প্রথম বিশ্ব

প্রথম বিশ্ব বলতে সেইসব দেশ বা অঞ্চলকেই বোঝায় যারা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে উন্নত ও পুঁজিবাদী বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত। অক্সফোর্ড অভিধান অনুসারে প্রথম বিশ্ব বলতে বোঝানো হয়েছে পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত শিল্পোন্নত ও পুঁজিবাদী দেশসমূহ।[১]

শীতল যুদ্ধ যুগের তৃতীয় বিশ্ব, এপ্রিল ১৯৭৫ সাল থেকে অগাস্ট ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সায়গনের পতন ও লাওস রাজ্যের সমাজতান্ত্রীক অধিভুক্তকরণ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
  প্রথম বিশ্ব: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্রসমূহ।
  দ্বিতীয় বিশ্ব: সোভিয়েত ইউনিয়ান, চীন ও তাদের মিত্রসমূহ।
  তৃতীয় বিশ্ব: নিরপেক্ষ এবং জোট-নিরপেক্ষ দেশসমূহ

প্রথম বিশ্বের এই ধারণাটা প্রথমে উদ্ভূত হয় পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতলযুদ্ধ চলাকালে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রথম বিশ্বকে সংগায়িত করা হয় যে সব দেশের জীবনযাত্রার মান উচ্চ, অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, আইনের শাসন, কার্যকরী গণতন্ত্র বিদ্যমান ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকির মধ্যে নেই বললেই চলে সেই সব দেশকে। মানব উন্নয়ন সূচক, শিক্ষার হার, জিপিপি, জিএনপি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে নির্ণয় হয় কোন দেশগুলো আধুনিক প্রথম বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত।[২] সাধারণভাবে, প্রথম বিশ্ব মানে হচ্ছে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলো।[৩]

ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব প্রায় দুইভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী শক্তি এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ। যা শীতল বা স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করে এই দুই ব্লকের মধ্যে। তখন থেকেই প্রথম বিশ্বের ধারণাটি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকক্ষেত্র বিবেচনায় নিয়ে নিরূপণ করা হয়। যদিও ১৯৪০ সালের দিকে জাতিসংঘ নিজেই প্রথমে এই প্রথম বিশ্বের ধারণাটির সূচনা করেন।[৪]

বর্তমানে প্রথম বিশ্বের ধারণাটা কিছুটা সেকেলে হয়ে গেছে। তথাপিও এটি বলতে বোঝায় পুঁজিবাদী, শিল্পোন্নত, সম্পদশালী ও উন্নত দেশগুলো। এই সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান এবং বেশির ভাগ উত্তর আমেরিকার ও ইউরোপের দেশগুলো।[৫] বর্তমান বিশ্ব সমাজে প্রথম বিশ্ব বিবেচনা করা হয় সেই সব দেশগুলোকে যে সব দেশের অর্থনীতি অধিক উন্নত, যাদের বিশ্বের অপরাপর দেশের উপর প্রভাব রয়েছে, যাদের জীবনযাত্রার মান অতিউচ্চ, এবং যে দেশগুলো প্রযুক্তিতে অনেক উন্নত।[৫] শীতল যুদ্ধের পর প্রথম বিশ্বের এই দেশগুলো ন্যাটো সদস্যভুক্ত হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী ধারণার সমর্থক ছিল, নিরপেক্ষ দেশগুলো যারা উন্নত ও শিল্পোন্নত ছিল, এবং সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত দেশসমূহ যাদের শিল্পোন্নত বিবেচনা করা হয়। সেই হিসেবে ইউরোপ সাথে সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত ধনী দেশসমূহ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, এবং জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। একটি দেশ কতটা সভ্য সেই বিবেচনায়ও প্রথম বিশ্বকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। নেশন অনলাইন অনুসারে, শীতল যুদ্ধের পর ন্যাটোভুক্ত দেশসমূহঃ [৫]

