প্যারিস শান্তি সম্মেলন, ১৯১৯
প্যারিস শান্তি সম্মেলন, যা ভের্সাই শান্তি সম্মেলন নামেও পরিচিত, ১৯১৮ সালের যুদ্ধসন্ধি অনুযায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে আয়োজিত একটি সম্মেলন যেখানে ৩২টিরও বেশি দেশের কূটনীতিকরা যোগদান করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্রপক্ষ পরাজিত অক্ষশক্তির জন্য শর্তাবলী তৈরির উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করে।
সম্মেলনের মূল সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে রয়েছে লীগ অফ নেশনসের সৃষ্টি; পরাজিত দেশগুলির সাথে পাঁচটি শান্তিচুক্তির পাশাপাশি জার্মানির সাথে ভের্সাই চুক্তি; জার্মানি এবং অটোমানদের বিদেশে দখলকৃত অংশগুলি পুরস্কার হিসেবে দিয়ে দেয়ার আদেশনামা, মূলত ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে; জার্মানির উপর ক্ষতিপূরণের দায় চাপানো এবং জাতিগত সীমানা নির্ধারণে নতুন জাতীয় সীমারেখা প্রণয়ন। মূল সিদ্ধান্ত ছিল জার্মানির সাথে ভের্সাই চুক্তি, যেটির ২৩১ নং অনুচ্ছেদে "জার্মানি এবং এর মিত্রদের আক্রমণ"-কে যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়। এটি জার্মানির জন্য অপমানকর একটি বিধান সত্ত্বেও জার্মানি তার ব্যয়বহুল ক্ষতিপূরণের অংশবিশেষ (১৯৩১ সালে এই ক্ষতিপূরণের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে) পরিশোধও করে।
বিখ্যাত "বৃহৎ চার" রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমঁসো এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী ভিত্তোরিও এমানুয়েলে ওরলান্দো। তারা নিজেরা ১৪৫ বার দেখা করেন এবং সকল মূল সিদ্ধান্ত তৈরী করেন, যেগুলি পরে অন্যরাও অনুমোদন দেয়।[১]
পূর্ণ বিবরণ
১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি সম্মেলনের উদ্বোধন হয়।[২] দিনটি ছিল এক হিসেবে প্রতীকী, কেননা, ১৮৭১ সালের এই দিনেই প্রথম উইলিয়াম প্যারিস বিজয়ের অল্প কিছুক্ষণ পূর্বে ভার্সাই প্রাসাদের হল অফ মিরর্স-এ নিজেকে জার্মান সম্রাট হিসেবে ঘোষণার দেন।[৩][৪] ২৭টি দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের ৫২টি কমিশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এই কমিশন অসংখ্য বিশেষজ্ঞের সহায়তায় ১৬৪৬টি অধিবেশনের মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করে, যার মধ্যে যুদ্ধবন্দী, সমুদ্রতল দিয়ে তার, আন্তর্জাতিক বিমান চালনা, যুদ্ধকালীন দায়িত্ব, ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে মূল সুপারিশগুলি ছিল ভার্সাই চুক্তির মধ্যে অন্তর্গত যার অধ্যায় ছিল ১৫টি এবং ধারা ৪৪০টি। এছাড়া অন্য পরাজিত দেশগুলির জন্যেও চুক্তি ছিল।
সম্মেলনের নিয়ন্ত্রক ছিল পাঁচ মূলশক্তি -ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান। বাস্তবে জাপানের ভূমিকা ছিল খুবই ছোট এবং "বৃহৎ চার"-এর নেতারাই ছিল সম্মেলনের হর্তাকর্তা।[৫] তারা নিজেরা ১৪৫বার নিজেদের মধ্যে সম্মিলিত হন এবং সকল মূল সিদ্ধান্তগুলি নেন।[১] পরবর্তীতে সকল প্রতিনিধিদের সাথে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তগুলির অনুমোদন হয়। ১৯২০ সালের ২১শে জানুয়ারি লীগ অব নেশনস এর উদ্বোধনী সভার মাধ্যমে এই সম্মেলনের সমাপ্তি হয়।[৬][৭]
পাঁচটি মূল শান্তিচুক্তি প্যারিস শান্তি সম্মেলনে তুলে ধরা হয় (বন্ধনীতে যেসব দেশের উপর আরোপিত হয় সেগুলির নাম দেয়া হল):
- ভের্সাই চুক্তি, ২৮শে জুন ১৯১৯ (জার্মানি)
- সাঁ জেরমাঁ চুক্তি, ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯১৯ ( অষ্ট্রিয়া)
- ন্যয়ি চুক্তি, ২৭শে নভেম্বর ১৯১৯ (বুলগেরিয়া)
- ত্রিয়ানোঁ চুক্তি, ৪ই জুন ১৯২০ (হাঙ্গেরি)
- সেভ্র চুক্তি, ১০ই আগস্ট ১৯২০; যেটি পরবর্তীকালে সংশোধিত হয়ে লোজান শহ্রে চুক্তি হয় ২৪শে জুলাই ১৯২৩ সালে (অটোমান সাম্রাজ্য /তুর্কি প্রজাতন্ত্র)
মূল সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে ছিল লীগ অব নেশনসের সৃষ্টি; জার্মানির সাথে ভের্সাই চুক্তিসহ পরাজিত পক্ষের সাথে পাঁচটি শান্তি চুক্তি; জার্মানি এবং অটোমানদের বিদেশে দখলকৃত অংশগুলি পুরস্কার হিসেবে দিয়ে দেয়ার আদেশনামা, মূলত ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে; ক্ষতিপূরণের দায় জার্মানির উপর দেয়া এবং জাতীয়তাবাদের সীমারেখা নির্ধারক নতুন জাতীয় সীমানা আঁকা। তবে মূল ছিল জার্মানির সাথে ভের্সাই চুক্তি যেখানে ২৩১ নং সেকশনে যুদ্ধের দায়ভার জার্মানি ও এর মিত্রদের উপর দেয়া হয়। এই বিধান জার্মানির জন্য অপমানকর ছিল। তার উপর জার্মানিকে বেশ বড়সড় ক্ষতিপূরণের দায়ও দেয়া হয়েছিল (যদিও ১৯৩১ সালে ক্ষতিপূরণের সমাপ্তির আগে এর খুব সামান্য পরিমাণই পরিশোধিত হয়েছিল)।
যেহেতু সম্মেলনের সকল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল একতরফাভাবে, বিশেষ করে "বৃহৎ চারের" ইচ্ছানুযায়ী; প্যারিস সেসময় বিশ্বকর্তৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে, যা পরবর্তীকালে ইউরোপের রাজনৈতিক রূপরেখা পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। ভের্সাই চুক্তির কারণে জার্মানির সামরিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়া, যুদ্ধের সঙ্ঘটনের দায় এবং ব্যয়বহুল ক্ষতিপূরণের সকল দায় তার উপর দেয়াকে নাৎসিবাদের উত্থান এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার অন্যতম মূল কারণ হিসেবে মনে করা হয়। "লীগ অব নেশনস" যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচনার শিকার হয় কারণ এর ফলে কংগ্রেসের যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা নস্যাৎ হয়ে যায়। এর পরিবর্তে- হার্ডিং প্রশাসন জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরির সাথে নতুন চুক্তি করে। রিপাবলিকার জার্মানিকে এতে আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। কম্যুনিস্ট বা সাম্যবাদী রাশিয়ার প্রতিনিধি না থাকলেও শ্বেত রাশিয়ার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন দেশ তাদের প্রতিনিধিদের পাঠায় যাতে তারা চুক্তিতে বিভিন্ন সংযোজন আবেদন (অসফল) করতে পারে। এর মধ্যে দক্ষিণ ককেশাসের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে জাপানের অন্যান্য বৃহৎ শক্তিগুলির সাথে জাতিগত সমতার দাবীও ছিল।
