জেনেভা কনভেনশন

আন্তর্জাতিক আইন

জেনেভা কনভেনশন চারটি চুক্তি ও তিনটি বাড়তি প্রটোকল নিয়ে গঠিত, যা যুদ্ধে মানবিক আচরণ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। বস্তুত, একবচন শব্দ হিসেবে জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ সালের একটি সন্ধিপত্রকে নির্দেশ করে, যেটি সম্পাদিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ও এর ফলাফল হিসেবে। এই সন্ধিপত্রেই চতুর্থ চুক্তিটি যোগ করা হয় ও প্রথম তিনটি চুক্তির (১৮৬৪, ১৯০৬, ১৯২৯) হালনাগাদ করা হয়। চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের (১৯৪৯) বিভিন্ন অনুচ্ছেদে যুদ্ধকালীন সময়ে বা সামরিক সংঘাতে ধৃত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারসমূহ নির্দিষ্টভাবে ও বিশদ ভাষায় নিরূপণ করা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আহতদের এবং যুদ্ধাঞ্চল ও এর কাছাকাছি এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা। ১৯৪৯ সালের এই চুক্তিগুলোকে সম্পূর্ণরূপে অথবা রিজার্ভেশনসহ (একটি চুক্তির কার্যধারা মুলতুবি রাখার প্রক্রিয়া) আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করেছে ১৯৬ টি দেশ।[১]

জেনেভা কনভেনশন: যুদ্ধে মানবিক নীতি প্রতিষ্ঠাকারী প্রথম জেনেভা কনভেনশনের (১৮৬৪) স্বাক্ষর ও মোহরাঙ্কিত পৃষ্ঠা

জেনেভা কনভেনশন যেহেতু যুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট মানুষের বিষয়ে, তাই এর অনুচ্ছেদসমূহে যুদ্ধ ও যুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে যথোচিত নির্দেশ দেয়া হয়নি। এই দুইটি প্রসঙ্গ মূলত হেগ কনভেনশনের বিষয়বস্তু (প্রথম হেগ কনফারেন্স ১৮৯৯ সালে ও দ্বিতীয় হেগ কনফারেন্স ১৯০৭ সালে সম্পাদিত হয়)। এছাড়াও, রাসায়নিকজীবাণু যুদ্ধ নিয়ে নির্দেশনা রয়েছে জেনেভা প্রটোকলে (যুদ্ধে শ্বাসরোধকারী, বিষাক্ত ও অন্যান্য গ্যাসের ব্যবহার এবং জীবাণুতাত্ত্বিক যুদ্ধপ্রণালী নিষিদ্ধকরণের জন্য যে প্রটোকল, ১৯২৯)।

ইতিহাস

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রেডক্রসের পোস্টার

১৮৬২ সালে হেনরী ডুনান্ট যুদ্ধের বিভীষিকা নিয়ে তার মেমোয়ার অভ সলফেরিনো বইটি প্রকাশ করেন।[২] তাঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা তাঁকে নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলঃ

  1. যুদ্ধকালীন সময়ে একটি স্থায়ী ত্রাণ সংস্থা, এবং
  2. একটি সরকারি চুক্তি যা সংস্থাটির নিরপেক্ষতার স্বীকৃতি দেবে এবং যুদ্ধাঞ্চলে সংস্থাটিকে সাহায্য প্রদানের অনুমতি দেবে।

প্রথম প্রস্তাবটির কারণে প্রতিষ্ঠা পেল রেডক্রস। আর দ্বিতীয়টি জন্ম দিয়েছিল প্রথম জেনেভা কনভেনশন। এই দুইটি অর্জনের জন্য ১৯০১ সালে ফ্রেদেরিক পাসির সাথে যৌথভাবে হেনরী ডুনান্ট নোবেল শান্তি পুরস্কার পান[৩][৪] যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থ সৈনিকদের সার্বিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে প্রথম জেনেভা কনভেনশনটি সম্পাদিত হয়েছিল।

১৮৬৪ সালের ২২শে আগস্ট মোট বারোটি দেশ প্রথম চুক্তিটির দশটি অনুচ্ছেদ প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে।[৫] এ প্রচারিভাযানে মার্কিন রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা ক্লারা বার্টন যথেষ্ট প্রভাব রাখেন । অবশেষে ১৮৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্র এর অনুমোদন দেয়।[৬]