পশ্চিমা ধারণাভুক্ত দেশের অন্তর্গতঃ

নিরপেক্ষ দেশের অন্তর্গতঃ

সংজ্ঞার পরিবর্তন

যেহেতু শীতল যুদ্ধের পরে 'প্রথম বিশ্ব' শব্দবন্ধটা আর তেমন একটা কার্যকরীভাবে প্রযোজ্য হয় না। ফলে প্রথম বিশ্বের অনেক প্রকার সংজ্ঞা নিরূপিত হয়েছে, যদিও সবগুলোই একই ধারণা পোষন করে। জন ডি দানিয়েলস, একাডেমি অব ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রথম বিশ্বকে বলেছেন, 'উচ্চ-আয়ের শিল্পোন্নত দেশসমূহ'।[৬] স্কলার ও প্রফেসর জর্জ জে ব্রায়জাক প্রথম বিশ্ব বলতে দেখিয়েছেন, 'আধুনিক, শিল্পোন্নত উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশসমূহ'।[৭] যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির ইনফরমেশন এজেন্সি ও মেরিডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের সাবেক পরিচালক এল রবার্ট কোল এর মতে, 'প্রথম বিশ্ব' শব্দবন্ধটি 'পরিপূর্ণভাবে উন্নত' শব্দবন্ধের সমার্থক।[৮]

অন্যান্য সূচকগুলো

'প্রথম বিশ্ব' এই টার্মের সংজ্ঞার ভিন্নতার এবং দ্যার্থবোধকতার কারণে বর্তমানে এটি ভিন্ন আঙ্গিকে রূপায়িত হচ্ছে। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ দেশগুলোর সম্পদের প্রাপ্যতার উপর ভিত্তি করে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বিশ্বের অবতারণা করেছিল।[৯][১০] এটি আরও বিভিন্ন দিক থেকে দেখা যায়। কেউ কেউ এটিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন সামাজিক-রাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় রেখে জিএনপি'র (সামষ্টিক জাতীয় আয়) উপর ভিত্তি করে যা মার্কিন ডলারে হিসাব করা হয়।[৯] প্রথম বিশ্বর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ভারী শিল্পে উন্নত, গণতান্ত্রীক দেশসমূহ।[৯] দ্বিতীয় বিশ্বর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আধুনিক, সম্পদশালী, শিল্পোন্নত দেশসমূহ; কিন্তু যারা সমাজতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।[৯] বাকি বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই তৃতীয় বিশ্বর অন্তর্ভুক্ত; আর চতুর্থ বিশ্বর দেশ বলতে তাদেরকেই বুঝায় যাদের মাথাপিছু আয় বার্ষিক ১০০ ডলারের নিচে।[৯]

তিন বিশ্ব মডেল

NATO Countries

প্রকৃতপক্ষে, প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব, এবং তৃতীয় বিশ্ব এই টার্মগুলি ব্যবহারিত হয়েছে বিশ্বকে তিনটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করার জন্য। এগুলো আকস্মিকভাবে উদ্ভূত হয় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে 'শীতল যুদ্ধ' চলাকালে বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতার প্রতিযোগিতার ফসল হিসেবে এইসব নামের আবির্ভাব। তারা দুইটি ক্যাম্প বা ব্লক সৃষ্টি করেছিল নিজেদের সুবিধার জন্য। এই ব্লকগুলো গঠিত হয়েছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের ধারণার উপর ভিত্তি করে।[১১]

স্নায়ুযদ্ধ বা শীতল যুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে যথাক্রমে ন্যাটোওয়ারশ প্যাক্ট নামে দুইটি ব্লক গঠিত হয়েছিল । এই দুই ব্লককের অন্যভাবেও ডাকা হত। যাদের একটিকে বলা হত ন্যাটো বা পশ্চিমা ব্লক ও অন্যটিকে বলা হত ওয়ারশ প্যাক্ট বা পূর্ব ব্লক। অবস্থাগত দিক থেকে এগুলো ছিল দুইটি ভিন্ন ধরনের ব্লক এবং বলতে গেলে এগুলো ছিল দুইটি পৃথিবী, যদিও তাদেরকে এক নম্বর ও দুই নম্বর হিসেবে গনণা করা হয় নি। [১২][১৩][১৪] উইনস্টন চার্চিল'র বিখ্যাত লৌহ পর্দা বা আয়রন কার্টন বক্তৃতা থেকে শীতল যুদ্ধের সূচনা বিবেচিত হয়।[১৫] তার বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, পশ্চিম ও পূর্বের বিভক্তি একটি দৃঢ বাস্তবতা যা তিনি 'আয়রন কার্টন বা লৌহ পর্দা' বলে অভিহিত করেছেন। [১৫]

