ঘাত তরঙ্গ

পদার্থবিজ্ঞান-এ ঘাত তরঙ্গ বা শক ওয়েভ (ইংরেজিঃ Shock Wave বা Shockwave-) বলতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া এক বিশেষ ধরনের তরঙ্গ বোঝায় যার বেগ উক্ত মাধ্যমের শব্দের বেগের চেয়েও অধিক। সাধারণ তরঙ্গ এর মতো ঘাত তরঙ্গও এক স্থান হতে অন্য স্থানে শক্তি সঞ্চালন করে কিন্তু পার্থক্যটি হলো ঘাত তরঙ্গ সংঘটিত হয় আকস্মিকভাবে ও এ তরঙ্গটি অবিচ্ছিন্ন এবং মাধ্যমের ধর্ম যেমন চাপ, তাপমাত্রাঘনত্বের উপর নির্ভরশীল। [১][২][৩][৪][৫][৬]কোনো তরঙ্গের সুপারসনিক প্রবাহের সময় অতিরিক্ত তরঙ্গ এক্সপ্যানশন পাখার মাধ্যমে সৃষ্টি করা যায় যা পরবর্তীতে ঘাত তরঙ্গের অভিমুখী হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় অথবা একীভূত হয়। এর ফলে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার সৃষ্টি হয়। ঘাত তরঙ্গের ফলে উচ্চ শব্দশক্তি উৎপন্ন হয় যা সনিক বুম বা শব্দাঘাত নামে পরিচিত। সনিক বুম তখনই উৎপন্ন হয় যখন বায়ু মাধ্যমে কোনো বস্তু শব্দের চেয়ে বেশি বেগে গতিশীল হয় এবং এটি সংঘটিত হওয়ার অন্য একটি কারণ গঠনমূলক ব্যতিচার।

তীক্ষ্ণ বস্তুর উপর একত্রিত ঘাত তরঙ্গের শ্লেরেন ছবি

ঘাত তরঙ্গ অরৈখিক বেগ সলিটনের মতো নয় এবং এটি তুলনামূলকভাবে তাড়াতাড়ি কোনো স্থানে ছড়িয়ে পরে। ঘাত তরঙ্গ যখন কোনো পদার্থের ভেতরে দিয়ে অতিক্রম করে তখন শক্তি সংরক্ষিত হয় কিন্তু এনট্রপি বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাবে পদার্থের বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে পরিবর্তন হতে দেখা যায় এবং শক্তি হ্রাসের কারণে কাজ পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও সুপারসনিক বস্তুসমূহে Wave Drag ব্যবহার করলে শক্তিশালী ও অপরিবর্তনীয় ঘাত তরঙ্গ সঞ্চালিত হয়।

ধরণ

ঘাত তরঙ্গ নিচে বর্ণিত কয়েক ধরনের হতে পারে-

সাধারণ

মাধ্যমের প্রবাহ দিকের সাথে ৯০ ডিগ্রি কোণ (সমকোণ) করে ঘাত তরঙ্গ উৎপন্ন হলে তাকে সাধারণ ঘাত তরঙ্গ বলা হয়।

তীর্যক

মাধ্যমের সাথে তীর্যকভাবে ঘাত তরঙ্গ উৎপন্ন হলে তাকে তীর্যক ঘাত তরঙ্গ বলা হয়।

ধনুক

এ ধরনের ঘাত তরঙ্গ কোনো ভোঁতা বস্তুর উজানমুখী হয়ে সৃষ্টি হয় বস্তুটির প্রবাহ বেগ 1 Mach অতিক্রম করে।

অন্যান্য শব্দসমূহঃ

ঘাত সম্মুখভাগ (Shock Front)ঃ এটি সেই স্থান যেখানকার বস্তুসমূহ ঘাত তরঙ্গের ফলে ধর্মে ও বাহ্যিক দিক থেকে পরিবর্তিত হয়৷

সংযোগ সম্মুখভাগ (Contact Front)ঃ যে গ্যাস ঘাত তরঙ্গের সৃষ্টি করে সেই গ্যাস ও পরিবেশের বায়ুমন্ডলের মধ্যকার এলাকা।

সুপারসনিক প্রবাহে ঘাত তরঙ্গ

এখানে পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে ঘাত তরঙ্গের চাপ বনাম সময় লেখচিত্র দেখানো হয়েছে। কোনো বস্তুর সূচনা প্রান্ত (লাল) ঘাত তরঙ্গ সৃষ্টি করে এবং শেষ প্রান্তের (নীল) বিস্তৃতি ঘটে

