জৈব যৌগ
হাইড্রোকার্বন ও হাইড্রোকার্বন হতে সৃষ্ট যৌগসমূহকে জৈব যৌগ বলে। জৈব যৌগ হল এক ধরনের যৌগিক পদার্থ যার সাধারন উপাদান হিসেবে কার্বন থাকে। ঐতিহাসিক কারণে কিছু যৌগ যেমন- কার্বনেট, কার্বনের সাধারণ অক্সাইড, সায়ানাইড এবং কার্বনের রূপভেদকে অজৈব যৌগ হি হয়। ১৮২৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে, জৈব যৌগ শুধু প্রাণশক্তির প্রভাবে জীব ও প্রাণীদেহে সৃষ্টি হয়, একে পরীক্ষাগারে সংশ্লেষণ করা সম্ভব নয় (যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল বিজ্ঞানী বার্জেলিয়াসের প্রাণশক্তি তত্ত্ব থেকে)। ফ্রেডরিখ ভোলার ১৮২৮ সালে অজৈব অ্যামোনিয়াম সায়ানেট থেকে পরীক্ষাগারে ইউরিয়া সংশ্লেষণ করেন, যা একটি জৈব যৌগ।[১] এর ফলে শতাব্দীকাল ধরে প্রচলিত ধারণার অবসান ঘটে।
জীব ও প্রাণিদেহ মূলত জৈব যৌগের সমন্বয়ে গঠিত। কার্বনের যৌগসমূহ তথা জৈব যৌগের প্রস্তুতি, ধর্ম, গঠন, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় জৈব রসায়নে।
ইতিহাস
প্রাণশক্তি মতবাদ
১৮১৫ সালে বিজ্ঞানী বার্জেলিয়াসের জীব থেকে জৈব যৌগ পাওয়ার মতবাদটিকে প্রাণশক্তি মতবাদ বলা হয়।“জৈব” কথাটির উৎপত্তি হয় প্রথম শতাব্দীতে। বিভিন্ন কারণে পশ্চিম বিশ্বের বিজ্ঞানীরা প্রাণশক্তি মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এই মতবাদ অনুযায়ী কিছু মৌল কেবলমাত্র ভূ-পৃষ্ঠ, পানি, বায়ু ও আগুন থেকে জীব-শক্তির মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। একে বলা হত প্রাণশক্তি যা শুধু প্রাণী বা উদ্ভিদে বিদ্যমান। এসব মৌলই হল জৈব যৌগ। এরা অজৈব যৌগ হতে ভিন্ন প্রকৃতির। অজৈব যৌগসমূহ রাসায়নিক স্নগশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব।আধুনিক পরমাণুবাদের উদ্ভব হওয়ার পরও বেশ কিছুকাল এই প্রাণশক্তি মতবাদ প্রচলিত ছিল। সর্বপ্রথম ১৮২৪ সালে এই মতবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এসময় ফ্রেডরিখ ভোলার সায়ানোজেন হতে অক্সালিক এসিড সংশ্লেষণ করে, যা একটি জৈব যৌগ হিসেবে এতকাল পরিচিত ছিল। এর চেয়ে আরও একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা ছিল ১৮২৮ সালে ভোলারের পটাশিয়াম সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সায়ানেট হতে ইউরিয়া সংশ্লেষণ। দীর্ঘকাল ধরে জৈব যৌগ হিসেবে প্রাণীর মূত্রে উদ্ভব ঘটত এতকাল জানা ছিল। এরপর আরও অনেক জৈব যৌগ পরীক্ষাগারে অজৈব যৌগ থেকে সংশ্লেষিত হয় কোনরকম উদ্ভিদ বা জীবের প্রভাব ছাড়াই।
আধুনিক শ্রেণিবিন্যাস
