বঙ্গাব্দ

বঙ্গ অঞ্চলে প্রচলিত সৌরচান্দ্রিক বর্ষপঞ্জি

বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ হলো দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গ অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি সৌর বর্ষপঞ্জি[১] বর্ষপঞ্জিটির একটি সংশোধিত সংস্করণ বাংলাদেশের জাতীয় ও সরকারি বর্ষপঞ্জি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাআসাম রাজ্যে বর্ষপঞ্জিটির পূর্ববর্তী সংস্করণ অনুসরণ করা হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে নববর্ষ পহেলা বৈশাখ নামে পরিচিত।

বাংলা সনকে বলা হয় বাংলা সংবৎ[২] বা বঙ্গাব্দ,[৩] এখানে একটি শূন্য বছর আছে, যা শুরু হয় ৫৯৩/৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে। এটি যদি পহেলা বৈশাখের আগে হয় তবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির খ্রিস্টাব্দ বা সাধারণ সালের বছরের তুলনায় ৫৯৪ বছর কম, অথবা পহেলা বৈশাখের পরে হলে ৫৯৩ বছর কম হবে।

বাংলা বর্ষপঞ্জির সংশোধিত সংস্করণ ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।[৪][৫] ভারতের বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐতিহ্যগত ভারতীয় হিন্দু বর্ষপঞ্জি ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে ও এটি হিন্দু উৎসবসমূহ নির্ধারণ করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন][১]

ইতিহাস

বঙ্গাব্দের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। কারোর মতে ৭ম শতাব্দীর হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনকারী, আবার কারোর মতে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কিংবা মুঘল সম্রাট আকবর বাংলায় প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জির সাথে চান্দ্র ইসলামি বর্ষপঞ্জি (হিজরি) একত্রিত করে তৈরি করেছিলেন।

বৌদ্ধ/হিন্দু প্রভাব

কিছু ইতিহাসবিদ ৭ম শতাব্দীর হিন্দু রাজা শশাঙ্ককে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনকারী বলে মনে করেন, যার শাসনকাল ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়।[৩][৪][৬] বঙ্গাব্দ (বাংলা সন) শব্দটি আকবরের সময়কালের চেয়ে বহু শতাব্দী পুরনো দুটি শিব মন্দিরেও পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায় যে আকবরের সময়ের অনেক আগে থেকেই একটি বাংলা বর্ষপঞ্জি বিদ্যমান ছিল।[৩]

প্রাচীনকালে হিন্দুরা একটি বর্ষপঞ্জি পদ্ধতি গড়ে তুলেছিল।[৭] ছয়টি প্রাচীন বেদাঙ্গের মধ্যে একটি যার নাম জ্যোতিষ,[৮][৯] হল সময় ধরে রাখার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী সংস্থার গতিবিধি নজরদারি ও ভবিষ্যদ্বাণী করার বৈদিক যুগের ক্ষেত্র।[৮][৯][১০] এটি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের জন্য একটি পরিশীলিত সময় বজায় রাখার পদ্ধতি ও বর্ষপঞ্জি তৈরি করেছিল।[৭]

হিন্দু বিক্রমীয় বর্ষপঞ্জির নামকরণ করা হয়েছে রাজা বিক্রমাদিত্যর নামানুসারে এবং শুরু হয় ৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।[১১] ভারতের গ্রামীণ বাঙালি সম্প্রদায়গুলোয়, ভারত ও নেপালের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলা বর্ষপঞ্জি "বিক্রমাদিত্য" নামে পরিচিত। যাইহোক, এই যেখানে এটি ৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় অঞ্চলগুলোর বিপরীতে বাংলা বর্ষপঞ্জি ৫৯৩ থেকে শুরু হয় যা প্রস্তাব করে যে প্রারম্ভিক সূত্রের বছরটি কিছু সময়ে সামঞ্জস্য করা হয়েছিল।[১২][১৩]

বিভিন্ন রাজবংশ যাদের অঞ্চল বাংলায় বিস্তৃত ছিল, ১৩শ শতাব্দীর আগে তারা বিক্রমীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করত। উদাহরণস্বরূপ, পাল সাম্রাজ্যের যুগে সৃষ্ট বৌদ্ধ গ্রন্থ ও শিলালিপিতে "বিক্রম" ও আশ্বিনের মতো মাসগুলোর উল্লেখ রয়েছে, একটি পদ্ধতি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যত্র সংস্কৃত গ্রন্থে পাওয়া যায়।[১৪][১৫]

