নগদ (অর্থ)

অর্থনীতিতে, নগদ অর্থ হল মুদ্রার ভৌত রূপ, যেমন ব্যাংকনোট এবং কয়েন।

মার্কিন ডলার (ব্যাংকনোট)

হিসাবরক্ষণ এবং আর্থিক হিসাববিজ্ঞানের ভাষায় নগদ হল চলতি সম্পদ যার মধ্যে মুদ্রা বা মুদ্রার সমতুল্য মূল্য রয়েছে এবং যেটির মূল্য সাথেসাথেই বা দ্রুত সময়ে পাওয়া যায়। নগদ অর্থ রিজর্ভ হিসেবে অথবা একটি কাঠামোগত প্রবাহের মাধ্যমে রাখা হয় যাতে আর্থিক বাজারের আকর্ষিক মন্দা এড়ানো সম্ভব হয়।

ব্যুৎপত্তি

ইংরেজি শব্দ 'Cash' বা 'নগদ' এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ছিল 'মানি বাক্স'। পরবর্তীতে, ১৮ শতকের দিকে এটি 'অর্থ' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। 'Cash' বা 'নগদ' শব্দটি মধ্য ফরাসি Caisse (মানি বক্স) থেকে এসেছে, যা প্রাচীন ইতালীয় Cassa এবং সর্শেবষ পর্যন্ত ল্যাটিন Capsa (বক্স) থেকে এসেছে।[১][২].

নগদ শব্দের আরেকটি উৎপত্তি হল পর্তুগিজ শব্দ Caixa, যেটি তামিল শব্দ காசு ( kācu হিসাবে উচ্চারিত), থেকে এসেছে। এর অর্থ সোনা, রৌপ্যে বা তামার ছোট মুদ্রা।[৩]

ইতিহাস

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপে কয়েন, রৌপ্য গয়না এবং হ্যাকসিলভার কয়েক শতাব্দী ধরে অর্থের একমাত্র রূপ হিসেবে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে, মধ্যযুগের প্রথম দিকে ভেনিসের বণিকরা বড় অংকের লেনদেনের জন্য এক ধরনের রূপার বারের ব্যবহার করা শুরু করে। প্রায় একই সময়ে ভেনিসের বণিকরা তাদের ব্যাংকগুলোকে অর্থ প্রদানের নির্দেশ দিতে এক ধরনের কাগজের বিল ব্যবহার করা শুরু করে। ভেনিসের বণিকরা ওই সময়ে যেই জায়গাগুোতে তাদের প্রতিনিধি অফিস পরিচালনা করতো সেখানে তারা চিহ্নিত রৌপ্য বার ব্যবহার করতো। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং বলকান অঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাজ্য এবং কিভান রুসও বড় অংকের লেনদেনের অর্থ প্রদানের জন্য চিহ্নিত রূপার বার ব্যবহার করেছিল। বিশ্ব অর্থনীতির বিকাশ এবং রৌপ্য সরবরাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে মুদ্রার আকার বড় হতে থাকে। ১৫ শতক থেকে আন্তর্জাতিক অর্থ প্রদানের জন্য একটি আদর্শ মুদ্রা তৈরি করা হয়।

১৭ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রা ইংল্যান্ডে তৈরি করা হতো। ইংল্যান্ডে সংস্কৃত कृष-কারসা থেকে নগদ শব্দটি গৃহীত হয়েছিল। कृष-কারসা শব্দের অর্থ হচ্ছে সোনা বা রৌপ্যের ওজন নির্ণয় করা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রায় উর্দু এবং ইংরেজি উভয়ই লেখা ছিল, যাতে বাণিজ্যে এর ব্যবহার সহজতর হয়। ১৬৭১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা বোম্বেতে একটি টাকশাল স্থাপনের নির্দেশ দেন যা বোম্বাইন নামে পরিচিত ছিল। ১৬৭৭ সালে এটি রাজকীয় অনুমোদন পায়।

ইউরোপে কাগজের মুদ্রার ব্যবহার শুরু করার প্রায় ৫০০ বছর আগে তাং রাজবংশের আমলে চীনে প্রথম কাগজের মুদ্রা ব্যবহৃত হয়েছিল।[৪] ১৩ শতকে মার্কো পোলো চীন সফরের সময় অবাক হয়েছিলেন যে ওই সময়ে মানুষ লেনদেনের জন্য রৌপ্য বা সোনার তৈরি মূল্যবান মুদ্রার পরিবর্তে কাগজের অর্থের ব্যবহার করে। মার্কো পোলো বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে গ্রেট কান কাগজের অর্থ তৈরি করতে তুঁত গাছের একটি অংশ ব্যবহার করেছিল এবং সেই সাথে এটিকে প্রমাণীকরণের জন্য কাগজে ছাপ দেওয়ার জন্য একটি সিল ব্যবহার করা হয়েছিল। মার্কো পোলো সেই সময়ে অর্থ জালিয়াতির সুযোগ সম্পর্কেও তুলে ধরেন এবং জালিয়াতির শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডর কথা উল্লেখ করেন।[৫] ১৭ শতকের দিকে মূল্যবান ধাতুর অভাবের কারণে ইউরোপীয় দেশগুলি কাগজের অর্থ ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে অর্ম্থনীতিতে কম মুদ্রা তৈরি হয় এবং প্রচলন কম হয়। [৬] প্রথমদিকে, এটি ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু, ১৮ শতকের দিকে সিলন এবং এসেকুইবো, ডেমেররা এবং বারবিসের সীমান্তবর্তী উপনিবেশগুলিতে কাগজের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছিল। জন ল ব্যাংকনোট তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাংক রয়্যালের সাথে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন।