আদেশপত্র
সম্মেলনের অন্যতম মূল ইস্যু ছিল জার্মানির অন্য দেশে করা উপনিবেশগুলির অবসান করা (অস্ট্রিয়ার কোন উপনিবেশ ছিল না এবং অটোমান সাম্রাজ্যের ইস্যু ছিল ভিন্ন)।[৮][৯]
ব্রিটিশদের অধীন দেশগুলি তাদের ভূমিকার জন্য পুরস্কারের দাবী করে। অস্ট্রেলিয়া দাবী করে নিউ গিনি, নিউজিল্যান্ড সামোয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা দাবী করে দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকা (বর্তমান নামিবিয়া)। উইলসন চেয়েছিলেন জার্মানির সকল উপনিবেশগুলি লীগ অব নেশনসের মাধ্যমে শাসন করতে যতদিন না তারা স্বাধীনতার জন্য তৈরি হয়। অন্যদিকে লয়েড জর্জ তার অধীন দেশগুলির জন্য ভিন্ন প্রস্তাব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন যেখানে তিন ধরনের আদেশপত্র থাকবে। একধরনের আদেশপত্র ছিল তুর্কি প্রদেশগুলির জন্য যেখানে প্রদেশগুলি ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মাঝে ভাগ করে দেয়া হবে।
দ্বিতীয়ত, নিউ গিনি, সামোয়া এবং দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকা অংশগুলি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এত কাছাকাছি ছিল যে এদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে দেয়া সম্ভব ছিল না। এছাড়াও আফ্রিকান উপনিবেশগুলির "ক্লাস বি" আদেশপত্র অনুযায়ী যে দেখাশোনার প্রয়োজন ছিল তা উপনিবেশবাদী শক্তিশালী দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের পক্ষেই করা সম্ভব। সে হিসেবে ইতালি এবং পর্তুগালের ভাগ্যে কম অংশই পড়ে। উইলসনসহ অন্যরা শেষপর্যন্ত সমাধানে পৌঁছে। অধীন দেশগুলি যেসব উপনিবেশের জন্য "ক্লাস সি" চেয়েছিল সেগুলি পায়। বিষুবরেখার উত্তরে জার্মান অধিকৃত অংশ পায় জাপান।[১০][১১][১২]
উইলসন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোন আদেশপত্র চাননি। তাঁর শীর্ষ উপদেষ্টা কর্নেল হাউস খুব ঘনিষ্ঠভাবে অন্যদের অংশ পুরষ্কৃত করায় নিয়োজিত ছিলেন। উইলসন বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার দাবীর কারণে বেশ বিরক্ত ছিলেন। তিনি এবং হিউয়ের কিছু পুরনো বিবাদ ছিল, সবচেয়ে জনপ্রিয়টি হল-
উইলসনঃ "কিন্তু শেষপর্যন্ত তুমি মাত্র পাঁচ মিলিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বল"।হিউঃ "কিন্তু আমি ৬০ হাজার মৃতেরও প্রতিনিধিত্ব করি" (আকারে অনেক বড় হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের মৃতের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার)[১৩]।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
ইউরোপে ১৯১৮ সালে ডিসেম্বরে উইলসনের আগমনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের আর কোন রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালীন সময়ে ভ্রমণ করেননি।[১৪] যুদ্ধশেষে এক বছর পরে উইলসন প্রস্তাবিত ১৪ দফা ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি জার্মানি ও অটোমান সাম্রাজ্যসহ এর মিত্রদের অনেকেরই মন ও হৃদয় জয় করে নেয়।
উইলসনের কুশলী কূটনীতি এবং ১৪ দফাই মূলত যুদ্ধবিরতির পরিস্থিতি তৈরি করে যার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। উইলসন অনুভব করেন বিশ্বমানবতার পক্ষ হয়ে শান্তি আলোচনার জন্য তাঁর ভূমিকা রাখা উচিত। যেহেতু যুদ্ধ পরবর্তীতে তার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সবাই আশা ভরসা করছিল, সেজন্য, উইলসন শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বদলে বহিঃবিশ্বমুখী (interventionism) নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু উইলসন শীঘ্রই প্রতিবন্ধকতার (বিবাদ ও পরস্পরবিরোধী দাবির) মুখে পড়েন।[১৫] তিনি মূলত সবচে বেশি চেষ্টা করেছিলেন ফরাসি (জর্জ ক্লেমঁসো) এবং ব্রিটিশ লয়েড জর্জদের জার্মানি এবং এর ইউরোপের মিত্রসহ মধ্যপ্রাচ্যে সাবেক অটোমান সাম্রাজ্য ঘিরে তাদের চিন্তাভাবনার দিক পরিবর্তন করতে। উইলসনের ১৪দফা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি লাভ করতে ব্যর্থ হয় কারণ ফ্রান্স ও ব্রিটেন এর কিছু দফা এবং মূলনীতি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়।
ইউরোপে, তার ১৪দফার অনেকগুলি অন্য শক্তিগুলির সাথে ভিন্নমতের ছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনই মনে করত না যে আর্টিকেল ২৩১ অনুযায়ী জার্মানির উপর যুদ্ধের সকল দায় দায়িত্ব দেয়া সঠিক ছিল।[১৬] শেষপর্যন্ত ১৯২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরির সাথে পৃথক শান্তিচুক্তি করে।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে, ইতিমধ্যেই থাকা ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, দাবীর পাশাপাশি নতুন আদেশপত্রের কারণে সন্ধিআলোচনা বেশ জটিলাকার ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্র আশা করত ১৪দফা অনুযায়ী আরও অনেক স্বাধীন এবং কুশলী কূটনৈতিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠার যেখানে গণতন্ত্র, সার্ভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকবে। অন্যদিকে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল এবং তাদের এই উপনিবেশি মনোভাব ত্যাগের কোন ইচ্ছাও ছিল না।
পূর্বের গোপন সাইক-পিকট চুক্তি এবং আরব ভূমি (প্রাক্তন অটোমান সাম্রাজ্য) সংক্রান্ত আদেশপত্র গ্রহণের মধ্যেই সম্মেলনে ইহুদী এবং আরবপক্ষের দাবীদারদের বক্তব্য নেয়া হয়। এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট উইড্র উইলসন স্থানীয়দের মতামতের জন্য একটি আন্তর্জাতিক তদন্তকারী কমিশন গঠনের সুপারিশ করেন। কমিশনের ধারণা প্রথমে গ্রহণ করলেও ব্রিটিশ এবং ফ্রান্স পরবর্তীতে অসম্মতি জানায়। শেষপর্যন্ত শুধু মার্কিন কিং-ক্রেন (King-Crane) কমিশন তৈরী হয়, যা ১৯১৯ সালে পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন ঘুরে বেড়ায় এবং বিভিন্ন বিবৃতি ও মতামত সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন প্রেসিডেন্ট উইলসনে কাছে জমা দেয়।[১৫] এই প্রতিবেদন উইলসনের কাছে জমা দিলেও ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে 'নিউইয়র্ক টাইমসে' (The new york time) প্রকাশের আগে দীর্ঘদিন জনসম্মুখে আসে নি।.[১৭] ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি ইহুদিরাষ্ট্র তৈরির প্রাক পরিকল্পনা কংগ্রেসে অনুমোদন হয়।[১৮]
