শ্রীলঙ্কা

দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র

শ্রীলঙ্কা (ইউকে: /sri ˈlæŋkə, ʃr -/, ইউএস: /- ˈlɑːŋkə/ (); সিংহলি: ශ්‍රී ලංකා (আধ্বব: [ʃriː laŋkaː]); তামিল: இலங்கை, প্রতিবর্ণী. Ilaṅkai (আইপিএ: [ilaŋɡaj])), যার সাবেক নাম সিলন এবং দাফতরিক নাম শ্রীলঙ্কা প্রজাতান্ত্রিক সমাজবাদী জনরাজ্য, হল দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। এটি ভারত মহাসাগরে, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ও আরব সাগরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত; এটি মান্নার উপসাগরপক প্রণালী দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। ভারত এবং মালদ্বীপের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার একটি সামুদ্রিক সীমান্ত রয়েছে। দেশটির বিধানিক রাজধানী শ্রী জয়বর্ধনপুর কোট্টে এবং বৃহত্তম শহর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র কলম্বো

শ্রীলঙ্কা প্রজাতান্ত্রিক সমাজবাদী জনরাজ্য

  • ශ්‍රී ලංකා ප්‍රජාතාන්ත්‍රික සමාජවාදී ජනරජය (সিংহলি)
  • இலங்கை சனநாயக சோசலிசக் குடியரசு (তামিল)
  • সিংহল:Śrī Laṅkā Prajātāntrika Samājavādī Janarajaya
    তামিল:Ilaṅkai Jaṉanāyaka Sōsalisak Kuṭiyarasu
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রনিশান
রাষ্ট্রনিশান
জাতীয় সঙ্গীত: শ্রীলঙ্কা মাতা
(বাংলা: “শ্রীলঙ্কা মা”)
শ্রীলঙ্কার অবস্থান
রাজধানীশ্রী জয়বর্ধনপুর কোট্টে (বিধানিক)[১]
কলম্বো (নির্বাহী ও বিচারিক)[২]
৬°৫৬′ উত্তর ৭৯°৫২′ পূর্ব / ৬.৯৩৩° উত্তর ৭৯.৮৬৭° পূর্ব / 6.933; 79.867
বৃহত্তম নগরীকলম্বো
সরকারি ভাষা
স্বীকৃত ভাষাইংরেজি
নৃগোষ্ঠী
(২০১২[৪])
৭৪.৯% সিংহল
১১.২% শ্রীলঙ্কান তামিল
৯.২% শ্রীলঙ্কান মূর
৪.২% ভারতীয় তামিল
০.৫% অন্যান্য (বার্ঘার, মালয়, বেদ্দ, চীনা, ভারতীয়-সহ)
ধর্ম
(২০১২)
৭০.২% বৌদ্ধধর্ম (রাষ্ট্রধর্ম)[৫][৬]
১২.৬% হিন্দুধর্ম
৯.৭% ইসলাম
৭.৪% খ্রিষ্টধর্ম
০.১% অন্যান্য
জাতীয়তাসূচক বিশেষণশ্রীলঙ্কান
সরকারএককেন্দ্রিক অর্ধ-রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রজাতন্ত্র
রনিল বিক্রমসিংহ[৭]
• আইনসভার সভাধ্যক্ষ
মহিন্দ যাপা অবেবর্ধন[৮]
• প্রধান বিচারপতি
জয়ন্ত জয়সূর্য
আইন-সভাআইনসভা
গঠন
• সিংহল রাজ্য স্থাপিত[৯]
৫৪৩ খ্রি.পূ.
• রজরট স্থাপিত[১০]
৪৩৭ খ্রি.পূ.
• ক্যান্ডীয় যুদ্ধ
১৭৯৬
• ক্যান্ডির চুক্তি স্বাক্ষরিত
১৮১৫
• স্বাধীনতা
৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮
২২ মে ১৯৭২
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
আয়তন
• মোট
৬৫,৬১০ কিমি (২৫,৩৩০ মা) (১২০তম)
• পানি (%)
৪.৪
জনসংখ্যা
• ২০২০ আনুমানিক
নিরপেক্ষ বৃদ্ধি ২২,১৫৬,০০০[১১] (৫৭তম)
• ২০১২ আদমশুমারি
২০,২৭৭,৫৯৭[১২]
• ঘনত্ব
৩৩৭.৭/কিমি (৮৭৪.৬/বর্গমাইল) (২৪শ)
জিডিপি (পিপিপি)২০২১ আনুমানিক
• মোট
বৃদ্ধি $৩০৬.৯৯৭ বিলিয়ন[১৩] (৫৬তম)
• মাথাপিছু
বৃদ্ধি $১৩,৯০৯[১৩] (৮৮তম)
জিডিপি (মনোনীত)২০২১ আনুমানিক
• মোট
বৃদ্ধি $৮৪.৫৩২ বিলিয়ন[১৩] (৬৪তম)
• মাথাপিছু
বৃদ্ধি $৩,৮৩০[১৩] (১১৩তম)
জিনি (২০১৬)৩৯.৮[১৪]
মাধ্যম
মানব উন্নয়ন সূচক (২০১৯)বৃদ্ধি ০.৭৮২[১৫]
উচ্চ · ৭২তম
মুদ্রাশ্রীলঙ্কান রুপি (Rs) (LKR)
সময় অঞ্চলইউটিসি+০৫:৩০ (শ্রীমাস)
তারিখ বিন্যাস
  • দদ-মম-সসসস
  • সসসস-মম-দদ
গাড়ী চালনার দিকবাঁদিক
কলিং কোড+৯৪
আইএসও ৩১৬৬ কোডLK
ইন্টারনেট টিএলডি
  • .lk
  • .ලංකා
  • .இலங்கை
ওয়েবসাইট
www.gov.lk

