চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ , উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরী করার জন্য বৃহৎ পরিসরেমেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) কে একসাথে করা হয়েছে। [১]

স্ব-চালিত গাড়ি

ইতিহাস

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটি সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন একদল বিজ্ঞানী যারা জার্মান সরকারের জন্য একটি উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশল তৈরী করছিলেন। [২] ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব ২০১৫ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ্যমে শব্দটিকে বৃহৎ পরিসরে উপস্থাপন করেন। [৩] "চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে আয়ত্ত করা" ছিল ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের ডেভোস-ক্লোস্টারস এ অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভার বিষয়বস্তু। [৪]

১০ অক্টোবর, ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম স্যান ফ্র্যান্সিস্কোতে তাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্র উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়।। [৫] এটি (চতুর্থ শিল্প বিপ্লব) শোয়াবের ২০১৬ সালে প্রকাশিত বইয়ের বিষয় এবং শিরোনামও ছিল। [৬] শোয়াব এই চতুর্থ যুগের জন্য এমন সব প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং বায়োলজি ( সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমস ) কে একত্রিত করে এবং পারস্পরিক সংযোগ স্থাপনের অগ্রগতির ওপর জোর দেয়। [৭] শোয়াব আশা করেন এই যুগটি রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অফ থিংস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংস, ডিসেন্ট্রালাজড কনসেনসাস, পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের এবং সম্পূর্ণ স্বশাসিত যানবাহন [৮] এর ক্ষেত্রে উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত হবে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্রেট রিসেট প্রস্তাবনায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে COVID-19 মহামারী [৯] পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠনের কৌশলগত টেকসই সমাধান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

প্রথম শিল্প বিপ্লব

বাষ্প এবং জল শক্তি ব্যবহার করে হস্তসাধিত শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়াকে মেশিন চালিত পদ্বতিতে রুপান্তের মাধ্যমে প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল । নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগে দীর্ঘ সময় লেগে গিয়েছিল। সুতরাং, যে সময়কালকে এটি নির্দেশ করে তা ইউরোপ এবং আমেরিকার ক্ষেত্রে ১৭৬০ থেকে ১৮২০ বা ১৮৪০ এর মধ্যে। এর প্রভাব পড়েছিল বস্ত্র শিল্প, লৌহ শিল্প, কৃষি এবং খনিখনন কাজে যদিও বস্ত্র শিল্পই সবচেয়ে দ্রুততার সাথে মানিয়ে নিয়েছিল। এর সামাজিক প্রভাব মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ক্রমেই শক্তিশালী করে তুলছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ শিল্পেও এর প্রভাব ছিল। [১০]

দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব

দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব বা প্রযুক্তিগত বিপ্লব এর সূচনা ঘটেছিল ১৮৭১ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে। এর মূলে ছিল রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্কের ব্যাপক বিস্তার যা মানুষ এবং চিন্তা-ভাবনার দ্রুততর স্থানান্তরের সুযোগ তৈরী করেছিল। ক্রমবর্ধমান বৈদ্যুতীকরণ কারখানাগুলোকে আধুনিক প্রোডাকশন লাইন বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছিল। এটি ছিল উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে একটি দুর্দান্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়। যার কারণে অনেক কারখানা শ্রমিকের চাকরি মেশিনগুলো দখল করে নেয় এবং বেকারত্ব বৃদ্বি পায়। [১১]

তৃতীয় শিল্প বিপ্লব

বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে দুটি বিশ্ব যুদ্ধের শেষে যখন শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পূর্বের তুলনায় অনেকটা শিথিল, তখন তৃতীয় শিল্প বিপ্লব ওরফে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটে। এক দশক পরে আসে জেড 1 কম্পিউটার, যা ফ্লোটিং-পয়েন্ট নাম্বার এবং বুলিয়ান লজিক ব্যবহার করে হিসাব নিকাশ করত। এটা ছিল আরও ডিজিটাল অগ্রগতির সূচনা। যোগাযোগ প্রযুক্তিতে পরবর্তী উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সুপার কম্পিউটার । এই সময়ে উৎপাদন প্রক্রিয়াতে কম্পিউটার এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে যন্ত্রপাতি মানব শক্তির জায়গা দখল করতে শুরু করে।[১২]