ফ্রান্স ও ব্রিটেন "লীগ অব নেশনস"-এ থাকতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করেন।[১৯] কিন্তু যেহেতু বিচ্ছিন্ন থাকার মনোভাব ছিল প্রবল এবং লীগের দলিলের কিছু কিছু দফার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের কিছু দ্বন্দ্ব ছিল সেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ভের্সাই চুক্তিকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন কিংবা "লীগ অব নেশনস"এ যোগদান করে নি, যদিও উইলসন এই লীগ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন যাতে সকম সমাধান যুদ্ধের মাধ্যমে না হয়ে কূটনৈতিক উপায়ে শান্তিপুর্ণভাবে সমাধান হয়।
১৯২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র[২০] অস্ট্রিয়া,[২১], প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিং থাকাকালীন জার্মানি[২২], অস্ট্রিয়া[২১] ও হাঙ্গেরির সাথে পৃথক পৃথক বিভিন্ন চুক্তিস্বাক্ষর করে।
ব্রিটিশদের ভূমিকা
সম্মেলনে ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা, ঐক্য আর স্বার্থ সংরক্ষণ। তবে তারা সম্মেলনে যোগ দেয় কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই:
- ফ্রান্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- দূরসমুদ্রে জার্মান নৌবহরের হুমকি নিরসন
- এলাকাভিত্তিক বিবাদ নিরসন
- "লীগ অব নেশনস"কে গুরুত্বসহকারে সমর্থন দেয়া[২৩]
জাপানের জাতিগত সমতার প্রস্তাব ব্রিটিশদের কোন মূল স্বার্থবিরোধী হয় নি। তথাপি, সম্মেলনে জাতিগত সমতার প্রস্তাব বিশেষ করে ব্রিটিশদের অধীন দেশগুলোতে অভিবাসনের বিষয়টি গুরুত্ব পায়, যা প্রতিনিধিদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করে। ব্রিটেন জাতিগত সমতার বিষয়টি সম্মেলনের মূল লক্ষ্যগুলির একটি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষপর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ান প্রতিনিধিদের শান্ত করতে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঐক্যের নিমিত্তে বিষয়টি মেনে নেয়।[২৪]
ব্রিটেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার অধীন দেশগুলি থেকে প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সম্মত হয়। তথাপি তারা নবগঠিত আইরিশ প্রজাতন্ত্রের, সম্মেলনে উত্থাপন করা জাতিগত পরিচয়, কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং প্রস্তাবিত লীগ অব নেশনসের সদস্য হওয়ার আবেদন বাধাগ্রস্থ করে। চেয়ারম্যান ক্লেমঁসোকে লিখা আইরিশ দূতের সর্বশেষ "স্বীকৃতির দাবী" বিষয়ক চিঠির কোন উত্তরও দেয়া হয় নি।[২৫] ব্রিটিশরা আইরিশদের জন্য দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার (উপনিবেশ মর্যাদাবিহীন) একটি আইনের পরিকল্পনা করে এবং ১৯২০ সালে বাস্তবায়নও করে। এমনিতেও ১৯১৮ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদানের নিয়ম অক্ষুণ্ণ করায় ১৯১৯ সালের দিকে আইরিশ জাতীয়তাবাদীরা মিত্রপক্ষের দেশগুলির বিরাগভাজন হয়।
ডেভিড লয়েড বলেন, শান্তি সম্মেলনে তিনি বসে ছিলেন যীশু খ্রিষ্ট এবং নেপোলিয়নের মাঝে বিধায় তার ভূমিকা তেমন খারাপ ছিল না। এর মাধ্যমে যেমন একদিকে উইলসনের আদর্শবাদীতার প্রকাশ ঘটে তেমনি অন্যদিকে ক্লেমঁসো-র অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ পায় যিনি জার্মানিকে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।[২৬]
অধীন দেশগুলির উপস্থিতি
ব্রিটিশদের অধীন দেশগুলিকে সম্মেলনের জন্য আলাদা কোন আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। বরং ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের অধীনে তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য বলা হয়।[২৭]
কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট বোর্ডেন মনে করতেন তার দেশ ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রগুলির অন্যতম বিধায় সম্মেলনে তিনি আলাদা আসন পাওয়ার যোগ্য। প্রাথমিকভাবে এই দাবীর বিপক্ষে শুধু ব্রিটিশরাই না, মার্কিনীরাও ছিল কারণ তারা ব্রিটিশ অধীন একটি দেশকে অতিরিক্ত ব্রিটিশ ভোট হিসেবে গণ্য করে। বোর্ডেন মনে করিয়ে দেন যে, কানাডা যুদ্ধে প্রায় ৬০,০০০ লোক হারিয়েছে যা মার্কিনীদের ৫০,০০০ লোকের অনুপাতে অনেক বেশি ছিল। অন্তত একারণে হলেও একটি ক্ষুদ্র শক্তির প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার তাঁর আছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ শীঘ্রই কিছুটা নমনীয় হন এবং কানাডা, ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউফাউন্ডল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিদের উপস্থিতির ব্যাপারে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করান। তারা লীগ অব নেশনসে তাদের নিজস্ব আসনও পান।[২৮]
কানাডা যদিও যুদ্ধে ৬০,০০০ লোক হারিয়েছিল, তথাপি তারা না কোন ক্ষতিপূরণ চেয়েছিল না চেয়েছিল কোন আদেশপত্র।[২৯]
প্রধানমন্ত্রী বিলি হিউজের (Billy Hughes) নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়ান প্রতিনিধিদল তাদের দাবীর (ক্ষতিপূরণ, জার্মান নিউ গিনির অন্তর্ভুক্তি এবং জাপানের জাতিগত সমতার প্রস্তাব প্রত্যাখান) পক্ষে কঠিন লড়াই করে। হিউ জাপানের উত্থান নিয়ে সচেতন ছিলেন। ১৯১৪ সালে যুদ্ধ ঘোষণার কয়েক মাসের মধ্যেই জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড দূরপ্রাচ্য এবং প্রশান্ত এলাকার জার্মান অধীন অংশ দখল করে নেয়। যদিও জাপান ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই এইসব এলাকার দখল নেয়, যেকারণে হিউ সচেতন হয়ে উঠেন।[৩০]
ফরাসি ভূমিকা
ফরাসি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমঁসো-র প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল জার্মানিকে সামরিক, কৌশলগত এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করা।[৩১][৩২] বিগত ৪০ বছরে দুই দুইবার ফ্রান্সের মাটিতে জার্মান আক্রমণের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন যাতে জার্মানরা পুনরায় আর আক্রমণ করতে না পারে। মূলত তিনি চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্য যেন এই নিশ্চয়তা দেয় যে ফ্রান্স পুনরায় কোন জার্মান আক্রমণের শিকার হলে তারা নিরাপত্তা দেবে।