শ্রীলঙ্কার নথিভুক্ত ইতিহাস ৩,০০০ বছর পুরনো, যেখানে প্রাগৈতিহাসিক মানববসতির প্রমাণ রয়েছে যা কমপক্ষে ১২৫,০০০ বছর আগের।[১৬] দেশটির একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রাচীনতম পরিচিত বৌদ্ধ রচনাবলি, যা সম্মিলিতভাবে পালি ত্রিপিটক নামে পরিচিত, চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতির সময় রচিত, যা ২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘটিত হয়েছিল।[১৭][১৮] শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থান ও গভীর পোতাশ্রয় প্রাচীন রেশম পথ বাণিজ্য গমনপথের আদিকাল থেকে আজকের তথাকথিত সামুদ্রিক রেশম পথ পর্যন্ত এটিকে দারুণ কৌশলগত গুরুত্ব প্রদান করেছে।[১৯][২০][২১] এর অবস্থান এটিকে একটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করেছিল, যার ফলে এটি ইতোমধ্যেই সুদূর প্রাচ্যেদেশীয় ও ইউরোপীয়দের কাছে অনুরাধাপুর যুগ থেকেই পরিচিত ছিল। দেশটির বিলাসদ্রব্য ও মশলার ব্যবসা বহু দেশের ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করেছিল, যা শ্রীলঙ্কার বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যা তৈরিতে সাহায্য করেছিল। সিংহল কোট্টে রাজ্যে একটি বড় রাজনৈতিক সংকটের সময় পর্তুগিজরা শ্রীলঙ্কায় (মুখ্যত দুর্ঘটনাক্রমে) এসে পৌঁছয় এবং তারপর দ্বীপের সামুদ্রিক অঞ্চল ও এর লাভজনক বাহ্যিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। শ্রীলঙ্কার কিছু অংশ পর্তুগিজদের দখলে চলে যায়। সিংহল-পর্তুগিজ যুদ্ধের পর ওলন্দাজ ও ক্যান্ডি রাজ্য সেই অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ওলন্দাজ দখলিগুলো এরপর ব্রিটিশরা দখল করে নেয়, যারা পরবর্তীতে ১৮১৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত উপনিবেশায়নের মাধ্যমে পুরো দ্বীপের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করে। ২০শ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য একটি জাতীয় আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৪৮ সালে সিলন একটি অধিরাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৭২ সালে শ্রীলঙ্কা নামক প্রজাতন্ত্র অধিরাজ্যটিকে স্থলাভিষিক্ত করে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ইতিহাস একটি ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা ১৯৮৩ সালে শুরু হয়েছিল এবং ২০০৯ সালে চূড়ান্তভাবে শেষ হয়েছিল, যখন শ্রীলঙ্কা সশস্ত্র বাহিনীর কাছে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ঈলম পরাজিত হয়েছিল।[২২]

আজ শ্রীলঙ্কা একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র, বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতিসত্তার আবাসস্থল। সিংহল জাতি দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তামিল জাতি, যারা একটি বড় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, তারাও দ্বীপটির ইতিহাসে একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে। অন্যান্য দীর্ঘকালীন প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মূর, বার্ঘার, মালয়, চীনা এবং আদিবাসী বেদ্দ।[২৩]