হিন্দু পণ্ডিতরা সূর্য, চাঁদ ও গ্রহের চক্র পর্যবেক্ষণ এবং গণনা করে সময় রাখার চেষ্টা করতেন। সূর্য সম্পর্কে এই গণনাগুলো সংস্কৃতের বিভিন্ন জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থে দেখা যায়, যেমন: ৫ম শতাব্দীতে রচিত আর্যভট্টের আর্যভট্টীয়, লতাদেবের ৬ষ্ঠ শতাব্দীর রোমাক ও বরাহমিহির দ্বারা পঞ্চ সিদ্ধান্তিক, ব্রহ্মগুপ্তের ৭ম শতাব্দীর খন্ডখ্যাদ্যাক এবং অষ্টম শতাব্দীর সিদ্ধাধিশ্যাক[১৬] এই গ্রন্থগুলো সূর্য ও বিভিন্ন গ্রহ উপস্থাপন করে এবং সংশ্লিষ্ট গ্রহের গতির বৈশিষ্ট্যগুলো অনুমান করে।[১৬] সূর্যসিদ্ধান্ত-এর মতো অন্যান্য গ্রন্থগুলো তম শতাব্দী থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে সম্পূর্ণ হয়েছে বলে জানা যায়।[১৬]

পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামঝাড়খণ্ডের মতো ভারতীয় রাজ্যে বাঙালিদের দ্বারা ব্যবহৃত বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জিটি সংস্কৃত পাঠ সূর্যসিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি প্রথম মাস বৈশাখ হিসেবে মাসগুলোর ঐতিহাসিক সংস্কৃত নাম ধরে রেখেছে।[৪] তাদের বর্ষপঞ্জিটি হিন্দু বর্ষপঞ্জি পদ্ধতির সাথে আবদ্ধ থাকে ও বিভিন্ন বাঙালি হিন্দু উৎসব নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়।[৪]

ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রভাব

আরেকটি তত্ত্ব হল যে বর্ষপঞ্জিটি প্রথম বাংলার একজন হোসেন শাহী সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (রাজত্বকাল ১৪৯৪-১৫১৯) বাংলায় প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জির সাথে চান্দ্র ইসলামি বর্ষপঞ্জি (হিজরি) একত্রিত করে তৈরি করেছিলেন।[৩] অন্য একটি তত্ত্ব বলে যে শশাঙ্কের বর্ষপঞ্জিটি আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল যখন তিনি হিজরি বর্ষপঞ্জি দ্বারা ভূমি রাজস্ব আদায়ে অসুবিধা প্রত্যক্ষ করেন।[৩]

মুঘল শাসনামলে ইসলামি হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বাঙালিদের কাছ থেকে ভূমি কর আদায় করা হতো। এই বর্ষপঞ্জি একটি চান্দ্র বর্ষপঞ্জি ছিল এবং এর নতুন বছরটি সৌর কৃষি চক্রের সাথে মিলতো না। কিছু সূত্র অনুসারে বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি বাংলায় মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনের জন্য হয়েছে, যিনি ফসল কাটার কর বছরের সময় এটি গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা সনকে বঙ্গাব্দ বলা হয়। আকবর রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ শিরাজিকে চান্দ্র ইসলামি বর্ষপঞ্জি ও সৌর হিন্দু বর্ষপঞ্জিকে একত্রিত করে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে বলেন এবং এটি ফসলি সন (ফসলি বর্ষপঞ্জি) নামে পরিচিত ছিল। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এর মাধ্যমে বাংলা বর্ষপঞ্জির সূচনা হয়।[৪][৫] শামসুজ্জামান খানের মতে এটি হতে পারে যে একজন মুঘল গভর্নর নবাব মুর্শিদ কুলি খান, সর্বপ্রথম পুন্যহোর ঐতিহ্যকে "আনুষ্ঠানিক ভূমি কর আদায়ের দিন" হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন ও বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু করার জন্য আকবরের আর্থিক নীতি ব্যবহার করেছিলেন।[৬][১৭]