জার্মান কৌশল

"ইন্ডাস্ট্রি ৪.০" সংক্ষেপে আই৪.০ বা শুধু আই৪ শব্দটি ২০১১ সালে জার্মান সরকারের একটি উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশলের একটি প্রকল্প থেকে সৃষ্ট, যেখানে উৎপাদন শিল্পে কম্পিউটারাইজেশনের বিকাশ সাধন করা হয় ।[১৩] একই বছর হ্যানোভার ফেয়ারে "ইন্ডাস্ট্রি ৪.০" শব্দটিকে সর্বপ্রথম সর্বসমক্ষে প্রচার করা হয়। [১৪] অক্টোবর ২০১২ তে কার্যরত দল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বাস্তবায়নের সুপারিশ উপস্থাপন করে। এই দলের সদস্য এবং অংশীদারগণ ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চালিকা শক্তি হিসেবে স্বীকৃত। ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল হ্যানোভার ফেয়ারে কার্যরত দল তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন রবার্ট বোশ জিএমবিএইচের সিগফ্রিড ডায়াস এবং জার্মান বিজ্ঞান ও প্রকৌশল একাডেমির হেনিং ক্যাগারম্যান। [১৫]

কোম্পানিগুলো “ইন্ডাস্ট্রি ৪.০” এর নীতিসমূহ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কখনো কখনো নতুন করে সাজিয়ে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, এরোস্পেস পার্টস প্রস্তুতকারক মেগগিট পিএলসি নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রির ৪.০ গবেষণা প্রকল্প এম 4 তৈরী করেছে। [১৬]

“ইন্ডাস্ট্রি ৪.০” বিশেষত ডিজিটাইজেশন কীভাবে শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে জার্মানিতে ওয়ার্ক ৪.০ শীর্ষক আলোচনা হচ্ছে। [১৭]

জার্মান সরকারের ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ কৌশলের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল অত্যন্ত ফ্লেক্সিবল উৎপাদনের (বৃহৎ আকারে) শর্তে পণ্যের প্রবল স্বনির্ধারণ (কাস্টোমাইজেশন)।[১৮] সেলফ-অপটিমাইজেশন, সেলফ-কনফিগারেশন [১৯] , সেলফ-ডায়াগনজ, কগনিশন এর প্রবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জটিল কাজে কর্মীদের বুদ্বিমান সহায়তায় প্রয়োজনীয় স্বয়ংক্রিয়করণ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে চলেছে।[২০] ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর বৃহত্তম প্রকল্প হল জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রক (বিএমবিএফ) এর শীর্ষস্থানীয় ক্লাস্টার প্রকল্প "ইন্টেলিজেন্ট টেকনিক্যাল সিস্টেমস অস্টওয়েস্টফ্যালেন-লিপ্পে( ইটস ওডাব্লুএল)"। আরেকটি বড় প্রকল্প হল বিএমবিএফ এর রেস-কম [২১] এছাড়াও ক্লাস্টার অব এক্সিলেন্স "ইন্টিগ্রেটিভ প্রোডাকশন টেকনোলজি ফর হাই-ওয়েজ কান্ট্রিজ"।[২২] ২০১৫ সালে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ইউরোপীয় কমিশন CREMA ( XaaS এবং ক্লাউড মডেলের ওপর ভিত্তি করে ক্লাউড ভিত্তিক র‍্যাপিড ইলাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারিং) দিগন্ত 2020 নামের একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করে। [২২]

পরিকল্পনা নীতিমালা এবং লক্ষ্যমাত্রা

শিল্প ৪.০ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে চিহ্নিত চারটি পরিকল্পনা নীতি রয়েছে:[২৩]