শ্রীলঙ্কা চা, কফি, নারিকেল, রাবার উৎপাদন ও রফতানিতে বিখ্যাত। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংবলিত সমুদ্রসৈকত, ভূদৃশ্য তদুপরী সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শ্রীলঙ্কাকে সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

নামকরণ

প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা অনেক নামে পরিচিত হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রীক ভূগোলবিদগণ একে তপ্রোবান[২৪][২৫] এবং আরবরা সেরেনদীব নামে ডাকত। ১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজরা এই দ্বীপে পৌঁছে এর নাম দেয় শেইলাও যার ইংরেজি শব্দ হল সিলন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের অধীনে থাকা অবস্থায় তারা এই নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৪৮ সালে এই নামেই স্বাধীনতা পায় এবং পরে ১৯৭২ সালে দাপ্তরিক নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়,‌‍‌‍‌‌মুক্ত, সার্বভৌম ও স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ "শ্রী" ও "লংকা" থেকে। শ্রী শব্দের অর্থ পবিত্র এবং লংকা অর্থ দ্বীপ।[২৬][২৭]

ইতিহাস

প্রাগৈতিহাসিক

শ্রীলঙ্কার প্রাক-ইতিহাস ১,২৫,০০০ বছর এবং সম্ভবত ৫,০০,০০০ বছর আগের।[২৮] যুগটি পুরা প্রস্তর যুগ, মেসোলিথিক এবং প্রারম্ভিক লৌহ যুগে বিস্তৃত। শ্রীলঙ্কায় আবিষ্কৃত পুরা প্রস্তর যুগ মানব বসতিগুলির মধ্যে, পাহিয়াঙ্গালা (৩৭,০০০ পূর্বাব্দ), চীনা পর্যটক সন্ন্যাসী ফা-হিয়েনের নামে নামকরণ করা হয়েছে;[২৯] বাতাদমবেলেনা (২৮,৫০০ পূর্বাব্দ);[৩০] এবং বেলিলেনা (১২,০০০ পূর্বাব্দ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই গুহাগুলিতে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক মানুষের দেহাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন যাকে তারা বালাঙ্গোডা ম্যান নাম দিয়েছে, এবং অন্যান্য প্রমাণ [৩১] যে তারা কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকতে পারে এবং গাড়ি চালানোর জন্য গৃহপালিত কুকুর রেখেছিল।[৩২]

শ্রীলঙ্কার আদি বাসিন্দারা সম্ভবত বৈদিক জাতির পূর্বপুরুষ,[৩৩]আনুমানিক ২,৫০০ জন আদিবাসী আধুনিক শ্রীলঙ্কায় বসবাস করে।

প্রোটোহিস্টোরিক সময়কালে (১০০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শ্রীলঙ্কা সাংস্কৃতিকভাবে দক্ষিণ ভারতের সাথে একত্রিত হয়েছিল,[৩৪] এবং একই মেগালিথিক সমাধি, মৃৎপাত্র, লোহার প্রযুক্তি, চাষের কৌশল এবং মেগালিথিক গ্রাফিতি ভাগ করে নিয়েছে।[৩৫][৩৬] এই সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সটি প্রাকৃত ভাষাভাষীদের স্থানান্তরের আগে দক্ষিণ ভারত থেকে ভেলিরের মতো দ্রাবিড় গোষ্ঠীর সাথে ছড়িয়ে পড়ে।[৩৭][৩৮][৩৫]

দ্বীপের প্রথম লিখিত উল্লেখগুলির মধ্যে একটি ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণে পাওয়া যায়, যা লঙ্কা নামে একটি রাজ্যের বিবরণ প্রদান করে যা ঐশ্বরিক ভাস্কর বিশ্বকর্মা সম্পদের দেবতা কুবেরের জন্য তৈরি করেছিলেন।[৩৯] বলা হয় যে কুবের ছিলেন তার রাক্ষস সৎ ভাই রাবণ দ্বারা উৎখাত হয়েছিল।[৪০]

শ্রীলঙ্কান মুদ্রা, প্রথম শতাব্দী

শ্রীলঙ্কার ইতিহাস বৌদ্ধ সভ্যতার সাথে বেশ সম্পর্ক আছে। বৌদ্ধ ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে শ্রীলঙ্কার ইতিহাস পাওয়া যায়। দীপবংস, মহাবংসের তথ্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর ভারতীয় শাক্যজাতির বিজয়বাহু তার হাজার সৈন্য নিয়ে প্রথম এখানে এসেছিলেন। তারপর তারা শ্রীলঙ্কায় এসে বসতি স্থাপন করেন। বুদ্ধের জীবিত অবস্থায় বুদ্ধ শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য সাক্ষ্য দেয়।