এছাড়াও ক্লেমঁসো উইলসনের ১৪ দফার ব্যাপারে সংশয়ী এবং হতাশ ছিলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, "মিস্টার উইলসনের ১৪ দফা বিরক্তিকর। সর্বশক্তিমান খোদার আছে মাত্র ১০টি!" উইলসন ফ্রান্সের সাথে কিছু চুক্তিস্বাক্ষরের মাধ্যমে কিছু দফা জিতে নেন, কিন্তু পরবর্তীতে ওয়াশিংটনে ফিরে তিনি সিনেটের অনুমোদনের জন্যে তা উত্থাপন করেননি, ফলশ্রুতিতে তা কখনো বাস্তবায়ন হয়নি।[৩৩]
এছাড়া ফরাসিদের বিকল্প একটি নীতি ছিল জার্মানির সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। ১৯১৯ সালের মে মাসে রনে মাসিলি নামক একজন কূটনীতিককে বার্লিনে বারকয়েক গোপন মিশনে পাঠানো হয়। মিশনে থাকাকালীন মাসিলি তার সরকারের পক্ষ হয়ে আসন্ন শান্তিচুক্তির এলাকাভিত্তিক এবং অর্থনৈতিক দফাগুলি পুনরালোচনার প্রস্তাব দেন। তিনি ফ্রান্স এবং জার্মান কর্মকর্তাদের মাঝে "কার্যকরী আলোচনা"-র ব্যাপারে প্রস্তাব দেন।[৩৪] এছাড়াও মাসিলি জার্মানদের বলেন যে, ফ্রান্স মনে করে যুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মিলিত "অ্যাংলো-স্যাক্সন শক্তি" তার জন্যে সবচেয়ে বড় হুমকির কারণ হবে। তিনি মন্তব্য করেন যে, অ্যাংলো-স্যাক্সন শক্তির বিরোধিতা করা ফ্রান্স এবং জার্মানি উভয়ের জন্য অতিজরুরী এবং মনে করিয়ে দেন যে ফ্রান্স এবং জার্মানির মধ্যের "চরম বিরোধিতা" দুই দেশের জন্যই ক্ষতিকর যার ফলে উপকৃত হবে অ্যাংলো-স্যাক্সন শক্তি।[৩৫]
কিন্তু জার্মানরা ফরাসিদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা মনে করে যে, ফ্রান্সের প্রস্তাব আসলে তাদের ধোঁকা দিয়ে "ভের্সাই চুক্তি" অবিকৃত রাখার কৌশল। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাউন্ট উলরিখ ফন ব্রকডর্ফ-রান্টসাউ মনে করেতেন ফ্রান্সের[৩৫] তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র শান্তিচুক্তির কাঠিন্য কমাতে বেশি আগ্রহী। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় লয়েড জর্জ জার্মানির সুবিধার জন্যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন।
ইতালীয় ভূমিকা
জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার সাথে মিত্রতা সত্ত্বেও ১৯১৪ সালে ইতালি নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল। ১৯১৫ সালে তারা মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। এর পিছনে কারণ ছিল লন্ডনে মিত্রপক্ষের সাথে করা বিভিন্ন অঞ্চল দখলে একটি গোপন চুক্তি: ত্রেন্তো, ব্রেন্নেরো পর্যন্ত তিরোল, ত্রিয়েস্তে এবং ইসত্রিয়া, ফিউমে বাদে ডালমেশীয় উপকূলের বাকি এলাকা, ভালোনা এবং আলবেনিয়ার অধীন অঞ্চল, তুর্কির আনাতোলিয়া এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার উপনিবেশগুলি।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী ভিত্তোরিও এমানুয়েলে ওরলান্দো যুদ্ধের পূর্বে লন্ডনে করা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর প্রতি জনসমর্থন ছিল। যুদ্ধকালীন ৭ লক্ষ সৈন্যের মৃত্যু এবং ১২ শত কোটি (১২,০০০,০০০,০০০) লিরার বাজেট ঘাটতির ফলে সরকার এবং জনগণ এইসব (এমনকি লন্ডন চুক্তির চেয়েও বেশি) এলাকা নিজেদের অধিকার বলে মনে করে। অনেক ইতালীয়ই ফিউমে শহরটির ইতালীয় জনসংখ্যাধিক্যের কারণে একে ইতালির অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে মনে করত।[৩৬]
"বৃহৎ চারের" সাক্ষাতে ওরলান্দোর বেশিরভাগ কূটনীতি বিফলে যায় ইংরেজি জ্ঞানের অভাবে, যেখানে অন্যরা শুধু ত্রেন্তো থেকে ব্রেন্নেরো, ডালমেশীয় বন্দর জারার এবং স্বল্প কিছু ডালমেশীয় দ্বীপ দেয়ার পক্ষে ছিল। অন্য সকল অঞ্চল অন্যান্য দেশকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। বড় শক্তিগুলি ইতালির আধিপত্যবাদী উচ্চাশার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল। যদিও ইতালি তার দাবীর বেশিরভাগই পেয়েছিল, কিন্তু ওরলান্দোকে ফিউমে, ডালমেশিয়ার বেশিরভাগ এবং উপনিবেশগুলির অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ফলে তিনি রাগান্বিত হয়ে সম্মেলন ত্যাগ করেন।[৩৭]
এতে ইতালিতে একরকম হতাশার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। জাতীয়তাবাদী এবং ফ্যাসিবাদী দলগুলি প্রচার শুরু করে যে মিত্রপক্ষ ইতালির সাথে বিশ্বাসঘাতকা করেছে এবং তাদের দেনা পূর্ণ পরিশোধিত হয়নি। এর ফলশ্রুতিতে জাগরণ হয় ইতালীয় ফ্যাসিবাদের।
গ্রীক ভূমিকা
প্রধানমন্ত্রী এলেফথেরিয়োস ভেনিজেলোস (Eleftherios Venizelos) গ্রীসের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন প্যারিসে জড়ো হওয়া সকল প্রতিনিধিদের মধ্যে ভেনিজেলসকে শান্তিচুক্তির দফাগুলি সমাধানে সবচে এগিয়ে রাখেন। ভেনিজেলস থ্রেস এবং এশিয়া মাইনর (পরাজিত বুলগেরিয়া ও অটোমান সাম্রাজ্যের এলাকা), উত্তর এপিরাস, ইমভ্রস ও টেনেডস এ গ্রীসের সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেন যা ছিল মূলত মেগালি আইডিয়া(Megali Idea) বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য। এছাড়াও তিনি ইতালিয়ানদের সাথে ডোডেকেনিজ এর স্বত্বত্যাগের চুক্তি(ভেনিজলস- তিত্তনি চুক্তি) করেন। পন্টাসের গ্রিকদের জন্যে তিনি পন্টিক-আরমেনিয়ান রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেন। একজন উদারপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে, ভেনিজেলোস ছিলেন ১৪ দফা এবং লীগ অব নেশনস এর কট্টর সমর্থক।
জাপানের ভূমিকা
জাপান সাম্রাজ্যের পক্ষে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মার্কাস সায়নজি কিনমোচি (Saionji Kinmochi)-র নেতৃত্বে একটি বিশাল প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। তারা মূলত ছিল "বিগ ফাইভের" অন্যতম কিন্তু ইউরোপ সংক্রান্ত আগ্রহ কম থাকায় এই ভূমিকা পরিত্যাগ করে। এর পরিবর্তে তারা দুটি দাবীতে মনোনিবেশ করেঃ লীগের চুক্তিতে এর জাতিগত সমতার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তি এবং জার্মানির প্রাক্তন উপনিবেশগুলি যা সান্তাং(কিয়াচো সহ) নামে পরিচিত, বিষুবরেখার উত্তরের প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলির (মার্শাল দ্বীপ, মাইক্রোনেশিয়া, মারিয়ানা দ্বীপ, এবং ক্যারোলাইন) উপর জাপানের দাবী প্রতিষ্ঠা। কার্যত নেতৃত্বে ছিলেন মাকিনো যেখানে সায়নজির ভূমিকা ছিল প্রতীকী এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য সীমাবদ্ধ। জাপানি প্রতিনিধিদল শুধুমাত্র জার্মানির অর্ধেক পেয়ে অখুশী ছিল এবং তারা একারণে সম্মেলন বর্জন করে।[৩৮]