সমুদ্রস্থ যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থ সৈনিকদের সার্বিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে ১৯০৬ সালের ৬ই জুলাই-এ সম্পাদিত জেনেভা কনভেনশনে দ্বিতীয় চুক্তিটি গৃহীত হয় । এটিই দ্বিতীয় জেনেভা কনভেনশন। এই চুক্তিটিতে সুনির্দিষ্টভাবে সমুদ্রপথে যুদ্ধরত সেনাবাহিনীকে নির্দেশ করা হয়েছে। [৭] ১৯২৯ সালের ২৭শে জুলাইয়ে সম্পাদিত যুদ্ধবন্দিদের সাথে সু-আচরণ ও তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনেও এটি বহাল রাখা হয় এবং কার্যকর হয় ১৯৩১ সালের ১৯শে জুন তারিখে।[৮] ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে যে যুদ্ধাপরাধের ঘটনা প্রকাশ পায় তার প্রতি তীব্র ক্ষোভ থেকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী এক শান্তিকামি ও মানবহিতৈষী স্পৃহা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৪৯ সালে একের পর এক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতে পূর্বের তিনটি জেনেভা কনভেনশনকে হালনাগাদকরণ ও সুনিশ্চিতকরণসহ যুদ্ধকালীন সময়ে বেসামরিক জনগণ রক্ষার্থে একটি নতুন ও বিশদ জেনেভা কনভেনশন যোগ করা হয়। এটাই ছিল চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন।

এই দলিলসমূহের বহু বিস্তারিত ব্যাপ্তিসত্ত্বেও সময়ের সাথে সাথে এর অসম্পূর্ণতা উপলব্ধি করা গেছে। বস্তুত স্নায়ুযুদ্ধের শুরু থেকেই যুদ্ধের ধরন বদলে গেছে, ফলে অনেকেই মনে করেন যে, ১৯৪৯-এর জেনেভা কনভেনশন প্রকৃতপক্ষে এক অধুনা-লুপ্ত বাস্তবতার জন্য প্রযোজ্য।[৯] একদিকে বেশিরভাগ সামরিক সংঘাত ছিল অভ্যন্তরীণ যা পরিণত হয়েছিল গৃহযুদ্ধে, আবার অপরপক্ষে বেশিরভাগ যুদ্ধ হয়ে উঠছিল ক্রমবর্ধমানভাবে অসম বা অসঙ্গতিপূর্ণ। তাছাড়া সাম্প্রতিককালের যুদ্ধ ও সংঘাতগুলোতে বেসামরিক জনগণকে উত্তরোত্তর ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে, যার ফলে যুদ্ধকালীন সময়ে বেসামরিক সামগ্রী ও জনগণের প্রকৃত সুরক্ষার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ১৮৯৯ এবং ১৯০৭-এর হেগ কনভেনশন হালনাগাদ করা হয়েছে এবং এ হালনাগাদকরণ ছিল অতীব প্রয়োজনীয়। এ সমস্ত ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৭ সালে দুটি প্রটোকল গৃহীত হয় যা কিনা ১৯৪৯ সালের কনভেনশনকে বাড়তি সুরক্ষার ব্যবস্থাসহ আরও সম্প্রসারিত করেছে। ২০০৫ সালে সংক্ষিপ্ত তৃতীয় প্রটোকলটি যুক্ত হয় যা চিকিৎসা সেবার নিরাপত্তামূলক প্রতীক চিহ্ণের জন্য রেডক্রসরেডক্রিসেন্ট-এর প্রতীকচিহ্ণের বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে রেডক্রিস্টাল। এই প্রতীকটি সেই সব দেশের জন্য প্রযোজ্য যারা রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্টের প্রতীকচিহ্ণকে আপত্তিকর মনে করে।

জেনেভা কনভেনশন ও এর চুক্তিসমূহ

জেনেভা কনভেনশনে যে সব বিধি যুক্ত হয়েছে তা যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাতের সময়ে প্রয়োগযোগ্য এবং এই আইন বা বিধিসমূহ সেই ব্যক্তিবর্গকে রক্ষার চেষ্টা করে যারা সংঘাত বা বৈরিতায় লিপ্ত নয় অথবা যারা সংঘাত ও বৈরিতায় আর অংশগ্রহণ করছে না, যেমনঃ

  • আহত বা অসুস্থ যোদ্ধা
  • যুদ্ধবন্দী
  • বেসামরিক জনগণ
  • ধর্ম এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে নিয়োজিত কর্মীবৃন্দ

কনভেনশনসমূহ

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কনভেনশন শব্দটি সম্মেলন এর সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বরং এই শব্দটি কূটনীতিতে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সন্ধিপত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৪৯ সালে প্রথম তিনটি জেনেভা কনভেনশনের পরিমার্জন ও সম্প্রসারণ করা হয় এবং এতে চতুর্থ কনভেনশনটি যোগ করা হয়।