প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সৈকত ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বণিকদের কাছে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য, বার্মা, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ এখানে ব্যবসা করত। ১৫০৫ সালে পর্তুগীজরা সর্বপ্রথম এখানে পৌঁছায়। ১৭শ শতাব্দীর দিকে ডাচরা আসে যদিও ১৭৯৬ সালে দ্বীপটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায়। ১৮১৫ সালে ক্যান্ডি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এলে সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয় উপনিবেশ এখানে চা, রাবার, চিনি, কফি এবং নীলের চাষ শুরু করে। তখন কলম্বোকে প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তারা আধুনিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, রাস্তাঘাট এবং চার্চ তথা পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ১৯৩০ সালের দিকে স্থানীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের নির্যাতন-অত্যাচারের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সিলন নামে দেশটি স্বাধীনতা পায়। ১৯৬০ সালের ২১শে জুলাই শ্রীমাভো বন্দেরনায়েক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি ছিলেন সারা পৃথিবীর প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭২ সালে শ্রীমাভো বন্দেরনায়েকের প্রধানমন্ত্রীত্বে সিলন থেকে শ্রীলঙ্কা নামকরণ করা হয়।

ভূগোল ও জলবায়ু

শ্রীলঙ্কা ইন্ডিয়ান প্লেটের উপর অবস্থিত যা পূর্বে ভারত-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের অংশ ছিল।[৪১] শ্রীলঙ্কা ভারতমহাসাগরের উপর, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। শ্রীলঙ্কাকে ভারতীয় উপমহাদেশের মূলভূমি অংশ থেকে পৃথক করা হয় মান্নার উপসাগরীয় অঞ্চল এবং পল স্ট্রেট দ্বারা। হিন্দু পৌরানিক কাহিনী অনুযায়ী রামের শাসন আমলে ভারতের মূল ভূমি থেকে রাম সেতু নামে একটি সংযোগ ছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশের বর্ণনাকারীদের মতে ১৪৮০ সালের ঝড়ে ধ্বংস হবার আগে ইহা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ছিল।[৪২] কেবল দক্ষিণ দিকের বেড়ে ওঠা পর্বতমালা ছাড়া দ্বীপটির বেশির ভাগ উপকূলীয় সমতল ভূমি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫২৪ মিটার(৮২৮০ ফিট) উঁচু পিদুরুতালাগালা শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ বিন্দু। শ্রীলঙ্কায় ১০৩ টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘতম নদীটির নাম হল মহাবলিগঙ্গা যা ৩৩৫ কিলোমিটার (২০৪ মাইল) বিস্তৃত।

শ্রীলঙ্কার গড় তাপমাত্রা ১৬সে. যা গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ ৩৩ সে.পর্যন্ত হতে পারে । দিন রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ৪ থেকে ৭ সে.। সাধারণত দক্ষিণাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় আর্দ্রতা সবচেয়ে বেশি থাকে, কলম্বোর মত জায়গায় সারা বছর প্রায় ৭০% আর্দ্রতা থাকে, জুন মাসের দিকে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে তা সর্বোচ্চ ৯০% পর্যন্ত হয়।[৪৩]

উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত

শ্রীলঙ্কা ইন্দোমালয়া ইকোজোনের মধ্যে থাকা বিশ্বের ২৫ টি জীববৈচিত্র্য হটস্পটগুলির মধ্যে একটি ।[৪৪] শ্রীলঙ্কায় এশিয়ার সর্বোচ্চ জীববৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায় যদিও দেশটি আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট।[৪৫] বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও প্রাণী উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যায় যেখানে ৩২১০ টি ফুলের উদ্ভিদের মধ্যে ২৭% উদ্ভিদ এবং ২২% স্তন্যপায়ী প্রাণী স্থানীয়।[৪৬] শ্রীলঙ্কা ২৪ টি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগার ঘোষণা করেছে যাদের মধ্যে রয়েছে এশিয়ান হাতি, চিতাবাঘ, শ্লথ ভালুক, অনন্য ছোট লরিস, বিভিন্ন ধরনের হরিণ, বিপন্ন বন্য শূকর, পোর্কিউপাইনস এবং ভারতীয় বনরুই[৪৭]