এটি হোসেন শাহ বা আকবর কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়। বাংলা বর্ষপঞ্জি ব্যবহারের প্রথা আকবরের আগে হোসেন শাহ শুরু করেছিলেন।[৩] অমর্ত্য সেনের মতে, আকবরের সরকারি বর্ষপঞ্জি "তারিখ-ইলাহি" ও এর ১৫৫৬ সালের শূন্য বছর ছিল পূর্ব-বিদ্যমান হিন্দু ও ইসলামি বর্ষপঞ্জির মিশ্রণ। আকবরের মুঘল দরবারের বাইরে ভারতে এটি খুব বেশি ব্যবহৃত হয়নি এবং তার মৃত্যুর পর তিনি যে বর্ষপঞ্জি চালু করেন তা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। যাইহোক, সেন যোগ করেন, বাংলা বর্ষপঞ্জিতে "তারিখ-ইলাহি"-এর চিহ্ন রয়েছে।[১৮] সেন বলেন যে, বাংলা বর্ষপঞ্জি ও নতুন বছর কেউ গ্রহণ করুক না কেন, এটি ঐতিহ্যগত বাংলা বর্ষপঞ্জির উপর ভিত্তি করে বসন্তের ফসল কাটার পরে জমির কর আদায়ে সহায়তা করে, কারণ ইসলামি হিজরি বর্ষপঞ্জির মাধ্যমে সংগ্রহের তারিখ নির্ধারণে প্রশাসনিক অসুবিধা তৈরি করেছিল।[৩]

শামসুজ্জামান বলেন, "এটিকে বাংলা সন বা সাল বলা হয়, যা যথাক্রমে আরবি ও ফার্সি শব্দ, এটি থেকে বোঝা যায় যে এটি একজন মুসলিম রাজা বা সুলতান প্রবর্তন করেছিলেন।"[৬] বিপরীতে, সেনের মতে এর ঐতিহ্যবাহী নাম বঙ্গাব্দ[৩][৫] আকবরের যুগে বর্ষপঞ্জিটিকে তারিখ-ই-ইলাহি বলা হত। বর্ষপঞ্জির "তারিখ-ই-ইলাহি" সংস্করণে মাসের প্রতিটি দিনের একটি আলাদা নাম ছিল ও মাসগুলোর নাম এখন যা আছে তার থেকে আলাদা নাম ছিল। বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী আকবরের নাতি শাহ জাহান রবিবার থেকে শুরু হওয়া সাত দিনের সপ্তাহ ব্যবহার করার জন্য বর্ষপঞ্জি সংস্কার করেন ও বিদ্যমান শক বর্ষপঞ্জির মাসের নামের সাথে মিল রাখতে অজানা সময়ে মাসগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল।[৫] এই বর্ষপঞ্জিটি বাংলাদেশের মানুষ যে বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে আসছে তার ভিত্তি।[১][৩][৫]

অজ্ঞাত উৎপত্তি

শামসুজ্জামান খান[৬] এবং নিতীশ সেনগুপ্তের মতে বাংলা বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি পরিষ্কার নয়।[৩]

বর্ষপঞ্জি সংস্কার

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ভারত একটি প্রজাতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবার পরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একটি জাতীয় পঞ্জিকা প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এর ফলে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ১৮৭৯ শকাব্দে ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি “পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি” গঠন করেন। এই কমিটি শকের পঞ্জিকাসহ ভারতে প্রচলিত অন্যান্য বর্ষপঞ্জিসমূহের সংস্কারসাধনে নিযুক্ত হয়। উক্ত কমিটি শকাব্দকে ঋতুনিষ্ঠ ও সর্বস্তরে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য এবং আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচলিত গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সাথে সমন্বয় রেখে চলার জন্য এই বর্ষপঞ্জীকে সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়। "সূর্যসিদ্ধান্তে" উল্লিখিত নিরয়ণ বর্ষগণনারীতি[১৯] পরিহার করে "পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি" সায়ন সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করে এবং বারো মাসের দৈর্ঘ্য স্থির করে দেয়।[১৯][২০][২১] মেঘনাদ সাহা কমিটি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রচলিত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিকার আমূল পরিবর্তন করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রস্তাব পেশ করেন। এই কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী—