মাধ্যমের আকস্মিক পরিবর্তন দ্বারা ঘাত তরঙ্গকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয় যাকে দশা পরিবর্তন বিষয়টির সাথে তুলনা করা যায়। সুপারসনিক বস্তুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার চাপ বনাম সময় ডায়াগ্রাম পর্যবেক্ষণ করলে লক্ষ্য করা যায় কীভাবে ঘাত তরঙ্গের ফলে বস্তুর দশা পরিবর্তন চলমান দশা পরিবর্তন এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়।

কোনো বস্তু বা তরঙ্গ যখন কোনো প্রবাহীতে দ্রুত গতিতে গতিশীল হয় তখন বস্তুর আশপাশের প্রবাহী কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারে না এবং উক্ত দ্রুতিশীল বস্তু না আসা পর্যন্ত অবস্থানও পরিবর্তন করতে পারে না। ঘাত তরঙ্গের ক্ষেত্রে, তরলটির ধর্ম ঘনত্ব, চাপ, তাপমাত্রা, প্রবাহ বেগ, মাধ্যমের শব্দের বেগের সাপেক্ষে উক্ত প্রবাহীর প্রবাহ বেগ ইত্যাদি আকস্মিকভাবে পরিবর্তিত হয়। বায়ুতে ঘাত তরঙ্গের বেধ প্রায় ২০০ ন্যানোমিটার যা গ্যাস অণুসমূহের মুক্ত পথের সমান। [৭] এর ধারাবাহিকতায় বলা যায়, ঘাত তরঙ্গকে কোনো রেখা বা সমতল হিসেবে ব্যবহার করা যায় যদি প্রবাহক্ষেত্র যথাক্রমে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক হয়৷

ঘাত তরঙ্গের উৎপত্তি তখন হয় যখন কোনো চাপ সুপারসনিক গতিতে সামনের দিকে অতিক্রম করতে থাকে আর পারিপার্শ্বিক বায়ুর সাথে সংঘর্ষ ঘটায়। [৮] যে অঞ্চলে এরূপ্ন সংঘর্ষ হয় সেখানে শব্দ তরঙ্গ প্রবাহের বিপরীতে ভ্রমণ করার চেষ্টা করে এবং এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছে যেখান থেকে সেটি আর সামনে এগোতে পারে না। অন্যদিকে উক্ত অঞ্চলটিকে ক্রমান্বয়ে চাপ সৃষ্টি হতে থাকে, যার ফলে উচ্চচাপ বিশিষ্ট ঘাত তরঙ্গ ক্রমাগত তৈরি হয়৷

ঘাত তরঙ্গ সাধারণ শব্দ তরঙ্গের অনুরূপ নয়। ঘাত তরঙ্গ কোনো গ্যাসের ধর্মের তীক্ষ্ণ পরিবর্তনের রূপ গ্রহণ করে৷ বায়ুতে ঘাত তরঙ্গ জোরালো "ক্র‍্যাক" বা "স্ন্যাপ" রকমের শব্দ হিসেবে শোনা যায়। দুরত্ব যদি বেশি হয়, তাহলে ঘাত তরঙ্গ অরৈখিক তরঙ্গ হতে রৈখিক তরঙ্গে পরিণত হতে পারে৷ তখন এক বিশেষ ধরনের শব্দ তরঙ্গ নির্গত হয় যা শুনে মনে হয় তরঙ্গটি বায়ুকে উত্তপ্ত করে ও শক্তি হ্রাস করে। শব্দটি শোনা যায় সনিক বুমের মতো ধুম অথবা ধড়াশ ধরনের, যা সাধারণত সুপারসনিক বিমান থেকে নির্গত শব্দের অনুরূপ।