অনুর্বর জাফনা উপদ্বীপে প্রচুর পরিমাণে বাবলা জন্মায়। শুষ্ক ভুমির গাছগুলির মধ্যে সাটিনউড, আবলুস, মেহগনি এবং সেগুন অত্যন্ত মূল্যবান প্রজাতি। আর্দ্র অঞ্চলটি একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিরহরিৎ বন যেখানে লম্বা গাছ, প্রশস্ত বৃক্ষপত্রাবলী, আঙ্গুর ও শাক লতাগুল্মের ঘন জঙ্গল দেখা যায়।

সরকার

শ্রীলঙ্কার সুপ্রীম কোর্ট, কলম্বো।

শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী দেশটি গণতান্ত্রিক, সামজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হবে, দেশটিকে একেশ্বরবাদী রাষ্ট্রও বলা হয়েছে। সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সংসদীয়রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার সমন্বয়ে। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক বাহিনীর প্রধান প্রশাসক ও সরকার প্রধান এবং তিনি নির্বাচিত হন ছয় বছরের জন্য। রাষ্ট্রপতি দেশের সংসদ এবং ২২৫ সদস্যের আইন প্রণয়নকারী পরিষদের কাজে দায়বদ্ধ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে একজনকে মন্ত্রী সভার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির ডেপুটি হিসেবে কাজ করেন এবং সংসদের সরকারি দলের নেতৃত্ব দেন। প্রতিটি জেলা হতে সংসদ সদস্যরা সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি সংসদের একবছর কার্যক্রম অতিবাহিত হবার পর সংসদ স্থগিত অথবা সমাপ্তি ঘোষণা করতে পারেন। সংসদ সকল প্রকার আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখে। শ্রীমাভো বন্দেরনায়েক শ্রীলঙ্কার নির্বাচিত প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তার সুযোগ্যকন্যা চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হবার আগে ১৯৯৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। মৈত্রীপাল সিরিসেনরানিল বিক্রমাসিংহে ৯ জানুয়ারি, ২০১৫ তারিখে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

অর্থনীতি

চিনামন, রাবার, সিলন চা রপ্তানির জন্য শ্রীলঙ্কা বিখ্যাত। ইংরেজ শাসনের সময় স্থাপিত আধুনিক সমুদ্রবন্দর এই দ্বীপ দেশটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে।[৪৮] শ্রীলঙ্কার আবাদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেশের দারিদ্র্যতা ও অর্থনৈতিক অসমতাকে বৃদ্ধি করছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিকতা সরকারের অর্থনীতিকে মারাত্মক প্রভাবিত করেছে। সে সময় উপনিবেশিক চাষাবাদ ভেঙ্গে পৃথক করা হয়েছে এবং শিল্প কলকারখানাকে জাতীয়করণ করা হয়। যখন জীবনযাত্রার মান ও সাক্ষরতার হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে তখন নিম্ম উৎপাদন হার ও কম বৈদেশিক বিনিয়োগের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ব্যাহত হয়েছে। ১৯৭৭ সালের পর শ্রীলঙ্কার সরকার বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করেছে। যেহেতু চা, কফি, চিনি, রাবার এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি সমহারে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাই সরকারীভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরন, বস্ত্রশিল্প, টেলিযোগাযোগ এবং শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে কৃষিজাত পন্যের রিপ্তানি কমে দাড়ায় ২০% (যেখানে ১৯৭০ সালে ছিল ৯৩%) অপরদিকে বস্ত্র ও গার্মেন্টস ক্ষেত্রে বেড়ে দাড়ায় ৬৩%। ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে জিডিপি ছিল ৫.৫% যা ১৯৯৭-২০০০সালে দাড়ায় ৫.৩%। ২০০৩ সালে কলম্বো স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করায় এবং দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ হল শ্রীলঙ্কা।

রাজনীতি

শ্রীলঙ্কার রাজনীতি একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রপতি হলেন একাধারে রাষ্ট্রের প্রধান ও সরকার প্রধান। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের উপর ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার এবং আইনসভা উভয়ের উপর ন্যস্ত।শ্রীলঙ্কার রাজনীতি প্রধানত সাবেক রাষ্ট্রপতি মহিন্দ রাজাপক্ষের বামপন্থী শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমসিংহের ডানপন্থী ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাছাড়াও কিছু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, সমাজতান্ত্রিক এবং তামিল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল আছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

শ্রীলঙ্কা যদিও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তেমন তৎপর নয় । এই দেশের পাসপোর্টে ১৬টি দেশে বিনা ভিসায় ভ্রমণ করা যায়, যা পাসপোর্ট শক্তি সূচকে ৮৪তম স্থানে রয়েছে।[৪৯] এদেশ বহুদেশীয় সংস্থা যেমন জাতিসংঘের সাথে যুক্ত। নিজের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং উন্নয়ন বেগবান করাই এসকল সংস্থায় যোগদানের মুল উদ্দ্যেশ্য। তাছাড়াও কমনওয়েলথ,সার্ক, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিল, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক এবং কলম্বো পরিকল্পনার সদস্য দেশ।