প্রাণশক্তি মতবাদ ভুল প্রমাণিত হলেও জৈব ও অজৈব যৌগের মধ্যে পার্থক্য আজ অবধি অব্যাহত আছে, এর কারণ অসংখ্য জৈব যৌগের সংগঠন ও বিন্যস্তের জন্য।[২] এমনও অনেক জৈব যৌগের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের প্রাণী বা উদ্ভিদের সাথে গঠনগত ও ধর্মের দিক থেকে কোন সম্পর্ক নেই। জৈব জৌগের কোন আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নেই। কোন কোন পাঠ্যবই কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন বিশিষ্ট যৌগকে জৈব যৌগ বলে থাকে। আবার কিছু বই যেসব অণুতে কার্বন বিদ্যমান, তাদেরকেই জৈব যৌগ বলে।[৩] কার্বন পরমাণু বিশিষ্ট অণুর বৃহত্তর সংজ্ঞায় তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় অল্প পরিমাণ কার্বন বিশিষ্ট যৌগ যেমন- কার্বনেট, সাধারণ অক্সাইড, সায়ানাইড, কার্বনের বহুরূপসমূহ ইত্যাদি বিবেচনা করা হয় না।
প্রচলিত কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধনের সংজ্ঞায় প্রায়োগিক ও ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত জৈব যৌগসমূহ বিবেচনা করা হয় না। এই সংজ্ঞা অনুসারে ইউরিয়া এবং অক্সালিক এসিড জৈব যৌগ নয়। এই যৌগদুইটি প্রাণশক্তি মতবাদে বিতর্কের বিষয় ছিল। IUPAC এর Nomenclature of Organic Chemistry শীর্ষক বইয়ে সুনির্দিষ্টভাবে ইউরিয়া[৪] ও অক্সালিক এসিডকে জৈব যৌগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[৫] অন্যান্য যৌগ যাতে কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন নেই তবে ঐতিহাসিকভাবে জৈব যৌগ হিসেবে পরিচিত, তাদের মধ্যে রয়েছে- বেনজিনহেক্সোল, মেসোক্স্যালিক এসিড, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড। মেলিটিক এসিডে কোন কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন না থাকলেও একে জৈব যৌগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৬] এই “কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন নিয়ম” কার্বন-ফ্লোরিন বিশিষ্ট যৌগের ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা নির্ধারণে সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন- এই নিয়ম অনুযায়ী টেফলন একটি অজৈব যৌগ কিন্তু টেফজেল জৈব যৌগ। একইভাবে অনেক হ্যালো-অ্যালকেনও এই নিয়ম অনুসারে অজৈব কিন্তু অন্যান্য জৌগসমূহ জৈব। এই কারণে এবং অন্যান্য কিছু কারণে কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন বিশিষ্ট যৌগসমূহকে জৈব যৌগের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শ্রেণিবিভাগ
জৈব যৌগকে অনেক উপায়ে শ্রেণিবিভাগ করা যায়। একটি বিশেষ পন্থা হল, প্রাকৃতিক এবং সংশ্লেষিত জৈব যৌগ। এছাড়া জৈব যৌগসমূহকে হেটেরো-পরমাণুর উপস্থিতির ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করা যেতে পারে, যেমন- অর্গ্যানোমেটালিক যৌগ, যেগুলোতে কার্বন ও ধাতুর মধ্যে বন্ধন থাকে এবং অর্গ্যানোফসফরাস যৌগ, যেগুলোতে কার্বনের সাথে ফসফরাসের বন্ধন থাকে।আকারের ভিত্তিতে জৈব যৌগসমূহকে ক্ষুদ্রাকার অণু এবং পলিমার এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়।
প্রাকৃতিক যৌগ