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ (১ চৈত্র ১৮৭৯ শক) ভারত সরকার এই সংস্কারপ্রাপ্ত পঞ্জিকাকে ভারতের জাতীয় পঞ্জিকা হিসাবে গ্রহণ করে এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সর্বস্তরে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সাথে "ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি"-এর ব্যবহার প্রচলন করে।[২২][২৩][২৪] কিন্তু সমস্ত প্রশাসনিক বিভাগে, আকাশবাণী এবং দূরদর্শনের ঘোষণায় শক পঞ্জিকা এবং এর পঞ্জিকা সাল শকাব্দের প্রচলন হলেও[২৪] এখনও ১ চৈত্র (২১/২২ মার্চ), ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জির নববর্ষের দিন জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে স্বীকৃত হয়নি। ধর্মীয় নিরয়ণ বর্ষপঞ্জির বহুল প্রচলনের কারণেই সম্ভবত সংস্কারকৃত এই বর্ষপঞ্জিটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে।[১৯][২৫] সাহা কমিটির প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ভারত সরকার এস পি পান্ডের নেতৃত্বে আশির দশকে আরেকটি কমিটি করে। এই কমিটি মেঘনাদ সাহার প্রস্তাবসমূহকে মূল ধরে ১৪ই এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসাবে নির্ধারণ করে প্রস্তাব পেশ করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

বাংলাদেশও বেশ কয়েকবার বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে "বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার" নামে বাংলা একাডেমি কমিটি গঠন করে যা "শহীদুল্লাহ কমিটি" নামে পরিচিত হয়। এই কমিটি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সুপারিশকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে। এই কমিটি আধুনিক গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি রীতি অনুসারে মধ্যরাত্রি থেকে দিনের সূচনা করার অর্থাৎ তারিখ পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়। প্রচলিত মাপে সূর্যোদয়ে দিনের শুরু অর্থাৎ তারিখ পরিবর্তিত হতো।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে এর ভিত্তিতে বাংলা দিনপঞ্জিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এর পরেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বাংলা বর্ষপঞ্জিকাকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক করার জন্য ১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদকে প্রধান করে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, ভাষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই কমিটি মেঘনাদ সাহা ও শহীদুল্লাহ কমিটির মূল সুপারিশের নিরিখে ২০টি সুপারিশ পেশ করে। এর উল্লেখযোগ্য ছিল চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুনকে অধিবর্ষের মাস হিসেবে নির্ধারণ করা। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে যে বছর ফেব্রুয়ারি মাস অধিবর্ষ হবে, সেই বছর বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে হবে ৩১ দিন।[২৬]

তারপরেও জাতীয় দিবসগুলোয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি ও বাংলা বর্ষপঞ্জি মূলানুগ না হওয়ায় জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো দুটো বর্ষপঞ্জিতে আলাদা দিনে পড়তো। যেমন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা বর্ষপঞ্জির পাতায় দিনটি ৮ই ফাল্গুন হলেও ২০১৫ বাংলা বর্ষপঞ্জিতে তা পড়ে ৯ই ফাল্গুন। বাংলা বর্ষপঞ্জির এমন বিদ্যমান অসামঞ্জস্য দূর করে পুরোপুরি বিজ্ঞানভিত্তিক এবং জাতীয় দিবসগুলোকে মূলানুগ করতে ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়, পদার্থবিজ্ঞানী জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক আলী আসগর, একাডেমির পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জি প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে তৃতীয়বার বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটি কমিটি করা হয়।[২৭] এই কমিটি প্রধানত বিশেষ দিনগুলোয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিকে ও বাংলা বর্ষপঞ্জিকে মূলানুগ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের সুপারিশ পেশ করে। এই কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী—

  • বৈশাখ থেকে আশ্বিন— এই ছয় মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে।
  • কার্তিক থেকে মাঘ এবং চৈত্র— এই পাঁচ মাস ৩০ দিন গণনা করা হবে।
  • ফাল্গুন মাস ২৯ দিনে গণনা করা হবে।
  • খ্রিস্টাব্দের অনুগামী বছরে ফাল্গুন মাসে বঙ্গাব্দের অধিবর্ষ হবে অর্থাৎ যে খ্রিষ্টাব্দে অধিবর্ষ হবে সেই বাংলা বছরে ফাল্গুন মাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে।

বাংলাদেশে শামসুজ্জামান খান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। বর্তমানে সরকারিভাবে এই বর্ষপঞ্জিই চালু আছে।

বর্ষপঞ্জি

বাংলা বর্ষপঞ্জি হল একটি সৌর বর্ষপঞ্জি[১][৫]

মাস

বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ "সূর্যসিদ্ধান্ত" থেকে। বঙ্গাব্দ বা বাংলা পঞ্জিকায় প্রথম মাস বৈশাখ থেকে শুরু হলেও হিন্দু পঞ্জিকায় তা শুরু হয় চৈত্র থেকে।[২৮]