১৯৫২ সালে ফ্রেঞ্চ জনসংখ্যাতাত্ত্বিকবিদ আলফ্রেড সোভে বিপ্লব-পূর্ব ফ্রান্সের তিনটি রাজ্যের অবস্থা্র প্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্ব নামটি উল্লেখ করেছিলেন।[১৬] প্রথম দুই এস্টেট হচ্ছে অভিজাত ও যাজকগোষ্ঠীর এবং বাকি সব হচ্ছে তৃতীয় এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত।[১৬] তিনি পুঁজিবাদী বিশ্বকে (প্রথম বিশ্ব) অভিজাত ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে (দ্বিতীয় বিশ্ব) তুলনা করেছেন যাজক সম্প্রদায়দের সাথে; আর বাকিদের তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সোভে তৃতীয় বিশ্বকে দেখিয়েছেন যে সব দেশ শীতল যুদ্ধে জড়ায় নি বা পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্বে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নি।[১৬][১৭] With the coining of the term Third World directly, the first two groups came to be known as the "First World" and "Second World" respectively. Here the three-world system emerged.[১৪]

তথাপিও, Secwepemc|Shuswap চীফ জর্জ ম্যানুয়েল বিশ্বাস করতেন 'তিন বিশ্ব মডেল' সেকেলে হয়ে যাবে। ১৯৭৪ সালে তার বই The Fourth World: An Indian Realityতে তিনি চতুর্থ বিশ্বের ধারণা দিয়েছেন। সেখানে তিনি চতুর্থ বিশ্ব বলতে সেই আদিবাসী জনগণের জাতিগুলোকে--সাংস্কৃতিক বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী-- বুঝিয়েছেন যাদের সাধারণ বাস্তবতায় কোনো রাষ্ট্র নেই।[১০] বরং তারা একটি দেশের ভিতরে বা বহুদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। উদাহরণস্বরূপ, রেড ইন্ডিয়ান বা আদিবাসী আমেরিকানরা উত্তর আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বাস করে।[১০]

শীতল যুদ্ধ পরবর্তী

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ব্লকের বিলুপ্তি ঘটে; সাথে সাথে দ্বিতীয় বিশ্ব নামটিও কার্যকারীতা হারায়।[১৮] বর্তমানে প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের সংজ্ঞার কিছুটা পরিবর্তন ঘটলেও এগুলোর মূল ধারণার কোনো এদিক-ওদিক হয় নি।

অন্যান্য বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক

ঐতিহাসিক

শীতল যুদ্ধের সময় প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক ছিল খুবই বন্ধুর। প্রথম বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও দ্বিতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহের মধ্যের উত্তেজনা নিয়মিতভাবে বিদ্যমান ছিল। প্রাথমিকভাবে শীতল যুদ্ধটি ছিল এর নামের মতোই যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যের আদর্শগত লড়াই।[১৯] অনেকগুলো মতবাদ ও পরিকল্পনা শীতলযুদ্ধের গতিধারা নির্ণয়ে ভূমিকা রেখেছিল যেমন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ট্রুম্যান ডকট্রিন, মার্শাল প্লান, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মলোটোভ প্লান।[১৯][২০][২১] এটির কার্যকরী প্রমাণ দৃশ্যগত হয় পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত বার্লিন দ্বারা। পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্বের সাথে যাতে খুব বেশি সখ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা প্রভাবিত পূর্ব বার্লিন করতে না পারে সেজন্য তারা সেখানে বার্লিন দেয়াল তুলে দিয়েছিল।[২২]

বলতে গেলে প্রথম বিশ্ব ও দ্বিতীয় বিশ্বের সংজ্ঞা নিরূপিত হয় তৃতীয় বিশ্বের সংজ্ঞা দ্বারা। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো মতামত নিরপেক্ষ ও জোট-নিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই এই দেশগুলো ছিল প্রথম বিশ্ব ও দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের দলে টানার জন্য টার্গেটস্বরূপ। এই টানাপোড়েনে যে দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র আকৃষ্ট করতে পেরেছিল তারা হয়েছিল পুঁজিবাদী ও গণতন্ত্রের প্রতিভূ; আর যারা সোভিয়েতভুক্ত হয়েছিল তারা সমাজতান্ত্রিক মডেলের অন্তর্ভুক্ত। যেখানে ভিয়েতনাম পুরোটাই সমাজতান্ত্রিক ব্লকের, কিন্তু শুধু কোরিয়া পেনিনসুলার উত্তরাংশ সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।[২৩][২৪] ডমিনো মতবাদ বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে তৃতীয় বিশ্ব ও প্রতিপক্ষ দ্বিতীয় বিশ্বের সাথে সম্পর্ক নির্ণয়ে চালিত করেছিল।[২৫] ডমিনো মতবাদের আলোকে বিশ্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গিকারগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রক্সিযুদ্ধগুলো জিততে পেরেছিল।[২৬]

