নার্ভ এজেন্ট

ক্ষতিকর নার্ভ গ্যাস

নার্ভ এজেন্ট (কখনও কখনও নার্ভ গ্যাস নামেও পরিচিত) হচ্ছে এক শ্রেণীর জৈব রাসায়নিক যা মস্তিষ্ক থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে স্নায়ুর দ্বারা সংকেত পাঠানোর প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এটি কাজ করে এসিটাইলকোলিনস্টেরেস নামের একটি এনজাইমকে বাধাদানের মাধ্যমে, যা এসিটাইলকোলিন নামক নিউট্রোটান্সমিটারে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে।

নার্ভ এজেন্টের বিষক্রিয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোখের তারার সংকোচন, অত্যধিক লালা তৈরি, খিঁচুনি এবং অনিচ্ছাকৃত মলমূত্রত্যাগ এ ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। শ্বাসযন্ত্র এবং অন্যান্য পেশীগুলির উপর শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যে শ্বাসকষ্ট বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণে মৃত্যুও হতে পারে। কিছু নার্ভ এজেন্ট সহজেই বাষ্পীভূত বা অ্যারোসলে পরিণত হয় এবং এদের শরীরে প্রবেশের প্রাথমিক রাস্তা হচ্ছে শ্বসনতন্ত্র। কিছু নার্ভ এজেন্ট ত্বকের মাধ্যমেও শোষিত হতে পারে, যার ফলে এই ধরনের এজেন্টের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শ্বসনযন্ত্রের পাশাপাশি পুরো শরীরের স্যুট পরিধান করা প্রয়োজন।

নার্ভ এজেন্ট সাধারণত অম্বর বর্ণের বা বর্ণহীন, স্বাদহীন তরল যা গ্যাসে পরিণত হতে পারে। সারিন এবং ভিএক্স (নার্ভ এজেন্ট) গন্ধহীন, টাবুনের কিছুটা ফলের মত গন্ধ এবং সোমানের সামান্য ক্যাম্ফরের মত গন্ধ আছে। [১]

জৈবিক প্রভাব

নার্ভ এজেন্ট স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এ ধরনের সমস্ত এজেন্ট একই ভাবে কাজ করে। এরা এসিটাইলকোলিনস্টেরেস এনজাইমকে বাধাপ্রদান করে কোলিনারজিক সঙ্কট তৈরি করে, যা পেশীর সংকোচন নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুর সিন্যাপসিসের মধ্যে এসিটাইলকোলিন এর ভাঙ্গনের জন্য দায়ী। এসিটাইলকোলিন এজেন্টটি না ভাঙলে, পেশীগুলি শিথিল হতে পারে না এবং কার্যকরভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। [২] :১৩১–১৩৯ এর মধ্যে হৃদপেশী এবং শ্বাসের জন্য ব্যবহৃত পেশীও অন্তর্ভুক্ত। এই কারণে, বিষক্রিয়ার প্রথম লক্ষণ সাধারণত কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখা দেয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে শ্বাসকষ্ট বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটতে পারে। [১]

নার্ভ এজেন্টের সংস্পর্শে আসার প্রাথমিক লক্ষণগুলো হচ্ছে নাক দিয়ে পানি পড়া, বুক ভারী হয়ে আসা এবং চোখের তারার সংকোচন। এরপর দ্রুতই আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট, বমিভাব ও মুখ থেকে লালা ঝড়তে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর সাথে সাথে অনৈচ্ছিক লালা ঝরা, অশ্রু ঝরা, মূত্রত্যাগ, মলত্যাগ, পরিপাক তন্ত্রের যন্ত্রণা ও বমি হতে থাকে। চোখ ও/বা ফুস্ফুসে ফোস্কা এবং জ্বালা হতে পারে।[৩][৪] এই পর্যায়ের পরে মায়োক্লনিক জার্ক (মাংসপেশির ঝাঁকুনি) ও তারপর স্ট্যাটাস এপিলেপ্টিকাস-সদৃশ মৃগী খিঁচুনি হতে পারে। এরপর শ্বসনতন্ত্রের সম্পূর্ণ অবনতির ফলে মৃত্যু ঘটে, যা খুব সম্ভবত মধ্যচ্ছদার নিউরোমাস্কুলার জাংশনে অতিরিক্ত প্রান্তীয় কার্যক্রমের ফলে হয়। [২]:১৪৭–১৪৯

নার্ভ এজেন্টের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এর নিরবচ্ছিন্ন সংস্পর্শের ফলে বাড়তে থাকে। নার্ভ এজেন্টের থেকে বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের প্রায় সবাই দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক ত্রুটি ও সংশ্লিষ্ট মানসিক প্রভাব ভোগ করেন। [৫] আক্রান্ত হবার অন্তত ২-৩ বছর পর্যন্ত টিকে থাকা লক্ষণগুলোর মধ্যে ঝাপসা দৃষ্টি, ক্লান্তভাব, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, কর্কশ স্বর, বুক ধড়ফড় করা, নিদ্রাহীনতা, কাঁধের জড়তা ও চোখের ক্লান্তি অন্তর্ভুক্ত। নার্ভ এজেন্ট দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সিরাম ও লোহিত রক্তকণিকার এসিটাইলকোলিনেসটিরেসের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকে এবং অন্যান্য সমস্যা যত খারাপ হয় এর পরিমাণ ততই কম থাকে। [৬][৭]

ক্রিয়া কৌশল

একটি স্বাভাবিকভাবে ক্রিয়াশীল মোটর স্নায়ু উদ্দীপিত হলে, এটি অ্যাসিটাইলকোলিন নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণ করে, যা একটি পেশী বা অঙ্গে এই উদ্দীপনাকে প্রেরণ করে। উদ্দীপনাটি প্রেরিত হবার পর অ্যাসিটাইলকোলিনেস্টিয়ারেজ এনজাইম পেশী বা অঙ্গকে শিথিল করার উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ অ্যাসিটাইলকোলিনকে ভেঙ্গে ফেলে।