জাতিগত সমতা প্রস্তাব
জাপান ১৩ই ফেব্রুয়ারি লীগ অব নেশনস চুক্তির ২১নং অনুচ্ছেদে সংশোধনীর মাধ্যমে "জাতিগত সমতা দফা" অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেয়।[৩৯] যাতে বলা ছিলঃ
লীগ অব নেশনসের দেশগুলির মূলনীতি হবে সকল দেশের মাঝে সমতা। উচ্চ পক্ষের সবাই জাতিগত কিংবা দেশগত ভিন্নতা সত্ত্বেও সঙ্গতি রেখে যত দ্রুত সম্ভব লীগের সদস্য সকল ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে সমান সম্মান বজায় রেখে আচরণ করবে।
যেহেতু কনফারেন্সের চেয়ারম্যান, প্রেসিডেন্ট উইলসন জানতেন যে যুক্তরাজ্য এই সিদ্ধান্তের ঘোরতর বিরোধী, তাই তিনি সবার অংশগ্রহণে সার্বজনীন ভোটের পক্ষে রায় দিলেন। ১৯১৯ সালের ১১ এপ্রিল কমিশনের শেষ সেশনে এই প্রস্তাব বিপুল ভোট পায়, কিন্তু যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়া এর বিরোধিতা করে। অস্ট্রেলীয়্রা যুক্তরাজ্যের পক্ষ নেয় মূলত অস্ট্রেলিয়ার "শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়া নীতি" রক্ষা করার জন্য। এই প্রস্তাবের পরাজয়ের ফলে জাপান পশ্চিমাদের সহযোগিতা করা থেকে সরে নিজেদের জাতীয়তাবাদী নীতিমালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।[৪০]
ভূমি সংক্রান্ত দাবী
জাপানিরা দাবী করে সান্টাংকে চীনারা বিতর্কিত করেছে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় জাপান ১৮৯৭ সালে জার্মানিকে প্রদান করা এলাকা দখল করে নেয়। ১৯১৭ সালে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ইতালির সাথে গোপন এক চুক্তিতে জাপানকে এইসব এলাকা দখলের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। যুক্তরাজ্যের সাথে জাপানের পারস্পরিক চুক্তি ছিল। জাপান প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের দক্ষিণ এলাকায় ব্রিটিশ দখলদারিত্বকে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে রাজি হয়। মার্কিন প্রতিনিধিদলের চীনের পক্ষে মত থাকলেও, ভের্সাই চুক্তির ১৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জার্মানি অধিকৃত চীনের জিয়াওযু এলাকা, স্বাধীন সার্বভৌম চীনের কর্তৃপক্ষের হাতে না দিয়ে জাপানের হাতে তুলে দেয়া হয়। চীনা প্রতিনিধিদলের নেতা লৌ চেং-চিয়াং (Lou Tseng-Tsiang) স্বাক্ষর করার পূর্বে এই সিদ্ধান্ত আটকে রাখার দাবী করেন। কিন্তু তার দাবী বাতিল করে চীন ব্যতীত সকল প্রতিনিধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই গর্হিত সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় চীনে ব্যাপক প্রতিবাদ হয় যা "৪ঠা মে আন্দোলন" নামে পরিচিত। এর ফলে বিষুবরেখার উত্তরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চল ক্লাস সি আদেশ অনুযায়ী জাপানের অধীনে চলে যায়।[৪১]
চীনের ভূমিকা
চীনা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন লৌ চেং-চিয়াং যার সহযোগী হিসেবে ছিলেন ওয়েলিংটন কু এবং চাও রুলিং। পশ্চিমা শক্তির পূর্বেই, কু জার্মানির দখল করা স্যানডং প্রদেশ চীনের কাছে ফিরিয়ে দেবার দাবী করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বিদেশের মাটিতে সেদেশের আইনের আওতার বাইরে থাকা, নিজস্ব বাহিনী থাকা এবং বিদেশের মাটি ইজারা দেওয়া বন্ধ করার আহবান জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ প্রদর্শনীর পরও পশ্চিমা শক্তিগুলি তার এই দাবী প্রত্যাখ্যান করে জার্মান অধিকৃত অঞ্চল জাপানের হাতে তুলে দেয়। যার প্রতিক্রিয়ায় ৪ঠা মে চীনে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ হয় (৪ঠা মে আন্দোলন নামে পরিচিত) এবং সরকারের উপর ভের্সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যানের চাপ বাড়তে থাকে। একারণে প্যারিস শান্তি সম্মেলনের চুক্তিস্বাক্ষর অনুষ্ঠানে চাইনিজ প্রতিনিধিদলই একমাত্র চুক্তি স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকে।[৪২]
স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন
সমগ্র রুশ সরকার (শ্বেতাঙ্গ)
আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়াকে সম্মেলন থেকে বাদ রাখা হলেও, কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে তিন বছর ধরে লড়ে যাওয়া,[৪৩] গণপরিষদের উত্তরাধিকারী এবং রাশিয়ার শ্বেতাঙ্গ আন্দোলনের রাজনৈতিক শাখা- রুশ প্রাদেশিক কাউন্সিল (প্রিন্স লেভভ এর নেতৃত্বাধীন) সম্মেলনে উপস্থিত ছিল। প্রতিনিধিত্বে ছিলেন সাবেক জার আমলের মন্ত্রী সের্গেই জাজনভ(Sergey Sazonov)। পরিহাসের বিষয় হল, যদি জারের পতন নাও হত তিনিই রাশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে উপস্থিত থাকতেন। কাউন্সিল অবিভক্ত রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, যদিও কেউ কেউ পোল্যান্ড এবং ফিনল্যান্ড হারানোর বিষয়টি মধ্যস্থতায় প্রস্তুত ছিল।[৪৪] কাউন্সিল এলাকাভিত্তিক সকল দাবির ব্যাপারে অথবা সাবেক রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বায়ত্বশাসন বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়।
ইউক্রেন
১৯১৯ সালের সম্মেলন ছিল ইউক্রেনের জন্য বিদেশী শক্তিগুলোর থেকে স্বীকৃতি এবং সমর্থন পাওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ।[৪৫] ১৬ জানুয়ারি "বৃহৎ পাঁচের" সাথে এক সাক্ষাতে লয়েড জর্জ ইউক্রেনের নেতা সাইমন পেতলিউরাকে (১৮৭৪-১৯২৬) একজন দুঃসাহসী ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি ইউক্রেনকে বলশেভিক বিরোধী দুর্গ হিসেবে অগ্রাহ্য করেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্যার এইরি ক্রো পোল্যান্ড এবং পূর্ব গালিসিয়ার একত্রীকরণের বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ঠিকই করতে পারে নি যে তারা অভিভক্ত রাশিয়াকে সমর্থন করবে নাকি বিভক্ত রাশিয়াকে করবে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সাথে ভারসাম্য বজায়ের জন্য অভিভক্ত শক্তিশালী রাশিয়ার পক্ষপাতি ছিল, কিন্তু ব্রিটেন ছিল ইন্ডিয়ার হুমকির ভয়ে। পেতলিউরা কাউন্ট তেস্কিভিচকে ভ্যাটিকানে তার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান, এবং পোপ পঞ্চদশ বেনেডিক্ট ইউক্রেনের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেন। কার্যকরভাবে ইউক্রেন ছিল মূলত উপেক্ষিত।[৪৬]