  • প্রথম জেনেভা কনভেনশন সম্পাদিত হয় ১৮৬৪ সালে, যার লক্ষ্য ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থ সৈন্যদের অবস্থার সার্বিক উন্নতি
  • দ্বিতীয় জেনেভা কনভেনশন সম্পাদিত হয় ১৯০৬ সালে, সমুদ্রস্থ যুদ্ধক্ষেত্রে আহত, অসুস্থ এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের সৈন্যদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে
  • তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনটি যুদ্ধবন্দিদের প্রতি আচরণ ও তাদের নিরাপত্তা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত, ১৯২৯
  • চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনটি যুদ্ধাবস্থায় বেসামরিক জনগণ রক্ষার্থে সম্পাদিত, ১৯৪৯

এই কনভেনশনগুলোর সমষ্টিকেই বলা হয় "১৯৪৯ এর জেনেভা কনভেনশনসমূহ" বা সাধারণভাবে "জেনেভা কনভেনশন"।

প্রটোকলসমূহ

১৯৪৯ এর কনভেনশনকে তিনটি সংশোধনী প্রটোকলসহ কিছুটা পরিবর্তন করা হয়ঃ

  • প্রটোকল ১ (১৯৭৭) আন্তর্জাতিক সামরিক সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি রক্ষার্থে গৃহীত হয়
  • প্রটোকল ২ (১৯৭৭) অ-আন্তর্জাতিক সামরিক সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গকে রক্ষার সাথে সম্পর্কিত
  • প্রটোকল ৩ (২০০৫) অতিরিক্ত স্বাতন্ত্র্যসূচক প্রতীক পরিগ্রহ করা সংক্রান্ত বিষয়ে গৃহীত হয়

প্রয়োগ

যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাতের সময়ে সেইসব রাষ্ট্রের জন্যই জেনেভা কনভেনশন প্রযোজ্য যারা এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ২ এবং ৩ নং অনুচ্ছেদে জেনেভা কনভেনশনের প্রয়োগযোগ্যতা স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যদিও এই প্রয়োগযোগ্যতার বিষয়টি কিছু বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। যে সময়ে জেনেভা কনভেনশনের প্রয়োগ হবে, সে সময়টিতে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার লক্ষ্যে সরকারকে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত রষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। এই আইন কোনো দেশের সংবিধান বা তার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে পুরোপুরি সুসংগত না-ও হতে পারে। ফলে জেনেভা কনভেনশনের চুক্তিগুলো ব্যক্তিপর্যায়ে জনগণের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক চাপের কারণে কোনো কোনো সরকার এর দায়-দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা প্রদর্শন করতে পারে।

আন্তর্জাতিক সামরিক সংঘাতের সাথে সম্পর্কিত ২ নং ধারা

এই ধারা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সংঘাতের প্রতিটি ক্ষেত্রেই জেনেভা কনভেনশনের প্রয়োগ হবে। তবে এটি সেসব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেখানে যুদ্ধরত জাতিগুলোর মধ্যে কমপক্ষে একটি দেশ জেনেভা কনভেনশনের অনুমোদন দিয়েছে। প্রাথমিকভাবেঃ

  • আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণাকৃত জাতিসমূহের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের সব পরিস্থিতিতেই জেনেভা কনভেনশনের প্রয়োগ হবে। প্রয়োগযোগ্যতার এই মৌলিক চেতনাটি পাওয়া যায় ১৯৪৯ এর জেনেভা কনভেনশনের পূর্ববর্তীটিতে।
  • এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করা না হলেও কনভেনশনের অনুমোদনকারী দুই বা ততোধিক জাতির মধ্যে বিদ্যমান সামরিক সংঘাতের সব পরিস্থিতিতে জেনেভা কনভেনশনের প্রয়োগ হবে। পূর্ববর্তী প্রস্তাবটির এই নতুন রূপ যোগ করা হয়েছে ১৯৪৯ সালে, সেই সব পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রাখার জন্য যেখানে দুই বা ততোধিক জাতি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা না করলেও তাদের মধ্যে যুদ্ধ-পরিস্থিতি বিরাজ করে। [১০]
  • কনভেনশনে স্বাক্ষরকৃত দেশের জন্য জেনেভা কনভেনশনের প্রয়োগ হবে। এই নিয়মটি এমনকি সেই সব ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যেখানে বিরোধী দেশটি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি কিন্তু এর ধারাগুলোকে "গ্রহণ ও প্রয়োগ" করেছে। [১০]