নার্ভ এজেন্ট অ্যাসিটাইলকোলিনেস্টিয়ারেজ এনজাইমের কার্যক্রমকে ব্যাহত করে স্নায়ুতন্ত্রের বিঘ্ন ঘটায়। এটি এই এনজাইমের সক্রিয় প্রান্তে একটি সমযোজী বন্ধন তৈরি করে যেখানে সাধারণত অ্যাসিটাইলকোলিন ভেঙ্গে যায় (জলযোজন ঘটে)। এর ফলে অ্যাসিটাইলকোলিন জমা হতে থাকে এবং তার কাজ চালিয়ে যায় যার ফলে স্নায়ুর উদ্দীপনা ক্রমাগত সঞ্চালিত হতে থাকে এবং পেশীর সংকোচন বন্ধ হয় না। এই একই ঘটনা গ্রন্থি এবং অঙ্গ পর্যায়েও ঘটে থাকে, ফলে অনিয়ন্ত্রিত ঝিমানি, চোখ থেকে পানি ঝরা (ল্যাক্রিমেশন) এবং নাক থেকে অতিরিক্ত মিউকাস ঝরতে থাকে (রাইনোরিয়া)।

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নার্ভ এজেন্ট যেমন সোমান, সারিন, টাবুন ও ভিএক্স এর সাথে অ্যাসিটাইলকোলিনেস্টিয়ারেজ এর বিক্রিয়ার উৎপাদ ১৯৯০ সালে ইউ.এস সেনাবাহিনী এক্স-রে স্ফটিকবিদ্যা ব্যবহার করে শনাক্ত করে। [৮][৯] পরবর্তীতে বিক্রিয়ার উৎপাদগুলোকে অ্যাসিটাইলকোলিনেস্টিয়ারেজ এর বিভিন্ন উৎস এবং ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত উৎসেচক বিউটাইরাইলকোলিনেস্টিয়ারেজ ব্যবহার করে নিশ্চিত করা হয়েছে। এক্স-রে গঠনগুলো পারমাণবিক পর্যায়ে বিক্রিয়া কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো স্পষ্ট করে (বি.দ্র. স্টেরিওকেমিক্যাল উত্ক্রমণ) এবং প্রতিষেধক তৈরিতে একটি মূল হাতিয়ার উন্মোচন করে।

প্রতিষেধক

অ্যাট্রোপিন এবং সংশ্লিষ্ট অ্যান্টিকোলিনারজিক ওষুধ নার্ভ এজেন্ট বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে কারণ এরা অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টরসমূহকে বাধা দেয়, তবে এরা নিজেরাই বিষাক্ত। [১০] কিছু সংশ্লেষিত অ্যান্টিকোলিনারজিক যেমন বাইপেরিডেন[১১] অ্যাট্রোপিনের চেয়ে ভালভাবে নার্ভ এজেন্ট বিষক্রিয়ার মূল লক্ষণগুলো প্রশমিত করতে পারে, কারণ এরা অ্যাট্রোপিনের চেয়ে ভালোভাবে ব্লাড–ব্রেন ব্যারিয়ার অতিক্রম করে। [১২] এই ওষুধগুলো নার্ভ এজেন্ট আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন রক্ষা করতে পারলেও, সংস্পর্শের মাত্রার উপর নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তি অল্প কিংবা অধিক সময়ের জন্য অক্ষম হয়ে পড়তে পারেন। অ্যাট্রোপিনের প্রয়োগের শেষ ধাপ হচ্ছে শ্বাসনালীর নিঃসরণ পরিষ্কার করা। চাপমূলক অবস্থায় প্রয়োগের সুবিধার্থে, সামরিক সদস্যরা রণক্ষেত্রে অটোইনজেক্টরে ভরে অ্যাট্রোপিন ব্যবহার করেন (যেমন এটিএনএএ)। [১০] প্রালিডক্সিম ক্লোরাইড ও প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা ২-পিএএম নামেও পরিচিত। [১০] অ্যাট্রোপিনের মত স্নায়ুতন্ত্রের উপর নার্ভ এজেন্টের প্রাথমিক প্রভাবগুলোকে প্রশমিত করার বদলে, প্রালিডক্সিম ক্লোরাইড উৎসেচকের হাইদ্রক্সিল কার্যকরী মূলকের সাথে যুক্ত ফসফোরাইল মূলককে পরিষ্কার করে বিষগ্রস্ত উৎসেচককে (অ্যাসিটাইলকোলিনস্টিয়ারেজ) পুনরায় সক্রিয় করে। [১৩] অ্যাট্রোপিনের থেকে নিরাপদ হলেও এটি কাজ করতে বেশি সময় নেয়। [১০] প্রালিডক্সিম ক্লোরাইডের সাহায্যে অ্যাসিটাইলকোলিনস্টিয়ারেজের পুনরূজ্জীবন প্রক্রিয়া নিকোটিনিক রিসেপ্টরে বেশি কার্যকরীভাবে কাজ করে যেখানে অ্যাট্রোপিনের সাহায্যে অ্যাসিটাইলকোলিনের বাধাদান মাস্কারিনিক রিসেপ্টরে অধিক কার্যকরী। গুরুতর বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রায়শই দুটি ওষুধই ব্যবহৃত হয়।

আক্রমণ প্রতিরোধকারী ব্যবস্থা

বিউটাইরাইলকোলিনস্টিয়ারেজ যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীনে জৈবফসফেট নার্ভ এজেন্টের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধী ব্যবস্থা হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। নার্ভ এজেন্ট স্নায়ুতন্ত্রে এর প্রভাব বিস্তার করার আগেই এটি রক্তপ্রবাহে এটিকে বদ্ধ করে ফেলে। [১৪]