  • আন্তঃসংযোগ - মেশিন, ডিভাইস, সেন্সর এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে ইন্টারনেট অফ থিংস অথবা ইন্টারনেট অফ পিউপল (আইওপি) এর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন এবং যোগাযোগের ক্ষমতা[২৪]
  • তথ্যের স্বচ্ছতা - ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ তথ্যের স্বচ্ছতা দেয় যা অপারেটরদের সিদ্বান্ত নেওয়ার জন্য ব্যাপক তথ্য সরবরাহ করে। আন্তঃসংযোগের কারনে অপারেটর উৎপাদন প্রক্রিয়ার সমস্ত পয়েন্ট থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং সেসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শনাক্ত করতে পারে যেগুলো সিস্টেমের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করলে আরও কার্যকর হবে
  • প্রযুক্তিগত সহায়তা - সিদ্বান্ত গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধানে মানুষকে সহায়তা করার জন্য সিস্টেমের প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং কঠিন বা অনিরাপদ কাজের ক্ষেত্রে সহায়তা করার ক্ষমতা [২৫]
  • বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত - সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেমের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বতন্ত্রভাবে তাদের কাজ যথাসম্ভব সম্পাদন করার ক্ষমতা। কেবল কোনো ব্যতিক্রম, হস্তক্ষেপ বা সাংঘর্ষিক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে উচ্চস্তরে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় [২৬]

উপাদানসমূহ

ফাইভ জি সেল টাওয়ার

আমাদের সমাজ এবং চলতি ট্রেন্ডগুলোকে গভীরভাবে দেখলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অনেকগুলো উপাদানে ভাগ করা যায়।এই উপাদানগুলো কতটা ব্যাপক তা বুঝার জন্য উদাহরণস্বরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির নাম দেয়া হল:[২৭]

  • মোবাইল ডিভাইস
  • ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) প্ল্যাটফর্ম
  • অবস্থান সনাক্তকরণ প্রযুক্তি (বৈদ্যুতিক সনাক্তকরণ)
  • উন্নত মানব-মেশিন ইন্টারফেস
  • প্রমাণীকরণ এবং জালিয়াতি সনাক্তকরণ
  • স্মার্ট সেন্সর
  • বিগ অ্যানালিটিকস এবং উন্নত প্রক্রিয়া
  • বহুস্তরীয় গ্রাহক ইন্টারঅ্যাকশন এবং গ্রাহক প্রোফাইলিং
  • অগমেন্টেড রিয়েলিটি / ওয়্যারেবল টেকনোলজি
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা
  • ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং ট্রিগারড লাইভ ট্রেনিং [২৭]

মূলত এই প্রযুক্তিগুলি চারটি প্রধান উপাদানে নিয়ে আসা যেতে পারে, যা "ইন্ডাস্ট্রি ৪.০" বা "স্মার্ট ফ্যাক্টরি" শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করে:[২৭]

  • সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম
  • ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি)
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা
  • কগনিটিভ কম্পিউটিং [২৭]

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ ব্যাপক আকারে নতুন প্রযুক্তির সংযোগ করে উপযোগ তৈরী করে। সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম ব্যবহার করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরী করা সম্ভব। এই সিস্টেমের বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্বাধীনভাবে ডিসেন্ট্রালাইজড ডিসিশান নেওয়ার ক্ষমতা। [২৭]

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ অনেকাংশেই বৈদ্যুতিন শনাক্তকরণের ওপর নির্ভর করতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন পদ্বতিকে স্মার্ট করতে সেট টেকনোলজি স্থাপন করতে হবে। তাহলে আর ডিজিটাইজেশন এর প্রয়োজন হবে না। [২৮]

মুখ্য চালক

  • ভার্টিক্যাল এবং হরাইজন্টাল ভ্যালু চেইনের সমন্বয় এবং ডিজিটালাইজেশন— ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ পণ্য উন্নয়ন, উৎপাদন, স্ট্রাকচারিং এবং সেবাসমূহকে ভার্টিকালি সমন্বয় করে। হরাইজন্টাল ভাবে সাপ্লায়ার থেকে শুরু করে গ্রাহকসহ অংশীদারদের সকল অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ সমন্বয় করে।[২৯]
  • ডিজিটাল ব্যাবসায়িক মডেল এবং গ্রাহকদের প্রবেশাধিকার- গ্রাহক সন্তুষ্টি একটি চিরস্থায়ী প্রক্রিয়া। গ্রাহকদের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য সঠিক সময়ে সঠিক পরিবর্তন প্রয়োজন।

বৃহত্তম ট্রেন্ডস

সংক্ষেপে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হল উৎপাদন পদ্বতিতে এবং প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়করণ এবং তথ্য আদান-প্রদানের প্রচলন। যার মধ্যে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম (সিপিএস), আইওটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংস [৩০], ক্লাউড কম্পিউটিং,[২৩][৩১][৩২] , কগনিটিভ কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিগুলো অন্তর্ভুক্ত। [৩৩]