বেলারুশ
বেলারুশিয়ান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী আন্টন লুকিভিচ (Anton Łuckievič) এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বেলারুশের স্বাধীনতার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা। সম্মেলনের পথিমধ্যে চেকোস্লোভাক রাষ্ট্রপতি থমাস মাসারিক প্রতিনিধিদলকে প্রাগে অভ্যর্থনা জানান। সম্মেলনের মাঝে লুকিভিচ নির্বাসিত এডমিরাল কোলসাকের রাশিয়ান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই সেজেনভ এবং পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইগনাচি ইয়ান পেদেরেওস্কির সাথে সাক্ষাৎ করেন।[৪৭]
পোল্যান্ড এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের অধিকার
রাষ্ট্রপতি উইলসনের দৃঢ়তায় ১৯১৯ সালের ২৮শে জুন বৃহৎ চার পোল্যান্ডকে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করায় যেখানে নতুন দেশ হিসেবে সংখ্যালঘুদের অধিকারে বিষটি নিশ্চিত করা হয়েছিল। পোল্যান্ড প্রতিবাদের মুখে স্বাক্ষর করলেও জার্মান, ইহুদী, ইউক্রেনিয়ান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রয়োজনীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় তেমন কোন চেষ্টাই করেনি। একই চুক্তি চেকোস্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, যুগোস্লোভিয়া, গ্রীস, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া এবং পরবর্তীতে লাটভিয়া, এস্তোনিয়া ও লিথুয়ানিয়া স্বাক্ষর করে। ফিনল্যান্ড এবং জার্মানিকে সংখ্যালঘু অধিকার চুক্তি স্বাক্ষরে কোন চাপ দেয়া হয়নি।[৪৮]
পোল্যান্ডে মূল বিধানগুলি আইন-সংক্রান্ত সকল বিধিবিধানকে বাতিল করে মৌলিক আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সদ্য নতুন দেশটি অঙ্গীকার করে "জন্ম, জাতীয়তা, ভাষা, বর্ণ কিংবা ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা"। ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে সবাইকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়। বেশিরভাগ অধিবাসীদের নাগরিকত্ব দেয়া হলেও এই প্রক্রিয়ার মাঝেও ধোঁয়াশা থেকে যায়। এই চুক্তি নিশ্চয়তা দেয় মৌলিক নাগরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের, আইনের চোখে সকল নাগরিককে সমান অধিকারের এবং নাগরিক ও শ্রমিকদের সমঅধিকার ভোগ করার। জাতীয় ভাষা হয় পোলিশ, কিন্তু চুক্তি নিশ্চয়তা দেয় সংখ্যালঘুরা তাদের ভাষা প্রয়োজনমত ব্যক্তিগতভাবে, ব্যবসায়, ধর্ম পালনে, সংবাদে, জনসভায় এবং সকল আদালতের সামনে ব্যবহার করতে পারবে। সংখ্যালঘুরা সরকারের কোন বাধা ছাড়াই তাদের নিজস্ব খরচে এবং নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত দাতব্য সংস্থা, উপাসনালয় এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান- যেমন বিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারবে। সরকার যুদ্ধপূর্ব জার্মান অধ্যুষিত অঞ্চলে জার্মান ভাষাভিত্তিক পাবলিক বিদ্যালয় তৈরির উদ্যোগ নেয়। প্রাথমিকের পর থেকে সকল শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ জাতীয় ভাষাভিত্তিক। ১২নং অনুচ্ছেদে প্রয়োগকারী দফাটি অন্তর্ভুক্তি হয়। এর ফলে লীগ অব নেশনস কাউন্সিল চুক্তি বাস্তবায়ন এবং পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পায়।[৪৯][৫০]
ককেশাস
তিনটি ককেশিয়ান প্রজাতন্ত্র- আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং জর্জিয়া স্বীকৃতি লাভ করে। আর্মেনিয়ান প্রতিনিধিদলে ছিলেন আভেতিস আহারনয়ান(Avetis Aharonyan), হামো ওহানজানয়ান(Hamo Ohanjanyan), আর্মেন গারো(Armen Garo) এবং অন্যান্যরা। আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন আলিমর্দান তপচুবাশেভ(Alimardan Topchubashev)।
কোরিয়ান প্রতিধিদল
যেহেতু জাপান জবরদস্তি করে পহেলা মার্চের আন্দোলন নড়বড়ে করে দিয়েছিল, সেজন্যে কোরিয়ানদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার সুযোগ কমে গিয়েছিল। কোরিয়ান, জাপান, চীন এবং হাওয়াই থেকে একটি প্রতিনিধিদল প্যারিস পর্যন্ত পৌঁছুতে সক্ষম হয়। প্রতিনিধিদলে সাংহাইয়ের কোরিয়ান অস্থায়ী সরকারের পক্ষে কিম কিউ-সিক ছিলেন। জাপানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে চাইনিজরা তাদেরকে পিছন থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। সান ইয়াত সেনসহ সেসময়কার অনেক শীর্ষ চাইনিজ নেতা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের কোরিয়ান স্বাধীনতার বিষয়টি শান্তি সম্মেলনে উত্থাপনের প্রস্তাব দেন। বাস্তবে চাইনিজরা নিজেরাই জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যস্ত থাকায় কোরিয়ার জন্য বেশি কিছু করতে পারছিল না। জাপানের উপনিবেশ হওয়ায় চীন ব্যাতিরেকে আর কোন দেশই কোরিয়াকে তেমন গুরুত্ব দেয় নি। কোরিয়ান জাতীয়তাবাদীরা প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ব্যর্থ হওয়ায় বিদেশী সমর্থনের সকল সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে যায়।[৫১]
ফিলিস্তিন
১৯১৯ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি সম্মেলনে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে প্রাক্তন আরব প্রদেশগুলি বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত এবং নতুন গৃহীত আদেশপত্র বাস্তবায়নের জন্য ইহুদিরাষ্ট্রপন্থী সংগঠন তাদের খসড়া সমাধান উত্থাপন করে।[৫২]
খসড়াতে মূল দফা ছিল ৫টি:
- ফিলিস্তিনে ইহুদী সম্প্রদায় ইতিহাস এবং সেখানে তাদের জাতীয় আবাস করার অধিকারের স্বীকৃতি।
- সঠিক সময়ের মধ্যেই ফিলিস্তিনের সীমানা নির্ধারণ।
- ফিলিস্তিনের সার্বভৌম অধিকার লীগ অব নেশনসের অধীনের প্রদান এবং সরকারকে অত্যাবশ্যকভাবে গ্রেট ব্রিটেনের কাছে ন্যস্ত করা।
- অন্যান্য বিধানগুলি ফিলিস্তিনের সুবিধানুযায়ী আদেশপত্রের অংশ হিসেবে উচ্চ পার্টিগুলির দ্বারা অন্তর্ভুক্তি করা।
