুনরাদ্ধারের পিছনে কাজ করেছিল। ১৮৫০ সাল নাগাদ এই কলোনির জনসংখ্যা ৬০,০০০-এ উন্নীত হয় এবং পরের বছর উপনিবেশটি একটি আংশিকভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদের সাথে সীমিত স্বাধীনতা অর্জন করে।[৭৫][৭৬][৭৮]

কুইন্সল্যান্ড

১৮২৪ সালে, বর্তমান ব্রিসবেনের জায়গায় মোরেটন বে পেনাল সেটেলমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৪২ সালে অপরাধী কলোনি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এলাকাটিসর্বসাধারনের বসতি স্থাপনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৮৫০ সাল নাগাদ ব্রিসবেনের জনসংখ্যা ৮,০০০-এ পৌঁছায়। মকর রাশির ক্রান্তীয় অঞ্চলের উত্তরে বসতি স্থাপনের বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। যারকারনে উত্তরে বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা তুলনামুলক কম ছিল। উত্তরে পশুচারণজীবিদের উপস্থিতি ও কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপিয় এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমান্ত সহিংসতা তীব্র হয়ে উঠেছিল। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সরকার কুইন্সল্যান্ডকে পৃথকী করতে সম্মত হয়। ১৮৫৯ সালে কুইন্সল্যান্ডকে পৃথক উপনিবেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। নতুন উপনিবেশে ইউরোপিয় বসতি স্থাপনকারীর জনসংখ্যা ছিল ২৫,০০০ এবং এর বেশিরভাগ অঞ্চল আদিবাসী মালিকদের দখলে ছিল।[৭৯][৮০][৮১]

অপরাধী এবং ঔপনিবেশিক সমাজ

অপরাধী এবং মুক্তিবাদী

১৭৮৮ এবং ১৮৬৮ সালের মধ্যে, প্রায় ১৬১,৭০০ সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীকে (যাদের মধ্যে ২৫,০০০ জন মহিলা) নিউ সাউথ ওয়েলস, ভ্যান ডাইমেনস ল্যান্ড এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উপনিবেশে প্রেরণ করা হয়েছিল।[৮২] এই অপরাধীদের অধিকাংশেরই বার বার অপরাধ করার নজির ছিল।[৮৩] এসব সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের গড় সাক্ষরতার হার বেশ ভাল ছিল। তারা ভবননির্মান, কৃষিকাজ, পালতোলা, মাছ ধরা এবং শিকার সহ বিভিন্ন ধরনের কাজে দক্ষ ছিল।[৮৪]

প্রথম দিকের গভর্নররা নিউ সাউথ ওয়েলসকে অপরাধীদের শাস্তি ও সংস্কারের জায়গা হিসেবে দেখেছিলেন। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা সরকারি খামার এবং সরকারি কাজে যেমন জমি পরিষ্কার করা এবং ভবন তৈরি ইত্যাদি কাজ করত। ১৭৯২-এর পরে তাদের বেশীরভাগই ব্যক্তিগত নিয়োগকর্তাদের জন্য কাজ করত। ইমানসিপিস্টরা (যে সকল অপরাধীদের সাজার মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে বা ক্ষমা করা হয়েছে) কৃষিকাজের জন্য জমির ছোট প্লট এবং এক বছরের সরকারি রেশন দেওয়া পেত। পরে তাদের খামারে কাজে সাহায্যের জন্য অপরাধী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছিল।[৮৫] কিছু কয়েদিকে দোষী সামরিক অফিসারদের ব্যবসা চালানোর কাজে ব্যাবহার করা হতো। কারন তারা নিজেরা সরাসরি বানিজ্যের সাথে যুক্ত হতে চাইতেন না। এভাবে এই দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা কিছু বাণিজ্যিক দক্ষতাও অর্জন করে। সাজার ময়াদ শেষ হলে এসব দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের জন্য কাজ করতে পারত।[৮৬]

কয়েদিরা তাদের বরাদ্দকৃত কাজগুলি সম্পন্ন করার পরে মজুরির বিনিময়ে অন্য কাজ করার অনুমতি পায়। শ্রমের স্বল্পতার কারণে, ১৮১৫ সালের আগে হার পুরুষ শ্রমিকদের মজুরির অনেক বেশী ছিল। যদিও গৃহকর্মে নিযুক্ত মহিলাদের কাজের মজুরী অনেক কম ছিল।[৮৭] ১৮১৪ সালে গভর্নর ম্যাককুয়ারি আদেশ দেন যে কয়েদিদের বিকাল ৩ টা পর্যন্ত কাজ করতে হবে। এরপর কাজ করলে অতিরিক্ত কাজের জন্য বেসরকারী নিয়োগকর্তাদেরকে তাদের মজুরি দিতে হবে।[৮৮]

নারী

ব্যবসায়ী নারী এলিজাবেথ ম্যাকার্থার মেরিনো উল শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন।