সামরিক বাহিনী

প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের অন্তর্গত শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনী, শ্রীলঙ্কা নৌবাহিনী এবং শ্রীলঙ্কা বিমানবাহিনী এই তিন শক্তির সমন্বয়ে গঠিত। এখন পর্যন্ত দেশটিতে কখনই সামরিক শাসন জারি হয়নি যদিও স্বেচ্ছায় যোগদান করা ২৩০,০০০ জন সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে। সামরিক বাহিনীকে সহয়তা করার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরো দুটি আধাসামরিক বাহিনী আছে: স্পেশাল টাস্ক ফোর্স ও সিভিল ডিফেন্স ফোর্স।২০০৯ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত কোন কোস্ট গার্ড বাহিনী ছিল না, শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী তাদের কাজ করত। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পর থেকেই সামরিক বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বজায় রাখা। যার বেশির ভাগটা জুড়ে আছে এলটিটিইএর সাথে দীর্ঘ ৩০ বছরের যুদ্ধ। ২০০৯ সালের ১৮ মে এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের মৃত্যুর মাধ্যমে এই যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে বলে সামরিক বাহিনী দাবী করে আসছে।

জনউপাত্ত

ধর্ম

শ্রীলঙ্কায় ধর্ম (২০১২ শুমারি)[৫০][৫১]

  বৌদ্ধধর্ম (৭০.২%)
  ইসলাম (৯.৭%)
  অন্যান্য (০.০৫%)

বৌদ্ধধর্ম শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম ধর্ম এবং দেশটির সংবিধানের ২য় অধ্যায়ের ৯ম অনুচ্ছেদ মোতাবেক এটি শ্রীলঙ্কার “রাষ্ট্রধর্ম”, যাতে বলা আছে, “শ্রীলঙ্কা প্রজাতন্ত্র বৌদ্ধধর্মকে সর্বাগ্রে স্থান দেবে এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রের কর্তব্য হবে বুদ্ধশাসনকে রক্ষা ও লালন করা।”[৫২][৫৩] শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার ৭০.২% বৌদ্ধধর্ম চর্চা করেন যাদের অধিকাংশই প্রধানত থেরবাদ চিন্তাধারার অনুসারী।[৫৪] বেশিরভাগ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সিংহল জাতিগোষ্ঠীর, তবে সংখ্যালঘু তামিলরাও রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে মহেন্দ্র মৌর্য কর্তৃক বৌদ্ধধর্ম শ্রীলঙ্কায় প্রবর্তিত হয়েছিল।[৫৪] ওই একই সময় বোধিবৃক্ষের একটি চারা, যার নিচে বসে বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন, শ্রীলঙ্কায় আনা হয়েছিল। পূর্বে একটি মৌখিক ঐতিহ্য হিসাবে সংরক্ষিত থাকা পালি ত্রিপিটক ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শ্রীলঙ্কায় প্রথম লিপিবদ্ধ হয়েছিল।[৫৫] বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কাতেই বৌদ্ধধর্মের দীর্ঘতম নিরবিচ্ছিন্ন ইতিহাস রয়েছে।[৫৪] হ্রাসপ্রাপ্তির যুগগুলোতে থাইল্যান্ডবর্মার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কান ভিক্ষুত্ববাদী সিলসিলা পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল।[৫৫]

এটির পূর্ববর্তী হওয়া সত্ত্বেও অনুসারীর দিক থেকে হিন্দুধর্ম বর্তমানে বৌদ্ধধর্মের পরবর্তী স্থানে রয়েছে।[৫৬] খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের আগমনের আগে শ্রীলঙ্কায় হিন্দুধর্ম ছিল প্রধান ধর্ম। রাজা দেবনম্পিয়া তিসার রাজত্বকালে সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন করেন;[৫৭] সিংহলরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে কিন্তু তামিলরা হিন্দুই রয়ে যায়। তবে এটি ছিল পক প্রণালী জুড়ে কার্যকলাপ যা সত্যিকার অর্থেই শ্রীলঙ্কায় হিন্দুধর্মের টিকে থাকার দৃশ্য তৈরি করেছিল। শৈবধর্ম (ভগবান শিবের ভক্তিমূলক উপাসনা) ছিল তামিল জনগণের দ্বারা চর্চিত প্রভাবশালী শাখা, ফলে শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী হিন্দু মন্দির স্থাপত্য ও দর্শন হিন্দুধর্মের এই বিশেষ ধারা থেকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছিল। তিরুজ্ঞানসম্বন্তর তাঁর রচনায় শ্রীলঙ্কার কয়েকটি হিন্দু মন্দিরের নাম উল্লেখ করেছেন।[৫৮]