- আদেশপত্রে আরও কিছু বিশেষ শর্ত আরোপ যেমনঃ
- ইহুদী অভিবাসনের উন্নয়ন, ভূমিতে বসতি স্থাপন এবং বর্তমান অ-ইহুদীদের অধিকার রক্ষা।
- ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় আবাসন উন্নয়নে এবং কোন সর্বজনীন কাজে কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নে ইহুদী পরিষদের একজন প্রতিনিধি থাকা।
- স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত সরকার।
- ধর্মীয় উপাসনায় স্বাধীনতা। অধিবাসীদের মাঝে নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার, ধর্ম কিংবা বর্ণের কারণে কোন বৈষম্য করা যাবে না।
- পবিত্র ভূমিগুলির নিয়ন্ত্রণ অধিকার।
সম্মেলনকে প্রভাবিত করার বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইহুদীরাষ্ট্রপন্থীরা ফিলিস্তিন আদেশপত্র অনুচ্ছেদ ৭ এর কারণে ফিলিস্তিনের নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যাপারে বাধাপ্রাপ্ত হয়। "ফিলিস্তিনের প্রশাসন জাতীয়তা আইন বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে। সেখানে কিছু আইনি দফা থাকবে যার ফলে যেসব ইহুদী স্থায়ীভাবে ফিলিস্তিনে থাকবে তাদের ফিলিস্তিনের নাগরিকত্ব অর্জনের সুবিধা প্রদান।"[৫৩]
বেলফোরের ঘোষণাকে উদ্ধৃতি করে ইহুদীরাষ্ট্রপন্থীরা প্রস্তাব দেয় যে, ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে ইহুদীদের ঐতিহাসিক খেতাব স্বীকার করে নিয়েছে। ১৯২২ সালের ব্রিটিশ প্রস্তাবনা অনুযায়ী(যেখানে বেলফোরের ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল) উল্লেখ করা আছে যেঃ "যেহেতু ইহুদী এবং ফিলিস্তিনের মাঝে ঐতিহাসিক সংযোগ বিদ্যমান এবং সেই দেশের ভূমিতে তাদের জাতীয় আবাস পুনস্থাপনে স্বীকৃতি দেয়া হল..."[৫৪]
ঐতিহাসিক মূল্যায়ন
এই সম্মেলনে বিশ্ব মানচিত্র পুনর্গঠনেr ফলে অসংখ্য সংকটপূর্ণ আন্তর্জাতিক অসঙ্গতির অবতারণা হয় যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার অন্যতম কারণ। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এরিক হবসবাম উল্লেখ করেন যে
পূর্বে এবং পরবর্তীতে ইউরোপে জাতীয় সীমানা অনুযায়ী কোন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রণয়নের চেষ্টা করা হয় নি। একটি মহাদেশ গঠনের চেষ্টা- যেখানে অসংখ্য সংলগ্ন এলাকা আছে যাতে বিভিন্ন জাতীয় এবং ভাষাগত গোষ্ঠী আছে, মূলত বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের বিনাশের কারণ হয়। সত্যিকার অর্থে এটি ছিল জাতীয়তাবাদের অর্থহীনতা থেকে হ্রাসের স্থানীয় সংস্করণ। যদিও ১৯৪০ সালের আগে এটি পুরোপুরি প্রদর্শিত হয় নি।[৫৫]
উইলসনের ১৪দফা অনেক দিন ধরেই বিতর্কিত ছিল, সঠিকভাবে বললে জাতীয়তাবাদী স্ব-নিয়তিবাদের নীতি ছিল মূলত বাম-বিরোধী পদক্ষেপ। বানান হয়েছিল অক্টোবর আন্দোলনের ফলে ইউরোপ জুড়ে বিপ্লবের ধাক্কা শান্ত করতে এবং জাতীয়তাবাদের তাস ব্যবহার করে যুদ্ধের সমাপ্তি করতে।[৫৬]
সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ
- পৃথিবীর সমাপ্তি - World's End (১৯৪০) - আপটন সিনক্লেয়ারের পুলিতজার জয়ী লেনি বাড সিরিজের প্রথম উপন্যাস। বইয়ের দ্বিতীয় অংশে সিনক্লেয়ারের বর্ণনায় অসংখ্য ঐতিহাসিকভাবে সঠিক চরিত্র এবং ঘটনা অনুযায়ী প্যারিস শান্তি সম্মেলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক কূটকৌশল এবং এর পরিণতির বর্ণনা আছে।
- ঔপন্যাসিক রবার্ট গডার্ড (Robert Goddard)-এর প্রথম দুইটি বই বিশ্বের উপায় এবং পৃথিবীর কোণায় (The Ways of the World and The Corners of the Globe) মূলত সম্মেলনে পর্দার পিছনের সকল কলাকৌশলের উপর আলোকপাত করেছে।
- প্যারিস ১৯১৯ - Paris 1919 (১৯৭৩) - ওয়েলস সুরকার জন কেইল (John Cale) এর তৃতীয় স্টুডিও এলবামের নাম প্যারিস শান্তি সম্মেলন অনুযায়ী রাখা হয়। এর শিরোনাম গানে পশ্চিম ইউরোপে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের অনেক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়।
- বিপজ্জনক ব্যক্তিঃ এরাবিয়ার লরেন্স- A Dangerous Man: Lawrence After Arabia (১৯৯২) - একটি ব্রিটিশ টেলিভিশন সিনেমা যেখানে টি. ই. লরেন্সের ভূমিকায় রালফ ফিন (Ralph Fienne) এবং আমির ফয়সাল চরিত্রে আলেকজাডার সিডিগ (Alexander Siddig) ছিলেন এবং এটি মূলত চিত্রিত করে একটি নিরাপদ স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের জন্য তাদের সংগ্রাম।
- ১৯৯৩ সালের দ্য ইয়াং ইন্ডিয়ানা জোন্স ক্রনিকলস (The Young Indiana Jones Chronicles) এর পর্ব ছিল "প্যারিস. মে ১৯১৯"। যা লিখেছিলেন জোনাথন হেলস (Jonathan Hales) এবং প্রযোজনা করেছিলেন ডেভিড হেয়ার (David Hare), যেখানে ইণ্ডিয়ানা জোন্সকে দেখা যায় প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আমেরিকান প্রতিনিধিদলের অনুবাদক হিসেবে।
তথ্যসূত্র
আরও পড়ুন
- Albrecht-Carrie, Rene. Italy at the Paris Peace Conference (1938) অনলাইন সংস্করণ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ জুন ২০১১ তারিখে (ইংরেজি)
- Ambrosius, Lloyd E. Woodrow Wilson and the American Diplomatic Tradition: The Treaty Fight in Perspective (1990) উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Andelman, David A. A Shattered Peace: Versailles 1919 and the Price We Pay Today (2007) popular history that stresses multiple long-term disasters caused by Treaty. উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Bailey; Thomas A. Wilson and the Peacemakers: Combining Woodrow Wilson and the Lost Peace and Woodrow Wilson and the Great Betrayal (1947) অনলাইন সংস্করণ (ইংরেজি)
- Birdsall, Paul. Versailles twenty years after (1941) well balanced older account
- Boemeke, Manfred F., et al., eds. The Treaty of Versailles: A Reassessment after 75 Years (1998). major collection of important papers by scholars উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Bruce, Scot David, Woodrow Wilson's Colonial Emissary: Edward M. House and the Origins of the Mandate System, 1917–1919 (University of Nebraska Press, 2013).