বর্তমান

বর্তমানে আন্তঃবিশ্বের সম্পর্কগুলো মানুষ ও তথ্যের অবাধ চলাচলের উপরেই নির্ধারিত হচ্ছে।[২৭] বেশির ভাগ নব নব উদ্ভাবনগুলোর উৎপত্তিস্থল হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র যা পরবর্তীতে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ারটন বিজনিস স্কুলের গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে ৩০ টি সর্বোচ্চ উদ্ভাবনের বেশির ভাগই হয়েছে প্রথম বিশ্বে মানে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে।[২৮]

Global distribution of malaria risk

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে ফারাকটা ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। পানিবাহিত রোগের কারণে মৃত্যু ধনী দেশগুলোতে নেই বললেই চলে; কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে এটা একটি মাথাব্যাথার কারণ।[২৯]

পরিবেশগত প্রভাব

কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়েছেন যে তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশের উচ্চহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধিই মানব সমাজের জন্য হুমকীস্বরূপ নয়; বরং পৃথিবীর উপর একজন মানুষ কতটুকু প্রভাব বজায় রাখছে সেটাই মুখ্য।[২৭] জনপ্রতি প্রভাব বলতে এখানে বুঝাচ্ছে একজন কতটুকু সম্পদ ভোগ এবং অপচয় করছে সেটাকে। উন্নত বিশ্বের লোকজন তৃতীয় বিশ্বের লোকের চাইতে ৩২ শতাংশ বেশি সম্পদ ভোগ করছে এবং ৩২ শতাংশ বেশি সম্পদ অপচয় করছে।[২৭]যদিও চীন বিশ্বের সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ; তথাপিও মাথাপিছু হিসেব করলে তা উন্নত বিশ্বের চাইতে অনেক কম।[৩০]

জীবাস্ম জ্বালানীর প্রথাম ভোক্তা হিসেবে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর পরিবেশ দুষণ নজরে আসছে।[৩১] জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের উপর ভিত্তি করে কিয়োটো প্রোটোকল চুক্তিটি হয়েছিল যা রিও ডি জেনেরিওর ধরিত্রি সম্মেলনএ ১৯৯২ সালে চূড়ান্ত হয়।[৩২] এটি জাতিসংঘ ও উন্নত বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবকে স্বীকার করে একে মোকাবেলা করার উপায় নিয়ে প্রস্তাব রেখেছিল[৩২] উন্নয়নশীল বিশ্ব যেমন চীন ও ভারত এই চুক্তি অনুমোদন করে নি; কারণ তারা ভেবেছিল যে এর ফলে তাদের উন্নয়নের ধারা বাধাগ্রস্ত হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

সাম্প্রতিক অতীত ব্যতীত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর তেমন একটা গুরুত্বই ছিল না।[৩৩] এটার কারণ হচ্ছে বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরাই প্রথম বিশ্ব থেকে এসেছে।[৩৪] যত বেশি দেশ উন্নতির দিকে ধাবিত হবে, বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর প্রতিও তখন আগ্রহ সৃষ্টি হবে।[৩৩] তারপরও এটা বলা যায়, প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর এখনো অনেক বেশি বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক, সাংবাদিক রয়েছে যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর তাদের সমকক্ষ হওয়া বা তাদের সম্মান আদায় করে নেওয়া সত্যিই অনেক কঠিন।[৩৩]

উন্নয়ন তত্ত্ব

শীতল যুদ্ধের সময় পশ্চিমা দেশগুলোতে তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাপনার নিরিখে আধুনিকায়ন তত্ত্ব ও উন্নয়ন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছিল।[৩৫] পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা এই ধারণাগুলোকে তত্ত্বে রূপ দিয়েছিলেন এবং এর উপর ভিত্তি করে নীতি তৈরি করে তা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সঞ্চার করার আশা করছিলেন যাতে এই নতুন গঠিত দেশগুলো রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারে।[৩৫] যদিও বেশির ভাগ তত্ত্বগুলোই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এতে আগ্রহী না হওয়ায় কোন মডেলেই তাদের উন্নতি সাধিত হয় নি।[৩৫] পশ্চিমারা চেয়েছিলেন এই দেশগুলো তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকরণ করবে; বলতে গেলে, তারা চেয়েছিলেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পশ্চিমা উদার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে তথাকথিত 'প্রথম বিশ্বের রাষ্ট্র'ভুক্ত হোক।[৩৫] যারদরূন, আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন তত্ত্বের ঐতিহ্যের উদ্ভব হয়েছিল পশ্চিমা তথা যুক্তরাষ্ট্রেই মার্ক্সিস্ট ও নন-মার্ক্সিস্টের বিকল্প হিসেবে (সোভিয়েত ইউনিয়নের আশির্বাদপুষ্ট)।[৩৫]