ইসলাম দেশটির তৃতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ধর্ম, যেটি ৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি বা শেষদিক থেকে শুরু করে বহু শতাব্দী ধরে আরব ব্যবসায়ীরা প্রথম দ্বীপে নিয়ে আসে। দ্বীপের অধিকাংশ অনুগামীরা আজ সুন্নি যারা শাফিঈ মজহাবের অনুসরণ করে[৫৯] এবং ধারণা করা হয় যে তারা আরব ব্যবসায়ী ও স্থানীয় নারী, যাদেরকে তারা বিয়ে করেছিল, তাদের বংশধর।[৬০]

খ্রিস্টধর্ম অন্তত পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকে (এবং সম্ভবত প্রথম দিকে) দেশে পৌঁছেছিল,[৬১] যেটি ১৬শ শতাব্দীর শুরুর দিকে আগত পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের মাধ্যমে আরও বিস্তৃত প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।[৬২] শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার প্রায় ৭.৪% খ্রিস্টান, যাদের মধ্যে ৮২% রোমান ক্যাথলিক যারা তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য সরাসরি পর্তুগিজদের কাছ থেকে পেয়েছিল বলে দাবি করে। তামিল ক্যাথলিকরা তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে সাধু ফ্রান্সিস জ্যাভিয়ারের পাশাপাশি পর্তুগিজ মিশনারিদের দায়ী করে। অবশিষ্ট খ্রিস্টানরা সিলনের অ্যাংলিকান চার্চ ও অন্যান্য প্রোটেস্ট্যান্ট উপদলের মধ্যে সমভাবে বিভক্ত।[৬৩]

এছাড়াও ভারত থেকে আসা জরথুস্ত্রবাদী (পারসি) অভিবাসীদের একটি ছোট জনসংখ্যা রয়েছে যারা ব্রিটিশ শাসনামলে সিলনে বসতি স্থাপন করেছিল।[৬৪] এই সম্প্রদায়টি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে।[৬৫]

শ্রীলঙ্কানদের জীবন ও সংস্কৃতিতে ধর্ম একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা প্রতি মাসে চান্দ্র দিনপঞ্জি অনুসারে পোয়া দিবস পালন করে এবং হিন্দু ও মুসলমানরাও তাদের নিজস্ব ছুটি পালন করে। ২০০৮ সালের একটি গ্যালাপ পোলে শ্রীলঙ্কা বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক ধার্মিক দেশ হিসেবে স্থান পায়, যেখানে শ্রীলঙ্কার ৯৯% লোক বলে যে ধর্ম তাদের রোজকার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।[৬৬]

শিক্ষা ব্যবস্থা

উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সর্বোচ্চ সাক্ষর জনসংখ্যার একটি দেশ, যার সাক্ষরতার হার ৯২% এবং ৮৩% মানুষ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত। শিশুদের ৯ বছর মেয়াদী বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. সি. ডব্লিউ. ডব্লিউ কান্নানগারা কর্তৃক ১৯৪৫ সালে প্রণীত অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এ দেশের সাক্ষরতায় বিরাট অবদান রাখে। তিনি শ্রীলঙ্কার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে একটি করে মাধ্যমিক মহা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯৪২ সালে বিশেষ শিক্ষা কমিটি একটি যোগ্য ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রস্তাব করে। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে গ্রেড ১ থেকে ১৩ পর্যন্ত পাঠদান ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ও’লেভেল এবং এ’লেভেল পরীক্ষা যথাক্রমে ১১ এবং ১৩ গ্রেডে অনুষ্ঠিত হয়। বেশির ভাগ বিদ্যালয় ব্রিটিশ বিদ্যালয়ের ধাঁচে গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক মানের বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১৬টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে কলোম্ব বিশ্ববিদ্যালয়, পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জয়াবর্ধনপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, জাফনা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।

শ্রীলঙ্কা ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

শ্রীলঙ্কায় পরিবহন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত GM EMD G12 - ALBERTA লোকোমোটিভ

শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ শহরের মধ্যেই রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে জাতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। ১৯৮৭ সালের ২৬শে এপ্রিল প্রথম রেলওয়ে লাইন স্থাপিত হয়েছিল কলম্বোক্যান্ডির মধ্যে। শ্রীলঙ্কার মোট সড়কের পরিমাণ ১১,০০০কিমি (৬,৮৪০মাইল) যার বেশির ভাগই পাকা সড়ক। জাতীয় অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে সরকার অনেক রাজপথ নির্মাণ করার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। তার মধ্যে কলম্বো-কতোনায়েক, কলম্বো-ক্যান্ডি, কলম্বো-পেডিনা এবং অন্যান্য শহরের মধ্যবর্তী সংযোগ সড়ক কলম্বোর যানজট কমানোর জন্য। ভারতের চেন্নাই ও জাফনার মধ্যবর্তী সংযোজ সেতু করার পরিকল্পনা সরকারের আছে। শ্রীলঙ্কার ৪৩০ কিমি অন্তবর্তী জল যোগাযোগ রয়েছে। শ্রীলঙ্কার ১২টি পাকা বিমান বন্দর এবং দুইটি সাধারণ বিমান উড্ডয়ন ও অবতরন কেন্দ্র রয়েছে। দেশটি তার গভীর সমুন্দ্রবন্দরের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত তার মধ্যে কলম্বো, ত্রিকামেলি ও গালে অন্যতম।

ভাষা

সিংহলি এবং তামিল শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় ভাষা। শতকরা ১০ ভাগ লোক ইংরেজিতে সার্বক্ষণিক কথা বলে এবং শিক্ষা, গবেষণা ও ব্যবসায়িক কাজে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অনেক বেশি। বার্ঘার সম্প্রদায়ের লোকজন পর্তুগিজ ও ডাচ ভাষা ভিন্ন উচ্চারণে বলে থাকে। অন্যদিকে মালয় সম্প্রদায়ের লোকজন মালয়ের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে থাকে। শ্রীলঙ্কার ৭০% মানুষ বৌদ্ধ, ১৫% হিন্দু ও ৭.৫% ইসলাম ধর্মাবলম্বী।

গণমাধ্যম

জাতীয় বেতার কেন্দ্র, সিলন বেতার এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন বেতার কেন্দ্র। ১৯২৩ সালে এডওয়ার্ড হার্পার কর্তৃক এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। শ্রীলঙ্কা ব্রড কাস্টিং কর্পোরেশনের অধীনে এই কেন্দ্র হতে সিংহলী, তামিল, ইংরেজি ও হিন্দী ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে অনেক বেসরকারি বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা বাণিজ্যিক জনপ্রিয়তা ও সাফল্য পায়। ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন নেটওয়ার্ক নামে ১৯৭৯ সালে সর্বপ্রথম টেলিভিশন সম্প্রসারণ শুরু হয়। ১৯৯২ সালে বেসরকারী টেলিভিশন সংস্থা চালুর আগে টেলিভিশন সম্প্রচার সম্পূর্ণ সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল। বহুল প্রচলিত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার মধ্যে ডেইলি মিরর, দ্যা সানডে অবজার্ভার এবং দ্যা সানডে টাইমস উল্লেখযোগ্য।

খেলাধুলা

এসসিসি মাঠে শ্রীলঙ্কা এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট ম্যাচ, র্মাচ ২০০১।

যদিও শ্রীলঙ্কার জাতীয় খেলা ভলিবল তবুও ক্রিকেট এখানে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়।[৬৭] অন্যান্য খেলার মধ্যে রাগবি, ফুটবল, আথলেটিক্স, টেনিস ও নানা রকম জলক্রীড়া প্রচলিত। ক্রিকেটে ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল অনেক উল্লেখযোগ্য জয় পেয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ১৯৯৬ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ,[৬৮] ১৯৯৬ ও ২০০৪ ও ২০২২ এশিয়া কাপ জয়ী এবং ২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের এবং ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপ রানার্স আপ

[৬৯][৭০]। শ্রীলঙ্কার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বিভিন্ন খেলার আয়জন করা হয়। এখানে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের খেলার মাঠ রয়েছে। শ্রীলঙ্কা ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানভারতের সাথে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়জক ছিল এবং তারা ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়জক দেশ।

আরো দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

  1. সরকারী ওয়েব
  2. শ্রীলঙ্কা:ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে
  3. শ্রীলঙ্কা: Open Directory Project ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৯ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে
  4. উইকিমিডিয়া অ্যাটলাসে শ্রীলঙ্কা
  5. ভ্রমণ গাইড
🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