বিশুদ্ধ অ্যাসিটাইলকোলিনেস্টিয়ারেজ ও বিউটাইরাইলকোলিনস্টিয়ারেজ উভয়ই প্রাণীদের উপর পরীক্ষায় "জৈব পরিষ্কারক" হিসেবে জৈবফসফেট নার্ভ এজেন্টের পুরো শ্রেণিটির বিরুদ্ধেই স্টকিওমেট্রিক সুরক্ষা প্রদানে সফলতা দেখিয়েছে। [১৫][১৬] বর্তমানে বিউটাইরাইলকোলিনস্টিয়ারেজ উৎসেচকটি ফার্মাসিউটিক্যাল ঔষধ হিসেবে প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয় কারণ এ প্রোটিনটি (উচ্চতর ফার্মাকোকাইনেটিক্স) প্রাকৃতিকভাবেই মানবদেহের রক্তরসে পরিভ্রমণ করে। এছাড়াও এর সক্রিয় স্থলের আকার অ্যাসিটাইলকোলিনস্টিয়ারেজের তুলনায় বড় হওয়ায় নার্ভ এজেন্ট পরিষ্কারক হিসেবে বিউটাইরাইলকোলিনস্টিয়ারেজের নকশা ও উন্নয়নের জন্য ভবিষ্যতে অধিক স্থিতিস্থাপকতা প্রদান করতে পারে। [১৭]

শ্রেণি বিন্যাস

নার্ভ এজেন্ট দুটি প্রধান শ্রেণী রয়েছে। দুই শ্রেণীর মধ্যে যে সব এজেন্টের বৈশিষ্ট্য একই রকম, তাদের একটি সাধারণ নাম (যেমন, সারিন ) এবং দুটি ন্যাটোর শনাক্তকারী অক্ষর (যেমন, GB) দেওয়া হয়।

জি-সিরিজ

সর্বপ্রথম সংশ্লেষিত নার্ভ এজেন্ট টাবুনের রাসায়নিক গঠন।
জি-সিরিজের নার্ভ এজেন্ট [১৮]

জি-সিরিজ এর নামকরণ করা হয় কারণ জার্মান বিজ্ঞানীরা প্রথম এদের সংশ্লেষণ করেন। জি-সিরিজ এজেন্টসমূহ অস্থায়ী হিসেবে পরিচিত যেখানে ভি সিরিজ এজেন্টগুলো স্থায়ী হয়। এই শ্রেণীর সব এজেন্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অথবা তার পূর্বে আবিষ্কৃত ও সংশ্লেষিত হয়, যার নেতৃত্ব দেন জেহার্ড শ্রাডার (আইজি ফারবেন এর অধীনে)।

এই শ্রেণিটি নার্ভ এজেন্টের মধ্যে প্রথম ও প্রাচীনতম। সর্বপ্রথম সংশ্লেষিত নার্ভ এজেন্ট হচ্ছে ১৯৩৬ সালের GA (টাবুন)। এরপর ১৯৩৯ সালে GB (সারিন), ১৯৪৪ সালে GD (সোমান), এবং সবশেষে ১৯৪৯ সালে অধিক দুর্বোধ্য GF (সাইক্লোসারিন) আবিষ্কৃত হয়। GB হচ্ছে একমাত্র জি এজেন্ট যা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ত্র হিসেবে রকেট, বিমান বোমা ও কামানের কার্তুজে ব্যবহৃত হয়েছে। [১৯]

ভি-সিরিজ

ভিএক্স নার্ভ এজেন্টের রাসায়নিক গঠন।
ভি-সিরিজের নার্ভ এজেন্টসমূহ

ভি-সিরিজ হচ্ছে নার্ভ এজেন্টের দ্বিতীয় গোত্র। এতে পাঁচটি সুপরিচিত সদস্য রয়েছে যথা: ভিই, ভিজি, ভিএম, ভিআর ও ভিএক্স, এছাড়াও আরও কয়েকটি অখ্যাত উদাহরণ রয়েছে। [২০]

এই গোত্রের সর্বাধিক চর্চিত এজেন্ট, ভিএক্স ১৯৫০ এর দশকে যুক্তরাজ্যের পোর্টোন ডাউনে আবিষ্কৃত হয়। ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (আইসিআই) এর উদ্ভিদ সুরক্ষা পরীক্ষাগারে রনজিত ঘোষ নামের একজন রসায়নবিদ এক শ্রেণীর জৈবফসফেট যৌগের উপর গবেষণা করছিলেন (প্রতিস্থাপিত অ্যামিনোইথেনইথিওল এর জৈবফসফেট এস্টার)। শ্রাডারের মতই ঘোষ দেখতে পান যে এগুলো বেশ কার্যকরী কীটনাশক। ১৯৫৪ সালে আইসিআই এগুলোকে অ্যামিটন বাণিজ্যিক নাম ব্যবহার করে বাজারজাত করতে শুরু করে। তবে এটি নিরাপদ ব্যবহারের জন্য অন্ত্যন্ত বিষাক্ত হওয়ায়, পর্যায়ক্রমে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়। এই বিষক্রিয়া লক্ষ্য করে এর আরও কয়েকটি উপাদানের নমুনা পোর্টোন ডাউনে ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সেস গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। পরীক্ষা শেষে এই শ্রেণীর কয়েকটি যৌগ একটি নতুন গোত্রের নার্ভ এজেন্টে পরিণত হয় যা ভি এজেন্ট নামে পরিচিত( উৎসের উপর নির্ভর করে "ভি" অক্ষরটি ভিক্টরি, ভেনোমাস বা ভিসকাস থেকে এসেছে)। এদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত সম্ভবত ভিএক্স, ও এর পরেই ভিআর ("রাশিয়ান ভি-গ্যাস") এর অবস্থান (ভিজি হিসেবে অ্যামিটন বিস্মৃত হয়ে গিয়েছে)। সকল ভি-এজেন্ট স্থায়ী হয় অর্থাৎ এই এজেন্টগুলো সহজে ক্ষয় বা ধুয়ে যায় না এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাপড় বা অন্য কোথাও লেগে থাকতে পারে। এ কারণে শত্রুপক্ষের স্থল বাহিনীর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ বা সংকীর্ণ করে রাখতে, ভূখণ্ডে এগুলো ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই এজেন্টগুলোর ঘনত্ব তেলের মত; যার ফলে ভি-এজেন্টের সংস্পর্শের ঝুঁকি প্রাথমিকভাবে ত্বকের সাথে সম্পর্কিত তবে কেবলমাত্র এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভি-সিরিজ এজেন্টগুলোর মধ্যে একমাত্র ভিএক্স যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ত্র হিসেবে রকেট, কামানের কার্তুজ, বিমানের স্প্রে ট্যাঙ্ক এবং স্থলমাইনে ব্যবহৃত হয়েছে। [১৯][২১]