ঔপনিবেশিক অস্ট্রেলিয়ায় তখন লিঙ্গ ভারসাম্য ছিল না। দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের প্রায় ১৫ শতাংশ নারী ছিল। উপনিবেশে নারীদের স্বল্পতার কারণে তাদের মধ্যে বিবাহিতদের সংখ্যা ছিল বেশী। তারা স্বামী হিসাবে অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন ও বয়স্ক পুরুষদের বেছে নিত। প্রারম্ভিক ঔপনিবেশিক আদালত স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীদের অধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করে। মহিলাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থাও তারা করেছিল।

নারীরা উপনিবেশের প্রথম বছর থেকে ব্যবসা ও কৃষিকাজে সক্রিয় ছিল, প্রাক্তন কয়েদিদের মধ্যে সফল উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রাক্তন দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন উদ্যোক্তা মেরি রেইবে এবং কৃষিবিদ এলিজাবেথ ম্যাকার্থার। প্রথম ঔপনিবেশিক ব্যাংকের (১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) শেয়ারহোল্ডারদের এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন মহিলা।[৮৯] প্রথম ঔপনিবেশিক ব্যাংকের (১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) শেয়ারহোল্ডারদের এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন মহিলা।[৯০] ১৮৩০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান বসতি স্থাপনকারী জনসংখ্যার মহিলা অনুপাত ২৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশে উন্নীত হয়।[৯১]

ধর্মচারণ

উপনিবেশের প্রারম্ভিক গির্জার যাজকরাও ছিলেন সিভিল ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং দন্ড রেয়াদ করার ক্ষমতা ছিল। ১৮২০ সালের আগে চার্চ অফ ইংল্যান্ড ছিল একমাত্র স্বীকৃত চার্চ এবং এর পাদ্রীরা গভর্নরদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করত। স্যামুয়েল মার্সডেন (বিভিন্ন গির্জায় কর্মকাল ১৭৯৫-১৮৩৮) ধর্মপ্রচারক হিসাবে তার কর্মকান্ড, ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তার শাস্তির কঠোরতা এবং ক্যাথলিক ধর্ম ও আইরিশ অপরাধীদের প্রকাশ্যে তীব্র নিন্দা করার জন্য তিনি সর্বমহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন।[৯২] অপরাধীদের প্রায় এক চতুর্থাংশ ক্যাথলিক ছিল। তারা প্রায়ই একজন ক্যাথলিক যাজককে তাদের নিজ ধর্মের আচার অনুষ্ঠান করার জন্য অনুরোধ করত। সেখানে ক্যাথলিক ধর্মের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। ১৮০৪ সালের আইরিশ নেতৃত্বাধীন ক্যাসেল হিল বিদ্রোহের পর ক্যাথলিক ধর্মচারণ বৃদ্ধি পায়।[৯৩][৯৪][৯৫] ১৮২০ সালে গভর্নর ম্যাককুয়ারি নিউ সাউথ ওয়েলসে এবং ভ্যান ডাইমেনস ল্যান্ডে সরকারী ক্যাথলিক যজক নিযুক্ত করার আগে মাত্র দুজন ক্যাথলিক যাজক এই উপনিবেশে অস্থায়ীভাবে কাজ করেন।[৯৬] ১৮২৪ সালে, একজন অ্যাংলিকান আর্চডিকন নিযুক্ত হন। তার জন্য প্রথম উপদেষ্টা আইন পরিষদে একটি আসন বরাদ্দ করা হয়। অ্যাংলিকান পাদ্রী এবং স্কুলগুলিও রাষ্ট্রীয় সমর্থন পেয়েছিল। গভর্নর বার্কের আমলে এই নীতি পরিবর্তন করা হয়। ১৮৩৬ এবং ১৮৩৭ সালের চার্চ আইন দ্বারা সরকার চারটি বৃহত্তম সম্প্রদায়ের গির্জা এবং তাদের পাদ্রিদের ও ভবনগুলির জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রদান করা হয়। সম্প্রদায়গুলো হল, অ্যাংলিকান, ক্যাথলিক, প্রেসবিটেরিয়ান এবং মেথডিস্ট।[৯৬]

19th-century mosque in cemetery, Bourke, New South Wales

১৭০০ এর দশক থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ইসলাম ধর্মের উপস্থিতি ছিল। মুসলিম ম্যাকাসান ব্যবসায়ীরা আর্নহেম ল্যান্ডে (বর্তমানে উত্তরাঞ্চল) দীর্ঘ সময়ের জন্য় বাস করতো।[৯৭] প্রথম দিকের মুসলমানদের মধ্যে ছিল "আফগান" উট চালক যারা ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে অস্ট্রেলিয়ায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ১৮৪০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম উট আমদানি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, অষ্ট্রেলিয়ার শুষ্ক মরুময় এলাকায় পর্যটন করা। পরে বিশাল মরু এলাকায় চলাচলের সুবিধার কথা বিবেচনা করে উটে টানা ট্রেন তৈরীর জন্য উট আমদানী করা হয়।[৯৮]