প্রাকৃতিক যৌগ বলতে সেসব যৌগকে বোঝানো হয় যেগুলো জীব ও প্রাণীদেহে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়। এসকল যৌগ সাধারণত প্রকৃতি থেকে আহরণ করা হয়, কারণ কৃত্রিমভাবে এগুলোর উৎপাদন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যেমন- চিনি, অ্যালকালয়েড, টারপিনয়েড, পুষ্টির উপাদান যেমন ভিটামিন B12 এবং বিভিন্ন বিশালাকার ও জটিল প্রকৃতির জৈব যৌগ। এধরনের আরও কিছু যৌগ প্রাণরসায়নে যাদের প্রয়োগ এবং গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি তারা হলঃ অ্যান্টিজেন, কার্বহাইড্রেট, এনজাইম, হরমোন, লিপিড, ফ্যাটি এসিড, নিউক্লিক এসিড, পেপটাইড, অ্যামিনো এসিড, ভিটামিনসমূহ, চর্বি এবং তৈল।
সংশ্লেষিত যৌগ
যেসব যৌগ অন্য কোন যৌগের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়, তাদেরকে বলা হয় সংশ্লেষিত যৌগ। এসব যৌগ প্রাণী বা উদ্ভিদে পাওয়া যেতে পারে কিংবা প্রাকৃতিকভাবে নাও পাওয়া যেতে পারে। অনেক পলিমার যেমন- প্লাস্টিক ইত্যাদি হল জৈব যৌগ।
জৈব বিক্রিয়াসমূহের শ্রেণিবিন্যাস
জৈব বিক্রিয়াকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়।
- সংযোজন বা যুত বিক্রিয়া
এই ধরনের বিক্রিয়ায় দুটি পদার্থের প্রত্যক্ষ সংযোগে নতুন পদার্থের সৃষ্টি হয়। অসম্পৃক্ত যৌগে এই বিক্রিয়ার একটি পাই (∏) বন্ধন ভেঙ্গে দুইটি সিগমা (σ ) বন্ধন তৈরি হয়।
- প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া
যে বিক্রিয়ায় কোন যৌগ থেকে এক বা একাধিক পরমাণু বা মূলক অপসারিত হয়ে সে স্থানে অধিক সক্রিয় পরমাণু বা মূলক যুক্ত হয় তাকে প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া বলে। যেমন অ্যালকাইল হ্যালাইডের সাথে জলীয় ক্ষারকের বিক্রিয়ায় এলকোহল উৎপাদন একটি প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া।
R—X + OHΘ ͢-> R—OH+XΘ
এখানে XΘ আয়ন OHΘ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
- অপসারণ বিক্রিয়া
এটি যুত বিক্রিয়ার বিপরীত বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় কোন যৌগের পাশাপাশি অবস্থিত দুইটি বা চারটি পরমাণু অপসারিত হয়ে অসম্পৃক্ততার সৃষ্টি করে। অ্যালকাইল হ্যালাইডকে অ্যালকোহলীয় ক্ষারসহ ফুটালে হাইড্রোজেন হ্যালাইড অপসারিত হয় এবং অ্যালকিন, পানি ও XΘ তৈরি হয়। এ বিক্রিয়ায় ∏ বন্ধন ভেঙ্গে নতুন σ বন্ধন তৈরি হয়।
R—CH2—CH2X+KOH(এলকোহলীয়) -> ͢ R—CH=CH2+KX+H2O
ইথানল বাষ্পকে ৩০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হাইড্রোজেনের তামা উপর দিয়ে চালনা করলে হাইড্রোজেন অণু অপসারিত হয়ে ইথান্যাল গঠিত হয়।
CH3—CH2—OH + ͢Cu (তামা) -> CH3—CHO
- সমাণুকরণ বিক্রিয়া
যে বিক্রিয়ার ফলে বিক্রিয়কের অনুরূপ আণবিক সংকেত কিন্তু ভিন্ন গাঠনিক সংকেত বিশিষ্ট মৌল তৈরি হয় তাকে সমাণুকরণ বিক্রিয়া বলে। অ্যামোনিয়াম সায়ানেটকে উত্তপ্ত করলে ইউরিয়া তৈরি হয়।
NH4CNO ͢-> O=C—NH2
| NH2
n-বিউটেনকে অনার্দ্র AlCl3 সহ উত্তপ্ত করলে আইসোবিউটেন উৎপন্ন হয়।
CH3—CH2—CH2—CH3 ͢+Alcl3 ->
CH3 |
CH3—CH—CH3