নোভিচক এজেন্ট

নোভিচক (Russian: Новичо́к, "নবাগত") এজেন্ট এক শ্রেণীর জৈবফসফেট যৌগ, যা ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ায় তৈরি করা হয়। নোভিচক প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল উচ্চ মারণশীল রাসায়নিক অস্ত্রের আবিষ্কার ও উৎপাদন করা যা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অজানা ছিল। নতুন এজেন্টগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যা আদর্শ ন্যাটো রাসায়নিক-শনাক্তকরণ যন্ত্রে ধরা পড়ত না এবং রাসায়নিক-নিরাপত্তা বর্ম ভেদ করতে পারত।

নব্য-আবিষ্কৃত "তৃতীয় প্রজন্মের" অস্ত্রের সাথে কয়েকটি সোভিয়েত এজেন্টের দ্বৈত সংস্করণ তৈরি করা হয় এবং এদেরকেও "নোভিচক এজেন্ট" বলা হয়।

কার্বামেট

সব নার্ভ এজেন্ট জৈবফসফেট নয়, যা কয়েকটি দাবির সঙ্গে অসঙ্গত। [২২][২৩] এদের একটি বড় অংশ কার্বামেট যেমন ইএ-৩৯৯০ ও ইএ-৪০৫৬। দাবি করা হয় যে এ দুটিই ভিএক্স এর তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বেশি বিষাক্ত। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র[২০] ও সোভিয়েত ইউনিয়ন[২৪] উভয়েই কার্বামেট নার্ভ এজেন্ট তৈরি করে। এগুলো সিডব্লিউসি এর অধীনে সংজ্ঞায়িত নিয়ন্ত্রিত উপাদনের বাইরে হওয়ায় এদেরকে কখনও কখনও নোভিচক এজেন্টের সাথে "চতুর্থ প্রজন্মের" এজেন্ট হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।

কীটনাশক

কার্বামেট ও জৈবফসফেটসহ কিছু কীটনাশক যেমন, ডাইক্লোরভোস, ম্যালাথিয়ন এবং প্যারাথিয়ন হচ্ছে নার্ভ এজেন্ট। কীটপতঙ্গদের বিপাকক্রিয়া স্তন্যপায়ীদের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা হওয়ায় এই যৌগগুলো উপযুক্ত মাত্রায় ব্যবহার করা হলে মানবদেহ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের উপর এর প্রভাব সামান্য। তবে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ফলে চাষি ও কীটপতঙ্গের উপর এদের প্রভাব যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। যথেষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করা হলে, অন্যান্য নার্ভ এজেন্টের মতই তীব্র বিষক্রিয়া ও মৃত্যু ঘটতে পারে। কিছু কীটনাশক যেমন ডেমেটন, ডাইমফক্স ও প্যারাক্সন এর প্রভাব মানবদেহের উপর এতই বিষাক্ত যে এদেরকে কৃষিতে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমনকি এগুলোকে এক পর্যায়ে সম্ভাব্য সামরিক ব্যবহারের জন্য পরীক্ষা করা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকান জাতিবিদ্বেষী সরকার কর্তৃক প্রজেক্ট কোস্ট এর অংশ হিসেবে গুপ্তহত্যার অস্ত্র হিসেবে প্যারাক্সন ব্যবহার করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়। অনেক উন্নয়নশীল দেশে জৈবফসফেট কীটনাশক বিষক্রিয়া বিকলাঙ্গতার একটি প্রধান কারণ এবং এটি আত্মহত্যার পদ্ধতি হিসেবে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। [২৫]

বিস্তার পদ্ধতি

নার্ভ এজেন্টের বিস্তার ঘটাতে অনেক পদ্ধতি রয়েছে যেমন:[২৬]

  • অনিয়ন্ত্রিত অ্যারোসল যুদ্ধোপকরণ
  • ধূম্রপ্রয়োগ করা
  • বিস্ফোরণ
  • অ্যাটোমাইজার, হিউমিডিফায়ার ও ফগার

কোন পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হবে তা নির্ভর করে ব্যবহৃত নার্ভ এজেন্টের ভৌত অবস্থা, লক্ষ্যবস্তুর প্রকৃতি এবং কৌশলের অর্জনযোগ্য মাত্রার উপর। [২৬]

ইতিহাস

আবিষ্কার

নার্ভ এজেন্টের প্রথম শ্রেণী জি-সিরিজ ১৯৩৬ সালের ২৩শে ডিসেম্বর জার্মানিতে দৈবক্রমে আবিষ্কৃত হয়েছিল। আইজি ফারবেন এর জন্য কর্মরত জেরার্ড শ্রাডারের নেতৃত্বাধীন একটি গবেষণা দল এটি আবিষ্কার করেন। শ্রাডার ১৯৩৪ সাল থেকে লিভারকুসেনের একটি পরীক্ষাগারে আইজি ফারবেন এর জন্য নতুন ধরনের কীটনাশক তৈরির কাজ করছিলেন। উন্নত ধরনের কীটনাশক তৈরির লক্ষ্যে শ্রাডার অসংখ্য যৌগ নিয়ে গবেষণা করেন, যা পর্যায়ক্রমে টাবুন তৈরির দিকে অগ্রসর হয়।