মাসের নামদিন
(ভারত) (বাংলাদেশ, ১৯৬৬/১৯৮৭–২০১৮)
দিন
(বাংলাদেশ, ২০১৯–বর্তমান)
দিন
(ভারত) (দিনে সঠিক সময়কাল)
ঐতিহ্যগত ঋতু
বঙ্গে
মাসের নাম
(গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি)
মাসের নাম
(হিন্দু বিক্রমী সৌর)
বৈশাখ৩১৩১৩০/৩১ (৩০.৯৫০)গ্রীষ্মএপ্রিল-মেমেষ
জ্যৈষ্ঠ৩১৩১৩১/৩২ (৩১.৪২৯)মে, জুনবর্ষা
আষাঢ়৩১৩১৩১/৩২ (৩১.৬৩৮)বর্ষাজুন-জুলাইমিথুন
শ্রাবণ৩১৩১৩১/৩২ (৩১.৪৬৩)জুলাই-আগস্টকর্কট
ভাদ্র৩১৩১৩১/৩২ (৩১.০১২)শরৎআগস্ট-সেপ্টেম্বরসিংহ
আশ্বিন৩০৩১৩০/৩১ (৩০.৪২৮)সেপ্টেম্বর-অক্টোবরকন্যা
কার্তিক৩০৩০২৯/৩০ (২৯.৮৭৯)হেমন্তঅক্টোবর-নভেম্বরতুলা
অগ্রহায়ণ৩০৩০২৯/৩০[২৯][৩০] (২৯.৪৭৫)নভেম্বর-ডিসেম্বরবৃশ্চিক
পৌষ৩০৩০২৯/৩০ (২৯.৩১০)শীতডিসেম্বর-জানুয়ারিধনু
মাঘ৩০৩০২৯/৩০ (২৯.৪৫৭)জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিমকর
ফাল্গুন৩০/৩১ (অধিবর্ষ)২৯/৩০ (অধিবর্ষ)২৯/৩০ (২৯.৮৪১)বসন্তফেব্রুয়ারী-মার্চকুম্ভ
চৈত্র৩০৩০৩০/৩১ (৩০.৩৭৭)মার্চ-এপ্রিলমীন

দিন

অন্যান্য অনেক বর্ষপঞ্জির ন্যায় বাংলা বর্ষপঞ্জিতে সাত দিনের সপ্তাহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে সপ্তাহের দিনগুলোর নাম নবগ্রহের উপর ভিত্তি করে রাখা হয়েছে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির বিপরীতে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে দিনটি শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ের সময়, যেখানে গ্রেগরীয়তে দিন মধ্যরাতে শুরু হয়।

কিছু পণ্ডিতদের মতে আকবর যে বর্ষপঞ্জিটি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তন করেছিলেন তাতে মাসের প্রতিটি দিনের আলাদা আলাদা নাম ছিল, কিন্তু এটি ছিল কষ্টকর ও তার নাতি শাহ জাহান গ্রেগরীয়ের মতো এটিকে ৭ দিনের সপ্তাহে পরিবর্তন করেছিলেন, যেখানে গ্রেগরীয়ের ন্যায় সপ্তাহ রবিবার থেকে শুরু হতো।[৫]

দিনের নাম (বাংলা)দেবতা / গ্রহদিনের নাম (সিলেটি)দিনের নাম (রোহিঙ্গা)
রবিবাররবি / সূর্যরোইবাররুইবার
সোমবারসোম / চাঁদশোম্বারকম্বার
মঙ্গলবারমঙ্গল / মঙ্গলমঙ্গোলবারমঙ্গোলবার
বুধবারবুধ / বুধবুদবারবুইদবার
বৃহস্পতিবারবৃহস্পতি / বৃহস্পতিবিষুদবারবিসিব্বার
শুক্রবারশুক্র / শুক্রশুক্কুরবারকুক্কুরবার
শনিবারশনি / শনিশোনিবারকোনিবার

অধিবর্ষ

বাংলাদেশের সর্বশেষ সংস্কার (শামসুজ্জামান খান কমিটি) অনুযায়ী বাংলা সনের অধিবর্ষ গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অনুগামী। অর্থাৎ যে গ্রেগরীয় বর্ষ অধিবর্ষ হয় সেই বাংলা সনের ফাল্গুন মাস ২৯ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিনে হয়।[২৭]