এছাড়াও প্রটোকল ১ এর ১ নং ধারা অনুযায়ী ঔপনিবেশিক শাসন ও বিদেশী দখলদারিতার বিরুদ্ধে সামরিক সংঘাতও আন্তর্জাতিক সংঘাত হিসাবে বিবেচিত হবে।

যখন আন্তর্জাতিক সংঘাতের মানদণ্ড নিশ্চিত করা যাবে, তখনই জেনেভা কনভেনশনের সম্পূর্ণ সুরক্ষার প্রয়োগের ব্যাপারটি বিবেচনা করা হবে।

অ-আন্তর্জাতিক সংঘাতের সাথে সম্পর্কিত ৩ নং ধারা

এই ধারা অনুযায়ী, একটিমাত্র দেশের সীমানার ভেতরে সীমাবদ্ধ এবং প্রকৃতিতে আন্তর্জাতিক নয় এ রকমের সামরিক সংঘাতের জন্যেও যুদ্ধ-সম্পর্কিত কনভেনশনের ন্যূনতম কিছু বিধি প্রযোজ্য। উল্লেখ্য, এ ধারাটির প্রয়োগযোগ্যতা নির্ভর করে সামরিক সংঘাত শব্দটির অর্থের ওপরে।[১০] যেমন, এর প্রয়োগ হবে সরকার এবং বিদ্রোহী বাহিনীর সংঘাতে, অথবা দুইটি বিদ্রোহী বাহিনীর সংঘর্ষে, অথবা অন্য যেকোনো সংঘাতে যা যুদ্ধের বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধারণ করেও একটি দেশের সীমানার ভেতরেই সীমাবদ্ধ। মুষ্টিমেয় কিছু লোক একটি পুলিশ স্টেশনে হামলা চালালে তা এই ধারার সাপেক্ষে সামরিক সংঘাত নয়, এ ধরনের ঘটনা শুধুমাত্র আলোচ্য দেশটির আইনের অধীনেই বিবেচিত হবে।[১০]

আন্তর্জাতিক নয় এমন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে পুরো জেনেভা কনভেনশনের সবকয়টি ধারা বা বিধান প্রয়োগযোগ্য নয়। শুধুমাত্র ৩ নং ধারা[১০] এবং প্রটোকল ২ এ অন্তর্ভুক্ত সীমিত কিছু শর্তই এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রয়োগযোগ্য। অন্যথায় কনভেশনের অনেক অনুচ্ছেদ বা শর্তই একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক হবে, চুক্তির ধারা প্রয়োগ সীমিতকরণের যৌক্তিক ভিত্তি ছিল এটাই। এ ধারাটির শর্তসমূহ প্রযোজ্য হবে এই বিবেচনায় নিচের প্রস্তাবগুলো পাওয়া যায়ঃ

  • যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে না, এর ভেতরে সেই সামরিক ব্যক্তিগণও অন্তর্ভুক্ত হবে যারা অসুস্থতা, জখম বা বন্দীত্বের কারণে যুদ্ধে সক্রিয় নয়, তাদের সাথে সদয় আচরণ করতে হবে।
  • আহত ও অসুস্থদের যত্ন নিতে হবে, তাদের চিন্তা এবং আবেগকে শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।

কনভেনশন কার্যকরীকরণ

কনভেনশন বাস্তবায়নে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতা

জেনেভা কনভেনশন এবং অন্যান্য চুক্তির সাথে সম্পর্কিত সব বিষয়ের জন্য চূড়ান্ত ট্রাইব্যুনাল হিসাবে রয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। জাতিসংঘ সনদ হলো একটি কনস্টিটিউয়েন্ট ট্রিটি এবং এর ধারাগুলোর প্রতি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জাতিসংঘ সনদের ২৫ নম্বর এবং অন্যান্য ধারামতে[১১] জাতিসংঘের প্রতি আইনি ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা হতে হবে অন্যসব চুক্তির প্রতি বাধ্যবাধকতার চেয়ে বেশি ও তা হবে সর্বোচ্চ। তবে নিরাপত্তা পরিষদ কদাচিৎ জেনেভা কনভেনশন সম্পর্কে এর কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে, তাই বেশিরভাগ বিষয়েরই সুরাহা হয় আঞ্চলিক চুক্তি অথবা জাতীয় আইনের সাহায্যে।