গবেষণার সময় টাবুন কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকরী ছিল: সামান্য ৫ পিপিএম টাবুন প্রাথমিক পরীক্ষায় ব্যবহৃত সমস্ত পত্র উকুন ধ্বংস করেছিল। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারিতে শ্রাডার প্রথম বারের মত মানবদেহের উপর নার্ভ এজেন্টের প্রভাব সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন যখন পরীক্ষাগারের একটি টুলের উপর এক ফোঁটা টাবুন পড়ে গিয়েছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার এবং তার সহকারীর মায়োসিস (অক্ষিগোলকের সংকোচন), মাথা ঘোরা এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে শুরু হয়। তাদের সম্পূর্ণ সুস্থ হতে তিন সপ্তাহ সময় লাগে।

১৯৩৫ সালে নাৎসি সরকার একটি ফরমান জারি করে যাতে যে সকল আবিষ্কার সামরিক ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ভূমিকা রাখতে পারে সেগুলোকে সামরিক মন্ত্রণালয়ে পেশ করার আদেশ দেয়া হয়। ১৯৩৭ সালের মে মাসে শ্রাডার বার্লিন-স্প্যানডাউ এর সেনাবাহিনী অস্ত্র দপ্তরের রাসায়নিক যুদ্ধবিগ্রহ (সিডব্লিউ) বিভাগে টাবুনের একটি নমুনা পাঠান। বার্লিনের ভেরমাখত রাসায়নিক পরীক্ষাগারে শ্রাডারকে নমুনা প্রদর্শনের জন্য তলব করা হয়, যার পর শ্রাডারের পেটেন্ট আবেদন ও সংশ্লিষ্ট সকল গবেষণা গোপনীয় হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। সিডব্লিউ বিভাগের প্রধান কর্নেল রুডিগার টাবুন ও অন্যান্য জৈবফসফেট যৌগের উপর অধিকতর গবেষণার জন্য নতুন গবেষণাগার তৈরির নির্দেশ দেন। শীঘ্রই শ্রাডার রুর ভ্যালির উপার্টাল-এলবারফেল্ডে একটি নতুন গবেষণাগারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে গোপনে তার গবেষণা চালানোর জন্য চলে আসেন। প্রাথমিকভাবে যৌগটির সাংকেতিক নাম দেয়া হয় লে-১০০ ও পরে নাম রাখা হয় ট্রিলন-৮৩।

১৯৩৮ সালে শ্রাডার ও তার দল সারিন আবিষ্কার করেন। আবিষ্কর্তাদের সম্মানে তাদের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে এর নাম রাখা হয়: শ্রাডার (S), আম্ব্রোস (A), জেরার্ড রিটলার (R) ও ফন ডার লিন্ডে (in)[২৭] এর সাংকেতিক নাম রাখা হয় টি-১৪৪ বা ট্রিলন-৪৬। জানা যায় যে এটি টাবুনের চেয়ে দশগুণ বেশি সক্রিয়।

সোমান ১৯৪৪ সালে রিচার্ড কুন কর্তৃক বিদ্যমান যৌগসমূহ নিয়ে কাজ করার সময় আবিষ্কৃত হয়। এর নামটি নেয়া হয়েছে গ্রিক শব্দ 'ঘুমানো' অথবা লাতিন শব্দ 'প্রহার করা' থেকে। এর সাংকেতিক নাম ছিল টি-৩০০।

সাইক্লোসারিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবিষ্কৃত হলেও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা হারিয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে এটি পুনরায় আবিষ্কার করা হয়।

জার্মান কার্যকলাপ উন্মোচিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জি-সিরিজ নামকরণ ব্যবস্থা তৈরি করে। এতে টাবুনকে জিএ (জার্মান এজেন্ট এ), সারিনকে জিবি (জার্মান এজেন্ট বি), সোমানকে জিডি, ইথাইল সারিনকে জিই ও সাইক্লোসারিনকে জিএফ নাম দেয়া হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৯ সালে, রবক্র্যামার [de] এ জার্মান ঘাটির কাছে লুনবার্গ হিথ এর মুন্সটার-ল্যাগারে একটি পরীক্ষামূলক টাবুন কারখানা স্থাপিত হয়। ১৯৪০ এর জানুয়ারিতে একটি গপন কারখানার নির্মাণ শুরু হয় যার সাংকেতিক নাম ছিল "হোচওয়ের্ক" (হাই ফ্যাক্টরি)। এটির অবস্থান ছিল ব্রেসল (বর্তমান ভ্রোক্ল) থেকে সিলেসিয়া পর্যন্ত ওডার নদীর ৪০ কিমি (২৫ মা) তীরেডায়হার্নফারথ অ্যান ডার ওডার (বর্তমানে পোল্যান্ডের ব্রজেগ ডোলনি) তে।

বিশালাকার কারখানাটির আয়তন ছিল ২.৪ বাই ০.৮ কিমি (১.৪৯ বাই ০.৫০ মা) এবং এটি ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারখানা যাতে টাবুনের সকল মধ্যবর্তী ও চূড়ান্ত উৎপাদ তৈরি করা হত। কারখানাতির নিচে গোলাবারুদ পূর্ণ করার জন্য একটি ভূগর্ভস্থ কারখানা ছিল, যেগুলো এরপর আপার সিলেসিয়ার ক্রাপিটজে (বর্তমান ক্রাপকোউইস) সঞ্চিত করা হত। সে সময়ে জার্মানির অন্য সকল রাসায়নিক এজেন্ট প্রস্তুতকারক কারখানার মত এই কারখানাটিও পরিচালনা করত অ্যানোগানা জিএমবিএইচ [de], যা আইজি ফারবেনের একটি সহায়ক ছিল।