ঐতিহ্যবাহী ছিদ্রযুক্ত চীনা মুদ্রা যেটি নগদ হিসাবেও পরিচিত।

কাগজের নগদ অর্থ তৈরি করার ক্ষমতা ছিল প্রদেশগুলোর হতে, ফলে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন করা সহজ ছিল। ১৮১৬ থেকে মুদ্রাগুলি সাধারণত টোকেন মানি হয়ে ওঠে, যদিও কিছু বড় রৌপ্য এবং সোনার মুদ্রা ১৯২৭ সাল পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত ছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] প্রথম বিশ্বযুদ্ধে স্ট্যান্ডার্ড কয়েন অনেকাংশে অদৃশ্য হয়ে যায়। পরবর্তীকালে, মানসম্মত স্বর্ণমুদ্রা, প্রধানত ব্রিটিশ সার্বভৌম, এখনও উপনিবেশ এবং স্বল্প উন্নত অর্থনীতিতে ব্যবহার করা হয় এবং ১৭৮০ সালের রৌপ্য মুদ্রা মারিয়া থেরেসা থ্যালার ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির জন্য বাণিজ্য মুদ্রা হিসাবে ব্যাবহার করা হয় এবং সম্ভবত পরবর্তীকলে আরও অনেকদিন স্থানীয়ভাবে ওই মুদ্রা ব্যবহার করা হয়।

অর্থ সরবরাহের বা মূল্য পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে নগদের ব্যবহার দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে পরে। যেসব লোকেরা কার্ড বা ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার নিয়ে আগ্রহী নয় কেবল তারা এবং অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট মূল্য পরিশোধের জন্য নগদ ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ডেবিট কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে নগদের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। [৭]

প্রতিযোগিতা

নগদহীন পরিশোধ ব্যবস্থা

নগদহীন পরিশোধ ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সমস্ত আর্থিক লেনদেন নগদ (ভৌত ব্যাংকনোট এবং কয়েন) এর পরিবর্তে "ডিজিটাল" ব্যবস্থার (ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড) মাধ্যমে পরিচালিত হয়। নগদহীন সমাজ মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে আছে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য লেনদেন পরিচালনা করার জন্য বিনিময় প্রথা এবং বিনিময়ের অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। [৮] বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নগদহীন পরিশোধ ব্যবস্থা চালু আছে। অন্যদিকে নগদ অর্থের ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। যদিও নগদ অর্থের প্রচলন ধরে রাখতে বিভিন্ন দেশের সরকার আইন করে দেশের ব্যাংকগুলোকে নদগ লেনদেনের বাধ্যবাধকতা দিয়েছে।[৯]

ডিজিটাল এবং ভার্চুয়াল মুদ্রা

ডিজিটাল মুদ্রা হল এক ধরনের বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা যেখানে জনসাধারণের আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করা হয় এবং মজুত রাখা হয়। এই ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এখানে ব্লকচেইনের মত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ডিজিটাল মুদ্রার পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ সাধারনত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক কর্তৃপক্ষর হতে থাকে। অন্যদিকে, ভার্চুয়াল মুদ্রা হল মূল্যের একটি ডিজিটাল উপস্থাপনা যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা জারি করা হয় না বা নিয়ন্ত্রিত হয় না, যেমন বিটকয়েন[১০]

২০১২ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, নগদের বিকল্প হিসাবে ডিজিটাল মুদ্রার সম্ভাব্যতা এবং সুযোগ সুবিধা যাচাই সম্পর্কিত বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্ট প্রকাশ করে। [১১] ২০১৯ সালে সুইডিশ সরকার ভৌত বা নগদ সুইডিশ ক্রোনার বিকল্প হিসেবে ই-ক্রোনা চালুর জন্য গবেষণা করে। ওই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল নগদের পরিবর্তে ই-ক্রনা প্রচলনের ফলে অর্থনীতিতে কি প্রভাব পড়বে। যদিও, ই-ক্রোনা চালু করার বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। [১২]

আরোও দেখুন

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