প্রটেক্টিং পাওয়ারস

কনভেনশনে উল্লেখিত প্রটেক্টিং পাওয়ার শব্দদ্বয়ের একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। প্রটেক্টিং পাওয়ার বা নিরাপত্তাবিধানকারী শক্তি হলো এমন একটি রাষ্ট্র যেটি একটি নির্দিষ্ট সামরিক সংঘাতে অংশগ্রহণ করছে না, কিন্তু সংঘাতের সাথে সম্পৃক্ত একটি পক্ষের স্বার্থের দিকে খেয়াল রাখতে সম্মত হয়েছে। এই প্রটেক্টিং পাওয়ার, যে কিনা একটি মধ্যস্থতাকারী, সংঘাতে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে। যুদ্ধাঞ্চল পরিদর্শন ও যুদ্ধবন্দীদের সাথে সাক্ষাৎ করে কনভেনশনের প্রয়োগ হচ্ছে কিনা এই ব্যাপারটি পরীক্ষা করাও এর একটি কাজের মধ্যে পড়ে। শুধু তাই নয়, বন্দী, আহত ও বেসামরিক জনগণের পক্ষে প্রটেক্টিং পাওয়ারকে অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে।

কনভেনশনের লঙ্ঘন

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের লোগো

কনভেনশনের সব চুক্তির লঙ্ঘন গুরুত্বের দিক দিয়ে সমান নয়। সবচেয়ে ভয়ানক অপরাধগুলোকে গুরুতর চুক্তিভঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এ থেকে যুদ্ধাপরাধের একটি আইনি সংজ্ঞাও পাওয়া যায়। কনভেনশন সুরক্ষা দেবে এমন ব্যক্তির সাথে যে সমস্ত আচরণ দ্বিতীয় ও তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচিত হবে তা নিম্নরূপঃ

  • ইচ্ছাকৃত হত্যা, অত্যাচার অথবা মানব শরীরে জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ
  • ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাস্থ্যের বা শরীরে গুরুতর জখম বা ক্ষতি করা
  • কাউকে বলপূর্বক শত্রুশিবিরে কাজ করতে বাধ্য করা
  • যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত কাউকে পক্ষপাতহীন বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।

এছাড়াও নিম্নোক্ত কাজগুলোও চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচিত হবেঃ

  • কাউকে জিম্মি করে রাখা
  • বেআইনি ও নীতিবিগর্হিতভাবে সম্পত্তির ব্যাপক ধ্বংস ও আত্মসাৎকরণ যা সামরিক আবশ্যকতার প্রেক্ষিতে ন্যায্য নয়
  • বেআইনিভাবে কাউকে নির্বাসিত করা, স্থানান্তর করা বা আটক করে রাখা।[১২]

জেনেভা কনভেনশনের চুক্তিগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অবশ্যই উপরিউক্ত অপরাধগুলোর শাস্তি প্রদান করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং কার্যক্ষেত্রে সেই আইনের প্রয়োগও ঘটাতে হবে।[১৩] শুধু তাই নয়, চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো জাতীয়তা ও অপরাধ সংঘটনের স্থান নির্বিশেষে উল্লেখিত অপরাধে অভিযুক্তদেরকে অথবা এই সমস্ত অপরাধের আদেশ প্রদানকারী অফিসারদেরকে বিচারের সম্মুখীন করাতে আইনগতভাবে বাধ্য।

ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের মূলনীতি গুরুতর চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন প্রয়োগের জন্য জাতিসংঘ সনদ থেকে এর কর্তৃত্ব ও আইনসংগত অধিকার ঘোষণা করবে। ঠিক এই কাজটিই নিরাপত্তা পরিষদ করেছিলো যখন তারা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য ও এর পক্ষে মামলা দায়ের করার জন্য রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটিআর) এবং যুগোশ্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটিওয়াই) গঠন করে।

সাম্প্রতিককালে জেনেভা কনভেনশন

১৯৪৯ সালে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন সম্পাদনের পর থেকে যুদ্ধ ও যুদ্ধ সংঘটনের প্রকৃতি যদিও নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে, তারপরেও এই কনভেনশনগুলোকে আজও আন্তর্জাতিক মানবহিতৈষী আইনের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[১৪] এটি নিরাপত্তাবিধান করছে সেই সব যোদ্ধাদের যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অসমর্থ। শুধু তাই নয়, এই কনভেনশন বেসামরিক জনগণের সুরক্ষার ব্যাপারটিও নিশ্চিত করছে। সাম্প্রতিককালের সব আন্তর্জাতিক সামরিক সংঘাতে কনভেনশনের চুক্তিগুলো কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান যুদ্ধ (২০০১ - বর্তমানকাল),[১৫], ২০০৩ এর ইরাক আগ্রাসন, চেচনিয়া আগ্রাসন (১৯৯৪ - বর্তমানকাল)[১৬], এবং ২০০৮ এর রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধ।

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