চরম গোপনীয়তা ও কঠিন উৎপাদন ব্যাবস্থার কারণে কারখানাটি সম্পূর্ণ চালু হতে ১৯৪০ এর জানুয়ারি থেকে ১৯৪২ এর জুন পর্যন্ত সময় লাগে। টাবুনের অনেকগুলো পূর্ববর্তী রাসায়নিক এতটাই ক্ষয়কারী ছিল যে কোয়ার্টজ বা রূপার প্রলেপ না দেয়া বিক্রিয়া প্রকোষ্ঠগুলো শীঘ্রই বাতিল হয়ে যায়। টাবুন নিজেই এতই বিপদজনক ছিল যে উৎপাদনের শেষ ধাপটি একটি ডবল কাঁচ ঘেরা প্রকোষ্ঠে করতে হত ও কাঁচের দেয়ালের মাঝখানে উচ্চচাপে বায়ুপ্রবাহ ঘটানো হত।

তিন হাজার জার্মান নাগরিক হোচওয়ের্কে কর্মরত ছিলেন, যাদের প্রত্যেককে শ্বসনযন্ত্র ও রাবার/কাপড়/রাবার এর বহুস্তরীয় পোশাক দেয়া হয়েছিল যেগুলো দশবার ব্যবহারের পর ধ্বংস করে ফেলা হত। সমস্ত সাবধানতা অবলম্বনের পরেও, উৎপাদন শুরুর পূর্বেই ৩০০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, এবং আড়াই বছরের কার্যক্রমে অন্তত ১০ জন কর্মী মৃত্যুবরণ করেন। অ্যা হাইয়ার ফর্ম অফ কিলিং: দ্য সিক্রেট হিস্টোরি অফ কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার এ উল্লিখিত কয়েকটি ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপ:[২৮]

  • চারজন পাইপ মিস্ত্রির উপরে তরল টাবুন পড়ে যায় এবং রাবার স্যুট খোলার আগেই তাদের মৃত্যু হয়।
  • একজন কর্মীর রাবার স্যুটের ঘাড়ের মধ্যে দিয়ে দুই লিটার টাবুন ঢুকে যায়। দুই মিনিটের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
  • সাতজন কর্মীর মুখে টাবুনের প্রবাহ এমনভাবে এসে লাগে যে তরলটি তাদের শ্বসনযন্ত্র ভেদ করে ঢুকে যায়। জীবনসঞ্চারী পদক্ষেপ নেয়া সত্বেও তাদের মধ্যে কেবল দুইজনকে বাঁচানো যায়।

সোভিয়েত সেনাবাহিনীদের হাতে ধরা পড়ার পূর্বে এই কারখানায় ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০ টন টাবুন উৎপাদিত হয়েছিল[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এবং সেগুলো সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়নের জেরজিঙ্কে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। [২৯][৩০]

১৯৪০ সালে জার্মান সেনাবাহিনী অস্ত্র অফিস যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য সারিন গ্যাসের ব্যাপক উৎপাদনের নির্দেশ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে বহু পরীক্ষামূলক কারখানা নির্মিত হয় এবং একটি উচ্চ উৎপাদনশীল কারখানা নির্মাণাধীন ছিল (তবে সমাপ্ত হয়নি)। এ সময় জার্মানির নাৎসী বাহিনীর জন্য আনুমানিক ৫০০ কেজি থেকে ১০ টন সারিন গ্যাস উৎপাদন করা হয়।

এই সময়ে, জার্মান গোয়েন্দা বাহিনী মনে করত যে মিত্রশক্তিও এই যৌগগুলো সম্পর্কে জানত। এর কারণ হচ্ছে এই যৌগগুলি সম্পর্কে মিত্রশক্তিদের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে কোন আলোচনা ছিল না এবং এগুলো সম্পর্কে সমস্ত তথ্য ধামাচাপা দেয়া হচ্ছিল। সারিন, টাবুন এবং সোমান গ্যাসকে গোলাবারুদের সাথে যুক্ত করা হলেও, শেষ পর্যন্ত জার্মান সরকার মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এইসব এজেন্টপূর্ণ কার্তুজ আটক করার আগ পর্যন্ত মিত্রশক্তি এগুলো সম্পর্কে জানতে পারেনি।

জোসেফ বরকিনের বই দ্য ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট অফ আইজি ফারবেন এ এ সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে:[৩১]

স্পিয়ার, যিনি টাবুনের, সূত্রপাতের তীব্র বিরোধী ছিলেন, তিনি আই.জি. ফারবেনের বিষাক্ত গ্যাস ও কৃত্রিম রাবার বিভাগের প্রধান অটো অ্যাম্ব্রোসকে বৈঠকে নিয়ে আসেন। হিটলার অ্যাম্ব্রোসকে জিজ্ঞাসা করেন, "অপর পক্ষ বিষাক্ত গ্যাসের ব্যাপারে কি করছে?" অ্যাম্ব্রোস ব্যাখ্যা করেন যে, ইথিলিনের উপর শত্রুপক্ষের অধিক দখল থাকায়, সম্ভবত তাদের জার্মানির থেকে অধিক পরিমাণ মাস্টার্ড গ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। হিটলার বাধা দিয়ে বলেন যে তিনি প্রচলিত বিষাক্ত গ্যাসের কথা বলছেন না: "আমি বুঝি যে পেট্রোলিয়াম সমৃদ্ধ দেশগুলো বেশি পরিমাণে মাস্টার্ড গ্যাস তৈরির অবস্থানে রয়েছে, কিন্তু জার্মানির একটি বিশেষ গ্যাস রয়েছে, টাবুন। এই ক্ষেত্রে আমাদের জার্মানিতে একচেটিয়া আধিপত্য আছে।" তিনি বিশেষ করে এটা জানতে চাচ্ছিলেন যে শত্রুপক্ষের এমন কোন গ্যাসের উপর দখল আছে কিনা এবং এই এলাকায় সেটির অবস্থা কি। হিটলারকে হতাশ করে অ্যাম্ব্রোস বলেন, "আমার এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, টাবুন সম্পর্কেও বিদেশিদের জ্ঞান রয়েছেI আমি জানি যে, টাবুন ১৯০২ সালে জনসমক্ষে আসে, যখন সারিন ও এইসব বস্তুগুলো পেটেন্ট করা হয়." (...)অ্যাম্ব্রোস হিটলারকে জার্মানির অন্যতম গোপনীয় অস্ত্র সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। তিনি বলেন যে, টাবুন ও সারিনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ইতোমধ্যেই ১৯০২ সালের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এবং আই.জি. ফারবেন ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে দুটিরই পেটেন্ট নিয়েছে। এরপর অ্যাম্ব্রোস হিটলারকে সতর্ক করেন যে যদি জার্মানি টাবুন ব্যবহার করে, তবে এটির এই সম্ভাবনারও সম্মুখিন হতে হবে যে মিত্রশক্তি এই গ্যাসটি আরও বৃহৎ পরিসরে তৈরি করতে পারে। এই হতাশাজনক প্রতিবেদন পাওয়ার পর হিটলার হঠাৎ বৈঠক ছেড়ে উঠে যান। নার্ভ গ্যাস ব্যবহৃত হল না, অন্তত এই সময়ের জন্য, যদিও তাদের উৎপাদন ও পরীক্ষা চলতেই থাকবে।