পশ্চিমবঙ্গে প্রাচীন সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক নিরয়ণ বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই বর্ষপঞ্জির মাসগুলো নির্ধারিত হয় সূর্যের প্রকৃত আবর্তনকে ভিত্তি করে। এই বর্ষপঞ্জিতে বর্ষ সংখ্যা হতে সাত বিয়োজন করে তা ৩৯ দিয়ে ভাগ করতে হয়। যদি ভাগশেষ শূন্য হয় বা ৪ দিয়ে বিভাজ্য হয় তাহলে সে বর্ষটিকে অধিবর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং ৩৬৬ দিনের এই বর্ষের চৈত্র মাস ৩১ দিনের হয়। প্রতি ৩৯ বছরে ১০ টি অধিবর্ষ হয়।

ঐতিহ্যগত এবং সংশোধিত সংস্করণ

বাংলা বর্ষপঞ্জির দুটি সংস্করণ। শীর্ষ: পশ্চিমবঙ্গে অনুসরণ করা "প্রথাগত সংস্করণ"; নীচে: "সংশোধিত সংস্করণ" যা বাংলাদেশে অনুসরণ করা হয়।

পার্থক্য

ভারতীয় রাজ্যগুলোতে ব্যবহৃত বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জিটি সংস্কৃত গ্রন্থ সূর্য সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে চলে। প্রথম মাস বৈশাখ হিসেবে এটি মাসগুলোর ঐতিহাসিক সংস্কৃত নাম ধরে রেখেছে।[৪] তাদের বর্ষপঞ্জি হিন্দু বর্ষপঞ্জি পদ্ধতির সাথে আবদ্ধ থাকে ও বিভিন্ন বাঙালি হিন্দু উৎসব নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়।[৪]

বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি দ্বারা পুরনো বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধন করা হয়েছিল, প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিন, বাকি ৩০ দিন, ফাল্গুন মাসের সাথে প্রতি অধিবর্ষে ৩১ দিনে সমন্বয় করা হয়েছিল।[৪] এটি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে সরকারিভাবে গৃহীত হয়।[৪][৫]

ব্যবহার

বঙ্গদেশের ঋতু বৈচিত্রকে ধারণ করার কারণে বাংলা সনের জনপ্রিয়তা এসেছে। বঙ্গদেশের জলবায়ুকে ষড়ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ এবং শীত ঋতুর সাথে বর্ষাহেমন্ত ঋতু। বাংলা সনের মাসগুলোর উপর ভিত্তি করেই এই ঋতু বিভাজন করা হয়েছে।

বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতিতে বাংলা সনের ব্যবহার এখন আর পূর্বের পর্যায়ে নেই। নাগরিক জীবন যাপনের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় এর ব্যবহার এখন কেবল কৃষিজীবীদের মধ্যেই সীমাবব্ধ হয়ে পড়েছে। কৃষিজীবীরা এখনো বীজতলা তৈরি, বীজ বপন, ফসলের যত্ন, ফসল তোলা ইত্যাদি যাবতীয় কাজে বাংলা মাসের ব্যাপক ব্যবহার করেন। ব্যবসায় ব্যবস্থায় পূর্বের সেই বাংলা সন ভিত্তিক হিসাব ব্যবস্থা এখন গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি নির্ভর হয়ে পড়েছে। যার ফলে ব্যবসায়ের হিসাবের খাতা এখন রাষ্ট্রের আইনে যাকে সহজভাবে গ্রহণ করে সে পদ্ধতিতে রাখা হয়। ষাট বা সত্তর দশকেও যে হালখাতা দেখা যেতো উৎসবের মতন করে, তা দিনে দিনে ফিকে হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাংলায় (বাংলাদেশপশ্চিমবঙ্গ) যেমন পূজা এখনও বাংলা বর্ষপঞ্জি নির্ভর। হিন্দু সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সামজিক অনুষ্ঠানগুলো, যেমন বিয়ে, গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাশন, সাধভক্ষণ, জামাই ষষ্ঠী, ভাইফোঁটা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের দিন নির্বাচনে বাংলা মাসের দিনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। উৎসব পার্বণ যেমন পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি এগুলোও বাংলা মাস নির্ভর। শহরে মানুষরা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সাম্প্রতিক কালে পহেলা বৈশাখকে একটি সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের রূপ দিতে সচেষ্ট। ফার্সির নওরোজের মত বাংলা নববর্ষও সার্বজনীন উৎসবের মর্যাদায় এগিয়ে যাচ্ছে।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

  • কিম প্লফকার (২০০৯)। Mathematics in India। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। আইএসবিএন 978-0-691-12067-6 

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