বিশ্বায়ন

জাতিসংঘে'র ESCWA লিখেছে যে বিশ্বায়ন হচ্ছে 'একটি ব্যাপক বিস্তৃত বিষয় যাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।' সান জোসে স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়েস অসল্যান্ড লিখেছেনঃ বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি ব্যাপক বিতর্কিত বিষয় এবং বিশ্বায়নের মৌলিক ধারণার ও এর প্রভাব নিয়ে গোটা বিশ্বে দিন দিন প্রতিবাদ বাড়তেছে। [৩৬] যদিও বিশ্বায়ন নতুন কোন বিষয় নয়। হাজার বছর ধরে জনগণ এবং পরে কর্পোরেশনগুলো দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে জিনিসপত্র কেনা ও বেচা করে আসছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বিখ্যাত সিল্ক রোড দিয়ে মধ্য এশিয়াতে যা চায়না ও ইউরোপকে যুক্ত করেছে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল ছিল। তেমনই শতাব্দিকাল ধরে জনগণ ও কর্পোরেশনগুলো অন্য দেশে বিনিয়োগ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানকালের বিশ্বায়নের অনেক বৈশিষ্ট্যই আগের যুগের যা ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগে বিদ্যমান ছিল এখন চলমান।"[৩৭]

ইউরোপীয় ইউনিয়ন

প্রথম বিশ্বে বিশ্বায়নের সবচাইতে বড় উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে[৩৮] ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে একটি চুক্তি যেখানে দেশগুলো স্বেচ্ছায় একটি সাধারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে তারা কিছু একক জাতীয় সার্বভৌম প্রতিনিধি প্রেরণ করে যাতে সমগ্র ইউরোপকে বিবেচনায় রেখে তারা গণতান্ত্রিকভাবে উচ্চ পর্যায়ে একটি সাধারণ সার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।[৩৯] এর ফলে গঠিত হয় প্রায় অর্থ বিলিয়ন মানুষকে নিয়ে ২৮ টি দেশের সংগঠন। সামগ্রিকভাবে, ইউরোপ প্রায় বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জিডিপি'র উৎস এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মানুষ প্রায় ২৩টি ভাষায় কথা বলে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সকল দেশ যুক্ত হয়েছে এই উদ্দেশ্যে যে তারা শান্তি, গণতন্ত্র, সহযোগিতা, দৃঢ়তা, উন্নতি ও সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে নিজেদের মধ্যে।[৩৯] ২০০৭ সালের বক্তৃতায় বৈদেশিক সম্পর্কের ইউরোপীয় কমিশনার বেনিতা ফেরেরো ওয়াল্ডনার বলেনঃ 'বিশ্বায়নের উপরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নিহিত... বিশ্বায়ন যাতে সঠিকভাবে কাজ করে সে জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তিশালী ভুমিকা পালন করতে হবে....[৪০] ২০১৪ সালের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বক্তৃতায় ইটালির প্রধানমন্ত্রী মাতিও রেনজি বলেন; 'আমরাই কেবল পারি সভ্যতাকের বিশ্বায়নমুখী করতে।'[৪১] ২০১৬ সালে ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণাতে ইউরোপের বিশ্বায়নের চাবিকাঠি আরো একবার জার্মানির হাতে এসে পড়ল।

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ

বেশির ভাগ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে। সমাজতন্ত্রের পতনের ফলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বৃদ্ধি পেয়েছিল কারণ দেশগুলো বিশ্ব বাণিজ্যের উপর নজর দিয়েছে বেশি করে। [৪২] জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) ও পরে ওয়ার্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) স্বাভাবিকভাবেই সংরক্ষণবাদ নীতির অবসান ঘটিয়েছিল যা বিশ্ব বাণিজ্যের অন্তরায় ছিল।[৪২] সংরক্ষণবাদ নীতির এই অবলোপনের ফলে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোই বিশেষভাবে লাভবান হয়েছিল। কারণ তারাই পরবর্তীতে গ্যাটের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তৃতীয় ও অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে নিজেদের পণ্যের অবাধ বাজার সৃষ্টি করেছিল। [৪৩]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