— জোসেফ বরকিন, দ্য ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট অফ আইজি ফারবেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, রাসায়নিক অস্ত্রের একমাত্র বৃহৎ-পরিসরে ব্যবহার করে ইরাক, যখন তারা ইরানি সৈন্য ও কুর্দিদের বিরদ্ধে মাস্টার্ড গ্যাস ব্যবহার করে (১৯৮০–১৯৮৮ সালের ইরান–ইরাক যুদ্ধ)। কুর্দি গ্রাম হালাব্জা এর জনসাধারণ পর্যায়ে ইরাকি সৈন্যরা কিছু ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল, যা সম্ভবত মাস্টার্ড গ্যাস ও খুব সম্ভবত নার্ভ এজেন্ট ছিল। [৩২]

অম শিনরিঙ্ক্যো ধর্মীয় গোষ্ঠীর কর্মীরা অন্যান্য জাপানিদের উপর কয়েকবার সারিন গ্যাস প্রয়োগ করে, যার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল টোকিও সাবওয়ে সারিন অ্যাটাক। [৩৩][৩৪]

গলফ যুদ্ধে কোন নার্ভ এজেন্ট (বা অন্য কোন রাসয়নিক অস্ত্র) ব্যবহৃত হয়নি, তবে খামিসিয়াহ রাসায়নিক ডিপো ধ্বংসের সময় কিছু সংখ্যক মার্কিন ও ব্রিটিশ কর্মী এর সংস্পর্শে এসেছিলেন। এই ঘটনা ও সম্ভাব্য নার্ভ এজেন্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ব্যবস্থা হিসেবে অ্যান্টিকোলিনারজিক ওষুধের ব্যাপক ব্যবহারকে গলফ ওয়ার সিনড্রোমের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। [৩৫]

সিরিয়ান গৃহযুদ্ধের সময় ২০১৩ সালের একটি আক্রমণে ঘোউটায় সারিন ব্যবহৃত হয়েছিল, যাতে কয়েকশত মানুষের মৃত্যু হয়। অধিকাংশ রাষ্ট্রের মতে রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদের অনুগত বাহিনী এই আক্রমণ চালায়;[৩৬] যদিও, সিরিয় সরকার এর দায় অস্বীকার করেছে।

২০১৭ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-উনের সৎ ভাই কিম জং-নামের গুপ্তহত্যায় নার্ভ এজেন্ট ভিএক্স ব্যবহৃত হয়। [৩৭]

২০১৮ সালের ৪ঠা মার্চ, একজন সাবেক রাশিয়ান গুপ্তচর (যাকে উচ্চ দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলেও চর বিনিময় চুক্তির অধীনে যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতি দেয়া হয়), সারজেই স্ক্রিপাল ও তার কন্যা যিনি মস্কো থেকে ভ্রমণ করছিলেন দুজনকেই নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করা হয়। তারা বেঁচে যান ও পরে তাদের হাসপাতাল থেকে ছেড়েও দেয়া হয়। [৩৮] অধিকন্তু, নিক বেইলি নামের একজন উইল্টশায়ার পুলিশ অফিসার পদার্থটির সংস্পর্শে এসেছিলেন। তিনি এই ঘটনায় সর্বপ্রথম প্রতিক্রিয়াকারিদের মধ্যে একজন ছিলেন। একুশ জন ব্যক্তিকে এই নার্ভ এজেন্টের সংস্পর্শে আসার জন্য চিকিৎসা দেয়া হয়। তা সত্বেও, কেবলমাত্র বেইলি ও স্ক্রিপাল আশঙ্কাজনক অবস্থায় ছিলেন। [৩৯] ২০১৮ এর ১১ই মার্চ, ইংল্যান্ড জনস্বাস্থ্য বিভাগ, দ্য মিল পাব (যেখানে এই আক্রমণটি সংঘটিত হয়) অথবা নিকটবর্তী জিঝি রেস্তোরাঁয় অবস্থানকারী ব্যক্তিদের জন্য পরামর্শ জারি করে। [৪০] ২০১৮ সালের ১২ই মার্চ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বিবৃতি দেন যে এতে ব্যবহৃত পদার্থটি একটি নোভিচক নার্ভ এজেন্ট ছিল। [৪১]