কোনো গ্যাসকে ঘাত তরঙ্গের মধ্যে সুপারসনিক প্রবাহ করা হলে সেই গ্যাসটি সংকুচিত হয়। অন্যান্য কিছু পদ্ধতিও আছে যেমন আইসেনট্রপিক প্রক্রিয়া, যার মধ্যে একটি হলো প্রান্ডল - মেয়ার সংকোচন। উক্ত পদ্ধতিতে গ্যাসের একটি নির্দিষ্ট চাপের অনুপাতের জন্য গ্যাসটির তাপমাত্রা ও ঘনত্বে ভিন্নতা দেখা দেয় যাকে বিশ্লেষণমূলকভাবে গণনা করা করে বের করা যায় (বিক্রিয়া করে না এমন গ্যাসের ক্ষেত্রে)। ঘাত তরঙ্গ সংকোচন প্রক্রিয়ার ফলে মোট চাপ হ্রাস পায় যে কারণে এই প্রক্রিয়াকে গ্যাস সংকোচনের জন্য কম দক্ষ প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। উদাহরণঃ স্ক্র‍্যামজেট। সুপারসনিক বিমানের গায়ে যেসব চাপজনিত রেখা দেখা দেয় সেগুলো মূলত হয় ঘাত তরঙ্গ সংকোচন প্রক্রিয়ার ফলে।

সাধারণ ঘাত তরঙ্গ

আদর্শ গ্যাস উত্তোলনের প্রাথমিক প্রবাহী পদ্ধতির ক্ষেত্রে, ঘাত তরঙ্গকে অবিচ্ছিন্ন ধরা হয় যা অসীম জায়গায় এনট্রপির পরিমাণ বৃদ্ধি করে৷ যেহেতু কোনো প্রবাহী-ই অবিচ্ছিন্ন নয় তাই ঘাত তরঙ্গের আশেপাশে একটি নিয়ন্ত্রিত আয়তনের সৃষ্টি হয়৷ এই নিয়ন্ত্রিত আয়তনের ফলে যে পৃষ্ঠ সেই আয়তন সংলগ্ন থাকে সে পৃষ্ট ঘাত তরঙ্গের সমান্তরালে চলে যায়৷ এক পৃষ্ঠ প্রবাহী মাধ্যমের প্রাক-ঘাত (Pre shock) দিকে থাকে এবং আরেক পৃষ্ঠ থাকে পরবর্তী-ঘাতের দিকে (Post shock)। উক্ত পৃষ্ঠদ্বয় একটি গভীর স্থান দ্বারা একে অপর থেকে এমনভাবে পৃথক থাকে যেন ঘাত তরঙ্গ সেই পৃষ্ঠদ্বয়ের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে আবদ্ধ থাকে। এরূপ নিয়ন্ত্রিত পৃষ্ঠের মধ্যে ভরবেগ, ভর প্রবাহ ও শক্তি ধ্রুব থাকে। ঘাত তরঙ্গে তাপের সূচনা করে ডিটোনেশন দহন প্রক্রিয়া। এটি অনুমিত যে, সিস্টেমটি তখন রূদ্ধতাপীয় হয় অর্থাৎ, সিস্টেমের ভেতরে তাপ উৎপন্ন হয় না এবং বাইরে থেকে সিস্টেমেও তাপ আসে না ও কোনো কাজও সম্পন্ন হয় না। উল্লেখিত ব্যাপারগুলো বিবেচনা করে র‍্যাংকাইন-হুগোনিওট শর্ত -এর সূচনা হয়।

অন্যান্য ঘাত

তীর্যক ঘাত

যখন কোনো শক বা ঘাত তরঙ্গাকারে প্রবাহ ক্ষেত্রে প্রবাহ হওয়া শুরু করে এবং বস্তুর শরীর সংলগ্ন অবস্থায় থাকে, তখন যদি সেই তরঙ্গ প্রবাহ দিক থেকে যে কোনো কোণে বিচ্যুত হয় তখন উক্ত শককে Oblique Shock বা তীর্যক ঘাত বলা হয়।

ধনুক ঘাত

যখন কোনো তীর্যক ঘাতের কোণ এমন হয়ে যায় যে সেটি আর পৃষ্ঠে অবস্থান করতে পারে না তখন তখন একটি অরৈখিক বাহ্যমূর্তির সৃষ্টি হয় যেখান থেকে ঘাত তরঙ্গ বস্তুটির চারপাশে চলমান প্যাটার্ন তৈরি করবে। এ ধরনের শককে Bow Shock বা ধনুক ঘাত বলা হয়। এই ক্ষেত্রে, একমাত্রিক প্রবাহ মডেল যুক্তিযুক্ত নয় এবং পৃষ্ঠে কি পরিমাণ চাপ প্রয়োগ হয় তা জানার জন্য আরো গবেষণা জরুরি৷

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