স্মার্ট কারখানা

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব “স্মার্ট ফ্যাক্টরি” ধারণাটির পৃষ্ঠপোষকতা করে। মড্যুলার স্ট্রাকচারের স্মার্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম সকল ভৌত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরী করে এবং কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্বান্ত গ্রহণ করে।[৩৪] ইন্টারনেট অফ থিংস এর মাধ্যমে সিস্টেমগুলো নিজেদের মধ্যে এবং মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং পরস্পরের সহায়তা করে। এরা সমগ্র প্রতিষ্ঠানজুড়েই ভ্যালু চেইনের সকল অংশের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম। [২৩][৩৫]

ভবিষ্যদ্বাণীমূলক রক্ষণাবেক্ষণ

আইওটি সেন্সর এবং প্রযুক্তির ব্যবহার করে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি সরাসরি সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে পারে যার ফলে মেশিন অচল বা নষ্ট হওয়ার অনেক আগেই সমস্যা নির্ধারণ করে সাশ্রয়ী খরচে সমাধান করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক এলএ (লস অ্যাঞ্জেলস) এর একটি কোম্পানি বুঝতে পারল যে সিঙ্গাপুরে তাদের একটি যন্ত্রাংশ অস্বাভাবিক গতি বা তাপমাত্রায় কাজ করছে। তাহলে তারা যন্ত্রাংশটি মেরামত করার প্রয়োজন আছে কিনা সে বিষয়ে সিদ্বান্ত নিতে পারবে। [৩৬]

থ্রিডি প্রিন্টিং

বলা হয় ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ ব্যাপকভাবে থ্রিডি প্রিন্টিং এর ওপর নির্ভর করবে। থ্রিডি প্রিন্টিং এর সুবিধা হল এই পদ্বতিতে অনেক ধরনের কাঠামো প্রিন্ট করা যায় এবং পণ্য নকশা করাও সহজ। এছাড়াও এটি তুলনামূলকভাবে পরিবেশবান্ধব। স্বল্প পরিমাণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই পদ্বতিতে লীড টাইম এবং মোট উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম। তদুপরি থ্রিডি প্রিন্টিং  নমনীয়তা বৃদ্ধি করতে, গুদামজাতকরণের খরচ কমাতে এবং কোম্পানিকে ম্যাস কাস্টোমাইজেশন কৌশল গ্রহণ করতে সহায়তা করতে পারে। উপরন্তু এটি স্পেয়ার পার্ট প্রিন্ট এবং লাগানোর জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। এর ফলে সাপ্লায়ার নির্ভরতা এবং লীড টাইম হ্রাস পাবে। [৩৭]

থ্রিডি প্রিন্টিং এর ক্ষেত্রে নৈতিকতা এবং নিয়ণত্রণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরী হওয়া কিংবা কৃষিক্ষেত্র ছাড়াও মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে।[৩৮]

পরিবর্তনের গতিই হল ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর নির্ণায়ক। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গতি এবং এর ফলে মানুষের জীবনের আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক আছে। যা আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নির্দেশ করে এবং একটি নতুন যুগকে চিহ্নিত করে। [৩৯]

স্মার্ট সেন্সর

সেন্সর এবং ইন্সট্রুমেন্টেশন উদ্ভাবনকে চালিত করে। কেবল ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর জন্য নয় বরং স্মার্ট উৎপাদন, স্মার্ট মবিলিটি, স্মার্ট হোমস, স্মার্ট শহর এবং স্মার্ট কারখানাগুলির মতো অন্যান্য "স্মার্ট" মেগাট্রেন্ডগুলির জন্যও। [৪০]

স্মার্ট সেন্সর হল সেসব ডিভাইস যারা ডেটা তৈরী করে এবং সেলফ-মনিটরিং, সেলফ-কনফিগারেশন সহ জটিল প্রক্রিয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। ওয়্যারলেস যোগাযোগের করতে পারে বলে এদের ইন্সটলেশন অনেকাংশে সহজ এবং সেন্সরের অ্যারেগুলো বুঝতে সুবিধা হয়। [৪১]