- Clements, Kendrick, A. Woodrow Wilson: World Statesman (1999) উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Cooper, John Milton. Woodrow Wilson: A Biography (2009), scholarly biography; pp 439–532 উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Dillon, Emile Joseph. The Inside Story of the Peace Conference, (1920) online (ইংরেজি)
- Dockrill, Michael, and John Fisher. The Paris Peace Conference, 1919: Peace Without Victory? (Springer, 2016).
- Ferguson, Niall. The Pity of War: Explaining World War One (1999), economics issues at Paris pp 395–432
- Doumanis, Nicholas, ed. The Oxford Handbook of European History, 1914–1945 (2016) ch 9.
- Fromkin, David. A Peace to End All Peace, The Fall of the Ottoman Empire and the Creation of the Modern Middle East, Macmillan 1989.
- Gaddis, John Lewis (২০০৫)। The Cold War (ইংরেজি ভাষায়)। London: Allen Lane। আইএসবিএন 978-0-713-99912-9।
- Gelfand, Lawrence Emerson. The Inquiry: American Preparations for Peace, 1917–1919 (Yale UP, 1963).
- Ginneken, Anique H.M. van. Historical Dictionary of the League of Nations (2006) উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Henig, Ruth. Versailles and After: 1919–1933 (2nd ed. 1995), 100 pages; brief introduction by scholar উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Hobsbawm, E. J. (১৯৯২)। Nations and Nationalism since 1780: Programme, Myth, Reality। Canto (ইংরেজি ভাষায়) (2nd সংস্করণ)। Cambridge: Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-43961-9।
- Hobsbawm, E.J. (১৯৯৪)। The Age of Extremes: The Short Twentieth Century, 1914–1991 (ইংরেজি ভাষায়)। London: Michael Joseph। আইএসবিএন 978-0718133078।
- Keynes, John Maynard, The Economic Consequences of the Peace (1920) famous criticism by leading economist full text online (ইংরেজি)
- Dimitri Kitsikis, Le rôle des experts à la Conférence de la Paix de 1919, Ottawa, éditions de l'université d'Ottawa, 1972.
- Dimitri Kitsikis, Propagande et pressions en politique internationale. La Grèce et ses revendications à la Conférence de la Paix, 1919–1920, Paris, Presses universitaires de France, 1963.
- Knock, Thomas J. To End All Wars: Woodrow Wilson and the Quest for a New World Order (1995) উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Lederer, Ivo J., ed. The Versailles Settlement—Was It Foredoomed to Failure? (1960) short excerpts from scholars অনলাইন সংস্করণ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ জুন ২০১১ তারিখে (ইংরেজি)
- Lentin, Antony. Guilt at Versailles: Lloyd George and the Pre-history of Appeasement (1985)
- Lentin, Antony. Lloyd George and the Lost Peace: From Versailles to Hitler, 1919–1940 (2004)
- McFadden, David W. (১৯৯৩)। Alternative Paths: Soviets and Americans, 1917–1920 (ইংরেজি ভাষায়)। New York, NY: Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-195-36115-5।
- Macmillan, Margaret. Peacemakers: The Paris Peace Conference of 1919 and Its Attempt to End War (2002), also published as Paris 1919: Six Months That Changed the World (2003); influential survey উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Mayer, Arno J. (১৯৬৭)। Politics and Diplomacy of Peacemaking: Containment and Counterrevolution at Versailles, 1918–1919 (ইংরেজি ভাষায়)। New York, NY: Alfred A. Knopf।
- Nicolson, Harold (২০০৯) [1933]। Peacemaking, 1919 (ইংরেজি ভাষায়)। London: Faber and Faber। আইএসবিএন 978-0-571-25604-4। ৩০ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ মার্চ ২০১৭।
- Paxton, Robert O., and Julie Hessler. Europe in the Twentieth Century (2011) pp 141–78 উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Marks, Sally. The Illusion of Peace: International Relations in Europe 1918–1933 (2nd ed. 2003)
- Mayer, Arno J., Politics and Diplomacy of Peacemaking: Containment and Counter-revolution at Versailles, 1918–1919 (1967), leftist
- Newton, Douglas. British Policy and the Weimar Republic, 1918–1919 (1997). 484 pgs.
- Pellegrino, Anthony; Dean Lee, Christopher; Alex (২০১২)। "Historical Thinking through Classroom Simulation: 1919 Paris Peace Conference"। The Clearing House: A Journal of Educational Strategies, Issues and Ideas (ইংরেজি ভাষায়)। 85 (4): 146–152।
- Roberts, Priscilla. "Wilson, Europe's Colonial Empires, and the Issue of Imperialism," in Ross A. Kennedy, ed., A Companion to Woodrow Wilson (2013) pp: 492–517.
- Schwabe, Klaus. Woodrow Wilson, Revolutionary Germany, and Peacemaking, 1918–1919: Missionary Diplomacy and the Realities of Power (1985) অনলাইন সংস্করণ
- Sharp, Alan. The Versailles Settlement: Peacemaking after the First World War, 1919–1923 (2nd ed. 2008)
- Sharp, Alan (২০০৫)। "The Enforcement Of The Treaty Of Versailles, 1919–1923"। Diplomacy and Statecraft (ইংরেজি ভাষায়)। 16 (3): 423–438। ডিওআই:10.1080/09592290500207677।
- Naoko Shimazu (1998), Japan, Race and Equality, Routledge, আইএসবিএন ০-৪১৫-১৭২০৭-১
- Steiner, Zara. The Lights that Failed: European International History 1919–1933 (Oxford History of Modern Europe) (2007), pp 15–79; major scholarly work উদ্ধৃতাংশ ও পাঠ্য অনুসন্ধান (ইংরেজি)
- Trachtenberg, Marc (১৯৭৯)। "Reparations at the Paris Peace Conference"। The Journal of Modern History (ইংরেজি ভাষায়)। 51 (1): 24–55। জেস্টোর 1877867। ডিওআই:10.1086/241847।
- Walworth, Arthur. Wilson and His Peacemakers: American Diplomacy at the Paris Peace Conference, 1919 (1986) 618pp অনলাইন সংস্করণ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ জুন ২০১১ তারিখে (ইংরেজি)
- Watson, David Robin. George Clemenceau: A Political Biography (1976) 463 pgs. অনলাইন সংস্করণ[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] (ইংরেজি)
বহিঃসংযোগ
- NFB তথ্যচিত্র থেকে উদ্ধৃতাংশ প্যারিস ১৯১৯ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে (ইংরেজি)
- আমেরিকান জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি লাইব্রেরি কর্তৃক গৃহীত মার্কিন প্রতিনিধিদের দ্বারা ব্যবহৃত মানচিত্রের নমুনা, ইউডব্লিউ মিলওয়াকী (ইংরেজি)