সমুদ্রে নিষ্পত্তি

১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস সমুদ্রে রাসায়নিক অস্ত্র নিষ্কাশন নিষিদ্ধ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, প্রাথমিকভাবে অপারেশন চেস এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই ৩২,০০০ টন নার্ভ এজেন্ট এবং মাস্টার্ড এজেন্ট সমুদ্রে ফেলেছিল। মার্কিন সেনা রাসায়নিক উপাদান সংস্থার একজন ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার, উইলিয়াম ব্রঙ্কোইটসের ১৯৯৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্কিন সেনাবাহিনী কমপক্ষে ২৬ টি রাসায়নিক অস্ত্র ডাম্পসাইট তৈরি করেছে যা অন্তত ১১টি রাজ্যের পশ্চিম এবং পূর্ব উপকূলের সমুদ্রে অবস্থিত। নথির স্বল্পতার কারণে, বর্তমানে তারা মোট ডাম্পসাইটের কেবল অর্ধেকের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে জানেন। [৪২]

এই নিষ্কাশনের বাস্তুতন্ত্রীয় ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। লিকেজ এর ঘটনার ক্ষেত্রে, অনেক নার্ভ এজেন্ট পানিতে দ্রবণীয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়, তবে সালফার মাস্টার্ডের মত অন্যান্য কিছু পদার্থ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে রাসায়নিক অস্ত্র সমুদ্রতীরে ভেসে এসেছে বা দুর্ঘটনাবশত পুনরায় তুলে আনা হয়েছে, যেমন ড্রেজিং বা জালে মাছ ধরার সময়। [৪৩]

শনাক্তকরণ

গ্যাসীয় নার্ভ এজেন্ট শনাক্তকরণ

গ্যাসীয় নার্ভ এজেন্ট নিম্নলিখিতভাবে শনাক্ত করা যায় তবে এটি কেবলমাত্র এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

লেজার ফটোঅ্যাক্যুস্টিক বর্ণালীবীক্ষণ

লেজার ফটোঅ্যাক্যুস্টিক বর্ণালীবীক্ষণ (এলপিএএস) পদ্ধতি গ্যাসে অবস্থিত নার্ভ এজেন্ট শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে, গ্যাসীয় পদার্থ দ্বারা লেজার আলো শোষিত হয়। এর ফলে একটি উষ্ণ/শীতল চক্রের সৃষ্টি হয় এবং চাপের পরিবর্তন ঘটে। সুবেদী মাইক্রোফোন শব্দতরঙ্গ তৈরি করে যা চাপের পরিবর্তন ঘটায়। ইউ.এস.আর্মি রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা এমন একটি এলপিএএস ব্যবস্থা তৈরি করেছেন যা বাতাসের একটিমাত্র নমুনা থেকেই একাধিক বিষাক্ত গ্যাসের অস্তিত্ব নির্ণয় করতে পারে [৪৪]

এই প্রযুক্তিটিতে তিনটি ভিন্ন কম্পাঙ্কের সাথে মড্যুলেটেড তিনটি লেজার থাকে, যার প্রতিটি একটি পৃথক শব্দতরঙ্গের স্বর সৃষ্টি করতে পারে। আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য একটি ফটোঅ্যাক্যুস্টিক কোষ সেন্সরের দিকে নির্দেশিত হয়। এই কোষগুলোর মধ্যে বিভিন্ন নার্ভ এজেন্টের বাষ্প থাকে। লেজারের শব্দ তরঙ্গের স্বরের উপর প্রতিটি নার্ভ এজেন্টের নমুনার একটি নির্দিষ্ট প্রভাব রয়েছে। [৪৫] শাব্দিক ফলাফলের উপর নার্ভ এজেন্টের প্রভাবের কিছু উপরিপাতন ঘটে। তবে, এটির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল যে নতুন তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট অতিরিক্ত লেজার সংযুক্ত করলে এর নির্দিষ্টতা বৃদ্ধি পাবে। [৪৪] তবুও, বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অনেক বেশি লেজার যুক্ত করলে শোষিত বর্ণালীর উপরিপাতন ঘটতে পারে। এলপিএএস প্রযুক্তি প্রতি বিলিয়ন ঘনত্বে (parts per billion, ppb) গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে। [৪৫][৪৬][৪৭]

এই বহুতরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট্য এলপিএএস দ্বারা নিম্নোক্ত নার্ভ এজেন্টসমূহকে শনাক্ত করা যায়:[৪৪]

  • ডাইমিথাইল মিথাইল ফসফোনেট (ডিএমএমপি)
  • ডাইইথাইল মিথাইল ফসফোনেট (ডিইএমপি)
  • ডাইআইসোপ্রোপাইল মিথাইল ফসফোনেট (ডিআইএমপি)
  • ডাইমিথাইলপলিসিলোক্সেন (ডিআইএমই), ট্রাইইথাইল ফসফেট (টিইপি)
  • ট্রাইবিউটাইল ফসফেট (টিবিপি)
  • দুটি উদ্বায়ী জৈব যৌগ (ভিওসি)
  • অ্যাসিটোন (এসিই)
  • আইসোপ্রোপানল (আইএসও)

এলপিএএস দ্বারা শনাক্তযোগ্য অন্যান্য গ্যাস ও বায়ুদূষক হচ্ছে:[৪৬][৪৮]

  • CO2
  • বেনজিন
  • ফরমালডিহাইড
  • অ্যাসিটালডিহাইড
  • অ্যামোনিয়া
  • NOx
  • SO2
  • ইথিলিন গ্লাইকল
  • টিএটিপি
  • টিএনটি

অ-বিকিরণশীল অবলোহিত

অ-বিকিরণশীল অবলোহিত পদ্ধতি গ্যাসীয় নার্ভ এজেন্ট শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। [৪৬][৪৯]

অবলোহিত শোষণ

প্রচলিত অবলোহিত শোষণ গ্যাসীয় নার্ভ এজেন্ট শনাক্তকারী হিসেবে বলা হয়েছে। [৪৬]

ফ্যুরিয়ার রুপান্তর অবলোহিত বর্ণালীবীক্ষণ

ফ্যুরিয়ার রুপান্তর অবলোহিত (এফটিআইআর) বর্ণালীবীক্ষণ গ্যাসীয় নার্ভ এজেন্ট শনাক্তকারী হিসেবে জানা গিয়েছে। [৪৬]

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