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ তে সেন্সর, পরিমাপ বিজ্ঞান এবং স্মার্ট ইভাল্যুয়েশনের গুরুত্ব বিশেষজ্ঞদের দ্বারা স্বীকৃত। যার কারণে ইতোমধ্যে এই বিবৃতি প্রচলিত হয়েছে যে “ইন্ডাস্ট্রি ৪.০: সেন্সর সিস্টেম ছাড়া কোনো কিছুই অগ্রসর হতে পারে না” [৪২]

তবে কিছু অসুবিধা যেমন- সিনক্রোনাইজেশন ত্রুটি, ডাটা হারানো এবং বৃহৎ পরিসরে হারভেস্টেড ডেটা নিয়ে কাজ করা এসব একটি সম্পূর্ণ সিস্টেম বাস্তবায়নকে সীমাবদ্ব করে। এছাড়াও, ব্যাটারি পাওয়ারও একটি অন্যতম সীমাবদ্বতা। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রে স্মার্ট সেন্সর ব্যবহারের একটি উদাহরণ হল স্মার্ট ওয়াচ। স্মার্ট ওয়াচে সেন্সরগুলো ব্যবহারকারীর চলাচলের তথ্য গ্রহণ করে, তাদের প্রসেস করে এবং সবশেষে ব্যবহারকারী দিনে কয় পদক্ষেপ হেঁটেছে এমনকি কত ক্যালরি শক্তি ক্ষয় করেছে সে তথ্য প্রদান করে।  

কৃষি ও খাদ্য শিল্প

এই দুই ক্ষেত্রে স্মার্ট সেন্সর এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে।[৪৩] এই উদ্ভাবনধর্মী, সংযুক্ত সেন্সরগুলি জমিতে প্রাপ্ত তথ্য (পাতা-সংক্রান্ত, ভেজিটেশন ইন্ডেক্স, ক্লোরোফিল, হাইগ্রোমেট্রি, তাপমাত্রা, পানির প্রাপ্যতা, বিকিরণ) সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে যোগাযোগ করে। এর উদ্দেশ্য হল বৈজ্ঞানিক তথ্যসমূহের ওপর ভিত্তি করে স্মার্টফোন দিয়ে সঠিক সময়ে পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করে ফলাফল, সময় এবং অর্থের দিক দিয়ে জমি পরিচালনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কার্যকর করা। খামারে এই সেন্সরগুলো ব্যবহার করে শস্যের অবস্থা বোঝা যাবে এবং সঠিক সময়ে ইনপুট এবং চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়া যাবে। এমনকি সেচের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব।[৪৪]

খাদ্য শিল্পে আরও বেশি বেশি সুরক্ষা ও স্বচ্ছতা এবং পূর্ণ ডকুমেন্টেশন প্রয়োজন। এই নতুন প্রযুক্তিটি ট্র্যাকিং সিস্টেম হিসেবে এবং মানুষ ও পণ্যের ডাটা সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হয়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ইম্যাজিনেশন এইজ এর সূচনা করে। [৪৫]

লিঙ্গবৈষম্য এবং নারীদের ভূমিকা

গবেষকরা ধারণা করেন যে, ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ লিঙ্গবৈষম্যকে প্রভাবিত করবে। ভবিষ্যতে যে সকল পেশার অটোমেশন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম তার মধ্যে অন্যতম হল ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত(ম্যানেজারিয়াল) পেশা। এ ধরনের কাজের জন্য অবশ্যই জটিল পরিস্থিতিতে সিদ্বান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হবে। নেতৃত্ব, কর্মদক্ষতা, মানবিক গুণের দিক দিয়ে নারীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রমাণ থাকলেও নারীদের অপেক্ষাকৃত কম সুযোগ-সুবিধা ও অংশগ্রহণ, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জটিলতা, পূর্বের তুলনায় ঘন-ঘন এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, বাঁধাধরা সামাজিক রীতি এসবই বৈষম্য তৈরী করতে পারে। আবার প্রায়োগিক বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণে নারীদের আগ্রহ এবং সুযোগ কম থাকায় অটোমেশনের ফলে নারীদের চাকরির ক্ষেত্র আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হবে। সার্বিকভাবে নারীদের জন্য ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে।[৪৬][৪৭]