১৭৮৮ এর দশকে বঙ্গোপসাগর থেকে ভারতীয় নাবিকরা বাণিজ্য জাহাজে চেপে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল। হিন্দুধর্ম অস্ট্রেলিয়ার একটি সংখ্যালঘু ধর্ম যার অনুসারীর সংখ্যা ৪৪০,৩০০ জনেরও। ২০১৬ সালের আদমশুমারি অনুসারে মোট জনসংখ্যার ১,৯%।[৯৯]


মহাদেশ অন্বেষণ

১৭৯৮-৯৯ সালে জর্জ বাস এবং ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার্স সিডনি থেকে একটি ডিঙি নৌকায় তাসমানিয়া প্রদক্ষিণ করে দেখলে যে তাসমানিয়া আসলে একটি দ্বীপ।[১০০] ১৮০১-০২ সালে রাজকীয় জাহাজ ইনভেস্টিগেটরে চেপে ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ প্রদক্ষিণের নেতৃত্ব দেন। জাহাজে ছিলেন সিডনি জেলার আদিম অভিযাত্রী বুঙ্গারি, তিনি অস্ট্রেলিয়ান মহাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি, যিনি অস্ট্রেলিয়ান মহাদেশ প্রদক্ষিণ করেছিলেন। [১০০]

১৭৯৮ সালে প্রাক্তন কয়েদি উইলসন এবং দুই সঙ্গী গভর্নর হান্টারের নির্দেশে একটি অভিযানে সিডনির পশ্চিমে ব্লু মাউন্টেন অতিক্রম করেছিলেন। হান্টার এই অভিযানের ফলাফলের কথা গোপন করেছিলেন এই ভয়ে যে, এতে কয়েদিরা বসতি থেকে পালাতে উৎসাহিত হত। ১৮১৩ সালে, গ্রেগরি ব্ল্যাক্সল্যান্ড, উইলিয়াম লসন এবং উইলিয়াম ওয়েন্টওয়ার্থ একটি ভিন্ন পথ দিয়ে পাহাড় অতিক্রম করেছিলেন। এরপর সেন্ট্রাল টেবিলল্যান্ডে একটি সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল।[১০১]

চার্লস স্টার্ট ১৮২৮ সালে ম্যাককুয়ারি নদীর তীরে একটি অভিযানের গিয়ে ডার্লিং নদী আবিষ্কার করেন। ধারণা করা হক যে নিউ সাউথ ওয়েলসের অভ্যন্তরীণ নদীগুলি একটি ভূমধ্য সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার থমাস মিচেল ১৮৩০ এর দশক থেকে পূর্ববর্তী অভিযানগুলির অনাবিষ্কৃত দিকগুলো জানার জন্য একটি সিরিজ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। মিচেল তিনজন আদিবাসী গাইড নিযুক্ত করেছিলেন এবং উপনিবেশের আশেপাশে আদিবাসী স্থানের নাম রেকর্ড করার সময় খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি ১৮৩৬ সালে মারেতে আদিবাসী জমি মালিকদের সাথে তার দল একটি সংঘর্ষের জিড়েয়ে পরে। এসময় ইউরোপিয় অভিযাত্রিরা "যত পার তত গুলি করো" নীতি অনুসরণ করেছিল।[১০২][১০৩]

১৮৬০ সালে, বার্ক এবং উইলস মহাদেশের প্রথম দক্ষিণ-উত্তর ক্রসিং মেলবোর্ন থেকে কার্পেন্টেরিয়া উপসাগর পর্যন্ত অভিযানের নেতৃত্ব দেন। বন্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় এবং স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে এসব কৌশল শিখতে না পারায় তাদের অভিযান খুব একটা ফলপ্রসু হয়নি। বার্ক এবং উইলস ১৮৬১ সালে মারা যান। এই দুই ব্যাক্তি ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের কাছে ট্র্যাজিক হিরো হয়ে উঠেছিলেন। তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ৫০,০০০ জনেরও বেশি লোকসমাগম হয়। তাদের গল্প অসংখ্য বই, শিল্পকর্ম, চলচ্চিত্র এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে স্থান পায়।[১০৪][১০৫]


আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর ব্রিটিশ বসতির প্রভাব

১৭৮৮ সালের জানুয়ারী মাসে যখন প্রথম ব্রিটিশ নৌবহরটি প্রায় ১,৩০০ জন অভিবাসী নিয়ে সিডনি কোভে পৌঁছায়, তখন সিডনি অঞ্চলের আদিবাসী জনসংখ্যা আনুমানিক ৩,০০০ জন।[১০৬]

তথ্যসূত্র

আরও দেখুন

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