প্রতিবন্ধকতাসমূহ

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ:[৪৮][৪৯]

অর্থনৈতিক

  • উচ্চ ব্যয়
  • উপযুক্ত ব্যবসায়িক মডেলের সাথে খাপ খাওয়ানো
  • অস্পষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা / অতিরিক্ত বিনিয়োগ [৪৮][৪৯]

সামাজিক

  • ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগ
  • নজরদারি এবং অবিশ্বাস
  • অংশীদারদের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার অনীহা
  • কর্পোরেট আইটি ডিপার্টমেন্টের অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ার আশঙ্কা
  • সামাজিক বৈষম্য এবং অস্থিরতা বৃদ্বি
  • স্বয়ংক্রিয় এবং আইটি নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষত শ্রমিকদের চাকরি হারানো [৪৮][৪৯][৫০]

রাজনৈতিক

  • ব্যবস্থাপনা, মানদন্ড এবং সার্টিফিকেশন ফর্মের অভাব।
  • জনসাধারণ বিশেষত বিরোধিতাকারীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্যতা।
  • অস্পষ্ট আইনি ব্যবস্থা এবং ডেটা সুরক্ষা। [৪৮][৪৯]

সাংগঠনিক

  • আইটি সুরক্ষাজনিত সমস্যা, যেগুলো পূর্বে বন্ধ থাকা দোকান পুনরায় চালু করার সহজাত প্রয়োজনের জন্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে
  • জটিল মেশিন টু মেশিন ( এমটুএম) যোগাযোগ স্থাপন, স্বল্প ও স্থিতিশীল বিলম্ব কাল রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নির্ভরশীলতা ও স্থিতিশীলতা
  • উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অখন্ডতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
  • যেকোনো ধরনের তথ্য প্রযুক্তিগত বাধা এড়িয়ে চলা কেননা এগুলো উৎপাদনে ব্যয়বহুল বিভ্রাট ঘটায়
  • শিল্প কৌশল সম্পর্কে প্রায়োগিক জ্ঞান রাখার প্রয়োজনীয়তা ( ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন গিয়ারের কন্ট্রোল ফাইলগুলোতে অন্তুর্ভূক্ত থাকে)
  • চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে দ্রুত রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রিক দক্ষতার অভাব
  • শীর্ষ পরিচালকবর্গের নিবেদনের অভাব
  • কর্মীদের অপর্যাপ্ত যোগ্যতা [৪৮][৪৯]

প্রয়োগ

অ্যারোস্পেস শিল্পকে কখনো কখনো “ব্যাপক অটোমেশনের (স্বয়ংক্রিয়করণ) তুলনায় খুবই সামান্য পরিমাণ উৎপাদন” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে কয়েকটি কোম্পানি ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর নীতিগুলো পরীক্ষা করে সেসব জায়গায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার প্রযুক্তি তৈরী করেছে যেখানে অটোমেশনের প্রাথমিক খরচ অনেক বেশি। এর একটি উদাহরণ হল অ্যারোস্পেস পার্টস প্রস্তুতকারী মেগজিট পিএলসি এর এমফোর প্রকল্প। [১৬]

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংসের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে বশ এবং জার্মানীতে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর প্রয়োগের মধ্যে আছে সেসব মেশিন যারা ফেইলিওর এর পূর্বাভাস দিয়ে নিজেরাই মেরামত করতে পারে এবং অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিজে নিজেই সমন্বয় করতে পারে।   [৫১]

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ অ্যাকাডেমিয়া এবং গবেষণা ও উন্নয়নে ডিজিটাইজেশনের পৃষ্ঠপোষকতা করে যা ইনোভেশন ৪.০ নামে পরিচিত। ২০১৭ সালে লিভারপুল ইউনিভার্সিটিতে ৮১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে কম্পিউটার-এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিং[৫২] এর কেন্দ্র হিসেবে ম্যাটেরিয়ালস ইনোভেশন ফ্যাক্টরির (এমআইএফ) উদ্বোধন করা হয় যেখানে রোবোটিক ফর্মুলেশন[৫৩], ডেটা ক্যাপচার এবং মডেলিং উন্নয়ন কাজে ব্যবহ্রত হয়। [৫৪]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